অ্যালেনের আশ্চর্য লাইটার

অ্যালেনের আশ্চর্য লাইটার

মা-বাবা শখ করে নাম রেখেছিল আলাদিন। কিন্তু এই নাম সমাজে চললেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরোপুরি অচল আর সেকেলে। তাই ১৫ বছর বয়সে প্রথম ফেসবুক আইডি খোলার সময়ই আলাদিন হয়ে যায় অ্যালেন। অ্যালেনের বাবা নেই। মারা গেছেন বহু বছর আগে। মা আর একমাত্র বোনকে নিয়ে সমুদ্রের মাঝখানে ছোট্ট একটা দ্বীপে বাস করে ও। দ্বীপটার নাম মালিবাগ। দ্বীপটা ঢাকা মহাসাগরে জেগে উঠেছে অল্প কিছুদিন আগে।

্যালেন সকালে নৌকায় চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। বিকালে মতিঝিল-শাহবাগ এলাকায় জাল ফেলে মাছ ধরে। সন্ধ্যায় সেই মাছ বিক্রি করে চাল, ডাল, তরকারি আর মেগাবাইট কিনে ঘরে ফেরে। রাতে খেয়েদেয়ে সেই মেগাবাইট দিয়ে ফেসবুক চালায়। এভাবেই সুখে-দুঃখে কেটে যাচ্ছিল অ্যালেনের দিনগুলো।

তারপর ঘটল এক আশ্চর্যজনক ঘটনা!

সেদিনও আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফেসবুক চালাচ্ছিল অ্যালেন। এমন সময় একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল। আইডির নামটা বেশ অদ্ভুত—শাহনেওয়াজ খান। সাতপাঁচ ভেবে রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে ফেলল অ্যালেন। সঙ্গে সঙ্গে টুং করে শব্দ হলো মেসেঞ্জারে। শাহনেওয়াজ খানের আইডি থেকে দীর্ঘ এক মেসেজ এসেছে—

হেই ডিয়ার আলাদিন ওরফে অ্যালেন,
আমাকে তুমি চিনবে না। আমি তোমার দূরসম্পর্কের চাচা হই। পেশায় একজন জাদুকর। সমুদ্রের তলদেশে থাকি আমি। আমার বাসা তোমাদের ঢাকা থেকে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে চট্টগ্রাম মহাসাগরের একদম গভীরে। তোমার বাবা আর আমি ছিলাম অন্তরঙ্গ বন্ধু। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তোমার বাবা আমার ফোনে একটা লিংক সেন্ড করেন। বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে আলাদিনকে খুঁজে বের করে এই লিংকটা তাকে দিয়ে দিয়ো।’ সেই থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আমি লিংকটা নিয়ে অনলাইনে অনলাইনে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। তুমি যে তোমার নাম চেঞ্জ করে অ্যালেন রেখেছ, সেটা জানতাম না বলে এই ঝামেলাটা হয়েছিল।

তারপর একরকম ভাগ্যের জোরেই আজ তোমায় খুঁজে পেয়েছি। এখন আমি তোমার বাবার লিংকটা তোমাকে পাঠালেই দীর্ঘদিন বয়ে বেড়ানো ভার থেকে নিষ্কৃতি পাব। এটা তোমার বাবার আমানত, যার দাবিদার তুমি।

পরের মেসেজেই একটা লিংক পেল অ্যালেন। লিংকে ঢুকে দেখতে পেল, খুব পুরোনো একটা অ্যাপস স্টোর। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অ্যাপ দেখতে দেখতে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল অ্যালেনের। অযত্নে-অবহেলায় এক পাশে পড়ে থাকা অ্যাপটার নাম ‘আশ্চর্য লাইটার’।

অ্যালেন অ্যাপটার স্ক্রিনশট নিয়ে কিছুক্ষণ আগে পরিচিত হওয়া চাচাকে মেসেজ দিল। চাচা শাহনেওয়াজ খান রিপ্লাইয়ে ইতস্তত করে বললেন, ‘আমিও এমনটাই ধারণা করেছিলাম। তোমার বাবার সঙ্গে দৈত্যদের খুব ভালো ফ্রেন্ডশিপ ছিল। নিয়মিত ফেসবুকে চ্যাট হতো। তিনি তোমার জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে দামি আশ্চর্য লাইটারের ডাউনলোড লিংক রেখে গেছেন। এই অ্যাপ ইনস্টল করে, ওপেন করে, অ্যাপটার ভেতরের লাইটারে হালকা টাচ করলেই একটা দৈত্য তোমার সঙ্গে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করবে। তারপর পূরণ করবে তোমার মনের যেকোনো তিনটি আশা।

অ্যালেন অবাক হলো। বলল, ‘আমি তো জানতাম, এ রকম জিনিসের নাম হয় আশ্চর্য প্রদীপ। আর তা ছাড়া দৈত্য সরাসরি হাজির না হয়ে ই-মেইল করবে কেন?’

‘দুই প্রশ্নের একটাই উত্তর। দিন বদলেছে। সময় এখন ডিজিটাল প্রজন্মের। পুরানা প্রদীপ এখন চলে না। তার জায়গায় এসেছে আধুনিক লাইটার। আর তা ছাড়া আজকাল শপিংমল থেকে রেস্টুরেন্ট, সবই যদি অনলাইনে হতে পারে, তাহলে দৈত্য কেন নয়?’

অতঃপর চাচার কথামতো অ্যালেন অ্যাপটা ইনস্টল করল। ওপেন করতেই দেখল, স্ক্রিনের ওপর সুদৃশ্য একটা লাইটার। সেটাতে আঙুল দিয়ে একটু টাচ করতেই আগুন জ্বলার বদলে ধোঁয়া উঠতে লাগল। ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে না–যেতেই ফোনে নোটিফিকেশন এল, ‘ওয়ান নিউ মেইল।’ মেইলটা ওপেন করে অ্যালেন দেখল সেখানে লেখা, ‘আমি দৈত্য অনলাইন সেবাকেন্দ্র থেকে লাইটার দৈত্য বলছি। আমি আপনার মনের যেকোনো তিনটি ইচ্ছা পূরণ করব। ফিরতি রিপ্লাইয়ে আপনার ইচ্ছাগুলো ব্যক্ত করুন।’

অ্যালেন অনেক ভেবেচিন্তে তিনটি ইচ্ছার কথা জানাল, ‘এক কোটি টাকা, একটা বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের নৌকা আর একটা আইফোন টেন।’

রিপ্লাই এল, ‘প্রিয় গ্রাহক, আপনার ইচ্ছাগুলো আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। বিষয়টি আমাদের সিস্টেমে প্রসেস হচ্ছে। আপনি খুব দ্রুতই আপনার চাওয়া জিনিসগুলো বুঝে পাবেন। কিন্তু তার আগে শর্ত হিসেবে আপনাকে আমাদের লাইটার দৈত্য লিমিটেড কোম্পানির একটি প্রোডাক্ট কিনতে হবে। সে জন্য আপনি খুব দ্রুত নিচের নম্বরে ৫০ হাজার টাকা বিকাশ করুন।’

তারপর একটা ফোন নম্বর দেওয়া। অ্যালেনের মাথায় বাজ পড়ল। এই মুহূর্তে এতগুলো টাকা সে কোথায় পাবে? পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তার একমাত্র নৌকা, যেটা দিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় আর মাছ ধরে, সেটা বিক্রি করে টাকা পাঠাবে। কারণ, কিছুক্ষণ পর তো নতুন একটা নৌকা পাচ্ছেই।

যেই ভাবা সেই কাজ। নৌকা বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠিয়ে অ্যালেন দৈত্যকে মেইল করে জানাল। কিন্তু মেইলের উত্তর আর এল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অ্যালেন ভাবল, ‘শাহনেওয়াজ চাচাকে মেসেজ পাঠিয়ে দেখি কী সমস্যা হলো।’ কিন্তু মেসেজ দিতে গিয়ে সে দেখতে পেল, আইডিটা আর নেই! কথিত চাচা লোকটা তাকে ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছে!

অ্যালেন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। সে বুঝতে পারল সর্বনাশ হয়ে গেছে। তার চাচা হিসেবে পরিচয় দেওয়া শাহনেওয়াজ খান ছিল কোনো অনলাইন প্রতারক চক্রের সদস্য; যারা ওর নৌকা বিক্রি করা শেষ সম্বল টাকাগুলো মেরে দিয়ে পালিয়ে গেছে। এখন পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই অ্যালেনের।

গল্পের সারমর্ম: অনলাইনে প্রতারক হইতে সাবধান!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত