লোকটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম।
গুলিস্তানে আমি এমন একটা জায়গায় বসি যে তাকালেই এখান থেকে সামনের বড় ফুটপাত দেখা যায়। ফুটপাত জুড়ে শুধু জুতা আর জুতা। ইদানীং নতুন এক ধরনের টাইলস লাগিয়েছে ফুটপাতে, অনেকগুলি ফুটকি ফুটকি দেওয়া, আবার লম্বা লম্বা কতগুলি—আদিম মানুষ এভাবে পাশাপাশি আড়াআড়ি দাগ কেটে সম্পদের হিসাব কষতে শুনেছি। টাইলসে অমন কয়েকটা পাশাপাশি লম্বা দাগ। এই ফুটকি আর লম্বা দাগগুলো নাকি অন্ধদের জন্য। হতে পারে। লিফটে উঠতে গিয়ে একবার লক্ষ করেছিলাম, প্রতিটি সংখ্যা লেখা ঘরে এমন ছোট ছোট ফোঁটা ফোঁটা দেওয়া। পরে শুনেছিলাম, সেগুলো অন্ধদের জন্য। ঐ ফুটকিগুলোয় হাত রেখে অন্ধরা বুঝতে পারে, কত সংখ্যা লেখা।
এই ফুটপাত অন্ধদের জন্য নয় নিশ্চয়ই, কারণ ফুটকিঅলা টাইলস ঢেকে আছে জুতায়। স্বাভাবিক মানুষই হাঁটতে পারে না, আর তো অন্ধরা! হকাররা পুরো ফুটপাত দখল করে আছে। জুতা বেচছে। একটু ওদিকে এগোলে আরও নানা জিনিস পাওয়া যাবে। এই জায়গাটুকুতে শুধুই জুতা।
জুতা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। সব গরিব মানুষগুলো এখানে জুতা কিনতে আসে। আগে আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। নতুন নতুন মানুষ, নতুন নতুন দৃশ্য। আস্তে আস্তে বিরক্তি ধরে গেল। এই শহরে নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পা রাখা একটা মানুষের কাছে জুতা বিক্রির এই দৃশ্য আর কত ভালো লাগে! এমনিতেই মানুষের হাতের ভেজা টাকা ধরতে ধরতে আমার মন ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছে। টাকা ধরলেই মনে হয় সব টাকায় প্রস্রাব লাগানো। এমন বমি আসে আমার! টাকা ক্যাশ বাক্সে রেখে হাত ধুতে দৌড়াই। আগে তো একেকবার টাকা নিয়েই সাবান দিয়ে হাত ধুতে দৌড়াতাম। এখন আর প্রতিবার সাবান দিই না। মালিক খুব চেঁচামেচি করে। সাবান দিয়ে হাত ধুলেও মনে হয় যেন প্রস্রাবের গন্ধ লেগে আছে হাতে। জুতা বিক্রি, হকারের সাথে ক্রেতার ঝগড়া, রিকশা-গাড়ির টুংটাং-প্যাঁপোঁ, মাঝেমধ্যে পুলিশের ধাওয়া আর এই প্রস্রাব ভেজা টাকা—এই মুখস্থ দৃশ্যগুলির ভেতর আমার প্রতিটা দিন কেটে যায়।
আজও কাটছিল। এক লোক প্রস্রাব করে এসে পাঁচ টাকার একটা নোট দিল, যথারীতি ভেজা। নির্ঘাৎ প্রস্রাব লেগে আছে। শালারা প্রস্রাব করে বের হবে, টাকা দিয়ে চলে যাবে; এর মধ্যে টাকা কেন ভেজাতে হয়, এটাই বুঝি না আমি। ধরে নিচ্ছি যে প্রস্রাব করে, সে হাত ধোয়, তাই হাত ভেজা থাকে। কিন্তু হাতটা মুছে টাকা বের করতে সমস্যা কী! বার বার টাকা ধরি আর নিজেকে বোঝাই, লোকটা হাত ধুয়ে এসেছে বলেই টাকা ভেজা, প্রস্রাব লেগে নেই এতে, কিন্তু মন তো আর তা বোঝে না। মন বলে, না, টাকায় ‘মুত’ লেগে আছে। দূর থেকেও প্রস্রাব গন্ধ পাই।
আরও সমস্যা হয়, যখন কেউ দশ টাকার নোট দিয়ে হাঁটা দেয়। পায়খানা করে এলে তার জন্য দশ টাকা। এমন ঘেন্না লাগে ধরতে!
যথারীতি আরও একটি বিরক্তিকর দিন কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখ পড়ল ঠিক সামনের জুতার দোকানটার দিকে। ওখানে রোজ জুতা বিক্রি করতে বসে জাহেদ। মাঝে মাঝে তার ছোট ভাই শাহেদও বসে। আজ শাহেদই বসেছে। আমার চোখ গেল দোকানের সামনে আধাআধি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। আধাআধি বলতে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানো একটা মানুষ। জং ধরা স্টিল বা লোহার ক্রাচ। মানুষটার একটা পা নেই। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জুতা দেখছে। ছেলে-মেয়ে কারও জন্য কিনবে বোধ হয়। একেকটা জুতা উঠিয়ে দেখছে, আবার রেখে দিচ্ছে। কেন যেন দৃশ্যটা দেখতে খুব ভালো লেগে গেল আমার। এক পা নেই—একটা লোক জুতা কিনছে, দৃশ্যটা দেখাই কেমন আরামদায়ক।
দৃশ্যটিতে ছেদ ঘটল কর্কশ কণ্ঠে, ‘ভাই, পাঁচ টাকা ফেরত দেন।’
দশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছেন?’
‘প্রসসাব করছি।’
‘আপনে না দশ মিনিট আগে ঢুকলেন!’
‘কিসের দশ মিনিট! একটু আগে গেলাম।’
‘কী বলেন ভাই! আপনি কমসে কম পনেরো মিনিট আগে ঢুকছেন। নিশ্চয়ই পায়খানা করছেন। দশ টাকা লাগবে। ফেরত হবে না।’
লোকটা যেন খেপে উঠল, ‘ফাইজলামি করেন! প্রসসাব করছি, কয় হাগছি! একেক সময় একেক কথা! একটু আগে নিজেই বললেন যে দশ মিনিট আগে ঢুকছি, এখন আবার বলেন পনেরো মিনিট। টেকা দেন মিয়া।’
কিছু না বলে লোকটাকে পাঁচ টাকা ফেরত দিলাম। আজ ঝগড়া করতে ভালো লাগছে না।
লোকটা বেরিয়ে গেল পাঁচ টাকা নিয়ে। এ সময় শাহেদ ঢুকল হাসতে হাসতে, ‘কী ব্যাপার, জাভেদ ভাই। কার লগে ক্যাচাল লাগাইলা?’
‘কারও সাথে না। এক শালায় পায়খানা করছে, বলে যে প্রসাব করছে। স্বীকারই করল না। বের হয়া পাঁচ টেকা দিল।… কিন্তু তুই হাসিস কেন?’
‘আরে মজার ব্যাপার! এক লুলায় আসছে জুতা কিনতে। লুলা হালায় হাঁটতে পারে না, পাও আছে একটা, কয় জুতা কিনব। তা আবার নিজের জন্যে।’
আমি হেসে বললাম, ‘সমস্যা কী। খোঁড়া মানুষ কি খালি পায়ে হাঁটব?’
‘কেডায় কইছে খালি পাওয়ে হাঁটতে? হালায় একটা জুতা কিনতে আইছে।’
‘একটা জুতা মানে!’
‘এক পাও’র জন্য এক জুতা। ডাইন পাও। আমি কইলাম, একটা বেচমু না। কিনলে এক জোড়াই কিনতে হইব। হালায় কয়, না, একটাই কিনমু। শেষে বিরক্ত হইয়া খেদায়া দিলাম। কইছি, আপনের ডাইন পাওর জুতা লাগব, আপনে এক কাম করেন, সামনে গিয়া খুঁইজা দেখেন কোনো ডাইন পাও কাডা ভিখারি পান কি না। পাইলে লয়া আসেন। দুইজনে দুইডা নিবেন। হালায় গাইল পাড়তে পাড়তে চইলা গেল। লুলা, করে মনে হয় ভিক্ষা, আবার ভাব লয় সম্রাট শাহজাহানের। হা হা হা।’
শাহেদ জোরে জোরে হাসতে লাগল।
হঠাৎ কেমন একটা ঘোঁট পাকিয়ে ওঠে আমার ভেতর। কিছু একটা হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াই আমি। শাহেদকে বলি, ‘তুই দশ মিনিট বসতে পারবি? এইখান থিকা তোর দোকানও দেখা যায়। আমার একটু কাম আছে। জরুরি।’
শাহেদ মাথা নাড়তেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়। বহুদিন বাদে উত্তেজনা অনুভব করি আমি। বহুদিন বাদে!
সালমান শাহ মারা যাওয়ার ঠিক পরের দিন আমি ঢাকার লঞ্চে উঠি। মনে আছে, সেদিন শুক্রবার ছিল। বিকেলের বাংলা সিনেমা দেখছি, বিকেল চারটার সংবাদে জানাল, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। সম্ভবত ওই মুহূর্তে কারোরই হয়নি।
শনিবার ঠিক সকালে লঞ্চে উঠলাম। আমার পকেটে তখন মাত্র বারো টাকা—একটা দশ টাকার নোট, একটা দুই টাকার। পিঠের ব্যাগে একটা শার্ট, একটা প্যান্ট, ব্রাশ, একটা তোয়ালে আর একটা চিরুনি। পেস্ট নেওয়ার কথা মনে ছিল না। তখন আন্ডারওয়্যার পরি-টরি না। একবার তো মা এই নিয়ে ধমকই দিয়েছিলেন আমাকে। তাকে আবার বলেছিলেন আমার আব্বা। সেদিন রাতেই আব্বা নিজে দুইটা আন্ডারওয়্যার এনে দিলেন, একটা লাল রঙের, আরেকটার রং মনে নেই। সেই দুইটার একটা কই হারিয়ে গেল, আর পাইনি। অন্য একটা পরতে পরতে এমন করুণ দশায় পৌঁছেছে যে অনেক দিন আর পরা হয় না। সেটা আর ব্যাগে নিতে মন চাইল না।
ওই সমুদয় সম্পত্তি নিয়ে এসে উঠলাম কাউকে চিনি না, এমন এক শহর ঢাকায়। এক নম্বর নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।
একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছাই এফডিসিতে। সেই আসা নিয়ে বলতে চাইলে উপন্যাস হয়ে যাবে।
জানতাম, কোনোমতে একবার ঢুকতে পারলেই হয় এফডিসিতে। একবার কোনো পরিচালক আমায় দেখলেই কেল্লা ফতে। একটা চান্স!
ডিগ্রি ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে আমার অভিনয় দেখে এলাকার এমপি আমাকে সোনার মেডেল দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুমি একদিন বিরাট অভিনেতা হবা।’ কবর নাটকে মুর্দা ফকিরের অভিনয়েও আমি ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। রক্তাক্ত প্রান্তর-এর ইব্রাহিম কার্দিকে আমার এলাকার কে না চেনে! আমি সেই পার্ট করেছিলাম বলেই চেনে। শুধু আমি অভিনয় করেছিলাম বলেই! কে মনে রেখেছে জোহরাকে বা অন্য একটি চরিত্রকে?
বুঝতে শেখার পর আমাদের ছোট্ট মফস্বলের সিনেমা হলটিতে এমন একটা একটা সিনেমা ওঠেনি, যা আমি দেখিনি। ছোটবেলায় তো প্রতি সপ্তাহে একটা সিনেমা আসলেই শহরজুড়ে মাইকিং হতো, ‘আসিতেছে, আসিতেছে…’। আমি তখন অধীর হয়ে বসে থাকি আসন্ন সেই সিনেমাটির জন্য। আম্মাকে জ্বালিয়ে মারি টাকা টাকা করে। আমি আর সঞ্জয়, দুজন মিলে যাই সিনেমা দেখতে। একটা সিনেমা কয়েকবার করেও দেখি। পড়া বারবার পড়েও ঠিকঠাক মুখস্থ করতে পারি না, সিনেমার ডায়ালগ একবার শুনেই মুখস্থ হয়ে যায়। নায়কের ডায়ালগ হুবহু কপি করে শোনাই সঞ্জয়কে। সঞ্জয় বলে, ‘তুই অনেক বড় হিরো হবি, দেখ!’
তখন অবশ্য আমার নায়ক-টায়ক হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। ছিল স্রেফ সিনেমা দেখার নেশা।
নায়ক হওয়ার স্বপ্ন আমায় দেখায় সালমান শাহ নামের এক লিকলিকে যুবক। প্রথম সিনেমা দেখেই মাত হয়ে যাই। কী সিনেমা! আর কী অভিনয় এই ছেলের! আমার মনে হয় এর মতো হতে না পারলে জীবনই বৃথা।
সিনেমা হলে সব পুরোনো পুরোনো সিনেমা আসে। বেশির ভাগই এক-দেড় বছর আগে মুক্তি পাওয়া। সালমান শাহ’র নাম পত্রিকার পাতায় আগেও দেখেছিলাম, তখন এতটা টানেনি। এক সিনেমা দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যায় আমার। আগে শুধু সিনেমাহলে সিনেমা দেখতাম, আর শুক্রবার বিটিভিতে। সালমান শাহর লোভে ভিসিআর ভাড়া করে সিনেমা দেখতে লাগলাম। আব্বার পকেট থেকে টাকা সরানো শুরু করে দিই। সঞ্জয়দের ঘরে নতুন সাদাকালো টিভি, ভিসিআর ভাড়া করে চলে যাই ওদের বাড়ি। শান্তিমতো দেখতে পারি না অবশ্য। ওদের বাসার সবাই তো ভিড় করেই, আশপাশ থেকেও আসে। ফলে একটা ডায়ালগ হয়তো ভাল লেগে যায় আমার, পেছনে টেনে সেটা দেখতে গেলে সবাই গাল দিতে থাকে। গভীর রাতে আমি আর সঞ্জয় সেসব টেনে টেনে দেখি। পরদিন সঞ্জয়কে সিনেমার ডায়ালগ শোনাই। সঞ্জয় তাজ্জব হয়ে বলে, ‘তুই অনেক বড় হিরো হবি, দেখ! সালমান শাহ’র মতো।’
এক শুক্রবার সালমান শাহর মৃত্যুর খবর শুনে পরদিন শনিবার চোখ মুছতে মুছতে লঞ্চে উঠি আমি—কাউকে জানাই না—আব্বা-আম্মাকে না, এমনকি সঞ্জয়কেও না—আরেক শনিবার চোখ মুছতে মুছতে এসে এই পাবলিক টয়লেটের ক্যাশ বাক্সে বসি। এফডিসিতে ঘুরতে ঘুরতে যখন আমার ছেঁড়া জুতা, জীর্ণ জামা, ভঙ্গুর স্বপ্ন আর প্রায় পিঠের সাথে লেগে আসা পেট, তখন পাশে এসে দাঁড়ায় এফডিসির দাড়োয়ান। পিঠে হাত বুলিয়ে সে বলে, ‘বাবা, আমার এক চাচতো ভাইয়ের একটা ব্যবসা আছে। তুমি গিয়া সেইখানে বসো। এই চিন্তা বাদ দ্যাও, আব্বা। তুমি বাঁচবা না। খাওয়া-পরা জরুরি, নায়ক হওয়া না। আমি ঠিকানা দিতাছি, তুমি চইলা যাও।’
তারপরও অনেক দিন ঘুরেছি এফডিসির আশপাশে। দু’য়েকবার ভেতরেও যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওটুকুই সার। তত দিনে আমার অবস্থা করুণ। স্বপ্নের গায়ে ধীরে ধীরে মরচে পড়তে শুরু করে।
এফডিসির চাচাতো ভাইয়ের ব্যবসা এই পাবলিক টয়লেট চালানো। প্রথম দিন আমায় একবার দেখেই বলে, ‘এই ব্যবসায় শুধুই বিশ্বাস। তুমি রোজ একশ’ টেকা সরাইলেও আমার ধরার সাধ্য নাই। বলবা আইজ লোক কম, বিশ্বাস না কইরা উপায় নাই। যেভাবে হিসাব দিবা, আমি মানতে বাধ্য। কিন্তু তোমারে আমি বিশ্বাস করব। আমার চাচাতো ভাই কোনো দিন ভুল মানুষ পাডায় না, এইডা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ, তোমার গায়ে এখনো সৎ মানুষের ছাপ। অসৎ মানুষের ছাপ পড়লে আমি বিদায় কইরা দেবো।’
আমার দায়িত্ব হলো এই পাবলিক টয়লেটের ক্যাশ বাক্স সামলানো। এক ভেজা নোট রেখে আরেক ভেজা নোট ফেরত দেওয়া। আগে বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুতাম। মালিক খুব চেঁচামেচি করত। এখন সে-ও আর চেঁচায় না, আমারও হাত ধোয়া কমে এসেছে। স্বাভাবিক একটা জীবন। মাঝে মাঝে মন চায়, সব ছেড়েছুড়ে আবার বাড়িতে চলে যাই। কে জানে কেমন আছে আম্মা? আব্বাই বা কেমন আছেন? তারা কি এখনো রোজ কাঁদেন আমার জন্য? আমার ছোট বোনটা কেমন আছে? বিয়ে হয়েছে? বাচ্চা-কাচ্চা? কেমন আছে সঞ্জয়? সে কি বিয়ে করেছে? মন চায়, ওদের কাছে চলে যাই। কিন্তু এখনো বুকের মধ্যে ছোট্ট একটা আলপিন খচখচ করে। নায়ক হওয়া হলো না আমার। হলো না অভিনয় করা, সেরা অভিনেতা হওয়া। কিন্তু সুযোগ কি একেবারেই গেছে?
কোনোদিন কি সুযোগ এসে ধরা দেবে না? দেবে নিশ্চয়ই। বাড়িতে চলে গেলে কোনোদিন আসবে না সে সুযোগ।
আমি বসে থাকি গুলিস্তানের এক পাবলিক টয়লেটে। ভেজা নোট দেখি। ওপাশের জুতা দেখি। আর দেখি জুতা কিনতে আসা মানুগুলোকে। খুব গভীর রাত হলে মাঝে মাঝে মুখে মেকআপ লাগিয়ে আয়নার সামনে বিচিত্র সব চরিত্রে একা একা অভিনয় করি। কল্পনায় মঞ্চে উঠি। হাজার হাজার দর্শকের সামনে সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিই। স্পষ্ট শুনতে পাই তাদের করতালি।
লোকটা একটা ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে জুতা দেখছে। একটু পর ডান পায়ের এক পাটি জুতা হাতে নেয়। উল্টে-পাল্টে দেখে অনেকক্ষণ। তারপর হকারকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই, এই জুতাটা কত?’
দোকানদার নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়, ‘একদাম সাড়ে সাতশ’।’ সে কাস্টমার চেনে। এই খোঁড়া লোক জুতা কিনবে না। দাম শুনেই চলে যাবে। বড়জোর একটা দাম বলতেও পারে। সেই দাম এমন হবে যে শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যাবে। দোকানদার নিজেকে বার বার বোঝায়, যেই দামই বলুক, মাথা গরম করা যাবে না। ঠান্ডা থাকতে হবে একদম। এমনিতেই সকালবেলা মেজাজ খারাপ করে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে এসেছে সে।
ক্রাচে ভর দেওয়া লোকটা বলে, ‘ভাই আমি এই জুতাটার কথা বলতাছি।’
‘এইটাই সাড়ে সাতশ’ টেকা পড়ব জোড়া। একদাম।’
‘জোড়া না, ভাই। এই একটা?’
‘এই একটা মানে? একটা জুতা কেউ বেচে! ইয়ার্কি মারেন নাকি!’ দোকানদারের মাথা মুহূর্তেই গরম হয়ে যায়। আজ দিনটা ভালো যাবে না বোঝাই যাচ্ছে। অনেক কষ্টে রাগ সামলায় সে। ‘আপনের কাছে জুতা বেচমু না। যান। মিয়া পাগল!’
পঙ্গু লোকটা কী বলতে যায়, এমন সময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় আরেকজন পঙ্গু মানুষ। ডান দিকে একটা ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নতুন মানুষটা। ডান পা নেই তার। লুঙ্গির আড়ালে পড়ে গেছে। সম্ভবত কাটা। নিচে পড়ে থাকা অন্য এক পাটি জুতা হাতে নেয় সে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিছুক্ষণ দেখে। চামড়ার ফিতায় টান দেয় জোরে। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বলে, ‘বাম পায়ের এইটা আমি নিমু। এইটার দাম কত?’
পাশের ক্রেতা লোকটার মুখে স্বর্গীয় এক হাসি ফুটে ওঠে সে মুহূর্তে। নতুন লোকটার কনুইয়ে হাত ধরে সে বলে, ‘আপনের পায়ের মাপ কত ভাই? আমার বেয়াল্লিশ।’
নতুন আসা পঙ্গু লোকটি বলল, ‘আমারও পায়ের মাপ বেয়াল্লিশই। আমার বাম পায়ের একটা জুতা লাগব। সবাই শুধু ঠেইলা পাঠায়া দেয়। আপনেই কন, আমার লাগবে এক পায়ের জুতা, আমি দুইটা কিনব কেন? আল্লাহ-তালা কেমনে কেমনে আপনেরে পাওয়াইয়া দিলেন। আসেন আমরা দুইজন দুইটা জুতা নিই।… আগে দর করি। দর না কইরা জুতা কিনন ঠিক হইব না। এরা বড় ঠকায়।’
অনেক দিন বাদে গভীর রাতে না এসে তীব্র এক দুপুরে দাঁড়ালাম আমার নিজস্ব আয়নার সামনে। সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার নিতে হবে। সামনে হাজার হাজার মানুষ করতালি দিচ্ছে। আমার হাতে একপাটি জুতা। সেরা অভিনেতার পুরস্কার হিসেবে এটা পেয়েছি। এই দামি পুরস্কার সালমান শাহও পায়নি।
আস্তে আস্তে মেকআপ তুলছি। পনেরো বছরের চেনা দোকানদারও আমায় চিনতে পারেনি—এমন মেকআপ!
ক্রাচটা তখন দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে।