প্রায়শ্চিত্ত

প্রায়শ্চিত্ত

“চলো, ছাদে যাই।”
“বৃষ্টি পড়ছে তো।”
“সেজন্যই তো যাব। আসো আমার সাথে।”
নওশীন আমার হাত ধরে টানলো। আমি বাদ্ধ হয়ে ছাদের সিঁড়িভেঙ্গে যেতে যেতে বলি, “কীসব পাগলামি তোমার!”
নওশীন আমার কথায় পাত্তা দেয় না। আমি বলি, “আরে দাঁড়াও, চায়ের কাপটা তো রেখে আসি।”

আমি আধখাওয়া চায়ের কাপটা ডাইনিং টেবিলে রেখে আবারও সিঁড়িতে এসে দেখি কেউ নেই সেখানে। থাকবার কথাও নয়। নওশীন মারা গেছে দু’মাস হল। এই দু’মাসে কতবার যে সে আমার কল্পনায় এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। শুধু কল্পনায় নয়, স্বপ্নেও আসে মাঝে মাঝে। এরমধ্যে গত পরশুর স্বপ্নটা ছিল ভয়াবহ। অন্ধকার এক ঘরে এসে সে বসলো আমার পাশে আর অদ্ভুত ভয় লাগানো হাসি দিয়ে বলল, “খুব শীঘ্রই তুমি আমার এখানে চলে আসবে। তোমাকে ছাড়া আমি ভীষণ একা।”

নওশীনকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম বলে সে অনেক আহ্লাদী করতো। খুনসুটি তো আছেই। সেইসাথে ওর ভেতর কিছু রহস্যও ছিল। বিয়ের আগে সে আমায় বলেছিলো, “আমি কিন্তু একা নই।”
আমি বললাম, “মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ।”
“বইয়ের মত কথা বলো না। শোনো, আমার সাথে একজন প্রায় সবসময় থাকে।”
“কে সে?”
“একজন মৃত মানুষের আত্মা!”
আমি যারপরনাই বিরক্ত হই। বলি, “আজেবাজে হরর ফিল্ম দেখে তোমার আজ এই দশা।”
সে আমার কথা শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে বলে, “রাত হলেই তার সাথে আমার কথা হয়। সে জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকে আর আমি কথা বলি।”
আমি কিছু বলি না, হতাশ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।

মনে পড়ে সেদিনের জ্যোৎস্নাবিলাসের কথা। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই দেখি সে জানালার শার্সি টেনে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমি বলি, “কী দেখো?”
সে এমন চমকালো যা বলার নয়। বলল, “ঘুমিয়ে যাও। এ সময়টা শুধু আমার।”
আধ্যাত্মিকতার সুর পেয়েছিলাম সেদিন তার কথায়। বলেছিলাম, “আমিও দেখতে চাই।”
“না!”
সে খুব জোরের সাথে নিষেধ করলো। এ যেন রীতিমত শাসন। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। ওর কাঁধে থুতনি রেখে যখনই একটু রোমান্টিক হতে চাইলাম তখনই নওশীন রেগে গেল।

“কী হচ্ছে এসব? আমার কি ব্যক্তিগত কোনো সময় নেই?”
আমিও রেগে গেলাম।
“এটা কী এমন পার্সোনাল কাজ, হ্যা? মাঝরাতে পাগলের মত জানালার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?”
নওশীন একটা শ্বাস ফেলে শুষ্ক স্বরে বলে, “সেটা বোধকরি আমার মৃত্যুর পর জানবে, বুঝবে।”
সেদিন তার ঐ কথার রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি। সে হুট করেই তখন চাঁদের নরম আলোয় ভিজতে চাওয়ায় দুজনে মিলে ছাদে উঠে যাই এবং বাকিরাত দুজনে চাঁদের নিচে কাটিয়ে দিই।

এই মুহূর্তে অতীতের এই ঘটনা মনে পড়ায় জানালার দিকে আপনা হতে চোখ গেল। এখন সময় মাঝরাত। জানালায় চোখ রেখে দেখা যেতেই পারে নওশীন কী দেখতো। অতঃপর আমি জানালার শার্সি সরিয়ে বাইরে তাকালাম। তখন সামনে থাকা বিল্ডিংটায় বিচিত্র ভয়াবহ এক দৃশ্য দেখতে পেলাম। সাদা শাড়ি পরিহিত এক মেয়েকে দেখলাম ছাদের রেলিংয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। এটা দেখে ভয় আমাকে গ্রাস করে নিতে চাইলো যেন। সবথেকে ভয়াবহ ব্যাপার হল মেয়েটি একপর্যায়ে আমার দিকে তাকালো। তার চাহনিযুক্ত অভিব্যক্তিটার দরুন ভয়ে আমি শার্সি টেনে দিই। তারপর ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি সাদা শাড়ি পরিহিত মেয়েটি আমার পিছে দাঁড়িয়ে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কেবল তার দিকে চেয়ে থাকি। তখনই সে বলে, “তোমাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। নয়তো আমি তোমায় মেরে ফেলবো। মেরে ফেলবো…. মেরে ফেলবো.. ”

একই কথার পুনরাবৃত্তির দরুন ঘুম ভেঙে গেল। এটা স্বপ্ন ছিল তবু উপলব্ধির বিচারে বাস্তবতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। স্বপ্নের মেয়েটিই যে নওশীনের সাথে থাকা আত্মা ছিল তাতে আর সন্দেহ রইলো না। স্বপ্নে বলা কথাটি স্মরণ হল আমার—এবার সত্যিই প্রায়শ্চিত্ত করবার সময় এসে গেছে।

“হ্যালো ওসি সাহেব?”
“জ্বী বলুন মিঃ সাবের।”
“শুনুন, নওশীন হত্যার যে বিচারকার্য চলছে তার সমাধান আমার কাছে আছে।”
“কীরকম?”
“আসল হত্যাকারীকে খুঁজে পেয়েছি।”
“কে সেই হত্যাকারী?”
আমি লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলি, “আমি নিজেই।”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত