ডাক্তারখানা

ডাক্তারখানা

শ্যাম্পু খেয়ে ফেলেছি ডাক্তারসাহেব! পেটের অবস্থা ভীষণ রকমের খারাপ। কিছু তো খেতে পারছিই না। উল্টো পেট খারাপ হওয়ার কারণে বার বার বাথরুম যেতে হচ্ছে। ফলে যা পেটের ভেতরে ছিল, সেগুলো ও বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার কি হবে ডাক্তারসাহেব? তবে কি আমি আর বাঁচবো না? আমার সময় কি ফুঁরিয়ে এসেছে। আমার বউ কি এতো দ্রুতই বিধবা হয়ে যাবে! অনেকটা ঝড়ের বেগে চিৎকার- চেঁচামিচি করে লোকটি কথাগুলো বললেন।
ডাক্তারসাহেব লোকটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। খেয়াল করলেন লোকটির মাথার চারপাশে নাম মাত্র কটা চুল। আর ঠিক মাঝখানে বিশালাকৃতির টাক। টাকের স্থানটা কোনো এক অদ্ভুদ কারণে চকচক করছে। ভ্রু কুঁচকানো অবস্থায় রোগীকে বললেন :- বাহ্, অতি অসাধারণ কর্ম করিয়াছেন! মাথায় তো দেখছি একগাছা চুল ও নেই। তা আপনার কি কোনো কারণে মনে হয়, আপনার মাথার বদলে পেটের ভেতর চুল গজিয়েছে?
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে, রোগী তার মাথা খানিকটা নিচু করলেন। খুব সম্ভবত তিনি লজ্জা পেয়েছেন। তারপর মিন মিন করে বললেন:- ইয়ে..মানে না স্যার! তা মনে হবে কেন?

:- তবে শ্যাম্পু খেতে গেলেন কেন। দুনিয়ায় কি খাবারের অভাব পড়ছিল যে শ্যাম্পু গিলতে হবে। নাকি চালের দাম বৃদ্ধির কারণে শ্যাম্পু খাওয়ার অভ্যাস শুরু করেছেন। আগে তো মানুষ চালের দাম বৃদ্ধি পেলে আলু খেত। তখনকার যুগের স্লোগান ছিল “নিয়মিত আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান”। এখন তো আপনার জন্য নতুন স্লোগান লিখতে হবে ” নিয়মিত শ্যাম্পু খান, ভাতের উপর চাপ কমান”।

:- ইয়ে.. মানে, আসলে স্যার!

:- রাখেন আপনার ইয়ে..মানে! শ্যাম্পু কোথায়, কি কাজে ব্যবহার করতে হয় সেটা জানেন তো? নাকি আপনি আপনার কিডনি, পাকস্থলী ও লিভার শক্ত, মজবুত ও সিল্কি করার জন্য শ্যাম্পু গিলে খেয়েছেন?

:- না..স্যার ব্যাপারটা তেমন নয়! আমি জানতাম না ওটা যে শ্যাম্পু । আসলে আমার বউ চলে গেছে তার বাবার বাড়ি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখুন, তারপর দিন ই আবার কাজের বুয়ার মা মারা যায়। সে ও চলে যায় তার গ্রামের বাড়ি। আমি বাসায় একা। খাবার রান্না করার জন্য কেউ নেই। কিন্তু স্যার পেট কি তা বুঝে? তার তো খাবার চাই। পেটে তিন-চারটা আকাশ সমান ক্ষিদা নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। পুরো রান্নাঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রান্না করার জন্যে তেমন কিছুই পেলাম না। সব শেষে একটা ডিম পাওয়া গেল। কিন্তু ততক্ষণে আমার ক্ষিদা এতোটাই বেড়েছে যে দশ-পনেরটা ডিম খেলেও তেমন কিছুই হবে না।

আমি ভাবলাম আরেকটু খুঁজে দেখি, যদি আরো ডিম পাওয়া যায়। ডিম পাওয়া গেল না। একটা বাটি পাওয়া গেল। বাটির মধ্যে হলদে রঙ্গের কাঁচা ডিমের মতো কিছু একটা ছিল। আমি ভাবলাম এটা হয়তো ডিমই হবে। তাছাড়া কাজের বুয়া ডিম ভেঙ্গে গেলে এভাবে করে ডিম বাটিতে রাখে।

তারপর ওটার সাথে ঐ ডিমটা মিশিয়ে ভেজে ফেললাম। এবং গপাগপ খেয়ে ফেললাম। অবশ্য খাওয়ার সময় খানিকটা কমলালেবুর ফ্লেভার পাচ্ছিলাম। ভাবলাম মন্দ কি? কমলালেবুর ফ্লেভার তো খারাপ না।

এতটুকু শুনে ডাক্তার সাহেব মুচকি হাসলেন। এবং বললেন:- বাহ্, ব্যাপারটা তো বেশ ইন্টারেস্টিং। ডিমের ভেতর কমলালেবুর ফ্লেভার, মানে “টু ইন ওয়ান”। তারপর কি হলো বলুন।

