আমার বয়স তখন সবে সাত।
স্পষ্ট আমার মনে আছে সেদিন গুলোর কথা।
আমি বারবার চিৎকার দিয়ে সবাই কে বলার চেষ্টা করছিলাম ” আমার মা চুরি করেনি, আমার মা চোর না”। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনেনি।
জমিদার তার চাবুকের আঘাতে মা কে রক্তক্ষরণ করেছিলেন। জসিম চাচার সাহায্যে মা কে কোন রকম কুঠিরে এনেছিলাম। তখন সন্ধ্যা, চার-পাশে জোঁনাকি পোঁকা উড়ে বেড়াচ্ছিলো, মা আমায় ডেকে বলে ” মারে তোর জসিম চাচা কে একটু ডাকবি? উনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো” মায়ের কথা শুনে দৌড়ে জসিম চাচার বাড়ি গিয়েছিলাম, চাচি কিছুতেই জসিম চাচাকে আমার সাথে আসতে দিলেন না, মুখ গোমড়া করে কুঠিরে পৌঁছাতেই চিৎকার দিয়ে উঠলাম “মা গো! ওমা তোমার কি হয়েছে? এমন করছো কেন?” মা আমার কথায় কোন জবাব দিলো না।
মায়ের কপালে হাত দিতেই চমকে উঠলাম! মায়ের গা পুড়ে যাচ্ছে, ডোবা থেকে পানি তুলে অনবরত মায়ের মাথায় দিচ্ছিলাম, ছোট বেলায় দেখেছি “যখন আমার গা পুড়ে যেত তখন মা এমনি করতো”। কিছুক্ষণ পর পর মাকে ডাকছিলাম কিন্তু মা ছাড়া দিচ্ছিলো না, জমিদারের চাবুকের আঘাত হয়তো মা সহ্য করতে পারেনি। পরের দিন প্রভাতে মা চোখ খুললো, আমি পাশে বসে ছিলাম। মা আমায় ডেকে বললো “কিরে পাগলী! তোর চোখ মুখের এমন অবস্থা হলো কিভাবে?” আমি বিদুৎ গতীতে হেসে দিয়ে বললাম “মা কি হয়েছিলো তোমার? কাল সারা রাত একটিবারও কেন কথা বলোনি আমার সাথে? আমি তোমায় এত বার ডেকেছিলাম তুমি শুনতে পাওনি?” মা আমার কথা শুনে বুকে জড়িয়ে বলে “হ্যাঁ রে শুনতে পেয়েছিলাম কিন্তু জবাব দেওয়ার শক্তি হারিয়েছিলাম”। মা আমার মুখের হাসি দেখে তৃপ্তি পেল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো কিন্তু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলো না মা।
জমিদার বাড়ির কাছাকাছি যাওয়া নিষেধ করেছে জমিদার চাচা। জমিদার চাচা সেদিন বলেছেন “ওই লতা শুন তোর মায়ের মত চোর যেন জমিদার বাড়ির আশে-পাশেও না আসে”। মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলে মাকে নিয়ে চলে এসেছিলাম। জসিম চাচা সন্ধ্যার মৃদু আলোতে লুকিয়ে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসেন।
খাবার খেয়ে শান্তির ঢেকুর তুলে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চার-পাশে হলকা হালকা আলো ফুঁটেছে, মা আমায় ডেকে বলে “ওঠ মা, জলদি উঠ, প্রথম বাসটা ধরতে হবে, আমরা শহরে যাবো লতা মা” শহরে যাওয়ার নাম শুনেই লাফিয়ে উঠলাম, একটা ঝুলিতে আমাদের জামা-কাপড় নিয়ে বের হলাম শহরের উদ্দ্যশে।
শহর অনেক দূর! গ্রাম ছেড়ে শহরে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কখন যে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। মধ্য রাতে খিদার জ্বালায় ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি মা আমার পাশে নেই, এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম।
মাকে দেখতে না পেয়ে বসে বসে কাঁদছিলাম। কিছুক্ষণ পর মা এসে আমার পাশে বসে।
মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম “কোথায় গিয়েছো মা?” মা নিস্তদ্ধ কণ্ঠে বলে “শহর অনেক নোংরা রে মা”। সেদিন মায়ের কথাটার মানে বুঝিনি কিন্তু ১১ বছর পর আজ কথাটা বুঝতে পারলাম।
সারাদিন ফুল বিক্রি করে সন্ধ্যায় মাকে ভাঁপা পিঠা বানাতে সাহায্য করতে বসলাম।
ফুল বিক্রি করা এবং ভাঁপা পিঠা বিক্রি করা অর্থ দিয়ে আমাদের দিন না চললেও দু’বেলা পেট চলে বেশ! মানুষের চলাচল কমে গেলে আগুন নিবিয়ে শুয়ে পড়ি রাস্তার পাশে।
সেদিন রাতে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “মা আমরা গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম কেন?” মা উত্তরে বলে “জানি না রে মা! হয়তো ভাগ্যে ছিলো এমন!” জামা-কাপড় দিয়ে মোড়ানো একই বালিশে দুজনের মাথা, আমি মায়ের হাতে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম “আমার বাবা কে গো মা?” আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে মা বলে ” হয়তো জমিদার বুঝতে পারেনি আমার গর্বে তুই চলে আসবি!” মায়ের কথা শুনে নিশ্বাস পাথুরে হয়ে গেলো! মায়ের কথাটা বুঝতে আমার একদম কষ্ট হয়নি। হেসে দিয়ে মাকে বললাম “বেশ তো! রাত হয়েছে, চোখ দু’টো বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ো।
হাসি আল্লাদে ঘুমিয়ে পড়লাম দু’জন।
দ্বিপ্রহরে আচমকা অনুভব করলাম কয়েকজন আমার মুখ চেপে ধরেছে!
পাশের গলি থেকে হেঁটে বের হয়ে মায়ের দিক চেয়ে রইলাম, মা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে আর “লতা কই গেলি মা” বলে চেঁচাচ্ছে।
আস্তে আস্তে মায়ের কাছে এসে দাড়ালাম।
মা আমায় জড়িয়ে ধরে বলে “কি রে মা! কোথায় গিয়েছিস আমাকে না বলে?” আমি মৃদু হেসে মা কে বললাম ” শহর অনেক নোংরা মা”