শীতের রাত। ডিসেম্বর মাসের শেষ রাত আজকে। ইংরেজিতে থার্টি ফাস্ট নাইট বলে। রাত ১২ টা বাজার সাথে সাথে চারদিক আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠবে,সকলে যার যার মতো করে নতুন বছরকে বরণ করে নিবে। আমার তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। আমি তন্নী। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছি। কম্বলের নিচে আরাম করে শুয়ে কখনো টিভি দেখছি, কখনো মোবাইলটা নিয়ে ফেবুতে ঘাটাঘাটি করছি,আর কিছুক্ষণ পর পর খোলা জানালাটার দিকে তাকাচ্ছি।
কারণ কিছুক্ষণ পরেই কেউ একজন জানালার কাছে আসবে। হুম,রিয়াদ আসবে কিছুক্ষণ পরে।
রোজ রিয়াদ এ সময়ে এসে উপস্থিত হয়। আজও আসবে আমি জানি।
রিয়াদ আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের একটা বস্তিতে থাকে। টাকার অভাবে স্কুলে পড়তে পারেনা।
সারাদিন কাগজ কুড়ায়,,বয়স ৭-৮ বছর হবে। ওর মায়াবী চেহারার দিকে যে কেউ তাকালে সে যে নিশ্চিত ওই মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হবে সেটা আমি বলতে পারি।
সারাদিন কাজ শেষে ও আমার কাছে আসে টিভি দেখতে,,ওর নাকি ভালো লাগে খুব। আমিও ওকে সাথে নিয়ে একসাথে টিভি দেখি,, বেশ ভালোই লাগে।
অবেশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে রিয়াদ আসলো।
– আফা, ও আফা,জলদি টিভি টা ছাড়েন।
– কি রে রিয়াদ এতো হাঁপাচ্ছিস কেনো তুই? আর টিভি তো ছাড়া ই আছে।
– আফা দেহেন তো ১০:৩০ বাইজা গেছে কিনা?
– নাতো,, এখনোও ৫ মিনিট বাকি আছে। কেনো?
– আজকে ১০:৩০ এ আমারে বি.টি.ভি. তে দেহাইবো।
– তোকে টিভিতে দেখাবে? কিন্তু কিভাবে?
– হো আফা,,আইজকা কাগজ কুড়াইতে গেছিলাম,, তহন একজন সাংবাদিক আমার কাছে আইলো,, আইয়া আমার লগে অনেক কিছু কইলো,আর কইলো রাইত দশটায় নাকি আমারেও টিভিতে দেহাইবো।
– সত্যি বলছিস তুই? তোকে দেখাবে আজকে!!!!
– হো আফা,,আমার তো অনেক খুশি লাগতাছে আইজকা।
– আচ্ছা আয় বস, এখন ই অনুষ্ঠান শুরু হবে।
– আচ্ছা।
ঘড়িতে ১০:৩০ বেজে গেলো। পথশিশুদের ঘিরে একটি অনুষ্ঠান শুরু হলো। এখানে তারা নতুন বছরকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনা, আনন্দের কথাগুলো জানাবে।
অনুষ্ঠান চলতে লাগলো। সাংবাদিক এক একজন পথশিশুদের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করছে নতুন বছরে কার কি পরিকল্পনা রয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেলো সাংবাদিক রিয়াদের কাছে পৌঁছালো।
– এই যে, শোনো-
– জ্বী স্যার,আমারে কইতাছেন?
– হ্যাঁ তোমাকে বলছি। এইদিকে এসো।
– হো স্যার কন।
– নাম কি তোমার?
– রিয়াদ।
– কি করো তুমি?
– এই যে স্যার কাগজ কুড়াই।
– আচ্ছা তুমি কি জানো কালকে যে নতুন বছর শুরু হতে যাচ্ছে?
– হো জানি,, মাইনষের মুখে শুনতাছিলাম।
– এই নতুন বছরকে নিয়ে তোমার কালকের পরিকল্পনা কি?
– গরিবের আবার পরিকল্পনা! তয় আমার একটা পরিকল্পনা আছে।
– বলো তোমার পরিকল্পনা টা কি?
– খুব সকাল বেলায় উইঠা মায়েরে সালাম করমু। মায়ের কাছ থেইকা দোয়া লইয়া নতুন বছরের প্রথম দিনটা শুরু করমু। তয় কিছু টাকা জমাইছি নিজের কাছে,,, ওইগুলা দিয়া কিছু পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ কিনা নিমু। কালকে সকালে মায়েরে লইয়া পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ দিয়া পান্তা ভাত খামু। অনেক ভাললাগে। রোজ রোজ মায় আর আমি পঁচা ভাত,বাসি তরকারি খাইতে খাইতে আর ভাললাগেনা। কালকে নতুন বছরে মায়েরে লইয়া একটু ভালা কইরা ভাত খামু।
সাংবাদিক পকেট থেকে রুমাল টা বের করে চোখের জলটা মুছে নিলো। নিজের পকেট থেকে একটা ১০০০ টাকার নোট বের করে রিয়াদের হাতে দিলো। আর বললো– “তোমার মা আর তুমি এ টাকা দিয়ে নতুন জামা কিনে নিও। সুন্দর হোক তোমাদের নতুন বছর।”
দর্শক অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাথে থাকার জন্য।
আমাদের সমাজে এমন হাজার রিয়াদ আছে যারা অল্পতেই অনেক সন্তুষ্ট হয়। চলুন আমরা এসকল রিয়াদকে নিয়ে শুরু করি আমাদের নতুন বছরটি। অযথা বিলাসিতা না করে সে টাকায় রিয়াদদের ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে দিন। এ প্রত্যাশায় সুন্দর হোক সকলের নতুন বছর।
রিয়াদ বললো–“আফা কেমন লাগছে?”
ওর কথায় আমার ঘোর কাটলো। আর চোখের কোণে নোনতা জল অনুভব করলাম।
জলটা মুছে নিলাম আর বললাম–
“”আমিও তোর সাথে নতুন বছরটা শুরু করতে চাই
আমাদের চারপাশে এমন ও হাজারো রিয়াদ ছড়িয়ে রয়েছে,, চলুন না আমরা দামি আতশবাজি না কিনে ওদেরকে কিছু ভালো খাবার কিনে দেই। আমাদের মতোই ওদের মুখেও না হয় হাসি ফোটাই। সকলের নতুন বছরটা নতুন করে ভালোভাবে শুরু হোক।