যখন বৃষ্টি এল

যখন বৃষ্টি এল

ভরদুপুরে ফোনালাপে মগ্ন মহল্লার দুই ভাবি।
‘ভাবি, কী গরমটা পড়ছে দেখছেন?’
‘গরমের কথা আর বলবেন না, ভাবি! জানটা এক্কেরে শ্যাষ! আকাশ ভাইঙ্গা বিষ্টি না নামলে আর মুক্তি নাই।’
‘বিষ্টি নামব ক্যামনে, কন? বিষ্টি হইল রহমতের পানি। দেশজুইড়া যে অনাচার চলতেছে, এর মধ্যে রহমত থাকে কী কইরা?’
‘আর কারেন্টের অবস্থাটা দেখেন, এই আসে এই যায়, এই আসে এই যায়! ফাইজলামি আরকি! বিলটা আবার কানে মোচড় দিয়া ঠিকই আদায় করে।’
‘কারেন্টের এই তামাশার জন্যই তো মেয়েটারে কয়দিন পরে আসতে বলছি। জামাই, নাতি-নাতনি নিয়া আসবে, জাইনা-শুইনা তো আর কষ্ট দিতে পারি না।’
‘আরে, আমার তো এর মধ্যে কেলেঙ্কারি হইয়া গেছে! আমার মেয়েজামাইটা যে শরমিন্দা স্বভাবের, সেইটা তো আপনারে বলছি। সেদিন ওরা আসছে, গভীর রাত্রে গেছে কারেন্ট। জামাই কাউরে কিছু না বইলা পাটি নিয়া ছাদে গেছে শুইতে। পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটা, যার কথা আপনারে মাঝেমধ্যে বলি, সে ছিল ছাদে।’
‘এত রাতে ছাদে ক্যান?’
‘বুঝেন না, গাইছা মাইয়ার আর কাজ কী!’
‘তারপর?’
‘জামাইরে দেইখা দিছে চিত্কার!’
‘ক্যান, চিত্কার দিল ক্যান?’
‘তার আর কাম কী! রাইত দুপুরে রঙ্গ।’
‘তারপর?’
‘ফ্ল্যাটের সব মানুষ লাঠি লইয়া বাইর হইছে। মা গো, কী কেলেঙ্কারি! এরপর…’
‘ভাবি, একটু রাখেন। আমার উনি তো ডাকতে ডাকতে মনে অয় মইরা যাইতেছে! এইগুলার যন্ত্রণায় ভালো কোনো কথা শুনতে পারি না।’
দুই ভাবি ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে যাঁর ঘরকন্নার কাজে। দুজনের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে এই ফোনালাপ অতি আবশ্যক একটি বিষয়। দিনে অন্তত দুবার ফোনালাপ না হলে তাঁদের পেটের ভাত হজমই হয় না।

এদিকে আকাশে চলছে পটবদলের খেলা। শিগগিরই কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। নামল মুষলধারে বৃষ্টি। চলল টানা দুই ঘণ্টা। ধরণি শীতল হলো। প্রাণ জুড়াল নগরবাসীর। একই সঙ্গে জুটল নানা দুর্ভোগ।
বিকেলের দিকে আবার দুই ভাবির ফোনালাপ।
‘দেখছেন ভাবি, কী বিষ্টিই না হইল!’
‘আর বইলেন না! আমার ছোট ছেলে স্কুল থিকা ফিরার সময় ভিজা চুপচুপ। তার ওপর ময়লা পানি মাড়াইয়া আসছে। এখন খালি হাঁচি দিতাছে। মনে হয় জ্বর হইব। এর জ্বর হইলে জানটা ভাইজা খায়!’
‘আর রাস্তাঘাটে কী নোংরা কাদা দেখছেন, ভাবি। সন্ধ্যায় এক ভাগনির পানচিনিতে যাওয়ার কথা। আমার তো এখন বাইর হইতেই ইচ্ছা করতেছে না। এর মধ্যে বস্তির পোলাপানগুলা ওই কাদা পানিতে বল খেলতে নামছে। আপনার ভাই মোকামে যাইতেছিল, বল আইসা লাগছে তার গায়ে। বুঝেন অবস্থা! মাত্র সকালে লন্ড্রি থিকা পাঞ্জাবিটা ইস্তিরি করাইয়া আনছি।’
‘ভাইয়ের তো রাগ বেশি। নিশ্চয়ই খুব খেপছিলেন?’
‘খেপলেই কী, বস্তির পোলাগুলার তো আর নাগাল পায় নাই। যত ঝামেলা গেছে আমার ওপর দিয়া। বাসায় আইসা পাঞ্জাবিটা ছুইড়া দিয়া কয়, শুঁইকা দেখো। তার সন্দেহ, আসল জিনিস লাগছে!’
‘তারপর?’
‘কন, এইটা শুঁইকা দেখার জিনিস! বিষ্টি হয় না হয় না, এখন হইয়া এক জ্বালা হইছে!’
‘সেই কথা আর বলব কী, ভাবি! আমার বাসার সামনের রাস্তায় তো হাঁটুপানি জমছে। আপনের ভাই বিষ্টির আগে রাস্তার ওই পারে হামিদ সাহেবের বাসায় গেছিল কী কাজে, এখন আটকা পড়ছে। আসতে পারে না। ফোন দিছি, আমারে গান শুনায়—এই কূলে আমি ওই কূলে তুমি/ মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়…।’
‘রস আছে ভাইয়ের। আমারটার মতো রাগী না।’
‘কিন্তু পানি যে জমল?’
‘জমব না! ওরা তো ড্রেনগুলা ঠিক মতোন পরিষ্কার করে না। ম্যানহোলে জ্যাম।’
‘আরে, আমার বাসার সামনের ম্যানহোলে তো ঢাকনাই নাই! চোরে নিছে সেই কবে, এখনো ওইভাবেই আছে। খোলা ম্যানহোল দিয়ে ভুরভুর কইরা ময়লা পানি উঠতেছে। বৃষ্টি পানির সাথে ময়লা পানি মিশা…ইশ্, ভাবি, এই সিন দেখলে মইরা যাইতে ইচ্ছা করে!’
‘আপনের এইসব কথা শুইনা আমার খুব কষ্ট লাগতেছে, ভাবি! এক কাজ করেন, আমার বাসায় আইসা ঘণ্টা দুয়েক থাইকা যান। পানি নামলে পরে যাবেন।’
‘কী যে বলেন, ভাবি! যাব কী করে? আমরা এখন পানিবন্দী না!’

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত