গোতলপুরের নরহরিকে সবাই এক ডাকে চেনে। চেনে তার মুষ্টিবলের জন্য। সেই ছোটোবেলা থেকেই তার রাগজনিত ঘুসির ব্যাপক নামডাক। নরহরির তখনও নাকি মুখে ভালো করে বোল ফোটেনি। দুপুরবেলা মা খাইয়ে দেওয়ার পর সে রোজ চলে যেত বাড়ির পিছনে। চড়ে বসত একটা প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জামগাছে। বেশ কিছুক্ষণ ঐ গাছের ডালে কাটিয়ে তারপর আসত শুতে। মাকে বলত, ঐ গাছে এক দাদু আছে, সে নাকি ওকে রোজ নতুন নতুন গল্প শোনায়। নরহরি ছাড়া আর কেউ নাকি তাকে দেখতে পায় না।
বলাই বাহুল্য, ও বাড়ির কেউ ছোট্ট নরহরির কথা বিশ্বাস করেনি। সবাই তাকে ভরদুপুরে ঐ গাছে চড়তে মানা করল। কিন্তু নরহরি কিছুতেই কথা শুনছিল না। তাই একদিন নরহরির ছোটো কাকা রেগেমেগে কেটেই ফেললেন গাছখানা। আর তাতেই নাকি নরহরি ভীষণ খেপে গিয়েছিল। কাকাকে সামনে না পেয়ে বারান্দায় রাখা চালের বস্তাটাতেই মেরেছিল এক ঘুসি। ঐ এক ঘুসিতেই ফেটে গিয়েছিল বস্তাটা।
একটা বাচ্চার হাতে এতো জোর! এটা কী করে সম্ভব? অতঃপর ওকে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতার এক বড়ো ডাক্তারের কাছে। তিনি হাতের এক্স-রে করলেন, সঙ্গে আরো নানা পরীক্ষা- নিরীক্ষা। শেষটায় সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন – নরহরির হাতের হাড় ও পেশির গঠন ঠিক মানুষের মতো নয়, সঠিকভাবে বললে অনেকটা গোরিলার মতো। রেগে গেলে আবার পেশির কর্মক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই ওর ঘুসিতে অত জোর!
একথা শুনেই নরহরির বাবা ভজহরি, ছেলেকে নিয়ে গেলেন একটা বক্সিং কোচিং সেন্টারে। বক্সিং-কোচ এককালের জাতীয় চাম্পিয়ন। একটা বছর তিনেকের বাচ্চা বক্সিং শিখতে এসেছে দেখে তিনি তো হেসেই খুন। এদিকে সেই হাসি দেখে আবার নরহরির মেজাজও গরম হতে লাগল। কোচসাহেব কোনোমতে হাসি থামিয়ে নরহরিকে বললেন, ‘খোকা আমার পেটে একটা ঘুসি মারো তো, দেখি তোমার হাতে কত জোর!’ খোকা গুরুর আজ্ঞা পালন করতে এক মুহূর্ত দেরি করল না। তার ফল, বলাই বাহুল্য, খুব একটা সুখকর হল না। গুরুমশাই এক ঘুসিতেই চেতনা হারিয়ে ধরাশায়ী হলেন। জ্ঞান ফেরার পর ঘোষণা করলেন, তিনি আর কোনোদিন বক্সিং শেখাবেন না, পৈতৃক যে জমিটুকু আছে, তাতে হাল-চাষ করবেন।
এই ঘটনায় ভজহরি খুবই ব্যথিত হলেন। আসলে তিনি খুবই সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর দ্বারা কারুর কোনো অমঙ্গল হোক, এটা তিনি কোনোকালেই চান না। তাই সেই মুহূর্তেই তিনি ছেলেকে বক্সার বানানোর সব পরিকল্পনা চিরতরে ত্যাগ করলেন।
এরপর নরহরি স্কুলে ভরতি হল। ভজহরি তাকে পই পই করে বুঝিয়ে দিলেন, ভুলেও সে যেন কোনো সহপাঠীর গায়ে হাত না তোলে। নরহরি সেই উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করত বটে, কিন্তু কোনো কারণে একবার রেগে গেলে আর নিজের মুঠোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত না। নরহরির এই রেগে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ ছিল বন্ধুদের আনা টিফিন। বন্ধুরা বাড়ি থেকে সুস্বাদু কোনো খাবার এনে ভাগ না দিলেই নরহরি খুব রেগে যেত এবং এর ফলস্বরূপ তারা আক্রান্ত হত নরহরির হাতে। তবে এই নিয়ে ঐ সহপাঠীরা কখনো মাস্টারমশাইদের কাছে বা বাড়িতে নালিশ করার সাহস পেত না। তাই দিন কে দিন নরহরির সাহস বেড়েই যেতে লাগল।
এই সাহস একেবারে চরম সীমায় পৌঁছাল স্কুলে নতুন হেডমাস্টারমশাই আসার পর। ভদ্রলোকের নাম জগন্নাথ মল্লিক, দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষ। ক্লাসে অঙ্ক করান, ছাত্ররা তাঁকে যমের মতো ভয় পায়। নরহরি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। একদিন শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তিনি নরহরিকে নিজের রুমে ডেকে পাঠালেন। অভিযোগ, সে টিফিনের সময়ে কোনো একটা ক্লাসে ঢুকে বসার বেঞ্চ ভেঙেছে। নরহরি সে কথা স্বীকার করল না। জগন্নাথবাবু এবার ওকে হুমকি দিলেন, দোষ কবুল না করলে স্কুল থেকে বের করে দেবেন।
একথা শুনে নরহরি ভীষণ রেগে গেল। চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি ভুল করছেন স্যার, আমি বেঞ্চ ভাঙিনি।’ জগন্নাথ মল্লিক বছর পনেরো একটা স্কুলে দাপটের সঙ্গে হেডমাস্টারি করে তারপর এই স্কুলে এসেছেন। আর চাকরি করছেন তিন দশকেরও বেশি। এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে কোনো ছাত্র তো দূরের কথা, স্কুলের সেক্রেটারি মায় ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অব্দি ওঁর সঙ্গে এভাবে কখনো কথা বলেননি। ফলে ভদ্রলোক রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। সেই রাগের তাপে ওনার মুখের আকৃতি প্রায় বৃত্তাকার থেকে প্রথমে সমকোণী ত্রিভুজের মতো এবং শেষটায় একটা সামন্তরিকের আকার নিল। জগন্নাথ মল্লিক চিৎকার করে উঠলেন, ‘বেয়াদপ, আমাকে ভুল-ঠিক শেখাতে এসেছিস? আজ তোর ছাল আমি আজ ছাড়িয়ে নেব।’
রাগের ব্যাপারে ছাত্রও কিছু কম যায় না। ছাল ছাড়ানোর কথা শুনে নরহরির মাথাতেও রক্ত ফুটতে শুরু করল। সে জগন্নাথবাবুর সামনের টেবিলটায় সজোরে একটা কিল মেরে বলল, ‘আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন স্যার, কিন্তু একথা জেনে রাখবেন, বেঞ্চটা আমি ভাঙিনি।’
ইতিমধ্যে সেগুনকাঠের অমন শক্তপোক্ত বিশাল টেবিলটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে মেঝেতে। একটা দেশলাই বাক্সের ওপর হাতুড়ির ঘা পড়লে যেমনটা হয়, টেবিলটারও যেন সেই দশা। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে জগন্নাথ মল্লিকের মুখটা আবার বৃত্তাকার হয়ে গেল, তবে তার ব্যাস স্বাভাবিকের থেকে খানিক কম। মিনিট খানেক তিনি থ’ হয়ে বসে রইলেন। তারপর অত্যন্ত মিহি গলায় বললেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি বাবা নরহরি, তুমি আদৌ বেঞ্চটা ভাঙনি। আসলে ওকাজ তুমি করতেই পার না। আমি নিজের ভুল স্বীকার করে নিচ্ছি।’
ঘটনাটা কানে যেতেই ভজহরির তো লজ্জার শেষ নেই। উনি ছুটে গেলেন স্কুলে, হেডস্যারের কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু জগন্নাথবাবুর সেই এক কথা, ‘নরহরি কোনো দোষ করেনি, যা ভুল করেছি আমি।’ ঐ ঘটনার পর ভদ্রলোকের আরও বছর চারেক চাকরি ছিল। শোনা যায়, ঐ চার বছর জগন্নাথ মল্লিক নাকি স্কুলে আর কোনোদিন অঙ্ক করাননি। যে ক্লাসেই যেতেন, কেবল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ব্যাখ্যা করতেন।
যাইহোক, এরপর নরহরি ঐ স্কুল থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল। কিন্তু সে কলেজে ভরতি হতে চাইল না। পড়াশোনা তার আর ভালো লাগছিল না। এই অবস্থায় ভজহরি ভাবলেন ছেলেকে একটা ছোটোখাটো দোকান করে দেবেন। কিন্তু সেদিকেও নরহরির মন নেই। সে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু চেলা-চামুণ্ডা জুটিয়ে ফেলেছে। তারা নরহরিকে ‘বাহুবলী’ বলে ডাকে, খুব সমীহও করে। গ্রামের এককোণে একটা ক্লাব বানিয়ে তারা দিনরাত সেখানে আড্ডা মারে আর ফূর্তি করার বাহানা খুঁজে বেড়ায়। আজ ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন তো কাল জলসার ব্যবস্থা। গ্রামের লোক ওদের ঘাঁটাতে সাহস করে না, অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদাও দিয়ে দেয়।
ভজহরির কিন্তু ছেলের এইসব কীর্তিকলাপ একদম পছন্দ হয় না। তিনি একদিন নরহরিকে ডেকে বললেন, ‘নরু, তুই যা করছিস সেটা মোটেই ঠিক কাজ নয়। লোকে কিন্তু তোকে ভালোবেসে চাঁদা দিচ্ছে না, দিচ্ছে ভয় পেয়ে। এত তেজ ভালো নয় বাবা। এখনো সময় আছে, শুধরে যা।’
নরহরি বাবার কথা পাত্তাই দিল না। বলল, ‘তুমি চুপ কর তো। আমাকে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।’
নরহরির দেমাক আরো বেড়ে গেল গোতলপুরে যাত্রার আয়োজন করার সময়। আগে কোনোদিন ঐ এলাকায় যাত্রা হয়নি। নরহরি এক নামী যাত্রাদলের সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারা একরাতের জন্য চেয়ে বসল বিশ হাজার টাকা। অতঃপর নরহরি তার দলবল নিয়ে বের হল চাঁদা তুলতে। সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে টাকা দিয়ে দিল বটে কিন্তু পঞ্চানন পুরকাইত বেঁকে বসলেন। তিনি হাইকোর্টের নামকরা উকিল। প্রচুর উপার্জন কিন্তু বেজায় কিপটে মানুষ। গোতলপুরে কিছুদিন আগে উনি বাড়ি করেছেন। নরহরি সদলবলে চাঁদার জন্য তাঁর বাড়ি হাজির হতেই ভদ্রলোক ভীষণ চটে গেলেন। বলে বসলেন, ‘যাত্রা-ফাত্রা আমি দেখি না। তোমরা ফূর্তি করবে আর টাকা দেব আমি! মামদোবাজি নাকি? কোনো চাঁদা-ফাঁদা আমি দিতে পারব না।’
পঞ্চানন উকিলের এহেন মন্তব্যে নরহরি তো খেপে লাল। দাঁত কড়মড় করতে করতে সে উকিলবাবুকে বলল, ‘আপনার মতো হাড়-কেপ্পন, নীচমনের লোক আমি দুটো দেখিনি মশাই। আপনার কাছে চাঁদা চাইতে আসাই আমাদের ভুল হয়েছে।’
তাঁর মতো ডাকসাইটে উকিলকে কেউ অমন কথা বলতে পারে, পঞ্চানন পুরকাইত সেটা স্বপ্নেও ভাবেননি। তিনিও রেগে যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে গেলেন। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নরহরিকে বলে বসলেন, ‘তুই আমাকে এমন কথা বললি! জানিস আমি মানহানীর মামলা করে তোকে জেল খাটাতে পারি?’
কথাটা শুনে নরহরি আরো রেগে গেল। সে তেড়ে গেল পঞ্চানন উকিলের দিকে। চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আমার বিরুদ্ধে শুধু মানহানীর মামলা কেন, সঙ্গে আপনার বসতবাড়ির ভাঙার একটা মামলাও ঠুকে দিন। তাতে কেসটা জমবে ভালো।’ একথা বলেই সে উকিলবাবুর বাড়ির দেওয়ালে সজোরে মারল এক ঘুসি। পঞ্চানন পুকাইত অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর বাড়ির দশ ইঞ্চি দেওয়ালে আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি একাধিক ফাটল তৈরি হয়েছে। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারালেন। সবাই ভাবল, এ যাত্রায় আর নরহরির নিস্তার নেই। জেল, জরিমানা, কোনোটাই বোধহয় আর বাদ যাবে না।
কিন্তু মুখে-চোখে খানিক জল ছিটনোর পর উকিলবাবুর যখন চেতনা ফিরল, তখন তিনি একেবারে অন্য মানুষ। দয়ার সাগর বললেও কম বলা হয়। নরহরিকে ডেকে বললেন, ‘বাবা, যাত্রা তো খুব ভালো ব্যাপার। কিন্তু টাকা জোগাড় করার জন্য খামোখা দশজনের বাড়ি ঘুরে সময় নষ্ট করছ কেন? টাকা যা লাগবে সব আমি দেব। আমার পসার তো আর নষ্ট হয়ে যায়নি।’ এই বলে উকিলবাবু ঘর থেকে হাজার দশেক টাকা এনে নরহরির হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘এই টাকাটা আপাতত রাখ। তারপর যা লাগবে, আমার থেকে নিয়ে যেও, কেমন।’
ঘটনাটা ভজহরির কানে যেতে বেশি সময় লাগল না। আগেই বলেছি, উনি খুবই শান্তিপ্রিয় এবং সজ্জন মানুষ। নরহরিকে নিয়ে তাই ওঁর চিন্তা আরো বেড়ে গেল। ছেলেকে আবার খানিক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। নরহরি যথারীতি বাবার কথা কানে তুলল না। পঞ্চানন উকিলের দেওয়ালে চিড় ধরানোর পর সে ধরাকে সড়া জ্ঞান করতে শুরু করে দিল। যাত্রা শেষ হতে না হতেই এবার সে হুজুগ তুলল গোতলপুরে তিনদিনব্যাপী রামলীলার আয়োজন করবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। গোতলপুরের খেলার মাঠে বিরাট করে ম্যারাপ বাঁধা হলো। চারদিক থেকে চাঁদা তোলাও হলো প্রচুর। এলাকার এমএলএ সাহেবও নরহরিদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। নরহরি এবার ঠিক করল, গোতলপুরের প্রতিটা প্রান্তে লাউড স্পিকার লাগিয়ে অন্য গ্রামের লোকজনকেও তাদের অনুষ্ঠান শোনাবে, যাতে ওরা কী কাণ্ডটা করছে তা চারপাশের সবাই জানতে পারে।
গোতলপুরের পশ্চিমপ্রান্তে লোকজন বিশেষ থাকে না। ওদিকে আছে বিশাল একটা মাঠ। ঐ মাঠ পেরোলেই কিশোরগঞ্জ। তাই কিশোরগঞ্জের মানুষকে তাদের রামলীলা শোনানোর জন্য, মাঠের ধারের বিশাল জামগাছটায় দলবল নিয়ে নরহরি হাজির হল একটা চোঙা লাগাতে। এই সময়ে কোথা থেকে একটা রোগা প্যাংলা লোক এসে তাকে বলল, ‘বাবা, এখানে ঐসব চোঙা-টোঙা লাগিও না বাবা। এমনিতেই বেশি আওয়াজ আমার সহ্য হয় না, তার ওপর ঐ রাম-গান তো নয়ই।’
নরহরি বুড়োটার আপত্তি তো পাত্তা দিলই না, উল্টে খেঁকিয়ে উঠে বলল, ‘সহ্য না হলে এই কদিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকো। চোঙা আমি এই গাছেই লাগাব।’ যথারীতি চোঙা লাগিয়ে ওরা ফিরে এলো।
পরেরদিন সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়ে গেল রামলীলা। নরহরি নিজের সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে তদারক করতে লাগল গোটা অনুষ্ঠানটা। কিছুক্ষণ বাদে দলের এক ছোকরা এসে খবর দিল, কাল পশ্চিমের বিশাল জামগাছটায় যে লাউডস্পিকারটা লাগানো হয়েছিল, কে নাকি সেটা খুলে ফেলে দিয়েছে। ব্যাস, আর যায় কোথায়। খবরটা শুনেই নরহরির মাথায় রক্ত উঠে গেল। এত বড়ো সাহস! সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যে চোঙাটা লাগিয়ে এসেছে, সেটা কিনা খুলে ফেলে দিয়েছে! দেখাচ্ছি মজা। তিন-চারজন স্যাঙাত নিয়ে নরহরি ছুটল পশ্চিমের সেই জামগাছটার দিকে।
ওখানে পৌঁছে ওর মাথা আরো গরম হয়ে গেল। দেখল জামগাছটার তলায় চোঙাটা দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে, তার-টার সব ছিঁড়ে একশা। নরহরি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। তখন রাগে তার মাথার শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। এই অবস্থায় নরহরির হাত দুটো নিষপিষ করে উঠল। কিন্তু চারপাশে কাউকে না পেয়ে সে ঐ জামগাছেই কষিয়ে দিল সপাটে এক ঘুসি। সঙ্গে সঙ্গে থরথর করে কেঁপে উঠল গাছটা। বেশ ক’টা কাক কা কা করতে করতে উড়ে গেল, আর আগের দিনের সেই প্যাংলা বুড়োটা ধপাস করে পড়ল মাটিতে।
এমন একটা ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না, সকলেই বেশ ঘাবড়ে গেল। এই অবস্থায় নরহরিই প্রথম ধাতস্থ হল। সে বুড়োটাকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই লোকটা বলে উঠল, ‘তোমার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই খোকা! এভাবে কেউ গাছে ঘুসি মারে? দিলে তো আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে?’
নরহরি সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তারমানে তুমিই চোঙাটা গাছ থেকে ছুঁড়ে ফেলেছ? তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই গোটা গ্রামের লোক আমার ঘুসির কথা ভেবে ঠকঠক করে কাঁপে, আর তুমি কিনা…’
কথাটা বলতে বলতেই নরহরি লোকটার দিকে তেড়ে গেল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, ঐ বুড়ো মানুষটা কিন্তু তাতে এতটুকু ভয় পেল না। বরং সে একটু বাঁকা হেসে মন্তব্য করল, ‘তুমি তো আচ্ছা বেইমান হে, ছোকরা! যে তোমাকে বাহুবলী বানাল, তাকেই মারতে আসছ?’
একথা শুনে তো নরহরি হেসেই খুন। বলল, ‘কী বললে বুড়ো, তুমি আমাকে বাহুবলী বানিয়েছ? তা কোথায় কবে বানালে বলো দেখি? আমার শুনতে খুব ইচ্ছা করছে।’
‘ও মনে পড়ছে না বুঝি? আমি তোমাদের বাড়ির পেছনের ঐ শুকনো জামগাছটায় থাকতাম গো। রোজ দুপুরে খাওয়া সেরে তুমি আমার কাছে গল্প শুনতে আসতে। তখনই তো ভালোবেসে তোমার দুহাতে ঐ শক্তি দিয়েছিলাম। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্তু…’
‘গুলগল্প মারার আর জায়গা পাওনি। আমাকে খুব বোকা ভেবেছ তাই না? দেব এক্ষুনি এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে, তখন মিথ্যা বলা বেরিয়ে যাবে।’
নরহরি একথা বলতেই বুড়োটার গলার স্বর বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘তুমি আমার নাক ফাটাবে? দেখি তো তোমার হাত দুখানা।’ একথা বলেই বুড়ো নিজের দুহাত দিয়ে নরহরির হাত দুখানা চেপে ধরল। তৎক্ষণাৎ নরহরির মনে হলো, তার হাত দুটো যেন ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে। খানিকবাদে সে বুঝল দুহাতে তার আর আগের মতো জোর নেই। বুড়োটা এবার নরহরিকে বলল, ‘বাছা মারো দেখি গাছে আরেকটা ঘুসি, দেখি তোমার হাতে কেমন জোর।’
নরহরি তা-ই করল, আর তারপরেই হাতের যন্ত্রণায় ‘বাবাগো, মাগো’ বলে জুড়ে দিল চিৎকার। এবার ঐ বুড়ো আরেক কাণ্ড করে বসল। ঠিক যেভাবে লোকে তারের ওপর কাপড় মেলে সেভাবে নরহরির হাত দুটো ধরে তাকে টাঙিয়ে দিল জামগাছের ডালে। এই দৃশ্য দেখেই ভয়ে নরহরির চ্যালা-চামুণ্ডারা দে দৌড়। এতক্ষণে ওরা সবাই বুঝে ফেলেছে ঐ বুড়োটা আসলে একটা জ্যান্ত ভূত। সে যদি তাদের বাহুবলীকে গাছে টাঙিয়ে দিতে পারে, তাহলে ওদের কী হাল করবে, কে জানে!
সেদিন অনেক কান্নাকাটির পর নরহরি ছাড়া পেয়েছিল। আর গোটা গোতলপুর জেনে গিয়েছিল তার বাহুবল লুপ্ত হওয়ার কাহিনি। তাই ঐ দিনের পর নরহরি আর কোনোদিন ক্লাবের ধারেকাছে ঘেঁষেনি। যাত্রা-মোচ্ছব আয়োজন করার কথা মাথাতেও আনেনি। আর ভুলেও কোনোদিন যায়নি পশ্চিমের ঐ জামগাছটার দিকে। বাবার কথামতো একটা ছোটো দোকানে বসেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিল।