স্মৃতির শহর

স্মৃতির শহর

আমার স্ত্রীর নাম আকিফা। সে বাংলাদেশী নয়, এক পাকিস্তানী মেয়ে। ঠিকমত বাংলা ভাষাও জানেনা, আধোকাচা বাংলা বলার চেষ্টা করে কিন্তু উচ্চারণ সঠিক হয়না। আমিও তাকে বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য তেমন চেষ্টা করিনি। সর্বদা ইংরেজি কিংবা উর্দুতেই তার সাথে কথা বলি। আমি নিউজিল্যান্ড আসার ৭ বছর পর তার সাথে আমার পরিচয় হয়, আমার দুঃসময় সে আমার পাশে এমন ভাবে ছিলো যেন কোন চুম্বকীয় শক্তির টানে লোহা তার সংগে থাকে। আজকাল তার বায়না বাংলাদেশে আসবে। এ দেশের মানুষ দেখবে। কিন্তু আমার মোটেও দেশে আসার ইচ্ছানেই। যেদিন আমি দেশ ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমাই, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর কখনো দেশে আসবো না। কিন্তু আকিফা এত বেশী জোর করছিলো যে আমার ১০ বছর আগে নেওয়া প্রতিজ্ঞা ভেংগে দেশে আসার জন্য রাজি হতে হলো।

আকিফা তার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আর জামা কাপড় প্যাক করছে। আজ মেয়েটিকে বড্ড সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। তার কারন গত দুবছর ধরে সে যে বায়না ধরেছিলো আজ গিয়ে তা বাস্তব হতে চললো। আমি তাকে নিয়ে আজ রাতে নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে যাবো। আমি যে দেশকে ঘৃনা করি এমনটা না, যে দেশে আমার জন্ম, যে দেশের মাটি, পানির কাদায় মাখামাখি আমার ছোটবেলা। যে মায়ের বুলিতে আমি আজ কথাবলি সে দেশকে ঘৃনা করার মত দেশদ্রোহী আমি নই। কিন্তু দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি এক অভিমান রয়েছে বড্ড অভিমান। তাই দেশে ফিরতে চাইনি। তাছাড়া দেশে আমার কেউ নেই, বাবা মা গত হয়েছে অনেক বছর হলো। দুইবোন ছিলো তারা আজ কোথায় আছে তাও জানিনা। আমি যখন দেশ ছেড়ে নিউজিল্যান্ড এ আসি তখন তারা জর্ডান এ থাকতো। কমিউনিকেশন না হবার কারনে তাদের খবর এই মুহুর্তে বলতে পারছিনা। কিন্তু তারা হয়ত এখন বাংলাদেশেই আছে, এটা আমার বিশ্বাস। আমি যখন দেশের ভাবনায় বুদ হয়ে রইলাম, আকিফা আমার কাধে হাত রেখে বললো, “হোয়াট ইউ থিংক”। আমি কিছুক্ষন তাকে দেখে নিলাম, গত বছর ঈদের সময় যে নীলশাড়ি তাকে দিয়েছিলাম তা পড়েছে, লম্বা করে কাজল দিয়েছে চোখে, চুলগুলো বিদেশী স্ট্যাইলে খোপা করেছে, কানে লম্বা ঝুমকা, হাতে একগোছা চুড়ি সব মিলিয়ে আজ আকিফাকে কেন যেন আমার অপ্সরা মনে হলো। যদিও আমি কখনো আকিফাকে সরাসরি প্রশংসা করিনি, তারপরেও আজ কেন জানি তার প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছিলো খুব। কিন্তু আমি তা করলাম না, ড্যাবড্যাব করে তার রুপ দর্শন করতে লাগলাম। তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে সে আবার বলে উঠলো, “এনি প্রবলেম”। আমি আমার ধ্যান থেকে বের হয়ে আসলাম, আর তাকে বলতে লাগলাম “নাহ কোন সমস্যা না তোমার প্যাকিং শেষ?”

সে মুচকি এক হাসি ঠোটে এনে শুধু হ্যা বললো। তার এই হাসিটা আমাকে বড্ড জ্বালা দেয়, যতবার তার এই মুচকি হাসি দেখি ততবার আমার কোন এক নারীর কথা মনে পড়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আকিফার এই হাসির মধ্যেই সেই নারী লুকিয়ে আছে, যে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও আকিফার হাসি হয়ে আমার সাথে আছে। আকিফা আবার গায়ে হালকা ধাক্কা দিলো, আজকাল আমি বার বার ভাবনার জগতে হারিয়ে যাই। অনেক বছর আগে ফেলে রাখা আমার সে অতিত আমাকে বার বার তাড়া করে বেড়ায়। আকিফার ধাক্কাতে আমি একটু স্বাভাবিক হবার ভান করলাম, আর বলতে লাগলাম, “তুমি একবার সব কিছু দেখে নাও, আমি টেক্সিকে ফোন করে জেনে নেই সে কোথায় আছে।” আকিফা হয়ত আমার এই লুকোচুরির বাহানা বুঝে ফেলেছিলো, খানিকটা হতাশ হয়ে শুধু মাথা নাড়িয়ে আমাকে হ্যা সুচক ইংগিত দিলো। আমি সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে আসলাম বাসার নিচে।

ইতিমধ্যে টেক্সি চলে এসেছে। আকিফা সমস্ত ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসলো, ট্যাক্সির পেছনে সমস্ত ব্যাগ রেখে আমরা দুজন উঠে বসলাম। ট্যাক্সি নিউজিল্যান্ড এর অলিগলি সড়ক পেড়িয়ে হাইওয়ে দিয়ে এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে। পুরো ট্যাক্সিতে আকিফা আমার সাথে কোন কথা বলেনি, এয়ারপোর্ট এ আসার পরেও কথা বলেনি। যখন আমরা ইমিগ্রেশন পার হয়ে ওয়েটিংরুম এ অপেক্ষা করছি নির্দিষ্ট সময় হবার তখন সে বলতে লাগলো, “মুঝে পাতা নেহি, তুমহারে দিলমে কোনসা দারদ ছুপা হে। লেকিন মুঝে এ জরুর পাতা হে, তুম হার সুভা কইনা কই দারদ লেকে জাগতে হো। মে তুমহারা বিবি হু, মুঝে কিউ নেহি বাতাতে হো, তুমহারে দিলকি বাত? মুঝে কা ইতনা বি হক নেহিহে, মে তুমহারা দারদ ভুলানে কি দাওয়া বানজাও?”

আকিফার কথা শুনে আমি তার দিকে তাকালাম। তার চোখে পানি ছলছল করছে। মেয়েটি আমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছিলো যে আমি সাত জনম নিলেও এত ভালোবাসা পেতাম না। কিন্তু আমি তাকে ঠকিয়েছে প্রতিটি কদমে কদমে। আমার ঘরে আকিফা বাস করলেও আমার মনে অন্যকেউ বাস করে যা আমি এক নিখুঁত অভিনেতার মত অভিনয় করে তার থেকে আড়াল করে রেখেছি। এতদিন আকিফার সাথে সংসার করে এটুকু তো বুঝে গিয়েছি, তারমত ভালো পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন নারী আমাকে বাসতে পারবে না। আমি আকিফাকে কাছে টেনে নিলাম, সে ছোট বাচ্চাদের মত আমার কাধে মাথা হেলিয়ে দিলো। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম “সব কথা বলবো, আগে দেশে যাবো তারপর।” আকিফা হঠাৎ করেই আদুরী স্বভাবের হয়ে উঠলো, মাথা তুলে আমার গালে আর কপালে চুমু দিতে লাগলো। দুহাতে শক্ত করে আমাকে জরিয়ে ধরলো। এরই মধ্যে মাইকিং এ এলাউন্স হতে লাগলো, নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে যাবার উড়োজাহাজ এ উঠার জন্য। আমি আর আকিফা ওয়েটিংরুম থেকে বের হয়ে উড়োজাহাজ এ উঠে বসলাম।



পুরো একদিনের সফর পেড়িয়ে, আমি আর আকিফা শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ এসে পৌছেছি। বিমান বন্দরের বাহিরে এসে আমি আকিফাকে জিজ্ঞেস করলাম “কোথায় যাবে এখন” সে মুচকি হাসি দিয়ে বললো, তোমার গ্রামের বাড়ি। আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম। তারপর গাবতলী এসে আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম। বাসের টিকেট নিয়ে মাদারীপুর এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এখনো আমার বাড়ি যেতে ৬ ঘন্টার সফর পাড়ি দিতে হবে। সাড়াটি পথে আকিফা আমার কাধে মাথা রেখে দেশের প্রকৃতি উপভোগ করেছে, আমিও খুব গভীর মনোযোগী হয়ে আমার ফেলে আসা সেই দিনগুলোর স্মৃতির প্রেক্ষাপট ভেবে যাচ্ছি।

মাদারীপুর শহরে নেমে অটো রিক্সা করে মাদ্রা গ্রামের পথে আমি। এই সেই পথ যে পথে ১০ বছর যাবত আমার পায়ের ধুলো পড়েনি। কখনো কেউ এই পথের গলিতে আমার কন্ঠ শুনেনি, কারো সাথে গিলি ডান্ডা কাবাডি খেলাতেও মেতে উঠা হয়নি এতটি বছরে। মনেতে অনেক ভাবনা আমার, আবার সংকোচ ও কম নয়। আমি যে ঘরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি একটা সময় সে ঘর আনন্দে উল্লাসে মেতে থাকতো। মায়ের ভালোবাসা বাবার শাসন আর আমার খুনসুটি আবদারে পরিপুর্ন আমাদের সেই দোতলা বাড়িটি হয়ত আজ সুনসান হয়ে গেছে। শুধু নিরবতা আর আত্মচিৎকার ছাড়া হয়ত কিছুই নেই। বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে ঠাসা রয়েছে আমার বাল্যকালের স্মৃতি, ঠাসা রয়েছে প্রথম ঘর ছেড়ে যাবার সময় মায়ের কান্না, বাবার চাতক নয়নে আমার পথ দেখে যাওয়া এই বুঝি খোকা ফিরলো।

রয়েছে আমার প্রথম কান্নার চিৎকার, রয়েছে মায়ের আচলে মাথা লুকিয়ে প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হবার কষ্টে দিনরাত কেদে যাবার সেই না ভোলা এক জীবনের গল্প।

হঠাৎ করে অটোরিক্সা থেমে গেলো, ড্রাইভার এর কথার শব্দ কানে আসলো, “ভাইজান হাওলাদার বাড়ি এসে গেছে” আমি কোন প্রতিউত্তর করলাম না। মাথা বের করে বাড়ির দিকে তাকালাম। কাকার বাড়ি আজো আগের মতই আছে, সেই লাল রংয়ের দেয়াল এখনো পরিবর্তন হয়নি, চোখ ঘুড়িয়ে আমাদের ঘরের দিকে তাকালাম, দেয়ালে শ্যাওলা পড়ে গেছে কতকাল যেন এই দেয়াল আর পরিষ্কার হয়নি। আমি আকিফার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম, “ঘর আগায়া আব উতার যাও”। আমি আমার স্ত্রীর সাথে হিন্দিতে কথা বলার কারনে অটোর মানুষজন কৌতুহল ভাবে তাকালো, একজন বৃদ্ধ বয়স্ক লোক আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “এই বাড়ির তে কে থাকে তোমার” আমি একনজর তাকে দেখলাম, আর বলতে লাগলাম, এটা আমাদের বাড়ি আমার বাবার নাম ফজল হাওলাদার। লোকটি কেন জানি আবেগী হয়ে গেলো, অটো থেকে নেমে আমার সামনে দাঁড়ালো দু হাতে আমার গাল ছুঁয়ে দিলো, তার চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কিছু সে চিৎকার করে বাড়ির মানুষ ডাকতে লাগলো, আরে আজিজ আছিস নাকি ঘরে, সুহেল, নাজমা, ইব্রাহিম কই তোরা দেখ কে এসেছে, তাড়াতাড়ি আয়। এসব কথা বলতে বলতে সে তার চোখের পানি ছেড়ে দিলো। নিজেই বির বির করে বলতে লাগলো, নিজ হাতে তোরে কোলে বসাইয়া খাওয়াইছি। তুই ছোট থাকতে আমাদের গ্রামে অনেক বড় মারামারি হয় একজন মারা যায় পুলিশ আমাকে আসামী ভেবে ১৬ বছর জেল হাজতে রাখলো। তোকে দেখার বড্ড সাধ হতো, তোর মা যেত আমাকে দেখতে কিন্তু তোকে নিয়ে আসতে আমিই নিষেধ করতাম। আপন মামার এমন পরিস্থিতি দেখে আমার জন্য যদি তোর মনে ঘৃনা জমে না যায় এই ভয়ে। আর যখন আমি ফিরে আসলাম তখন তুই রাগ করে চলে গেলি, দশটি বছর ধরে তোকে কোথায় না খুজেছি আমি। বলতে বলতে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে উঠলো, আর সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাকতে লাগলো, তোরা কি মরছোস নাকি সব, কই গেলি তোরা বের হো।

আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে তার আনন্দের পাগলামী দেখছিলাম। এরই মধ্যে সোহেল বের হয়ে আসলো, সোহেল আমার চাচাতো ভাই, আমার থেকে ৫ বছরের ছোট। সোহেলকে আমার চিনতে মোটেও কষ্ট হয়নি। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জরিয়ে ধরলো, আর বলতে লাগলো, “আরে নজরুল ভাই, কেমন আছো ভাই, এমন রাগ কেউ করে, কোথায় ছিলে এতদিন।” আমাকে কথা বলার সুযোগ কেউ দিচ্ছেনা, লক্ষ করলাম সোহেলের চোখেও বিন্দু জল চকচক করছে। আমার উত্তরের সে অপেক্ষা করলো না, দৌড়ে ভেতরে গেলো। আর চিৎকার করে সমস্ত মানুষদের ডাকতে লাগলো, “কে কোথায় আছেন বের হন দেখেন নজরুল ভাই এসেছে” বাড়ির মানুষ একে একে ঘর থেকে বের হতে লাগলো, আশে পাশের বাড়ির মানুষ ও জরো হয়েছে। আমি আর আকিফা ব্যাগ নিয়ে বাড়ির উঠানে এসে আমার বড় বোন নাজমা কে পেলাম সে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো কপালে গালে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিলো বোনের ভালোবাসায়। দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আমাকে শুধু শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। তারমুখে কোন শব্দ নেই আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। আমিও তাকে জরিয়ে ধরলাম, কতক্ষন দাঁড়িয়েছিলাম সেই উঠানে বলতে পারবোনা। সবার দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম সবাই জলভরা আখি নিয়ে আমাদের দুজনকে দেখে যাচ্ছে। এক নজর আকিফার দিকেও দিলাম, সে বার বার হাতের টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে যাচ্ছে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে তার গালে। তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে নিলাম সে পাশে এসে দাঁড়ালো, আমি আপাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলাম, “আপা ওর নাম আকিফা আমার স্ত্রী” আপা আমাকে ছেড়ে এবার আকিফাকে জড়িয়ে ধরলেন, হাউমাউ করে উঠলেন। আমি আকিফা আর আপাকে এক সাথে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এরই মধ্যে সোহেল আমার দ্বিতীয় বোন হোসনেয়ারাকে ফোন করে বলে দিয়েছে আমি এসেছি। আমাদের বাড়ির দক্ষিন দিকে নদীর পাড়ে স্বামী নিয়ে থাকে। আমার কথা শুনতেই পাগলের মত ক্ষেত দিয়ে ছুটে এসেছে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দিলো, আর হাউমাউ করে ওরে আমার কলিজার ভাই রে….. কোথায় ছিলি রে এতগুলো বছর বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। পাগলের মত বকতে লাগলো।

নিজের চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না, শত চেষ্টার পরেও হুরহুর করে পানি ঝরে পড়তে লাগলো। সবাই মিলে আমাকে আর আকিফাকে ঘরে নিয়ে গেলো।



আমি আসার কারনে নাজমা আপা সবাইকে নেমন্তন্ন দিয়েছে। এই দাওয়াত এর দুটি কারন তারা আমার আর আকিফার বিয়ে আবার দিবে, একটি মাত্র ভাই আমি, আমার বিয়ে তারা না দেখে মরতে চায়না। আর দ্বিতীয় কারন অনেকদিন পর এই হাওলাদার বাড়িতে সুখ ফিরে এসেছে। আমার আর আকিফার বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক করলো, তাদের আনন্দে আমি কোন রকম বাধা প্রদান করিনি। যেভাবে তারা সুখ খুজে পাচ্ছে সেভাবেই তাদের কে করতে দিচ্ছি ফাকে একবার আকিফাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার কোন আপত্তি আছে নাকি? সে যে উত্তর দিয়েছিলো এমন উত্তর শুনে কষ্টেসৃষ্টে মানুষও সুখের নদীতে ভেসে যাবে, মজলিশ ভরা মানুষের সামনে সে বললো “আগার তুম মেরি জান মাংলেতি, তো হাছতে হুয়ে দে দেতা, লেকিং তুম তো মুঝে পেয়ার ওর খুশিয়া দে রাহিহো, মেরা ভালা কা ইনকার হো সাকতা হে”। সবাই হিন্দি না জানার কারনে এটার অর্থ সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হলো।

আমি সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম, আকিফা বাংলাদেশের কিছুই দেখেনি। বিয়ের তো এখনো সপ্তাহ খানেক সময় আছে আমি আকিফাকে নিয়ে দু-তিন দিন বাহিরে ঘুরে আসতে চাই। প্রথমে কেউ রাজী না হলেও পরবর্তীতে সবাই রাজী হলো। আমি আকিফা কে নিয়ে সিলেট মৌলভীবাজার যাবো বলে ঠিক করলাম। কারন আমি আকিফা কে কথা দিয়েছিলাম, আমার জীবনের গল্প আমি দেশে ফিরে জানাবো। আর আমার জীবনের শ্রেষ্ট গল্প রয়েছে সিলেটের অলগলিতে।

আমরা দুদিনের প্রয়োজনীয় জামা কাপড় নিয়ে সিলেটের জন্য বের হয়ে গেলাম। বাসে বসে আমি আকিফাকে বলতে লাগলাম, আজ তোমাকে একটি গল্প শোনাবো মোটেও কোন উপন্যাসের পাতা থেকে নেওয়া গল্প না। আমার জীবনের অবিচ্ছেদ এক অংশ এটা।

আমি ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাই ১৫ বছর আগে। তখন আমি কম্পিউটার ডিপ্লোমা শেষ করেছি। ঘরে কিছুটা অভাবের টানাপোড়ন চলছিলো, সংসারের হাল ধরার সময়টাও এসেছে। কি করা যায় তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেক চেষ্টা করেও আমি চাকুরী পাচ্ছিলাম না। আমার এক বন্ধু ছিলো নাম রায়হান, সে কাজ করতো সিলেটে “ওয়েডিং প্লানার হাউজ” নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানটির কাজই ছিলো বিয়ের ডেকোরেশন থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া, ভিডিও প্রোগ্রাম ইত্যাদি করা। সে তার রেফারেন্সে আমাকে সেখানে চাকুরী নিয়ে দিলো। আমি সিলেট মৌলভীবাজার চলে আসলাম। সেখান থেকেই জীবন কেমন যেন বিচিত্র হতে লাগলো। আমার অফিসটি ছিলো মৌলভীবাজার চৌমুহনী তে। প্রথম মাস খুব ভালোভাবেই কেটে গেলো আমার কর্মজীবন।

একদিন সকাল বেলা আমি থ্রিকোয়াটার প্যান্ট, আর স্যান্টু গেঞ্জি গায়ে দিয়ে দাত ব্রাশ করতেছিলাম রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। ভোর বেলা ছিলো তাই লোকজনের আশা যাওয়া কম, মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি চলছে আকাশে সুর্যের আলোয় সোনার মত চিকচিক করছে। এমন সময় শুনতে পেলাম পেছন থেকে একদল মেয়ের হাসি, আমি ব্রাশ মুখে নিয়েই পেছন ফিরে তাকালাম। চারটি মেয়ে হেটে আসছে মেইন রাস্তার দিকে। তিনজন। মেয়ে পড়েছিলো থ্রিপিস আর একজন বোরকার উপর গোলাপী রংয়ের হিজাব। আমি সেই মেয়েটিকে খুব করে দেখতে লাগলাম, আর ভাবলাম অপ্সরা বুঝি এমনি দেখতে হয়। যখন তারা আমার নিকটে এসে পড়লো, তখন একটি মেয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো, “আহা ভাইজানের বুঝি প্যান্ট কেনার টাকা নেই রে, তাই ছোট প্যান্ট পড়ে আছে” আমিও কথার জবাব দিতে ভুল করিনি, ঠোটে হাসির ভাব নিয়ে বলে ফেললাম, “ভাইয়ের জন্য এতটান বোনদের যদি থাকে তারা একজন বোরখাপরে মাথায় গোলাপী হিজাব বান্ধে এমন একটি মেয়ের সাথে বিয়ে করিয়ে দিলেই তো পারে। শশুর বাবা যৌতুক না দেক একটা প্যান্ট শার্ট তো দিবেই।

আমার কথা শুনে হিজাব পড়া মেয়েটি আড়চোখে আমার দিকে তাকালো। তার চোখের তীক্ষ্মতা এত বেশী ছিলো যে চোখ দিয়েই আমাকে মেরে ফেলেছিলো, তেছড়ি নয়নে ছুড়ি চালিয়ে দিলো আমার মনেতে। আমি যখন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার রুপ দর্শন করছিলাম তখন সে মেয়েটি বলে উঠলো “সিলেটি মেয়ে কি এতই সস্তা যে চাইলেই পাওয়া যায়” বলে সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারা আর না দাঁড়িয়ে হেটে যেতে লাগলো মৌলভীবাজার সরকারী কলেজের রাস্তা ধরে।

সেদিন থেকে প্রতিদিন আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম, থ্রিকোয়াটার প্যান্ট আর হাতে ব্রাশ নিয়ে। এতদিনের মধ্যে হিজাব পড়া মেয়েটির সাথে আমার কথা হয়নি, যাওয়ার পথে শুধু তাহমিনার সাথে কথা হতো, আর আমার প্রতি কথার উত্তরে আমি শুধু সেই হিজাব পড়া মেয়েকে ইংগিত করতাম। এভাবেই প্রায় দুমাস কেটে গেলো, এরমধ্যে একবারো তার বুলি ফুটেনি শুধু তেছড়ি নয়ন দিয়ে আমাকে দিনের পর দিন আঘাত করে যাচ্ছে। অবশেষে এক সময় তার নাম জানতে পারলাম মেয়েটির নাম মৌমি।

তিন মাসের পরিশ্রমে শুধু নামটাই জানা হয়েছে আমার, তখন তাহমিনার কথা সত্য মনে হয়েছিলো সিলেটী মেয়ে এত তাড়াতাড়ি ধরা দিবেনা। আমিও নাছোড়বান্দা হাল ছাড়বার মানুষনা। পানি কোথায় গিয়ে গড়াবে শেষ না দেখে ছাড়বোনা। একদিন সকালে তারা যখন দল বেধে আসছিলো আমাকে দেখে তাহমিনা কথা বলতে লাগলো, “আর কত পেছনে ঘুরবেন ছোট প্যান্টওয়ালা সাহেব” তাহমিনার কথা শুনে মৌমি বাদে সবাই হেসে উঠলো, সেও হাসছিলো মুচকি মুচকি। আজ যাইহোক মৌমির সাথে আজ কথা বলবোই। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, “আপনি এমন কেন?। মৌমি আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো আর বললো
০- কেন কি করছি?
— এতদিন ধরে আমি যে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি আপনি বুঝেন না?
০- কি করে বুঝবো আপনি তো তাহমিনার সাথেই কথা বলেন সব সময়।
— হ্যা বলি কিন্তু ইশারাতো আপনাকে দেই।
০- এত ইশারা আমি বুঝিনা।
— তাহলে কি বুঝেন?
০- আপনি যে থ্রিকোয়াটার প্যান্ট পড়েন। পায়ের উপর যে ঘনো পশম দেখা যায়, এইটা তে বুঝি আপনি একটা বনমানুষ।
মৌমির কথা শুনে সবাই এত জোরেই হেসে উঠলো যে ফাকা রাস্তা গুঞ্জন করে উঠলো। আমিও খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলাম, প্রথম দিন তার সাথে কথা হলো, আর আমাকে বনমানুষ বানিয়ে দিলো। তারা কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে হাসতে হাসতে চলে গেলো। আমিও বাসায় গেলাম, আর সিদ্ধান্ত নিলাম কালকে ফুলপ্যান্ট পড়ে দাড়াবো।

রাত যেন কোনভাবেই আমার কাটেনা, সারা রাত তার মিষ্টভাষী কথার সুর কাজল দেওয়া চোখ আর মায়াবী হাসির মানে খুজতেই ভোর হয়ে আসছে। ফুলপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে হাতে ব্রাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তারা আসছে, সবাই এসে আমার কাছেই দাড়ালো, তাহমিনা বলতে লাগলো, “ছোট বাচ্চাটি আজ বড় হয়ে গেছে” বলে হেসে উঠলো। আমি হাসার ভান করে মৌমির সামনে গেলাম, আজ বনমানুষ এর মত লাগছে কি? সে মাথা নাড়িয়ে না বললো। তার ব্যাগ থেকে একটি প্যাকেট বের করে সামনে এগিয়ে দিলো আমি হাতে নিয়ে তার ভেতর থেকে একটি ফুলপ্যান্ট পেলাম। ব্যাগের উপর লালকালিতে লেখা রয়েছে বনমানুষ হতে দেখতে পারবোনা, তাই আপনার জন্য এনেছি। সেদিন থেকে প্রতিদিন মৌমির সাথে দেখা আর হাজারো না বলা কথা বলা হতো। এখন তারা সবাই আমাকে আর মৌমি কে রেখে দূরে গিয়ে মৌমির আসার অপেক্ষা করে। তখনকার সময় হাতেগোনা মানুষ মোবাইল ব্যবহার করতো। আমাদের কথা বলার সুযোগ কম ছিলো বলে আমরা ভোরবেলায় দেখা করে সারারাত আর দিনের কথা বলে ফেলতাম। আর অপেক্ষা করতাম আরেকটি ভোর হবার।

এভাবেই আমাদের এক বছর প্রেমের দিন কেটে গেলো, আমি বেধে গেলাম এক না ভাংগা মায়ার বাধনে এক অপ্সরার প্রেমে মজনু হয়ে দিনরাত তার ভাবনাই ভাবতে লাগলাম। কিন্তু ভালোবাসাতে যদি কষ্ট না থাকে সে ভালোবাসা নাকি খাটি হয়না। তাই কষ্টের সাগরে আমাদেরকেও ডুব দিতে হলো।

মৌমির ভাই মৌলভীবাজার এর প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। সে যখন জানতে পারলো আমার কথা সেদিনই এক সর্বনাশা দিন হয়ে আসলো আমার জীবনে। সে জানতে পারার পরের দিন আমাকে ধরতে মৌমির পেছনে ভোরবেলাতে এসেছিলেন যা আমার জানা ছিলোনা। মৌমিকে আসতে দেখে আমি হাসিমুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আজ তার চোখে ভয় দেখলাম আমি, সে আমাকে চোখের ভাষায় বলেছিলো চলে যাও এখন কিন্তু তা বুঝতে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছিলো। মৌমির ভাই এসে আমার কলার ধরে বসলেন, কোন কথা না শুনে না বুঝেই আমাকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। তার সাথে আরো দুটো ছেলে ছিলো, তিনজনে মিলে ইচ্ছেমত কাপড় কাছাড় মত আমাকে কিল ঘুশি আর লাথি দিয়ে ওয়াশ করতে লাগলো মৌমি আমাকে বাচানোর জন্য ছুটে আসলে তার ভাইয়ের হাতে তাকেও উত্তমমধ্যম খেতে হলো। দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে আমার মাথা ফেটে গেলো, আমি জ্ঞানহীন ভাবে রাস্তার উপর পড়ে রইলাম। তারা মৌমিকে নিয়ে চলে গেলো। আমি অসহায় যাযাবর এর মত পড়ে রইলাম।

যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে, তখন আমার সামনে আমি আমার অফিসের ডিরেক্টর আজমল সাহেব আর রায়হান কে দেখতে পেলাম। আজমল সাহেব একটি কথাই বললো, জলে বাস করে কুমিরের সাথে যুদ্ধ আমি করতে পারবো না। তুমি তাকে নিয়ে মৌলভীবাজার ছেড়ে চলে যাও। আরো তিনচারদিন মৌমিকে দেখার আশাতে সেখানে থাকলেও আমি তা পারিনি যেদিন মাদারীপুর চলে আসবো সেদিন মৌমির একটি চিঠি তাহমিনার হাত দিয়ে আমার কাছে আসে, তাতে কয়েকটি কথাই লেখা ছিলো।

সব ভালোবাসা পুর্নতা পায়না আমাদের যাত্রা বুঝি এটুকুই ছিলো, আগামী মাসে আমার বিয়ে, তুমি এখান থেকে চলে যাও। আর শোন না তোমাকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু তুমি আমার ভাগ্য রেখাতেই নাই।

চিঠিটা পড়ে আমি কান্নায় ভেংগে পড়লাম। রায়হান আমাকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু চোখের পানি কিছুতেই বাধ মানেনা।

আমাকে নিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসলো, সেদিন থেকে আমি চিড়চিড় মেজাজের হয়ে গেলাম। কেউ আমাকে কিছু বললে সহ্য করতে পারিনা। হুটহাট রাগ হয়ে যাই, কথায় কথায় গালি গালাজ করি। অন্ধকারে মায়ের কোলে শুয়ে কাঁদতে পছন্দ করি এখন। মৌমির বিয়ের দিন আমি আবার সিলেট এসেছিলাম তার বাড়ি একদম নতুনের মত করে সাজানো। অগোছালো চুল আর মুখভর্তি দাড়ি হয়েছে এখন। আমি তার বাসার আবডালে দাঁড়িয়ে রয়েছি, কিন্তু আমাকে তার ভাই দেখেই চিনে ফেলেছিলো, কাছে এসে কলার ধরে ঘুশি তুললো আবার। কিন্তু আমি তার পায়ে পড়ে গেলাম, আর বলতে লাগলাম “ভাই আমি শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো বিয়ে শেষ হলে আমি এখান থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাবো আর কখনো আসবোনা। সে আমার কথা মেনে নিলো কিন্তু যাবার সময় আবার শাসিয়ে গেলো। আমি ঠায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এক নাগারে ভেতরের অনুষ্ঠান দেখে যাচ্ছিলাম। তাহমিনা কয়েকবার দেখেছে আমাকে কিন্তু মৌমির ভাইয়ের ভয়ে কথা বলেনি। এক সময় মৌমির বিয়ে শেষ হলো, বরযাত্রীরা বউ নিয়ে চলে যেতে লাগলো, সারাদিনের অপেক্ষা শেষ করে মৌমিকে দেখতে পেলাম। লাল শাড়ী, দেহ ভর্তি বাহারী গহনা তে সাজানো যেন এক পুতুল পরী লাগছে। সে গাড়িতে উঠ বসছে ধীরে ধীরে গাড়ি চলে যেতে লাগলো, মৌমি আমাকে দেখে কয়েকফোটা চোখের পানি ঝড়ালো, এটাই হয়ত সে তার ভালোবাসার শেষ প্রকাশ করেছে।

সবাই চলে যাবার পর মৌমির ভাই আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো, আমার সামনে খাবার দিয়ে বললো “নেহ বিয়ের খাবার খেয়ে এবার বিদায় হো” আমি না করলাম না, আমি হাজার বছর বেচে থাকলেও এমন বিয়ের খাবার আর খেতে পারবো না, এই বিয়ের খাবারে আমার কান্না, আমার রক্ত মিশ্রিত। এই খাবারে মৌমির ভালোবাসা ত্যাগ, কান্না মিশ্রিত এমন খাবার আর খাওয়া হবে না কোনদিন। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিনা, আমি খাচ্ছি আর চোখের পানি ঝড়িয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি ফোটা আমার খাবার প্ল্যাটে পড়েছে আমি সেই অস্রুসহ গিলে গিলে খেয়েছি আমার প্রেয়সী আমার ভালোবাসার ত্যাগের বিয়ের খাবার।

আমার গল্প শেষ করতে করতে আমরা সিলেট মৌলভীবাজার চলে আসলাম। আকিফা আমাকে জরিয়ে ধরে কতক্ষন কেদেছিলো জানা নেই, সিলেট আসতে বিকেল হয়েছে এখনো সন্ধ্যে হতে বেশ সময় বাকি। সিলেট এখন আগের মত নেই, আমি সেই রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি সব কিছুই অচেনা মনে হচ্ছে। উদ্দেশ্যে মৌমির বাসাটি আকিফাকে দেখিয়ে আনা। রাস্তার মধ্যে আকিফা জিজ্ঞেস করলো “তুমি ঘর কেন ছেড়েছিলে” আমি দীর্ঘ একটি নিশ্বাস নিয়ে বলতে লাগলাম, ঘর আমি ছাড়িনি আমাকে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবার জন্য বাধ করা হয়েছে। মৌমির বিয়ের দুইমাস পর আমি, বাবা মা ঢাকায় আসতেছিলাম মায়ের চিকিৎসার জন্য। তখন আমার এ দুইবোন জর্ডান গিয়েছিলো। সেদিন ঝরের দিন ছিলো, বিকেল নাগাত আমরা লঞ্চে উঠি। লঞ্চ মাঝনদে আসতেই শুরু হয় প্রকৃতির তাণ্ডব। নদীর ঢেউ কয়েক গুন বেড়ে যায়। পদ্মার মাঝখানে লঞ্চ ডুবিতে মা বাবা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমি কিভাবে যেন বেচে গেলাম, তারপর থেকে আমার আর ঘরে যাবার প্রয়োজন হয়নি। ব্যস্তার শহরে হামাগুড়ি দিতে দিতে নিউজিল্যান্ড গিয়ে পড়লাম।

দেখতে দেখতে আমি মৌমির বাসা খুজে বের করলাম। আমার ভেতরে যেতে একটু সংকোচ হচ্ছিলো, আকিফাকে ভেতরে পাঠালাম প্রথমে, আকিফা কিছুক্ষন পর একটি জগ আর পানি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। এসে আমাকে পানি দিলো আমি খেতে লাগলাম, তারপিছু একটি মেয়ে আসতেছে আমি ভালো করে দেখতে লাগলাম, নাহ এটা মৌমি না, কিন্তু আমার পরিচিত এমনটা মনে হচ্ছে। সে যত কাছে আসতেছে ততই তার চেহারা মনে পড়তে লাগলো আরে এতো তাহমিনা, তাহমিনা এই বাসায় কি করে মনেতে প্রশ্ন জাগলো।

তাহমিনা কাছে এসে আকিফাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, “ওর কুছ চাহিয়ে” আকিফা মাথা নেড়ে না উত্তর দিলো। আমি তাহমিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তাহমিনা আমার দিকে নজর দিতেই যেন চমকে উঠলো, সে কিছু একটা বুঝতে চাচ্ছে কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না। আমি তাহমিনাকে হাসিমুখে বলে উঠলাম, “এখনো কি এই রাস্তায় কেউ থ্রিকোয়াটার প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে?” তার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো জলে সে তার শাড়ির আচল দিয়ে মুখ চেপে ধরলো, এতগুলো বছর পর আবার আমার সাথে দেখা হবে এটা হয়ত সে কল্পনাতেও ভাবেনি। চোখথেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো, মৃদু শব্দে বলতে লাগলো, “ভাই ভেতরে আসুন, মৌমির মেয়ে আছে এখানে” মৌমি নামটা শুনে আর ধরে রাখতে পারলাম না ভেতরে গেলাম।

বাড়ির বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে আছে মৌমির বড় ভাই তাকে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। তাহমিনা আর মৌমির ভাইয়ের বিয়ে ৬ বছর আগে হয়। একটি এক্সিডেন্ট এ মৌমির ভাইয়ের পা অকেজো হয়ে যায় সেই থেকে তার স্থান হুইল চেয়ারটিতেই। তাহমিনা মৌমির মেয়েকে নিয়ে আসছে আমার সামনে, দেখতে একদম মৌমির মতই হয়েছে, সেই চোখ সেই নাক সেই গোলগাল গাল। আমি তাকে কাছে ডাকলাম, নাম কি তোমার “আমার নাম তাসফিয়া” আমার মনে পড়ে গেলো আরেকটি কথা আমি একবার মৌমিকে বলেছিলাম আমাদের মেয়ের নাম তাসফিয়া হবে। মৌমি আমার সেই কথা হয়ত ভুলেনি। হুইল চেয়ার এর চাকা ঘুরিয়ে মৌমির ভাই আমার কাছে আসলো, আমাকে চিনতে পেরে একটি কথাই বললো, “নজরুল ভাই আমাকে মাফ করে দিস” তার চোখে আমি করুণারূপ দেখেছি অসহায়ত্ব দেখেছি। আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে গেলাম। আর সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমার স্ত্রীর সাথে।

আমি তাহমিনার কাছে জানতে চাইলাম মৌমির কথা, সে জানালো মৌমি তাসফিয়া কে জন্ম দেবার ২ দিন এর মাথায় পরবাসী হয়েছে। মৌমির স্বামী, মৌমি মারা যাবার পর আরেকটি বিয়ে করে তারপর থেকে তাসফিয়া তাহমিনার কাছেই থাকে। তাহমিনার কোন সন্তান হয়নি তাই মৌমির মেয়েকেই তার মেয়ে হিসেবে বেছে নিয়েছে। মৌমি আর এই পৃথিবীতে নেই কথাটি শুনে থমকে গেলাম। কোন কথা বলতে পারলাম না, আকিফার হাত ধরে বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম, রাস্তার উপর আসতেই রংগিন চিত্রছবির মত আমার সামনে ভেসে উঠলো সেই ফেলে আসাদিন। এই মোড়েই দাড়িয়ে কথা বলেছি প্রেয়সীর সাথে, তার হাসির শব্দ শুনতে পারছি বাতাসের সাথে। আমার ফেলে আসা যে প্রেম এই রাস্তাতেই শুরু হয়েছিলো, এই রাস্তাতেই সে প্রেম ক্ষ্যান্ত হয়েছে। এখন শুধু মৌমি আর আমার ভালোবাসা গভীর রাতের নির্জনতায় থাকে। অতি গোপনে আপন পরশে বেচে আছে হৃদয়ের মাঝে আমার মনের ভেতর মৌমির প্রেম।

আমি আর একদিনো সিলেট এ রইলাম না। সেখান থেকে সোজা মাদারীপুর চলে আসলাম। আমার বাড়িতে বিয়ের আয়োজন বেশ জোরেশোরে চলছে। আমার আর আকিফার দ্বিতীয় বিয়ে হতে যাচ্ছে। সবার চোখে মুখে আনন্দ, আমিও যে আনন্দিত নই এমন না। কিন্তু মৌমি আর নেই, ভেবেছিলাম সে সুখের সংসার করছে আমাকে ভুলে, কিন্তু জানা ছিলোনা তার ভালোবাসার ছাপ রেখে যাবে তার মেয়ের রুপে। আর পরবাসী হয়ে সে হারিয়ে গিয়েছে শুধু আমার থেকে নয় পুরো পৃথিবী থেকে। আমার আর আকিফার দ্বিতীয় বিয়ে শেষ হলো। আজ আমার দ্বিতীয় বাসর রাত। বউ সেজে এক পাকিস্তানি মেয়ে আমার অপেক্ষায় বসে আছে, আমি পাশে গিয়ে তার ঘোমটা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “ডার লাগরাহা হে” সে মুচকি হেসে উত্তর দিলো “থোড়া থোড়া”। আমি গালভর্তি হাসি দিয়ে তার কপালে একটি চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত