ইদানীং আমার কী যে হলো কিছুই বুঝতে পারি না। খেতে, বসতে, শুতে এমনকি ঘুমাতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। ভাগ্যিস পোশাক পরিধানের সময় এমন অনীহা হয় না। হলে যে কী বিব্রতকর অবস্থায় পড়তাম তা আল্লাহ মালুম! তো আমার এই অনীহাপ্রীতির মূল কারণ যে প্রেম, ইহা বোধ করি আজকালকের ফিডার খাওয়া পোলাপানও অনুমান করতে পারে। আর যদি কেউ ইহা অনুমান করিতে ব্যর্থ হয়, তবে সে হচ্ছে আমার ক্লাসমেট প্রিয়া! অবশ্য তার অনুমান না করার পেছনে যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান ছিল। কোথায় যেন শুনেছিলাম- ‘একটি মেয়ে যখন প্রেমে পড়ে তখন তার প্রেমে পড়ার বিষয়টি একমাত্র সেই মেয়েটি ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। অথচ একটি ছেলে যখন নাকি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ে তখন দুনিয়ার সবাই বিষয়টি জেনে যায়, শুধু জানতে পারে না ওই মেয়েটি!’ যেহেতু আমি ছেলেদের ক্যাটাগরিতেই পড়ি, তাই আমার বেলাতেও এর কোনো ব্যাতিক্রম হয়নি। অর্থ্যাৎ, দুনিয়ার সবাই জানত আমি প্রিয়াকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার ক্লাসমেট প্রিয়া কখনো এটি জানতে বা বুঝতে পারেনি। আর এভাবেই লুকোচুরির মাধ্যমে কোনো রকমে ঠেলেঠুলে চলছিল আমাদের… থুক্কু! আমার প্রেম।
প্রিয়া আমার ভালোবাসার কথা না জানলেও তার সাথে আমার বন্ধুটা কিন্তু বেশ ভালোই ছিল। আর তাই তো প্রেমের টানেই হোক কিংবা হোক বন্ধুত্বের টানে সে কলেজের পাশাপাশি রেগুলার আমাদের বাসায়ও যাতায়াত করত। এমনকি আমি বাসায় না থাকলেও নাকি প্রিয়া এসে আমাদের বাসার সামনে উঁকি-ঝুঁকি মেরে যেত। তার এরকম উঁকি-ঝুঁকি মারার কারণটাকে আমি অবশ্য পড়ালেখার প্রতি ভীষণ দুর্বলতা এবং আমার প্রতি প্রবল আগ্রহ আছে বলে মনে করতাম! আর তাই তো সব সময় নানান কায়দায় প্রিয়াকে শুধু হেল্প করার সুযোগ খুঁজতাম। কিন্তু বিরক্ত হতাম তখন যখন প্রিয়ার মুখে আমার চেয়ে আমার বড় ভাইয়ের বেশি প্রশংসা শুনতাম। আমার ক্লাসমেট আমাকে ছেড়ে কেন আমার বড় ভাইয়ের প্রশংসা বেশি করবে এটাই বুঝে উঠতে পারতাম না।
যাই হোক- প্রিয়াকে না জানিয়ে তার সাথে লুকোচুরি প্রেম তো অনেক করলাম, এবার আর না। যে করেই তাকে আমি প্রপোজ করে ছাড়বই। এখন কিভাবে কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তায় বসলাম। চিন্তা করতে করতে কখন যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে কাছে চলে আসলো তার কোনো টেরই পেলাম না। ভাবলাম এই তো সুযোগ! এবারের
ভ্যালেন্টাইনেই না হয় প্রিয়াকে নিজের মনের কথা জানাব। কিন্তু যেই ভাবা সেই মোতাবেক কাজ আর করা হলো না। অর্থ্যাৎ মনের মাঝে সাহসের ঘাটতি থাকায় ভ্যালেন্টাইনের দিন প্রিয়াকে প্রপোজ করার ভাবনাটাকে আর বাস্তবে রূপ দেওয়া গেল না।
এ দিকে এই ভ্যালেন্টাইনের দিনে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমার এক বন্ধুর জন্মদিন পড়ে গেল। সারা জীবন দেখে আসলাম, যে দিন যার জন্মদিন হয় সে দিন সে তার বন্ধুবান্ধব আর আত্বীয়স্বজনদের নিজের বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ায়। কিন্তু আমার বেলায় হলো তার ঠিক উল্টো! অর্থ্যাৎ জন্মদিনের দিন সেই বন্ধুটি নিজেই এসে আমাকে ধরল এদিন তাকে ভালো কোনো হোটেলে নিয়ে কিছু খাওয়ানোর জন্য! আমি অবশ্য প্রথমে তার অনুরোধ থেকে বাইন মাছের মতোন মোচর দিয়ে দূরে সরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। কারণ এখানেও আমার ভাগ্য আমাকে সহায়তা করেনি। অতএব তাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়ানো বাদে আর কোনো গতি নেই। বিকেলে সেই বন্ধুকে নিয়ে চলে গেলাম শহরের এক নামহীন চাইনিজ হোটেলে! খাওয়া-দাওয়া শেষে নিজের পকেট থেকে কোরবান করলাম নগদ ৪৮০ টাকা। এরপর তাকে বিদায় জানানোর পর হোটেল থেকে বের হতে গিয়ে দেখলাম সেখানের এক কোনার টেবিলে মোটামুটি বড় ধরনের আয়োজন করে খাবার সাজিয়ে বসে আছে আমার ক্লাসমেট ওরফে মনের মানুষ প্রিয়া! দেখে বেশ অবাক হলেও কিছুই বলার ছিল না। আস্তে আস্তে তার টেবিলের সামনে যেতেই সেও আমাকে দেখে তাৎক্ষণিক অবাক হওয়ার ভান করল। কুশল বিনিময়ের পর আমি তার টেবিলের বিপরীত দিকের চেয়ারটায় বসতে চাইলে সে আপত্তি জানিয়ে বলল, জায়গাটা নাকি অন্য একজনের জন্য রিজার্ভ করা আছে। আমি বললাম, কে সেই একজন? জবাবে প্রিয়া জানায় তার ভালোবাসার মানুষ! এই কথা শুনে আমার মাথার তাপমাত্রা যেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আরো ১০৮ ডিগ্রি বেড়ে গেল। মনে মনে বললাম, শালা তুই যেই হোস না ক্যান আজ তোকে আমি দেখেই ছাড়ব। (এখানে তাকে শুধু দেখে নেওয়ার কথা বলেছি। কোনো কিছু করার কথা কিন্তু আর আমি বলিনি। কারণ, আমার মাঝে আবার সাহসের মাত্রাতিরিক্ত অভাব আছে কিনা!)
দেখতে দেখতেই চলে আসলো প্রিয়ার সেই ভালোবাসার মানুষ। তো যাকে দেখার জন্য আমি এতক্ষন মনে মনে বাঘের মত গর্জে উঠেছিলাম, সেই তাকে দেখার পর যেন পুরো ভেজা বিলাই হয়ে গেলাম! আর বিলাই না হয়েই বা কী করার আছে? কারণ প্রিয়ার ভালোবাসার মানুষ আর অন্য কেউ নয়, তিনি সাক্ষাৎ আমারই আপন বড় ভাই! এখন যেই ভাইয়ার সামনে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভয় পাই সেই ভাইয়ার সামনে তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের বলে দাবি করার মত ততটা সাহসী মানব আমি নই! আর তাই তো তাকে পাশ কাটিয়ে কোনো রকমে হোটেল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু লাভ হলো না। ভাইয়া আমাকে দেখে ফেললেন প্রিয়ার সাথে কথা বলা অবস্থায়। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, এখানে কেন এসেছিস? কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম, এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল তাই সে আমাকে খাওয়ানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। খাওয়া শেষে দেখলাম প্রিয়া এখানে বসে আছে। তাই তার সাথে কথা বলছিলাম। ভাইয়া বললেন, প্রিয়াকে তুই চিনিস? বললাম, হুম… আমরা একই ক্লাসে পড়ি। এরপর ভাইয়া বললেন, ঠিক আছে এখন বাসায় চলে যা। আর শোন, আমি যে প্রিয়ার সাথে হোটেলে খাবার খেতে এসেছি এটা কিন্তু বাসায় কাউকে বলিস না। আমি বললাম- জি আচ্ছা, বলব না। এরপর ভাইয়াকে বললাম, ঠিক আছে আমি তাহলে এখন যাই। ভাইয়া বললেন, আচছা যা।
এ দিকে আমাদের দুই ভাইয়ের কথাবার্তা গুলো পেছনের টেবিল থেকে সব শুনছিল প্রিয়া। তাই বিদায়ের আগে প্রিয়াকে বললাম, প্রিয়া এখন তাহলে আমি আসি। তারপর রাজ্যের তামাম দুঃখগুলোকে নিজের কাঁধে নিয়ে হোটেল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। যেই না এক পা সামনে বাড়ালাম অমনি প্রিয়া পেছন থেকে ডেকে আমাকে বলল, বুঝলি সুমন… সব যেহেতু জেনেই গেছিস তো আজ থেকে আমাকে আর প্রিয়া ডাকার কী দরকার? এখন থেকে আমি শুধুই তোর ভাবী!!