নগ্ন জীবন

এইতো হ্যাঁ আরেকটু ডানে, ঠিকাছে এবার সোজা হয়ে বসো, না না মাথাটা আরেকটু হেলে থাকবে ডানে।
হ্যাঁ এভাবেই বসে থাক, আর মিনিট পাঁচেক লাগবে’

স্যারের কথামতো প্রিয়ন্তীও বসে থাকলো ঘাড়টা একটু বেঁকিয়ে চোখ উপরে তুলে। চোখ পড়ে আছে দেয়ালের চিত্রকর্মটার উপর। এই তৈলচিত্রটা নিয়ে অনেক কথা শুনেছে সে এই পর্যন্ত স্যারের মুখ থেকে। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছবি। ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ‘Starry night over the Rhone’ ছবিটার দিকে তাকিয়েই থাকে প্রিয়ন্তী। কেমন জ্বলজ্বল করছে ছবির রাতের শহরটা। মনে হচ্ছে একটু একটু কেঁপেও যেন উঠছে ছবির একপাশের মানুষ দুটো। আচ্ছা ওরা এভাবে উঠে আসছে কোথায়? পিছনে এমন শান্ত শহর ফেলে?

প্রিয়ন্তীর হঠাৎ ইচ্ছে হয় সে ছবি হয়ে যাক। কোনো এক নিঃসঙ্গ মানুষের শোবার ঘরের ওয়ালমেটে ছবি হয়ে স্থির হয়ে যাক সে। ভ্যান গগের ছবিটির মত সেও সেই ছবিতে এমন পিছনে ফেলে আসতে চাইবে এই রাতের শহরকে, এক নিষিদ্ধ রাতের শহর।

পা’টা ব্যথা করতে থাকে। প্রিয়ন্তী ঘড়ির দিকে তাকায়, খেয়াল হয় গত দশ মিনিট ধরে সে এভাবে পা’টা উঁচিয়ে রেখে বসে আছে, কর্ণারে রাখা স্টিলটাতে একটুখানি ভর দিয়ে। পা’টা অবশ হয়ে আছে কেমন।
একটু করে আড়চোখে তাকায় ক্যানভাস সামনে রেখে গভীর মনোযোগে এঁকে যাচ্ছে যে মানুষটি তার দিকে।

প্রিয়ন্তীর ইচ্ছে হয় তাকে একটু ডেকে বলুক ‘স্যার দশ মিনিটের উপরে তো হয়ে এলো’ প্রিয়ন্তীর স্বগতোক্তি যেন শুনতে পেয়েই লোকটা তেমন ভঙ্গি করে বলে ‘কি হে কষ্ট হচ্ছে বেশি? এইতো এইতো আরেকটু’

বলেই আবার গভীর মনোযোগে আঁচড় কাটতে থাকে ক্যানভাসে। কাঁচাপাকা গোঁফ মানুষটার, সরু নাকের আগায় এসে চশমাটা আটকে আছে, নাকটার মত মানুষটার নামটাও কেমন যেন সরু সরু লাগে প্রিয়ন্তীর, শিশির আহমেদ, কেমন সরু প্রকৃতির নাম। চশমাপরা আর্টিস্ট খুব কম দেখেছে প্রিয়ন্তী। শিশির আহমেদ মধ্যবয়সের দোরগোড়ায়। মাথা ভরতি এখনো ঝাঁকড়া চুল। চোখের মধ্যে অন্যরকম আভা খেলা করে সবটাসময়। আর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। এই হাসিটাকে খুব ভয় করে প্রিয়ন্তী। গত একটা বছর ধরেই ভয় করে আসছে।
‘হ্যাঁ হয়ে গেছে, ড্রেসটা এবার পড়তে পারো। আর বোসো একটু, আমি কফি নিয়ে আসি’

শিশিরের কথা শুনে দ্রুতই হাত চালিয়ে ব্লাউজের উপর শাড়িটা জড়িয়ে নেয় প্রিয়ন্তী, মুখ ফুটে বলেই ফেলে ‘আজ যাই না? এমনিতেই দেরি হয়ে গেলো। মা অপেক্ষায় থাকবে’

শিশির আহমেদের ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা চিরাচরিত হাসিটা বিস্তৃত হয়। কাছে এগিয়ে এসে প্রিয়ন্তীর শাড়ির আঁচলটা পেঁচিয়ে ধরে বলে ‘খুব তাড়া? আমাকে একটু সময় দেওয়া উচিত না?’
কাঁচুমাচু করে প্রিয়ন্তী

– ‘স্যার আমি আজ যাই, দেরি হয়ে গেলো’
পা চালিয়ে দ্রুত বের হয়ে যায় প্রিয়ন্তী, দরজাটা খট করা শব্দে বন্ধ হয়।
শিশির আহমেদ তাকিয়ে থাকে দরজাটার দিকে। তার মুখে হাসিটা এখনো লেগে আছে।
‘বলি এত রাত করে যে ফেরো, তোমার বাচ্চা দুটোকে আমি তো আর সামলিয়ে পারি না বাপু!’
– ‘ মা আমি তো আর ওখানে ফুর্তি করতে বসে থাকি না, কাজ পড়ে গেলে আমিই বা কি করি!’

উলটো রাগ দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো প্রিয়ন্তী। বাচ্চা দুটো ঘুমিয়ে গেছে। বড় ছেলেটা রাফি, ষষ্ঠ শ্রেণীতে এবার। ছোটোটা নাফি, গেলো মাসে চার বছরে পা রাখলো। প্রিয়ন্তী খাটে এসে বসে, এগিয়ে গিয়ে চুমো খায় দু’ছেলের কপালে। কেমন স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে ঘুমন্ত ছেলে দুটোর মুখে। প্রিয়ন্তী তাকিয়ে থাকে। আজকাল কাজের চাপে ফুরসত পাওয়া হয় না তার। বাচ্চা দুটো কাকের ছানার মত হা করে থাকে মা কখন আসবে। মা আসে না, মায়ের হাতে তোলা খাবার পেটে পরে না। হা করে চেয়ে চেয়েই ঘুমিয়ে যেতে হয়। ঘুমিয়ে ওরা স্বপ্ন দেখে কোনো? ভাবে প্রিয়ন্তী।

বড় ছেলেটার স্কুল ফি, টিউশন ফি মাস শেষে বেড়েই যাচ্ছে। হারামজাদা সব স্কুলেই এক দশা। প্রিয়ন্তীর কপালে ঘাম হয়। মায়ের পা’টা এখনো সারে নি। একটু আগেই তো দেখলো পা’টা কেমন টেনে টেনে হাঁটছে। ক’দিন আগে বিকালে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো প্রিয়ন্তীর। শিশির আহমেদের কিছু সরঞ্জাম কিনতে যেতে হয়েছিলো নিউমার্কেটে। ১ নং গেইট দিয়ে মডার্ণে ঢুকে কিনেছিলো কিছু কার্টিজ পেপার, চার্ট পেপার আর রঙ, তুলি। আজকাল তেল কিংবা এনামেল রঙ ছেড়ে পোস্টার রঙ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে শিশিরকে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ইসহাক রনির নতুন ছবি ‘ভোগ’ এর ফিচার ফটোটা সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব পেয়েছে সে। এই সবটা খবরই রাখতে হয় প্রিয়ন্তীকে। এগুলো কেনাকাটা করতেই দেরি হয়ে গিয়েছিলো সেদিন।

বাড়ি ফিরে দেখেছিলো ঘরের ভেতরের আবহাওয়া থমথমে। আশেপাশে কাউকে না দেখে মায়ের ঘরে ঢুকে দেখে পায়ে জলপট্টি বাঁধা। রাফি নানুর পাশে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বসে আছে, নাফি তাকিয়ে আছে টিভির স্ক্রিনে। কার্টুন চলছে, পপাই চুরুট মুখে দিয়ে মাসল ফুলাচ্ছে, এতটুকুতেই ছেলেটা হেসে কুটিকুটি। প্রিয়ন্তী মায়ের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, রাফির দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ছোট্ট করে, ‘কিভাবে?’ ছাদ থেকে পানি আনতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে নানু কিভাবে পা ভেঙ্গেছে গড়গড় করে বলে যায় রাফি। প্রিয়ন্তী মায়ের মুখের দিকে তাকায়। ঝিম ধরে থেকে মানুষটা কোঁকাচ্ছে, পায়ের ব্যথায় মুখটাও কেমন নীল দেখাচ্ছে।

ডাক্তারকে কল দিয়ে সেদিন আনিয়েছিলো প্রিয়ন্তী। ডাক্তার বলেছে বোন ফ্রাকচার, হাসপাতালে ভর্তি করানো ছাড়া উপায় নেই। দ্রুত নিতে হবে, পারলে রাত পোহানোর সাথে সাথেই। ভ্যানিটিব্যাগ ঘেঁটেঘুটে সেদিন ভিজিটের টাকাটা দিয়ে বিদায় করতে পেরেছিলো ডাক্তারকে প্রিয়ন্তী। কিন্তু ঔষধের টাকা আর হয় না, হাসপাতালে ভর্তির টাকা তো না ই। পায়ের ব্যথায় সারারাত গোঙ্গানি ছিলো মায়ের, চোখমুখ লাল করে প্রিয়ন্তী শুনেছে।

প্রিয়ন্তী সে রাতেই কল করে জানিয়েছিলো শিশির আহমেদকে, সে রাজি, এবার পুরোপুরি নগ্ন হয়েই বসতে রাজি তার ক্যানভাসের সামনে।

প্রিয়ন্তী রূপবতী। রূপবতী বলতে হলে যা থাকা লাগে প্রিয়ন্তীর সে সবই আছে। ছিপছিপে গড়নের গৌরবর্ণা মেয়ে, চোখের পাপড়িতে যেন দিগন্তরেখার হাতছানি। নিটোল গাল দুটোতেও উপচে পড়া মায়া।

বছর দুয়েক আগে এই মায়াবতীর বাবা মরলো তিনবারের মাথায় স্ট্রোক করে। বাবার মৃত্যুর ছ’মাসের মাথায় গেল স্বামী। অভাগা মানুষটি কিনা ঐ একটা দিনই কেবল ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেনি। তাড়া ছিলো, মাসখানেক বাদে স্ত্রী সন্তানের মুখ দেখবার তাড়া।
মাথার উপরের ছায়া হারিয়ে প্রিয়ন্তী তখন নির্বাক প্রায়। ছেলে দুটোর মুখের দিকে তাকালেই আঁচল চাপা কান্না ঝড়তো। একা মাকে নিয়ে এলো নিজের বাসায়।

সংসার যুদ্ধে তখনো অনভিজ্ঞ মেয়েটি সার্টিফিকেটের ফাইল হাতে নিয়ে ঘুরেছে এখানে সেখানে। না, কোথাও হয়নি। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া তাকে কাজে নিতে রাজি হয়নি কোনো মালিকপক্ষই। সে সময়টাতেই এক বান্ধবীর মাধ্যমে জানতে পারে শিশির আহমেদের কথা। নিজের কাজে সহায়তার জন্য মেয়ে খুঁজছেন। শর্ত একটাই, মেয়ে রূপসী হতে হবে। রূপ খুঁজে পেলে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় কিনা তৈরি হয় অভিনব সৃজনশীল সব। প্রিয়ন্তীর রূপ ছিলো, চোখে পড়ার মতই রূপ। বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেলো। কাজ শুরু হলো শিশির আহমেদের স্টুডিওতে। প্রথম ক’মাস নির্ঝঞ্ঝাটেই গেলো সব। শিশির আহমেদের এক্সিবিসনের শিডিউল, এপয়ন্টমেন্ট, ইমেইল আর সরঞ্জামাদি কেনাকাটা, তদারকি এগুলো গুছিয়ে রাখাই ছিলো প্রিয়ন্তীর কাজ।
শিশির আহমেদের মুচকি হাসিটা তখনো ভালো না লাগলেও মুখ ফুটে কিছু বলার বা করার ছিলো না প্রিয়ন্তীর। এই চাকরিটা তার খুব দরকারি। বাসায় তার মা, দুটো ছেলে, তাদের ভরণপোষণ, বাসা ভাড়া সবকিছুই সামলাতে হচ্ছিলো তাকে একা দুটি হাতে।
শিশির আহমেদ একদিন প্রিয়ন্তীর রূপের প্রশংসা করে বসলো মোহনীয় ভঙ্গিতে। আনমনেই হয়তো সেদিন লজ্জায় হেসেছিলো প্রিয়ন্তী। শিশির আহমেদ আটকিয়েছে সেই লজ্জায়। নিজের লজ্জামাখা মুখই কাল হয়ে দাঁড়ালো প্রিয়ন্তীর।

সেদিন থেকেই নানাভাবে প্রিয়ন্তীকে নিজের মত করে পেতে চেয়েছে শিশির। মধ্যবয়েসি শরীরে স্বাদ জেগেছে, মন তো এখনো তরুণ। অথবা সদ্য মেলা দুটি কচি পাতার মতই সতেজ। শিল্পীর মন বুড়ো হয় না কখনো, হয়তবা কখনোই না।
কিন্তু কখনোই আক্রমণ করে বসার ধার ধারেনি শিশির আহমেদ। শিল্পীমন কুৎসিত হলে হতেও পারে, কিন্তু ব্যক্তিত্বের ছিটেফোঁটা থাকলেও তা প্রবল। এমনটাই ভাবে শিশির। প্রিয়ন্তীও নানাভাবে এড়িয়ে গিয়েছে শিশিরের কুৎসিত চোখ। আজ না কাল করে করে সে ছাড়তে পারেনি চাকরিটা। শিশির আহমেদের রকমসকমের প্রস্তাবগুলো পাশ কেটেছে দাঁতে দাঁত চেপে। এতদিন এভাবে এড়িয়ে গেলেও আর পারেনি মায়ের কথা ভেবে। পায়ের অপারেশনে লাগবে মোটা অংকের টাকা। তাই প্রিয়ন্তী শিশির আহমেদকে আঁকতে দিয়েছে নিজের ন্যুড পেইন্টিং। বিনিময়ে পেয়ে যাচ্ছে চাহিদানুযায়ী টাকা।

নিত্যদিনের মতো আজও রাফিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে প্রিয়ন্তী চলে আসে নিজের কাজে। স্টুডিওতে ঢুকেই দেখে হুলস্থুল কাণ্ড। সব সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। রুমের এককোণে চোখ যায় প্রিয়ন্তীর। শিশির আহমেদ ইজি চেয়ারটাতে বসে তাকিয়ে আছেন তার দিকেই। মুখে আজ মৃদু হাসিটা নেই। তার বদলে চোখগুলো টকটকে লাল। প্রিয়ন্তী কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে উঠলেন
– ‘১৬ নাম্বার সাইজের একটা তুলিও খুঁজে পেলাম না, তুমি কি জানো কোথায় আছে?’
কর্ণারের একটা ড্রয়ার থেকে তুলির প্যাকেটটা চুপচাপ বের করে দিলো প্রিয়ন্তী। পরক্ষণেই প্রশ্ন করলো
– ‘কোনো কারণে আপনার কি মন খারাপ? একটু কেমন যেন দেখাচ্ছে’
প্রিয়ন্তীর কথা শুনে শিশিরের ক্রোধ যেন ফেঁটে পড়তে চায়। ভারী কণ্ঠস্বর চেঁচিয়ে উঠে তার,
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমার খুব মন খারাপ! প্রিয়ন্তী প্রিয়ন্তী এদিকে, এদিকে আসো তুমি। দেখো, একটু দেখো ছবিটা!
বলতে বলতে হেঁচকা টানে প্রিয়ন্তীকে বড় ক্যানভাসটার পাশে নিয়ে আসে শিশির। দ্বিধাগ্রস্ত আর ভয়ার্ত চোখ নিয়ে ক্যানভাসটার দিকে তাকায় প্রিয়ন্তী। তাতে তার নিজেরই অবয়ব, একটা নগ্ন প্রিয়ন্তীর মূর্তি। কিন্তু কি মোহনীয় একটা ছবি এঁকেছে শিশির আহমেদ। তার পাকা হাতের কাজে আরো একবার বিস্ময়াভিভূত হলো প্রিয়ন্তী নিজেই।
শিশির আহমেদের যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হিতাহিত বোধ বলেও কিছু থাকছে না আর, নেশাগ্রস্থ লাগছে নিজেকে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণে খুব পারদর্শী সে, তবুও আজ যেন এই নেশা আর কাটানো যায় না। প্রিয়ন্তীকে এত কাছে পেয়েও আজ সে আর পারে না।
প্রিয়ন্তীর দুই হাত নিজের হাতে মুঠো করে কাঁপা কন্ঠে শিশির বলতে লাগলো,
– ‘প্রিয়ন্তী, প্রিয়ন্তী শুনো, তুমি আমার দেবী, তোমার মাঝে আমি আমার শিল্পের দেবীকে দেখেছি। বিশ্বাস করো প্রিয়ন্তী আমি এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারিনি কাল রাতে। তোমার এই দেবী রূপে থেকে থেকে ঝলসে গেছি সারাটা রাত।’
প্রিয়ন্তীর চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে টপটপ। মাথা নিচু করে ক্ষীণ কন্ঠে বলে,
– মায়ের জন্য এখনো আরো টাকা লাগবে অনেক।
– প্রিয়ন্তী আমি রাজি
– রাফির তিনমাসের স্কুল ফি আটকে আছে।
– হ্যাঁ, আমি রাজি
প্রিয়ন্তী এবার মাথা তুলে তাকায় শিশিরের দিকে। একদম চোখের দিকে তাকায় সরাসরি। দৃঢ় কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
– নাফিকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে হবে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ প্রিয়ন্তী হবে, সব হবে, সব।

বিকেল ৫ টার দিকেই বেরিয়ে পড়ে প্রিয়ন্তী। মনটা ফুরফুরে তার। যত পাপ, যত অনিষ্ট, যত দুঃখ সব নাহয় তালা দিয়েই আসলো শিশিরের ঐ রুমে। তার ব্যাগে এখন ক্যাশ টাকা আছে অনেকগুলো এটাতেই তার প্রশান্তি। মায়ের চিকিৎসা, রাফি নাফির ইচ্ছাপূরণ, সব হয়ে যাবে এখন।
বাসায় হেঁটে পৌঁছুতে আর সাত আট মিনিটের মত বাকি। রাস্তায় হাওয়াই মিঠাইওয়ালা দেখে হাঁক দেয় সে,
– এই ছেলে এদিকে আসো! হ্যাঁ, আমাকে দাও তো চারটা।
খুশিখুশি চেহারা নিয়ে হাওয়াই মিঠাইয়ের দিকে চেয়ে থাকে প্রিয়ন্তী। কতদিন হয়ে গেলো এমন সাধ করে কিছু কিনেনি। তার প্রিয় হাওয়াই মিঠাই কিনেনি। রাফি নাফির চেহারা চোখে ভাসে তার, দুজনকে দুটো মিঠাই ধরিয়ে জানতে চাইবে,
‘আম্মু আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি, তাই না বাবুরা?

নানুর পায়ের ব্যথা বেড়েছে হঠাৎ। বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে নানু। রাফি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। নানুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কি করা উচিত! তড়িঘড়ি করে নানুর ফোন থেকে মাকে কল দেয় রাফি। ফোন সুইচড অফ। রাফির অস্থিরতা বাড়ে। মাকে যে করেই হোক জানাতেই হবে, আজ যেন ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসে। নানুর খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথায় বুদ্ধি আসে। আম্মুর বড় ব্যাগটা ঘেটে দেখলে পারে, ওখানে তো আম্মুর স্যারের নাম্বার থাকার কথা। রাফি দরকার হয় শিশির আহমেদকে কল করে বলবে আম্মুকে যেন আজ তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়, নানু অসুস্থ। আলমারিটা খুলে ব্যাগ ঘাটে রাফি। একটা না একটা ভিজিটিং কার্ড তো থাকারই কথা। একটা খাম পায় রাফি। তড়িঘড়ি করে খুলে ফেলে। তিনটা ছবি খামটায়। রাফি প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না ছবিগুলোতে কি আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। চোখ সরিয়ে নেয়। খামচে ধরে থাকে ছবিগুলো। আম্মু ওখানে কি চাকরি করে? সে এমন কাপড়চোপড় খুলে বসে আছে কেন? ঐ লোকটা আম্মুর এমন ছবি কেন আঁকছে! আমার আম্মু কি ভালো আম্মু না? উহ! রাফি কঁকিয়ে উঠে। ছোট্ট বুকে ঘূর্ণি উঠে অজানা ক্রোধে। তার মাকে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষ হিসেবে জানে। কিন্তু আজ এই মানুষটাকে সে আর মা বলে ডাকবে কিভাবে? কিভাবে?

প্রিয়ন্তীর কি আর কখনো রাফিকে বলা হবে কেন তার মা এমন করেছে? কাকে আর বলবে ড্রয়ারে রাখা ছবিগুলো কিভাবে এসেছে ব্যাগে? সেদিন প্রিয়ন্তী শিশিরের ঘরের ড্রয়ার যদি না খুলতো সে কি বুঝতে পারতো কুচক্রী শিশির কোন মতলবে তুলে রেখে দিয়েছে ছবিগুলো! বুদ্ধিমতী প্রিয়ন্তী তো সেজন্যেই শিশির আহমেদের অজান্তে সরিয়ে ফেলেছিলো ছবিগুলো আর রেখে দিয়েছে নিজের ব্যাগে।
কাকে বলবে সে সবটা, কাকে জানাবে সে?

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত