১৯৭১ সাল,১ ডিসেম্বর
– মা, ও মা,দরজা টা একটু খোলো না,(ফিসফিস করে)
– কে? কে ডাকে? কে ওইখানে?
– মা,আমি জামিল। দরজাটা খোলো মা।
– জামিল!!! বাবা আইছোস!!! আয় বাপ ঘরে আয়, কতদিন দেখিনা তোরে। আয়…
– তোমারে খুব দেখতে মন চাইতাছিলো মা, তাই আইয়া পরলাম,দিনের বেলায় তো আইতে পারিনা, এখনও অনেক কষ্টে আইছি। মা, ও মা,কেমন আছো তুমি? তোমার শরীরটা ঠিক আছে মা?
– হ রে বাপ, আমার শরীর ঠিক আছে, তয় তুই এতো শুখাইয়া গেছোস কেন? খাইতে পারোস না ঠিক মতো না রে?
– নাহ,মা, কে কইছে খাই না? খাই তো মা, মা, খুব খিদা লাগছে,একটু ভাত খাওয়াইয়া দিবা?
– হ বাপ,তুই বস,আমি ভাত আনতাছি।
– আইচ্ছা মা।
জামিল একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর থেকে মুক্ত করতে জামিল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কিছুদিন ধরেই মায়ের কাছে আসার জন্য তার মনটা ছটফট করছিলো, তাই প্রাণ নাশের সংশয় থাকা স্বত্বেও মাকে এক পলক দেখতে রাতের আঁধারে ছুটে আসে তার মাকে দেখতে। ছোটো একটা বোন ছিলো জামিলের। নাম জান্নাত। বোনটা খাটে শুয়ে আছে,নির্ভয়ে,শান্তিতে ঘুমাচ্ছে,সে জানে যে কোনো সময়ে মিলিটারির আক্রমণে শেষ হয়ে যেতে পারে তার আর তার মায়ের জীবন। তবুও সে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে,কেননা,তার ভাই কথা দিয়েছিলো,দেশকে তারা শত্রুমুক্ত করবে,স্বাধীন করবে। জামিল অনেক দিন পর তার বোনটাকে ঘুমাতে দেখছে,জামিল জান্নাতকে ডাকছে না। শুধু দেখছে,আর চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়ছে। হঠাৎ জান্নাতের ঘুম ভেঙে গেলো। জান্নাত ঘুম ভেঙেই জামিলকে দেখলো। অনেকদিন পর ভাইকে দেখে জড়িয়ে ধরলো,আর ভীষণ কান্না করছিলো। জামিলের মা জামিলকে আর জান্নাতকে অনেকদিন পর একসাথে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে।
– বাজান রে,দেশ কবে স্বাধীন হইবো?
– হইবো মা,এইতো আর কিছুটা দিন অপেক্ষা করো, আর বেশিদিন লাগবো না মা দেইখো,আর দুই তিনটা বড় অপারেশন আছে,এর পরেই আমাগো দেশ স্বাধীন হইয়া যাইবো দেইখো।
– বাজানরে, আমার তো মেলা চিন্তা হয় রে তোর লাইগা,তুই একটু সাবধানে থাকিস বাজান।
– আহা মা, এতো চিন্তা কইরো না তো তুমি,,তোমার দোয়া আছে না সবসময় আমার লগে? কও মা, আছেনা?
-হ রে বাজান,তোর লাইগা তো সবসময় দোয়া করি।
-তাইলে?সন্তানের ওপর মায়ের দোয়া থাকলে সন্তানের কিছু হইতে পারে কও? কিচ্ছু হইবো না আমার।
আইচ্ছা মা,,অনেক দেরি হইয়া যাইতাছে,আমারে এখন যাইতে হইবো মা। তুমি,জান্নাত একটু সাবধানে
থাইকো মা।
– আইচ্ছা বাজান, তুই আমাগো রে লইয়া এতো চিন্তা করিস না,তুই সাবধানে থাকিস।
– আইচ্ছা মা,আমি যাই তবে।
যেয়েও আবার পিছনে ফিরে আসে জামিল। আজকে কেনো জানি জামিলের যেতে ইচ্ছে করছে না। তার মনটা কেমন জানি কু-ডাকছে। জামিল আবার ফিরে এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
” মা, আমি আবার ফিরে আসবো। ”
জামিল চলে আসলো মায়ের পায়ে সালাম করে। সেদিন জামিলের আসতে ইচ্ছে করছিলো না। বার বার বুক ফেটে কান্না আসছিলো,,তবুও জামিল সকল মায়া কাটিয়ে চলে এসেছিলো,,তার যে এখন অন্য মাকে বাঁচাতে হবে,,দেশ যে এখন পাক বাহিনীর হাতে বন্দি, বাঁচাতে হবে তার দেশকে,দেশের মানুষদেরকে। দূর করতে হবে সকল অন্ধকার,,সকল মানুষকে নতুন এক সকাল উপহার দেয়ার লক্ষ্যে জামিলের আজ ছুটে চলা। প্রতি মুহূর্তে প্রাণ হারানোর এক ভয়,কিন্তু লাখো মানুষের বাঁচার কথা ভেবে জামিলের নিজের প্রাণ হারানোর ভয় দূর হয়ে যায় নিমিষেই। জামিলের ব্যাগে প্রচুর বোমা,গোলা-বারুদ থাকে,কেননা শত্রু পক্ষ যে কোনো সময়েই হয়তো আঘাত হানতে পারে,,কিন্তু এই হাজারো গোলা-বারুদের মাঝে ব্যাগে আরও দুটি জিনিস আছে,তার বোনের জন্য লাল রঙের শাড়ি, লাল রেশমি চুরি,আলতা। জামিল মাকে কথা দিয়েছিলো,দেশকে স্বাধীন করে এসে তার বোনটার ভালো জায়গায় বিয়ে দিবে। আর আরেকটা জিনিস হলো তার মায়ের একটা ছবি। জামিল যখন ঘুমায়, ছবিটা পাশে নিয়ে ঘুমায়। মনে হয় যেনো তার মা তার সাথেই আছে সবসময়।
১৫ ই ডিসেম্বর, সন্ধ্যা ৭:০০ টা। হঠাৎ পাকবাহিনীর দল আক্রমণ করল জামিলদের বাড়িতে। দরজা ভেঙে হামলা করলো জামিলের মা আর বোনের উপরে। ভেতরে গিয়ে জামিলের মা কে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এলো। জামিলের মা আর বোন চিৎকার করছিলো, বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করছিলো, জামিলের মা বলছিলো-“আমার ছেলে ফিরে আসবে,ফিরে আসবে আমার ছেলে, আমার ছেলে তোদের সবাইকে শেষ করে দিবে,সবাইকে শেষ করে দিয়ে আমার ছেলে দেশকে স্বাধীন করবে। তোরা আমাকে শেষ করতে পারবি কিন্তু এ দেশের মুক্তিবাহিনীদের হাতে ধ্বংস হবি তোরা, ধ্বংস হবি।” সাথে সাথে পাকবাহিনীরা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিলো জামিলের মায়ের বুকখানা।
ভেতর থেকে জামিলের বোন জান্নাতের আর্তচিৎকার ভেসে আসছিলো। নরপশুগুলো শুনেনি কারো চিৎকার, আহাজারি, আর্তনাদ। শকুনের দলেরা ক্ষত- বিক্ষত করে দিয়েছিলো জান্নাতের দেহ,,ধর্ষণের পরে গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা করা হয়েছিলো তার দেহ, মাটিতে পড়ে ছিলো মা-মেয়ের নিথর প্রাণহীন দেহ।
জামিলের মা বড় আশা নিয়ে বসে ছিলো, তার ছেলে যে তাকে কথা দিয়েছে,সে ফিরে আসবে। জামিল আশায় আছে,দেশ স্বাধীন হবে,, সে আবার মায়ের কোলে ফিরবে, আবার মায়ের হাতে ভাত খাবে, বোনকে লাল শাড়িতে দেখবে, সারাবাড়ি বিয়ের আলোয় ঝলমল করবে, কিন্তু মানুষের সব আশা কি আর পূরণ হয়? কিছু আশা সারাজীবন আশা ই রয়ে যায়, বাস্তবে আর পূরণ হয়ে ওঠেনা। তেমনি জামিলেরও আশাগুলো আশা ই রয়ে গেলো, স্বপ্নগুলো সব দুঃস্বপ্ন হয়ে গেলো, কিন্তু জামিলের কাছে আজও সব অজানা। জামিল আজও অজানা আশায় বুক বেঁধে বসে আছে।
১৯৭১সাল,১৬ ই ডিসেম্বর
সকালে দুইটি বিরাট অপারেশন রয়েছে,সেগুলো শেষ করতে পারলেই পাকবাহিনীরা হয়তো এবার দমবে। সকাল হতেই সকলে এক এর পর এক শত্রুদের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে লাগলো, শত্রুরা একে একে সব শেষ হয়ে যাচ্ছিলো,, এভাবেই বিকেল গড়িয়ে এলো। হঠাৎ খবর এলো পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে। তারা তাদের পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে। চারদিকে “জয় বাংলা”, “জয় বাংলা” বলে মুখরিত হতে লাগলো। দেশ জুড়ে উড়তে লাগলো লাল সবুজের পতাকা। দীর্ঘ নয় মাস পর প্রায় ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। যুদ্ধে কারো ভাই শহীদ হয়েছে, কিংবা কারো বোন শহীদ হয়েছে,, কেউ পিতা- মাতা কে হারিয়েছে,,কেউ বা তাদের সন্তানকে হারিয়েছে। জামিলের মুখে আজ হাসির উল্লাস,,বিজয়ের হাসি।
জামিল আজ ভীষণ খুশি। লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে জামিল তার বাড়ির দিকে ছুটে চললো, সে যে তার মা কে কথা দিয়েছিলো, সে ফিরে আসবে তার মায়ের কাছে। তার মা, ছোটো বোনটা যে পথচেয়ে বসে আছে তার অপেক্ষায়।
জামিল বাড়ি ফিরলো,,পাগলের মতোন মা মা বলে চিৎকার দিতে দিতে ছুটে চলেছিলো,কিন্তু বাড়ির উঠোনে পা রেখে বন্ধ হয়ে গেলো জামিলের চিৎকার। জামিল দু’চোখ মেলে কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। জামিল আজ নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। জামিলের চোখের সামনে তার মা আর বোনের প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে আছে তার মায়ের বুক, যে বুকে শুয়ে হাজারো গল্প শুনতো জামিল, ভয় পেলে যে বুকে জামিলকে জড়িয়ে ধরতো তার মা,সে বুক আজ ক্ষত – বিক্ষত হয়ে আছে গুলিতে, অনেক আশা নিয়ে জামিল তার বোনের কাছে এসেছিলো, লাল শাড়ি পড়ে,পায়ে আলতা দিয়ে তার বোন শ্বশুর বাড়ি যাবে, কিন্তু সেই দানবের দলগুলো, শকুনের মতো ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে সে শরীর,,নরপশুগুলো বাঁচতে দেয়নি তাকে। আজ তার গায়ে লাল শাড়ির বদলে সাদা কাফনের কাপড়!
জামিল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, জামিল অঝোরে কেঁদে চলেছে, আকাশে বাতাসে আজ জামিলের আর্তচিৎকার,আহাজারি,,জামিল তার মায়ের কথা রেখেছে,,কিন্তু জামিলের মায়ের দু’চোখ ভরে তা দেখে যাওয়ার স্বাধ আর পূরণ হলোনা!
জামিল মা কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগলো- “মা, আমি ফিরে এসেছি, তোমার খোকা তোমার কথা রেখেছে মা, আমি ফিরে এসেছি মা, আমি ফিরে এসেছি।”
এ দেশের লাখো মানুষকে বাঁচানোর জন্য জামিলের মতো হাজারো ছেলেরা যুদ্ধ করেছে,, অনেকেই জামিলের মতোন মা-বাবা,ভাই-বোন হারিয়েছে,, কিন্তু দেশের শত শত মায়ের মাঝে জামিল তার মাকে খুঁজে পায়, দেশের শত শত মায়েরা জামিলদের আজও মনে রেখেছে। সকল মায়েদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সন্তানের মতোন। সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রইলো অসংখ্য শ্রদ্ধা।