:- তারপর থেকেই তো স্যার শুরু হলো আসল খেলা। হঠাৎ পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। একবার বাথরুমে গেলাম। বাথরুম থেকে বেরুতে না বেরুতেই আবার পেটে মোচড় দিল। এভাবে একটু পর পর পেটে মোচড় দেয়া শুরু হলো। খালি বাথরুমে যাই আর বেরুই, যাই আর বেরুই। এক পর্যায়ে বউকে ফোন করলাম, পুরো ঘটনা শুনে সে হাসতে হাসতে বললো:- আরে গাধা! ঐটা তো শ্যাম্পু ছিল। ওরেঞ্জ ফ্লেভারের বিদেশী শ্যাম্পু । দেখতে অনেকটা ডিমের মতো। এটা আমার মামা আমাকে বিদেশ থেকে পাঠিয়েছেন। বোতল থেকে শ্যাম্পু বের করতে গিয়ে বেশি বের করে ফেলেছিলাম। তাই বেশিটুকু বাটিতে রেখেছিলাম। বউয়ের মুখে এ কথা শোনার পর রাগে হাসবো না কাঁদবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শেষে আপনার শরণাপন্ন হলাম। কিছ একটা করুন স্যার! কিছু একটা করুন।
ডাক্তারসাহেব খানিকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন:- বর্তমানে আপনার ভেতরকার অনুভূতিটা কি রকম?
:- খানিকটা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে স্যার। খুব সম্ভবত ঐ শ্যাম্পুতে মেনথল ছিল। ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
:- বলছিলাম কি, রোগী সাহেব। আমার ধারণা শ্যাম্পু খাওয়ার ফলে আপনার ভেতরে নেগেটিভ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি কিছু পজেটিভ প্রতিক্রিয়া ও সৃষ্টি হয়েছে। এমনটাও হতে পারে শ্যাম্পুর কারণে আপনার কিডনীর কিংবা লিভারের কর্মক্ষমতা বেড়ে গেছে। পৃথিবীতে কত রকমের আশ্চর্য ঘটনাই ঘটে থাকে। যেগুলো আমাদের ধারণার ও বাইরে।

ডাক্তার সাহেবের কথায় রোগীর চোখ বড় হয়ে গেল। চোখভরা আশ্চর্য নিয়ে রোগী প্রশ্ন করলেন:- এসব কি বলছেন স্যার! আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা শুরু করছেন?

ডাক্তার সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন:- আরে না..না। ঠাট্টা করবো কেন? তাছাড়া আপনি কি আমার শ্যালক হন, যে আপনার সাথে ঠাট্টা করবো? শুনুন আপনাকে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধি দেই। আপনি একবার ” বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট” এ গিয়ে আপনাকে দেখিয়ে আসুন। তারা প্রাণী নিয়ে বিভিন্ন রকমের গবেষণা করে থাকেন। হতে পারে আপনার ভেতরটা গবেষণা করে শ্যাম্পু খাওয়ার কোন না কোন উপকারিতা উনারা খুঁজে পাবেন। পরে সেই উপকারিতার কথা সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে। তারপর সবাই প্রতিদিন নিয়মকরে শ্যাম্পু খাবে। আর শ্যাম্পু খাওয়ার সব ক্রেডিট যাবে আপনার উপর। এমনকি আপনার মৃত্যুর পরও সবাই আপনাকে একজন ” শ্যাম্পু খাদক” হিসেবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আপনার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করবে। সাদা গোলাপ অর্পন করবে। বুঝলেন রোগী সাহেব নিজেকে বিখ্যাত করার এই সুযোগ, এই সুযোগ কিন্তু বার বার আসবে না। তাই কাজে লেগে পড়ুন।

এবার রোগী খানিকটা রেগে গেলেন। রাগী কণ্ঠে বললেন:- দেখুন আমি আপনার কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছি। এসব আলতু ফালতু বুদ্ধির জন্য নয়!

রোগীর কথায় ডাক্তারসাহেব তেমন কিছু মনে করলেন না। তিনি বেশ ঠান্ডা ভাবে বললেন:- আচ্ছা ঐ বুদ্ধি যদি আপনার ভালো না লাগে, তবে আরেকটা অভিনব বুদ্ধি আপনাকে দেই। দেখুন মূলত আপনার ভুলটা হলো স্থানগত। যেটা চুলে দেয়ার দরকার ছিল সেটা পেটে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো আপনার পেটের ভেতর কোনো চুল নেই। থাকলে খুব সম্ভবত তেমন একটা অসুবিধা হতো না। এবার এক কাজ করুন। দ্রুত সেলুনে যান। ওখানে গিয়ে কিছু চুলও খেয়ে ফেলুন। তাহলে হবে কি, পেটের ভেতরে শ্যাম্পু তার চুলের ছোঁয়া পাবে….

পুরো কথা বলার আগেই রোগী সাহেব ভীষণরকম রেগে গেলেন। উনার শরীর কাঁপা শুরু করলো। কাঁপতে কাঁপতে বললেন :- রাখেন মিয়া আপনার ডাক্তারী। যত্তোসব পাগল-ছাগল চেম্বার খুলে বসে পড়েছে । গেলাম আমি। কথাটা বলেই রোগী হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।

যাবার সময় ডাক্তার সাহেবের ভিজিট টা পর্যন্ত দিয়ে গেলেন না । ডাক্তারসাহেব অনেকটা অসহায়ের মতো রোগীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর মনে মনে একটা গান গাইতেছেন:-

“চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিড়ে,
কাঁদিস কেন মন;
ভাঙ্গা গড়া এই জীবনে আছে সর্বক্ষণ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত