সাদা চুলের সাথে ব্লু লেন্সের চোখ।গোলাপি একটি জামায় থ্রিসিক্সটি ক্যামেরা রুমে ফোকাস ক্লিকে আমার এই সুন্দর রূপ দেয়া হয়েছিলো। হয়তো ওয়েস্টার্ন কোনোএক সুন্দরিকে তিনশো ষাট রাউন্ড ফোকাস করে! একটি কসমেটিক্স দোকানে আমাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেই হাসিব নামের এক ভদ্রলোক আমাকে তার মেয়ে নয়নতারার দ্বিতীয় জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। হ্যা আমি একটি পুতুল! আজকে আমি আপনাদের শোনাবো আমার আত্মকথা,আমার সব প্রাপ্তি-হারানোর কথা! সেখানে যাওয়ার পর এতো অবহেলা পাওয়ায় আমি ভাবতে লাগলাম কসমেটিক্স দোকানেই ভালো ছিলাম। সেখানে নিত্যনতুন মানুষ দেখতাম। আহা কত বাহারি সাজগোজ করা মেয়ে আসতো সেখানে! এখানে এসে নয়নতারার সদ্য গজানো দাঁতের কামড়ে যেন অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। মেঝেতে,খাটের উপর কখনওবা আলমারির উপর পড়ে থাকতে হতো।নয়নতারা যখন গুটিগুটি পায়ে পড়ে যেতে যেতে আমার কাছে আসে তখন মনেহয় এইবুঝি যম এলো! ইচ্ছে হয় দৌড়ে পালিয়ে যেতে! নয়নতারার পাপা ওকে কত সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। তখন আমার খুব হিংসে হতো! আমার বুঝি সাজতে ইচ্ছে করেনা? আমিও কতো সুন্দর সাজানো-গোছানো ছিলাম ওই কসমেটিক্স দোকানটায়। মাঝেমাঝে আমার মনটা খারাপ হয়ে যেতো এতো অবহেলা দেখে। তারপর নয়নতারাও বড় হতে থাকে আর ওকেও সবাই আদর করে নয়ন বলে ডাকে। তখন আমার খুব ইচ্ছে হতো কেউ আমাকেও সুন্দর একটা নামে ডাকুক।
তারপর দেখতে দেখতে নয়নও বড় হতে লাগলো! ও এখন তুতিয়ে কথাও বলেনা। এখন নয়ন আমাকে আগের মতো অবহেলা করেনা। আমার সাদা চুলে বেণী করে দেয়। আমাকে একটা নামও দিয়েছে! ও যখন ওর পাপাকে বলতো পাপা আমি পরি পুতুলকে বউ সাজাবো তখন আমার যে কি আনন্দ হতো! ও আমাকে পরি পুতুলই বলতো। ও আমার জন্য রঙবেরঙ পোশাক বানাতো আর ওগুলা পড়লে নিজেকে ব্লু আই লেন্সের সাথে ওয়ার্ল্ড ক্লাস মডেল মনে হতো! একদিন পাশের বাসার ভদ্রমহিলার সাথে নয়নের সমবয়সী নেহাল নামের একটা ছেলে এসেছিল আর আমার হোয়াইট হেয়ারের কয়েকগোছা ছিঁড়ে ফেলেছিল আর নয়ন আচ্ছা করে ওর কান টেনে দিয়েছিল! আমার জন্য এমন মিষ্টি প্রতিশোধে আমার যে কি আনন্দ লেগেছিল যেন আর আনন্দ আর ধরে না! তারপর ধীরেধীরে নয়ন আরও বড় হতে থাকে আর আমার সাথে আগের মতো খেলেনা! আমাকে আর বউ সাজায় না। একসময় আমাকে শোকেসে বন্দি করে রাখে। আর বের করেনা। আমার খুব ইচ্ছে হতো সেখান থেকে বেরিয়ে আবার নয়নের সাথে খেলতে। তখন নয়নের সাথে বাসায় প্রায়ই ওর বন্ধুরা আসতো আর নয়ন তাদের সাথে ছোটবেলার গল্প করার কালে আমাকে দেখিয়ে বলতো ওই পুতুলটাকে নিয়ে আমার ছেলেবেলা কাটিয়েছি।
তারপর আচমকা এক ঝড় এসে নয়নকে আমার আড়াল করে দেয়। আমি আর দেখিনা নয়নকে! ও আমায় ছেড়ে চলে গেছে!
হ্যা ওর বিয়ে হয়ে গেছে। যেদিন ওর বিয়ে হয় সেদিন অন্যকেউ ওকে সাজিয়ে দিয়েছিলো! ভাবতেই কেমন লেগেছিলো, যে মেয়েটা আমাকে বউ সাজিয়ে খেলতো আর যে মেয়েটা সাজাতে আর সাজতে ভালোবাসতো আজ সেই মেয়েটাকে সাজিয়ে দিচ্ছে অন্যকেউ! আমার আর তার বউ সাজার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ! আমার বউ রূপে সাজের পর কোনো বর আসেনি আর অন্যের বাড়িও যেতে হয়নি। কিন্তু ও সেদিন চলে গিয়েছিলো বরের বাড়ি! অবাক বিষয় হচ্ছে যে মেয়েটা কয়েকবছর আগেও পুতুলকে সাজাতো তার সাথে খেলতো সেই মেয়েটাকেই একটা ফ্যামিলি সাজাতে হবে! জলজ্যান্ত মানুষগুলোকে কেয়ারিং করতে হবে! এখন আমি নয়নকে দেখতেও পাইনা! কেমন আছে ও! ও কি কাউকে আমার মতো করে সাজায় এখন! হয়তোবা!
একদিন নয়ন আসে বছর চারেকের একটি মেয়ে নিয়ে। নয়ন ওকে তমিস্র বলে ডাকে, তাকে বেণী করে দেয়। চোখে কাজল লাগিয়ে দেয় আর মেয়েটাও মা মা বলে ডাকে। তখন বুঝতে পারি ওটা নয়নের মেয়ে!
আমাকে দেখে তমিস্র বলে উঠে,
-মা মা আমি ওই পুতুলটাকে বাসায় নিয়ে যাবো।
-আচ্ছা ঠিকাছে নিও।
সেদিন তমিস্র আমাকে ওই বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। আমি নয়নকে আবার কাছ থেকে দেখতে পাই। তমিস্র আমাকে নয়নের মতোই বউ সাজাতো, সাদাচুলে বেণী করে দিতো। তারপর আবার একসময় তমিস্রও হয়তো নয়নের মতো দূরে চলে যাবে। মানুষকে সাজাবে আর পুতুল খেলবেনা! আমাকে আবার পড়ে থাকতে হবে আরও একটি শোকেসে।
মেয়ে সত্যিই তুমি অদ্ভুত! আগে পুতুল সাজাতে আর এখন পুরো একটি সংসার সাজাও!
দিনশেষে পুতুলরাই জানে একটি মেয়ের কৈশোর পেরোনোর আগের সব হাসি-কান্নার কথা। তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা!