মিতা

মিতা

গ্রামের গার্লস স্কুল। ব্রিটিশ আমলে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছিল। সেই হিসেবে বেশ ঐতিহ্যবাহী স্কুল এটি।স্কুলের বারান্দা দিয়ে আয়শা ম্যাডাম যাচ্ছে। তখন নিধিকে দেখে ডাক দিল। এই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী।

~ এই নিধি‚ এদিকে আসো তো।
নিধি এসে বলল‚ “জ্বি ম্যাডাম।” অন্যদিকে পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে এসে বলল‚ “জ্বি ম্যাডাম।”
আয়শা ম্যাডাম অন্য মেয়েটিকে বলল‚ “তোমাকে তো ডাকিনি।”
= আপনিই তো বললেন নিধি এদিকে এসো।
~ তোমার নাম নিধি?
= জ্বি ম্যাডাম। ষষ্ঠ শ্রেণির নতুন ছাত্রী।
~ ওহ! আমি তোমাকে না এই নিধিকে ডেকেছি।
“আচ্ছা ম্যাডাম।” বলে মেয়েটি চলে গেল।

টিফিন ব্রেকে নিধি অন্য নিধিকে খুঁজতে লাগল। অনেক খোঁজার পর পেল। কাছে এসে পাশে বসে বলল‚
> হ্যালো মিতা।
নিধি বড় বড় চোখে তাকালো।
> ওহ! তোমার নাম তো নিধি। জানো আমার নামও নিধি। তাই তোমাকে মিতা বললাম। রাগ করলে নাকি?
= না না আপু। কি যে বলেন! রাগ করব কেন? আমি কিন্তু আপনাকে দু বছর আগে থেকেই চিনি।
> ওমা তাই নাকি? কিভাবে?
= আমি তখন ক্লাস ফোরে ছিলাম আর আপনি সিক্সে। তখন গ্রামের এক অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান কিসের জন্য যেন আপনার হাতে পুরষ্কার তুলে দিয়েছিল। তখন থেকেই আপনাকে চিনি।
> ওটা সেরা বক্তৃতার জন্য দেয়া হয়েছিল।
= ইয়ে মানে আপু … আমি কি আপনার ফ্রেন্ড হতে পারি?
> হিহিহি আমরা অলরেডি বন্ধু। তাইতো আমাদের নামও এক। এই পুরো স্কুলে নিধির নামের তৃতীয় কোনো মেয়ে নেই।
দুজনই হাসি দিল।

ঘন্টা পড়লো। টিফিন টাইম শেষ।
> আচ্ছা মিতা এখন ক্লাসে যাও। পরে কথা হবে।
= আচ্ছা আপু।
দুজনই নিজ নিজ ক্লাসে চলে গেল। ষষ্ঠ শ্রেণির নিধি অর্থাৎ ছোট নিধির খুব ভাল লাগছে। কারণ সেই পুরষ্কার পাওয়ার থেকেই ছোট নিধির জন্য বড় নিধি আইডল স্বরূপ হয়ে আছে। সে এই স্কুলে ভর্তির পরই বড় নিধিকে দেখেছিল। কিন্তু কথা বলার সাহস পায়নি। কিন্তু বড় নিধি নিজেই এসে ফ্রেন্ডশীপ করল।
অন্যদিকে বড় নিধিও বেশ খুশি। ছোট নিধি বেশ ভালই। কথাবার্তা খুব সুন্দর। নাম এক হওয়ায় এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছে তার প্রতি।

পরেরদিন সকালে স্কুলে এসে বড় নিধি দেখল ছোট নিধি শহীদ মিনারের পাশে বসে বই পড়ছে। বড় নিধি এসে তার পাশে বসে পড়লো। ছোট নিধি বলল‚
= আমার সাথে কথা বলবা না। আমি তোমার সাথে রাগ করছি।
> ওমা কেন? আমি কি করলাম?
= কাল ছুটির পর তুমি আমার সাথে দেখা করনি কেন?
> আরে মিতা আমি তখন বন্ধুদের সাথে পরীক্ষার ব্যাপারে কথা বলছিলাম।
= যাইহোক তুমি আমার সাথে আর কথা বলবা না।
বড় নিধি কানে হাত দিয়ে বলল, “এইযে দেখ কানে ধরেছি। আর এমন করব না। এবার থেকে প্রতিদিন ছুটির পর মিতার সাথে দেখা করে তবেই বাসায় যাব।
= মনে থাকবে তো?
> হ্যাঁ থাকবে। আমার মিতার যে রাগ। বাপরে বাপ।
= রাগ না এটা ভালবাসা বহিঃপ্রকাশ।
> ওমা তুমি এত ভারি কথা বল কিভাবে?
= হিহিহি তোমার থেকে শিখেছি।
দুজনই হেসে উঠলো।

এভাবে বেশ ভালই চলছে তাদের বন্ধুত্ব। বড় নিধি পড়ালেখার ব্যাপারে ছোট নিধিকে হেল্প করে। ছোট নিধি বড় নিধিকে নিজের শাসনে রাখে। ছেলেদের সাথে একদম মিশতে দেয় না। দুজনে এক সাথে অনেক সময় কাঁটায়। এক গ্রামে থাকায় দুজনে এক সাথে আড্ডা দেয়, স্টাডি করে। সবাই বলে দুই বান্ধবী নয় যেন দুই জমজ বোন। সময় গড়িয়ে গেল। এখন বড় নিধি দশম শ্রেণিতে আর ছোট নিধি অষ্টম শ্রেণিতে।

সেই চিরচেনা শহীদ মিনারের কোণায় মনমরা হয়ে বসে আছে ছোট নিধি। বড় নিধি এসে বলল,
> কিরে তুই মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন?
হুট করেই ছোট নিধি বড় নিধিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। বড় নিধি পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
> কিরে কি হয়েছে? কেউ বকেছে?
ডুকরে ডুকরে বলল, না।
> তাহলে এভাবে কাঁদছিস কেন?
= পরীক্ষার পর তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি তাই না?
এবার বড় নিধি বুঝলো কান্নার কারণ। এসএসসি পরীক্ষা শেষে তো হাই স্কুল লাইফ শেষ।
বড় নিধি বলল,
> ধুর পাগলী আমি কি তোকে ছেড়ে যাচ্ছি নাকি? পরীক্ষার পরেও আমি সবসময়ই আসব তোর সাথে দেখা করতে। তাছাড়া বন্ধের দিন তো এক সাথেই ঘুরব।
= সত্যি তো?
> হ্যাঁ রে পাগলী সত্যি। এবার কান্না থামা। চল চা খাব। আল বিল আমি দিব।
= তুইই তো দিবি। ছোটরা বিল দেয় নাকি? হিহিহি।
দুজনে মিলে চা নাস্তা করে যার যার বাসায় চলে গেল।

এসএসসি পরীক্ষা শুরু হল। ছোট নিধি প্রতিদিনই বড় নিধিকে শুভকামনা জানাতে হল সেন্টারে আসে। শেষ পরীক্ষার দিনেও এলো। সেদিন সবাইকে অবাক করিয়ে বড় নিধিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলল,
= এখন তুই আমাকে ভুলে যাবি। আমি জানি তুই আমাকে ভুলে যাবি।
> ধুর পাগলী আমি কখনোই তোকে ভুলব না। তুই আমার মিতা।
সেদিন ছোট নিধির কান্না থামেনি। দুজনেরই বাবা মা তাকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু তার কান্না থামেনি। বাধ্য হয়ে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। বড় নিধিও সেদিন খুব কেঁদেছিল। কেন তা সে নিজেও জানে না।

দু বছর পর,
পরীক্ষার পরেও দুজনের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু রেজাল্ট দেয়ার পর আর তা বেশিদিন টিকেনি। গ্রামে সুযোগ সুবিধা না থাকায় পড়ালেখার জন্য বড় নিধি ঢাকা শহরে চলে এসেছে। তারপর আর যোগাযোগ হয়নি তাদের। বড় নিধি যেদিন শহরের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠেছিল সেদিন ছোট নিধি অঝোরধারায় কেঁদেছিল। শুরুতে ছোট নিধি প্রতিদিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতো। যা দেখে তার বাবা মাও অবাক হয়ে যেত। সময়ের ছোট নিধির চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আবেগ যায়নি। সে এখনো স্কুলের শহীদ মিনারের এককোণায় একা বসে থাকে। আর মনে মনে বলে আমার মিতা আমার পাশেই আছে। চায়ের দোকানে চা খায় আর মনে মনে বলে আমার মিতা আমার পাশেই আছে। বন্ধের দিন তারা যেখানে যেখানে আড্ডা দিত সেখানে সেখানে যেয়ে বসে থাকত। আর মনে মনে বলত আমার মিতা আমার পাশে আছে।

আজ ছোট নিধির এসএসসি রেজাল্ট দিবে। সে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেছে গোল্ডেন পাওয়ার জন্য। আমাদের স্বপ্ন থাকে গোল্ডেন পাব ভাল কলেজে ভর্তি হব। কিন্তু ছোট নিধির টার্গেট ঢাকা কলেজ। কারণ সেখানে তার মিতা আছে। দুপুর দুইটার দিকে রেজাল্ট পাবলিশড হল। তার বাবা রেজাল্ট নিয়ে এসেছে। সবাই জিজ্ঞেস করে আমি পাশ করেছি? কিন্তু ছোট নিধি জিজ্ঞেস করল বাবা আমি গোল্ডেন পেয়েছি তো? মেয়ের প্রতি বাবারও কনফিডেন্স ছিল যে মেয়ে ভাল রেজাল্ট করবে। হলো তাই। ছোট নিধি গোল্ডেন পেয়েছে।

এডমিশন ফর্ম শুধু ঢাকা কলেজ থেকেই নিল। সবাই অবাক হল। শুধু এক কলেজ থেকে ফর্ম নেয়া বোকামিই তো। ছোট নিধি পরীক্ষা দিল। টিকেও গেল। কলেজে এসে প্রথম দিন থেকেই বড় নিধিকে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। বড় নিধির বাবা মা বলেছে সে ঢাকা কলেজে পড়ে। নিধি খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা তবুও পাচ্ছে না।

“মিতার সাথে কথা হয় না আজ দু বছর ১৩দিন। আজও ওর চোখের পানি আমার চোখে ভাসে।”
লেখাটা ডায়েরিতে লিখে বন্ধ করে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে পড়লো বড় নিধি। উদ্দেশ্য চায়ের টংয়ে যাবে। দুই বছর ধরে নিধি এই সময়টাতে চা খায়। কারণ সে তার মিতার সাথে এই সময়ে চা খেত। চা খেয়ে ক্যাম্পাসী দিকে হাঁটা দিল। ক্যাম্পাসে এসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ছোট নিধি মনমরা হয়ে তার পাশেই বসে আছে। কিন্তু পাশে একবারও তাকায়নি।

বাতাসে ডায়েরির বেশ কিছু পাতা উল্টে গেল। পাতা উল্টানোর শব্দ শুনে ছোট নিধি ডায়েরির দিকে তাকাল। অস্পষ্ট ভাবে “মিতা” শব্দটা দেখে তার চোখেমুখে আশার আলো ফুটে উঠলো। সে আগ্রহ নিয়ে ডায়েরির দিকে তাকাল। বাতাসে পৃষ্ঠা উলোটপালোট হতেই আছে। ছোট নিধি হাত দিয়ে থামালো। একটা পৃষ্ঠায় লেখা আছে‚ “আমার মিতা সবসময় শহীদ মিনারের কোণায় বসে থাকে। তাই আমিও কলেজের শহীদ মিনারে বসে থাকি।” লেখাটা পড়ে ছোট নিধি বড় নিধিকে বলল,
= excuse me আপু। এটা কি আপনার ডায়েরি?
বড় মিতা তাকাল। দেখে অবাক হয়ে গেল। এই দুই বছরে চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর বড় মিতারও স্টাইলের পরিবর্তন হয়েছে। দুজনের কাছে দুজনকে চিনি চিনি মনে হচ্ছে।

ছোট নিধি বলল,
= আপু আপনার ডায়েরিতে দেখলাম মিতা শব্দটা। এটা কি আপু?
> আপনাকে চিনি চিনি মনে হচ্ছে।
= আগে বলুন মিতা কে?
> আমার হাইস্কুল লাইফের স্পেশাল একজন। যাকে মিতা বলতাম।
নিধির চোখে পানি চলে এলো। আবেগ ভরা কণ্ঠে বলল,
= কেন বলতেন মিতা?
> আমাদের দুজনের নাম এক ছিল।
ছোট নিধি চাপা কণ্ঠে বলল,
= কি নাম ছিল?
ছোট নিধির চোখের পানি দেখেই বড় নিধি চিনে ফেলল এটাই তার মিতা। সেও কেঁদে বলল, “নিধি।”
সাথেসাথেই ছোট নিধি বড় নিধিকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল।

কাঁদতে কাঁদতে ছোট নিধি বলল,
= আমি বলেছিলাম না তুই আমায় ভুলে যাবি। দেখলি তো আমার কথাই সত্য হল।
বড় নিধিও কেঁদে কেঁদে বলল,
> এই দুই বছর ১৩ দিনে একটিবারের জন্যও তোকে ভুলিনি। দূরে এসেছি তো কি হয়েছে। মনটা তোর কাছেই ছিল।
= আমি কিন্তু তোকে ঠিকই খুঁজে বের করেছি। আমি এই কলেজে তোকে পাওয়ার জন্য ভর্তি হয়েছি।
> হ্যাঁ রে। আমি তোর মত মিতা পেয়ে সত্যিই ভাগ্যবতী।
= আবার ভুলে যাবি নাতো?
> নারে যাব না।
= ভুললেও অসুবিধা নাই। আমি ঠিকই খুঁজে বের করব। আমি তোর মত নই। মিতাকে এত সহজে ছাড়ছি না।

দুজন দুজনের চোখের পানি মুছে দিল। বড় নিধির বন্ধুরা এই মিতার কথা জানে তাই তারা সাদরে ছোট মিতাকে বরণ করল। সবার মুখ থেকে নিজের কথা শুনে ছোট নিধি বুঝলো তার মিতা তাকে ভুলেনি। দুজনই আজ অসম্ভব খুশি যা কেবলমাত্র তারাই জানে।

(সমাপ্তি)

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত