মোটা ফ্রেমের উল্টোদিকে যে ছেলেটা বসে আছে, তাকে দেখে খুব রাগ হচ্ছে মোহনার। ভিতরটা গুড়গুড় করছে রাগে। বাইরে ঢাক বাজছে। আজ দুর্গাপুজোর নবমী। পাশেই প্যান্ডেলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরী, বিজু, অলিদের দলটা শাড়ি পাঞ্জাবিতে সেজে ভিড় করে ফেলেছে। মাইকে মন্ত্র উচ্চারণ শোনা যাচ্ছে। এখুনি অঞ্জলি শুরু হবে। কাল পুজো শেষ, কোথায় আজ প্যান্ডেলে হুটোপাটি করবে মোহনা, তা নয়… সামনের এই গোমড়া মুখো ছেলেটা তার সব প্ল্যান মাটি করে দিয়ে গপাগপ মিষ্টি খাচ্ছে। আর মোহনা! একটা বেগুনি নীল শাড়ি জড়িয়ে বসে আছে ওদের সামনে। উফ ! এরা যে কখন যাবে ! যতই মিষ্টি খাক, সিঙ্গারা খাক, সেই তো একই রেসাল্ট আসবে। পরে জানাচ্ছি। সেই পরে আর আসে না, আসবেও না কখনো। সব জানে মোহনা। বোঝেও। কিন্তু ওর মা বাবাকে কে বোঝাবে ! আশায় বুক বেঁধে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে তারা। এইটা নিয়ে চার নম্বর। মাইকে ঢাকের আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মোহনার বুকের ধুকপুকুনি। এক্ষুনি ওরা বলল বলে। প্রতিবার পাত্রপক্ষ দেখতে এসে যা বলে, এরাও সেটা কখন বলবে, তাই ভেবে চলে মোহনা। ছেলেটা মন দিয়ে মিষ্টি খেয়ে চলেছে। এরপর মনে হয় সিঙ্গারাও খাবে। আগে তার পরীক্ষাটা নিয়ে যে না বাবা! তা নয়। খুক খুক করে কেশে ওঠে মোহনা। নাহ ! কোনো হেলদোল নেই ছেলেটার। খাচ্ছে, মা বাবার সাথে কথা বলছে। ওর সাথে আরো একজন এসেছে। ওর বন্ধু মনে হয়। সেও বকে যাচ্ছে সমানে। মোহনার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে ক্রমশ। সে হঠাৎ আর থাকতে না পেরে বলে ওঠে,
“আমায় কি একবার দেখে নেবেন ভাল করে ?” ওর এমন কথায় থমকে যায় ছেলেটা। তারপর ওর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বলে, “দেখেছি তো।”
“না, এভাবে নয়, ওড়নাটা সরাই মাথার ?”
“না, দরকার নেই।” দৃঢ় স্বরে বলে ওঠে ছেলেটা।
“দরকার নেই বলছেন ! আপনারা কি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা পড়েননি ভাল করে ?”
“পড়েছি। পড়েছি বলেই তো বলছি। দরকার নেই।”
এই প্রথম ভারী অবাক হয় মোহনা। কি বলছে ছেলেটা ? নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হয় না ওর।
রবিবারের খবরের কাগজের পাত্র চাই এর কলামে এক অদ্ভুত বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল রজতের। স্বাভাবিক যেসব বিজ্ঞাপনগুলো চোখে পড়ে , সেরকমই লেখা আছে ডিটেইলস কিন্তু সব শেষে লেখা একটা লাইন নাড়িয়ে দিয়েছিল রজতকে আমূল। তখনই সে ঠিক করে ফেলে এই মেয়েকে একবার গিয়ে দেখে আসতেই হবে। তারই ফল স্বরূপ রজত আজ মোহনার সামনে। না, পেশায় সে সাংবাদিক বা পুলিশ কোনোটাই নয়। এমনকি কোনো চাকুরিও করে না সে। তার নিজস্ব প্রিন্টিং এর ব্যবসা আছে। ছোট হলেও তার গ্রাফ ক্রমবর্ধমান।
এসবে যদিও কিছু এসে যায় না মোহনার। আগেও এরকম পাত্র এসেছে তাদের বাড়িতে। প্রথম প্রথম তাদের আসার খবর শুনে আশায় বুক বাঁধত মোহনা। ভাবত, এরকম বিজ্ঞাপন পড়ার পরেও তাকে দেখতে আসতে রাজি হয়েছে, এমন মানুষও আছে ! কিন্তু তারপর বুঝেছে সে, চিড়িয়াখানাতেও লোকে টিকিট কেটে জন্তুদের দেখতে যায়। মোহনাও সেরকমই একজন নমুনা বিশেষ। আগের অভিজ্ঞতা গুলোর কথা মনে করতে চায় না সে। ইনফ্যাক্ট, এই বিয়ে নামক ইনস্টিটিউশনটার প্রতি আর কোনো আগ্রহই নেই তার। সে এখন শুধু ভাবছে, পুজোর দধিকর্মার কথা। বিজুরা সব খেয়ে ফেলল। আজকের সেলফিও তোলা হবে না। মা বাবাটা না খুব বাজে! আর এই ছেলেটাও কেমন যেন ! তার সাথে কথা বলছে এমন, যেন সব খুব স্বাভাবিক। নাকি, এটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিত!
সন্ধ্যেবেলাতেই ফোনটা এল। ছেলের নাকি মোহনাকে পছন্দ হয়েছে ! বাবা মা আনন্দে আত্মহারা। মোহনা বিস্ময়ে চুপ করে গেল ! রাতে ঠাকুর দেখতে যাওয়া মাথায় উঠল তার। বিজুদের ফোন করে ক্যান্সেল করল প্ল্যান। নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল সে। মাথার ওড়নাটা সরিয়ে নিজের মুখটা পরিপূর্ণ দেখল মোহনা। অনেকদিন পর। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই একজন মেয়ে সে। তেইশ বর্ষীয়া। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। হাসি মজা কলেজ বন্ধু গান আঁকা নিয়ে মেতে থাকা এক মেয়ে। কিন্তু পাঁচ বছর আগে সব বদলে গেছিল এক দিন। তখন মোহনা অষ্টাদশী। কলেজ থেকে টিউশনি সেরে ফিরছে সন্ধ্যেবেলা। হঠাৎ তাদের বাড়ির আগের গলির মুখে দেখেছিল বেশ কিছু ছেলের জটলা। মৃদু স্বরে কিসব বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে। ওদের কথার মাঝে অলির নামটা বেশ কিছু বার শুনেছিল মোহনা। কৌতূহল বেড়ে গিয়েছিল আরো। মৃদু পদক্ষেপে ওদের পিছু নিয়েছিল সে। আর রাস্তা যত এগিয়েছিল তত সে বুঝতে পেরেছিল ওদের কথায় যে অলির কি ভীষণ সর্বনাশ করতে চলেছে ওরা। ভিতরে ভিতরে শিহরিত হয়ে উঠেছিল ও। হঠাৎ সে দেখে ওদের মধ্যে একটা ছেলে ফোন বের করে অলির নম্বর ডায়াল করে। ওকে বাড়ির বাইরে আসতে বলে। মোহনা চিনতে পারে এটা সেই ছেলেটা যার সাথে কিছুদিন আগে ব্রেকআপ করেছে অলি। কি করবে কিছু ভেবে পায় না মোহনা। অলি কি বলেছে ফোনে ? ও কি আসতে রাজি হয়েছে ? কিন্তু অলি মোহনার সাথে পরামর্শ না করে কিছু করবে না সেটা জানে সে। হ্যাঁ, অলিকে এখুনি একটা ফোন করা উচিৎ। ভাবা মাত্র পাঁচিলের পাশ থেকে উল্টো পথে হাঁটা লাগায় সে। আর তখনই বেজে ওঠে ব্যাগের ভিতর মোহনার ফোনটা। অলি ফোন করেছে।
তারপর মোহনাকে ড্রেনের ধার থেকে উদ্ধার করেছিল লোকজন। যে এসিডের বোতল ওরা এনেছিল অলির মুখে ছুঁড়বে বলে, তার সবটাই ঢেলে দিয়েছিল মোহনার মুখে। আইন আদালতে তারপর কেটে গেছে পাঁচটা বছর। দোষীরা লঘু শাস্তি পেয়ে বীর বিক্রম ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটাই তো স্বাভাবিক ! মোহনাও এখন আবার আর পাঁচজনের মতোই সাধারণ এক মেয়ে। বিবাহযোগ্যা। তাই বাবা মায়ের উৎকণ্ঠা তাকে নিয়ে। কে বিয়ে করবে ওই পোড়া মুখের মেয়েকে? তার আর সব গুণই যে ঢেকে যায় তার মুখের ওই পোড়া চামড়ায় ! মোহনা যদিও সব মেনে নিয়েছে। সে জানত একদিন মা বাবা ক্লান্ত হয়ে যাবে। মেনে নেবে সত্যিটা। তখন মোহনা মুক্ত। কিন্তু ততদিন তাকে ভদ্র মানুষদের সামনে বসতেই হবে প্রদর্শনীর মতো।
কিন্ত এই ছেলেটা কি পাগল ? তাকে পছন্দ হয়েছে বলল ! কি করে হতে পারে ! সে তো মোহনাকে দেখেওনি। তার বীভৎস রূপ দেখেনি। তবে ? এমনকি এই ছেলেটাই প্রথম যে তার এই পোড়া দাগের ইতিবৃত্তও জানতে চায়নি। এমনও হতে পারে ! না, ছেলেটাকে এখুনি ফোন করবে বলে মনস্থির করে ফেলে মোহনা। বাবার ফোন থেকে নম্বরটা নিয়ে সটান ছাদে উঠে যায় সে। নম্বর ডায়াল করে অপেক্ষা করে চলে সে।
“হ্যালো।”
“রজত বাবু, আমি মোহনা।”
“ও… হ্যাঁ… বলুন।”
“আপনি আমায় পছন্দ করেছেন শুনলাম।”
“হ্যাঁ।”
“হ্যাঁ মানে ! আমায় নিয়ে মজা করছেন ?”
“মজা ! একদমই নয় মোহনা। আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। যদিও, আপনি আমাকে মানা করতেই পারেন।”
হতভম্ব হয়ে যায় মোহনা। একে তো খবরের কাগজে ওরকম একটা বিজ্ঞাপন যেখানে সে সরাসরি লিখে দিয়েছিল যে সে এসিড এটাকের স্বীকার এক মেয়ে। তা জেনেও রজত তাকে দেখতে এসেছে। তার মুখের পোড়া দাগ দেখতেও চায়নি সে। আর বিয়েতে রাজিও হয়ে গেল ! এমনও হতে পারে ! ফোনটা কেটে দিল মোহনা।
অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে সে। অনেক অনেক কাল পর বুকের ভিতরটা মোচড়াচ্ছে। যে নদীর উৎস মুখ শুকিয়ে গেছে ভেবেছিল সে, সেই মুখে হু হু করে স্রোত বইতে চাইছে। মোহনা তো মেনে নিয়েছিল তার এই বদলে যাওয়া জীবন। একা একা আনন্দ কি করে পেতে হয়, তা একটু একটু করে শিখে নিয়েছিল সে। কিন্তু তার সব ভাবনা চিন্তা যে ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে ! তার জীবনেও একজনের আগমন ঘটতে চলেছে, যে শুধু তার ! তার জীবনটা তার বাকি বন্ধুদের মত বদলে যাবে ! কান্নাটাকে আর আটকে রাখতে পারে না মোহনা। পাঁচ বছরের সব জমানো কান্না একসাথে বেরিয়ে আসে চোখ থেকে। আর তখনই ফোনটা বেজে ওঠে আবার।
“হ্যালো।”
“মোহনা, কাঁদছেন ?”
“………….”
“কাঁদুন, আপনার কাঁদা খুব দরকার। যত কান্না কেঁদে নিন, আমি আছি।”
“আপনি… আপনি কেন বিয়ে করতে চাইছেন আমায় ? আমি তো অন্যদের মত নই।” কোনোমতে প্রশ্ন করে মোহনা।
“আপনি অন্যদের মত নয় বলেই তো আপনাকে জীবনসঙ্গী করতে চাইছি। আর আপনি যদি নিজে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন, সেই জীবনের আমায় অংশীদার করতে পারবেন না ?”
নিশ্চুপ থাকে মোহনা। কারো এমন কথার পর কিই বা বলার থাকতে পারে ? চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়তে থাকে ওর। কিন্তু কান্নার কারণটা ক্রমশ দুঃখ থেকে আনন্দে পরিণত হতে থাকে।
ধীরে ধীরে বাস্তবের মাটিতে রচনা হতে থাকে আপাত অবাস্তব এক গল্পের।
সমাপ্ত