মুখে ঠান্ডা কি যেন পড়ছে। কাথা ভিজে যাচ্ছে। চোখ খুলে হরবর করে উঠে বসলাম। ছোট ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি ঢালছে মাথায়। সামনে নিতু দাঁড়িয়ে। রাগ করার মতই অবস্থা। রাগ সামলে নিয়ে নিতুকে বললাম, কয়টা বাজে?
নিতু খানিকটা অবাক হলো। কিছু না বলে চলে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি ভাই নেই। পানির মগ নিচে পড়ে আছে। সকাল সকাল এমন অবস্থায় ঘুম ভাঙবে ভাবিনি।
প্লেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমার সামনে আর যাই থাকুক,এটা রুটি না। নিতু পাশে বসে থেকে উৎসাহ নিয়ে বসে আছে। রুটি খাবো কি খাবো না তাই ভেবে পাচ্ছিনা৷ একটা রুটি ছিড়ে তরকারি দিয়ে একটু মুখে দিলাম। না এতোটাও খারাপ না। দেখতে ঢাকা শহরের মানচিত্রের মত হলেও খেতে অত্যন্ত ভালো। নিতু আরেকটা রুটি দিয়ে বলল, ওই শুনো
হুম।
আমার না ঝগড়া করতে ইচ্ছা করতেছে।
অদ্ভুত আবদার! ঝগড়া করার ইচ্ছা কার হয়?
আমার হয়।
নিতু,মাথায় কি খিচুড়ি রান্না হচ্ছে তোমার? পাগলামি করোনা তো।
না,আমি ঝগড়া করবো।
যাও আজ ঘুরতে নিয়ে যাবো।
না।
দুইটা তুলা দেও কান আটকে রাখি।
শুনো না। ওই,ঝগড়া করতে ইচ্ছা করতেছে।
কি বাচ্চাদের মত কথা বলতেছ? বাচ্চা নাকি তুমি। দুইদিন পর তো তোমারই বাচ্চা হবে আর তুমি এইরকম বাচ্চামি করছ।
আমার ইচ্ছা আমি করতেছি। তোর কি রে?
তুই করে বলতেছ কেন?
আমার ইচ্ছা আমি বলমু,তোর কি।
আচ্ছা খেয়ে নেই। তারপর ঝগড়া হবে।
সত্যি?
না বইন,এখনই হবে।
সরি ডিস্টার্ব করলাম। খেয়ে নাও আগে।
খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে এসে কম্বল দিয়ে মুখ ঢাকলাম। নিতু কাজ করতে ব্যস্ত থাকবে এখন। কয়েক ঘন্টা আমার ধারে কাছে আসার সময় হবেনা। আজ ছুটির দিন তবুও বাচ্চারা পড়তে আসবে। সময় না কাটায় নিতু দুটো প্রাইভেট পড়ায়, ক্লাস ফাইভের দুটো জমজ মেয়েকে। পাশের বাসায় থাকে তাই তেমন কোন সমস্যা হয়নি,এখন পর্যন্ত। হতেও পারে। অবশ্য নিতু তাদের পড়ায় কম খেলে বেশি,তাই শুক্রবারেও এসে পরে বাচ্চা দুটো। হালকা উষ্ণতায় আমার চোখ ঘুমে জড়িয়ে গেল।
খটখট শব্দ হচ্ছে। মাথা তুলে দেখি টেবিলে এক বুড়ো বসে আছে। হাতে বই। পা দিয়ে চেয়ারে লাথি দিচ্ছে বারবার। আমি বললাম, কে? এখানে কিভাবে?
আমি গুরু রে পাগলা। চিনিসনি? কবি গুরু।
কবি গুরু?
হ্যাঁ,রবীন্দ্রনাথ।
ও,কিন্তু এখানে কেন?
এমনি,বসে আছি। বই পড়বি?
কি বই?
শেষের কবিতা। বইটা ভালো আছে। তিন নাম্বার কবিতা টা আমার বেশি ভালো লেগেছে।
আমি উঠে বসলাম। মুখে বিরক্তি নিয়ে বললাম, পড়বো না। আমার ঘুম পেয়েছে,বিদেয় হন এখন।
ভালো ভাবে বল এমনিতেই চলে যাব।
যাওয়ার সময় লাইট টা অফ করে দিয়ে যাবেন।
আচ্ছা। একটা ভুল করে ফেলেছি। চেয়ের কাপটা দেখতে গিয়ে একটা ডাট ভেঙে ফেলেছি। ডাট টা সাবধানে রেখে দিয়েছি বইয়ের ভেতর।
লাইট অফ করুন।
লাইট অফ হয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল। শরীর ঘেমে গেছে। ভয় পাওয়ার মত স্বপ্ন দেখলে এমনটা হয়,আমার ক্ষেত্রে উলটো টা ঘটলো কেন তা ভাবার বিষয়। হাস্যকর স্বপ্ন দেখলেও কি গা দিয়ে ঘাম ছাড়ে!
কয়েল দেয়া হয়েছে। কম্বল ভালো করে দেওয়া ছিল গায়ে৷ নিতু এসে ঠিক করে দিয়ে গেছে নিশ্চই। বিছানা থেকে নেমে মুখে পানি দিয়ে ছাদে গেলাম। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। শীতের দিনে বৃষ্টি হবার কথা না৷ কিন্তু হচ্ছে। আমার একটু খারাপ লাগছে। ইট দিয়ে ঘেরা বাড়িতে থাকলে বোঝাই যায় না বাইরে কি হচ্ছে। কিন্তু এই সময় যদি আমাদের পুরোনো টিনের বাড়িতে থাকতাম তাহলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ শুনতে পেতাম। নেশা ধরানোর মত সেই শব্দ। কিন্তু আজ সময়ের কারণে সেই নেশা থেকে বঞ্চিত হতে হলো।
নিতু চেয়ার নিয়ে ছাদের দরজার সামনে বসে আছে। হালকা বাতাস বইছে। নিতুর খোলা চুল গুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে দুলছে৷ নিতুর পাশে কিছুক্ষণ বসার জন্য এগিয়ে গেলাম। নিতু অবাক করে দিয়ে বলল, চলো নিচে যাই।
বলেই হুট করে উঠে চলে গেল নিতু। আমি তখনও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে৷ কোন কারণে নিতুর মন খারাপ।
আলনার কাপড় গোছাতে নিতু ব্যস্ত। বোঝাই যাচ্ছে এটা তার নকল ব্যস্ততা। গোছানো কাপড়কেই আবার গোছাচ্ছে৷ একটু পর হয়তো সাজতে বসবে৷ সাজলে নাকি মেয়েদের মন ভালো হয়ে যায় কথাটা ছোট বোনের কাছ থেকে শোনা৷ এর সত্যতা যাচাই করার মত অভিজ্ঞতা হয়নি এখনো।
নিতু!
হু
কিছু হয়েছে?
না তো।
মন খারাপ কেন?
কই মন খারাপ! যাও তো।
প্রেম টেম করতে ইচ্ছা করছে নাকি?
বিকেলের দিকে আমি মারামারি করিনা। নাহলে এখনই তোমার হাত পা ভেঙে দিতাম। উল্টাপাল্টা কথা বলবা না।
কি ব্যাপার! এতো রাগ কেন?
কিছুনা?
আচ্ছা তাহলে আমি যাই৷ কাজ করি গিয়ে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
তো?
কফি খাবো।
খাও,কফি থাকার কথা তো বাসায়।
নেই। তুমি বাইরে যেতে পারবা না,ঠান্ডা লাগবে। তাই..
এই কারণে মন খারাপ?
না
তো?
আমার কাছে স্পেশাল একটা দশ টাকার নোট আছে। ওটা দিয়ে কফি কিনতে হবে।
হাইরে বাহানা! আচ্ছা দাও কিনে নিয়ে আসি।
খুঁজে পাচ্ছিনা। আমার ঘর,রান্না ঘর,বসার ঘর সবজায়গায় খুজেছি,পাইনি। শুধু তোমার ঘরটাই বাকি।আমার ঘরে দশ টাকা খোজা হচ্ছে। সবজায়গায় টর্চ মেরে দেখা হয়ে গেছে। আমি চেয়ারে বসে বসে নিতুর কান্ড দেখছি। এই পাগল ধরণের মেয়ের মায়ায় কিভাবে জড়িয়ে গেছি নিজেও জানিনা। এখন আমার টেবিলে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। একটা বই নিয়ে আমার মাথার উপর ঝাড়ার সাথে সাথে খটাক করে মাথায় কি যেন পড়লো। মাথায় বাড়ি খেয়ে আমার পায়ের কাছে পড়লো জিনিস’টা হাতে নিয়ে দেখলাম কাপের ডাট। আমার প্রিয় কাপের ডাট ভেঙে বইয়ের ভেতর রাখা হয়েছিল৷ এ নিশ্চই স্বপ্নের রবীন্দ্রনাথ না। এ আমার বাস্তবের বউয়েন্দ্রনাথের বাদরামি। পাশ ফিরে নিতুকে ধমক দিতে গিয়ে দেখলাম টেবিলে একটা হলুদ খাম। নিতু আমার আশেপাশেও নেই। মুখে এখনও রাগের স্পষ্ট ছাপ,সাথে ফিরে পাওয়া সময়ের। প্রতি শুক্রবারে দেওয়া সেই দু লাইনের চিঠির কথা মনে করিয়ে দিল আমার বউয়েন্দ্রনাথ।