উঠোন থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে একবার আকাশের দিকে চায় রুমকি। সূয্যি মাথার উপর থেকে পশ্চিমে সরছে। চোখ কুঁচকে আবার দোরের দিকে তাকায় সে। মানুষটা ফিরল না এখনো ! ঘরের মধ্যে শুকনো জামাকাপড়গুলো রেখে আবার বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ায় রুমকি। এখন অবশ্য তার দেরি করেই ফেরার কথা। কালই বলছিল মানুষটা যে জমিতে বীজ পোঁতা শুরু হবে এবার। কিষেন জন লাগবে মেলা। তাদের তদারকি করতে হবে। একটু ঢিল দিলেই তিন দিনের কাজে এক হপ্তা লাগিয়ে দেবে উপরি মজুরি পাওয়ার লোভে। তাই হয়ত আজকের মত কাজ একেবারে সেরে ফিরবে সে। সে মানে রুমকির স্বামী বিশান। ছ’মাস হল বিয়ে করে ঘরে বৌ এনেছে বিশান। একটু বেশি বয়সের বিয়ে তার। হলে কি হবে! রুমকি এই সবে অষ্টাদশী। গরিব ঘরের দুঃখী মেয়ে সে। তবে বিয়ের করে আনার পর কনেকে দেখে গাঁয়ের পাঁচজনে তাকিয়েই রয়ে গেছিল। যেমন মিষ্টি মুখ তেমনি মিষ্টি স্বভাব তার। আর ভারী লাজুক সে। বিশান অবশ্য এই লাজুক স্বভাবের জন্যই আরো বেশি ভালবাসে তাকে। সংসারে তারা দু’জন ভিন্ন আর কেউ নেই। জমি, ঘর সব নিয়ে যখন থিতু হয়ে বসল বিশান, তখনই তার মা মারা গেল আর বাপ তো মরেছে আরো আগে। এখন এই দুটিতেই আগলে রেখেছে ঘর সংসার সব। একজন প্রদীপ তো অন্য জন তার সলতে।
কোমরে হাত দিয়ে উনুনের নিভু নিভু আগুনটার দিকে ঝুঁকে পড়ে রুমকি। এখনো ভালোই ঝিমঝিমে আঁচ আছে। ঠোঁট কামড়ে ভাবে রুমকি, সময় আছে। মানুষটা আসবে, খানিক জিরোবে, নাইবে ধোবে তবে তো খাবে। ততক্ষনে চারটি কুমড়ো ফুলের বড়া ভেজে নেওয়া যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খড়ের আটচালা থেকে বেতের ঝুড়িটা নামিয়ে পায়ে পায়ে বাড়ির পিছনে বাগানের দিকে এগোয় রুমকি। বাগানের মধ্যিখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। চোখে মুখে মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে দেখে চারিদিক। আহা ! বড় সাধের বাগান তার। নিজে হাতে একটু একটু করে একে গড়ে তুলেছে সে। বিশানও অবসর পেলেই তাকে সাহায্য করে। মাটি কুপিয়ে আলগা করে দেয়। দড়ির বাঁধন দিয়ে দেয় মাচায়। এই তো সেদিন ওই উচ্ছে গাছের মাচার নীচে বাঁধন দেওয়ার সময় বিশান হঠাৎ রুমকিকে জড়িয়ে ধরে একবারে লেপ্টে নিয়েছিল শরীরের সাথে। দড়ি, উচ্ছে লতায় জড়িয়ে একেবারে একসা কান্ড হয়েছিল ভাবতেই গা শির শির করে ওঠে রুমকির। হাত থেকে ঝপ করে পড়ে যায় ঝুড়িটা। চমকে ওঠে রুমকি। কাছেই একটা ব্যাঙ ডেকে ওঠে। ঝুড়িটা হাতে তুলে নিয়ে আবার চারদিক দেখে সে। শুধু সবুজ আর সবুজ সব জায়গায়। লাউ, কুমড়োর মাচায় ফুল এসেছে। পেঁপে গাছটায় এক গাছ পেঁপে। লঙ্কা, বেগুন, টমেটো ধরে আছে গাছ গুলোয়। কি ভাল লাগছে দেখতে ! তবে জায়গায় জায়গায় আগাছা জন্মেছে। আর বৃষ্টির জলে মাটি বসে গেছে এদিক ওদিক। জলদি একদিন লাগতে হবে কাজে। আজই বলবে বিশানকে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাগানের এক কোণে কুমড়ো গাছের মাচার দিকে এগিয়ে চলে রুমকি। এক ঝুড়ি কুমড়ো ফুল তুলে নিয়ে আবার হাঁটা দেয়। চটপট ভেজে ফেলবে বড়াগুলো।
আসন পেতে, জল গড়িয়ে, হাত পাখাটা নিয়ে বসল রুমকি। সামনে থালায় খাবার সাজানো। ধোঁয়া ওঠা ভাত, কলমি শাক ভাজা, কুমড়ো ফুলের বড়া, মুগের ডাল, পাঁচমিশালী একটা তরকারি, আমের আচার আর ঘরের গরুর দুধ। স্নান সেরে বিশান এসে বসেছে আসনে।
“বাবা ! কত কিছু রান্না করেছিস রে !” স্নেহ করে মাঝে মাঝেই রুমকিকে তুই করে বলে বিশান। ও জানে তাতে আরো লজ্জা পেয়ে যায় রুমকি। আর সেটা বেশ উপভোগ করে বিশান।
“কই কত কিছু ! সারাদিন তেতে পুড়ে কাজ করে এলে, আর এইটুকু দিয়ে যদি ভাত ধরে দিতে না পারি, তাহলে আর কি করলাম সারাদিন বাড়িতে বসে ?” হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতে করতে উত্তর দেয় রুমকি।
“বাব্বাহ ! তোর মুখে যে কথা ফুটেছে বড় !” হেসে ওঠে বিশান।
“আর হাসতে হবে না। নাও, ভাত ভেঙে শুরু কর এবার। বেলা পড়ে এল। মেলা কাজ আমার।”
“তুইও বোস।”
“তুমি ওঠো আগে। ওই পাতেই বেড়ে নেব আমি।”
বিশান আর কিছু না বলে শুরু করে।
“বাহঃ, কুমড়ো ফুলের বড়াটা বেশ মুচমুচে হয়েছে তো রুমি !” বড়ায় কামড় দিয়ে তৃপ্তি পায় বিশান। রুমকির মুখটাও প্রসন্ন হয়ে ওঠে। এই দু’বেলা মানুষটাকে যেমন হোক দুটো খাইয়ে তার তৃপ্ত মুখটা দেখতে পারলে যেন শান্তি হয় রুমকির। এর বেশি আর কি বা চাওয়ার আছে তার ?
বিশান খেয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। এখন একটু গড়াবে সে। এঁটো বাসনগুলো গুছিয়ে একপাশে করে রাখে রুমকি। রান্নার জায়গাটা ভাল করে নিকোয়। উঠোনটা ঝাঁট দিয়ে হাওয়ার সাথে উড়ে আসা পাতাগুলো পরিষ্কার করে। তারপর ঘরে ঢোকে জামাকাপড়গুলো গোছাবে বলে। দেখে বিশান ঘুমোচ্ছে। পা টিপে টিপে আলনার কাছে যায় সে। কিন্তু তার পায়ের নুপুরের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় বিশানের। পাশ ফিরে রুমকির পায়ের গোছটা খপ করে ধরে সে।
“কাছে আয় রুমি।”
“এই তুমি ঘুমাও নি !” চমকে ওঠে রুমকি।
“আয় না…” জড়ানো গলায় রুমকিকে কাছে টেনে নেয় বিশান। অন্যদিনের মত আজ আর বাধা দেয় না সে। বিশানের বাহুপাশে নিশ্চিন্তে নিজেকে আবদ্ধ করে নেয় সে। বাইরে সূয্যি তখন পশ্চিমে ঢলে গেছে প্রায়।
ঘন্টা খানেক পর ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে আসে রুমকি। বিশান ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশের দিকে তাকায় একবার সে। না আর দেরি করা যাবে না। এই বেলা বাসনগুলো মেজে একেবারে পুকুর থেকে নেয়ে আসবে, ঠিক করে সে। সেই মত বাসনগুলো নিয়ে বাগান পেরিয়ে পুকুরে যায় সে। দ্রুত গতিতে সব বাসন মেজে নিজেও গা ধুয়ে নেয়। গিয়ে সন্ধ্যে প্রদীপ দেখাতে হবে। তারপর আসনে আজ একটা নতুন নকশা তুলবে সে। মা শিখিয়ে দিয়েছিল “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।”
ভাবতে ভাবতে বাড়ির উদ্দেশ্যে এগোতে থাকে রুমকি। হতে ধরা মাজা বাসনগুলো। জল সপসপে শাড়িতে আলতো পায়ে হাঁটতে থাকে সে। বাগানের এঁটেল মাটিতে পা বসে বসে যাচ্ছে। হঠাৎ কিসে ঠোক্কর লেগে মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়েও সামলে নেয় সে ! ওই তো, বাগানের এক কোণে আগাছার সাথে মিশে আছে নিথর দেহটা। সেটার দিকে স্থির মরা মাছের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুমকি। মুখের পাশে গেঁজলা শুকিয়ে লেগে আছে আঠার মত। নীল হয়ে গেছে শরীর। ঠান্ডা কাঠের মত শরীরটার দিকে তাকিয়ে ঘটনাটা মনে পড়ে যায় রুমকির। কুমড়ো ফুল তুলতে আসার সময়ই বিপত্তিটা ঘটে। হাত থেকে ঝুড়িটা পড়ে যাওয়ার পর সেটা তুলতে গিয়েই দেখে একটা বিশাল গোখরো ঝপ করে কামড় বসিয়ে দিল কড়ি আঙুলে। এক ঝটকায় সাপটাকে ফেলে দিয়েছিল সে। কিন্তু নিজেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল সে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শেষ। বিশান এসেছিল তারও অনেকটা পর। নাহ ! একটা ব্যবস্থা করতে হবে এটার।
তুলসী তলায় প্রদীপ দেখিয়ে হাত জোড় করে রুমকি। “মাগো ! আমার এমন ভরা সংসার, অমন দেবতার মত সোয়ামী। মেলা কাজ যে এখন আমার ! এই সুখের সংসার ফেলে কি এখন আমার কোথাও যাওয়া চলে ? আমায় ক্ষমা কোরো মাগো। ওকে তাহলে কে দেখবে মা ! এই ঘর, এই সংসার… এসব ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি মুক্তি চাই না আমি।” প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায় রুমকি। বিশান উঠবে এবার। ওকে বলতে হবে এখন ক’দিন বাগানে না যেতে। যা ঝোপঝাড় হয়ে আছে ! ততদিনে ওটা পুরোপুরি মিশে যাবে মাটিতে নিশ্চয়ই।
মাথার ঘোমটাখানা খুলে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে আসনখানা নিয়ে বসে রুমকি। নকশা তুলতে থাকে,
“সংসার সুখের হয়”
সমাপ্ত