জন্মের মাত্র নয়দিন পর থেকে মায়ের কোলে আর আমার জায়গা হয়নি। বাবা মা মনে হয় চায়নি আমি অসময়ে দুনিয়াতে আসি। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই এই দুনিয়ায় আমার আগমন। অসময়ে বলার কারণ হল, আমার ভাইয়ের জন্মের চৌদ্দ মাস পর আমার আগমন। আমার ভাই ছিল তখন রোগাক্রান্ত। এই বাঁচে তো ঐ মরে যায়। সেই সময়ে আমার আগমনটা অবশ্যই বিরক্তিকর। মা আমাকে দেখবে নাকি রোগাক্রান্ত ভাইকে দেখবে? সেজন্য এদিক সেদিক
খোঁজ নিচ্ছিল কারো বাচ্চা লাগবে নাকি? আমাকে দিয়ে দিবে।
পুরো ঘটনাই বড় হয়ে আমি আমার দাদীর কাছে জানতে পারি।
আমার দাদীর সন্তান শুধু আমার বাবা। দাদা দাদী চুয়াডাঙ্গা থাকেন আর বাবা থাকেন খুলনায়। দাদী যখন জানতে পারে আমাকে দিয়ে দেবার জন্য মানুষ খুঁজতেছে তখন দাদী বলেন মেঘলা’কে আমি নিয়ে যাব। আমি লালন পালন করব।
মাত্র নয়দিন বয়সে মায়ের কোল ছেঁড়ে আমার ঠিকানা হয় দাদীর কোলে।
দাদা দাদী আমাকে ভালোবাসার অভাব দেয়নি। তাদের ঋন আমি কোনদিন শোধ করতে পারবনা। বাবা মায়ের অভাব বুঝতে পারি স্কুলে ভর্তি হবার পর। সবার বাবা মা কোলে করে, হাতের আঙ্গুল ধরে স্কুলে নিয়ে যায়। কোলে বসিয়ে খাবার খাওয়ায়। আর আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম। তখন বাবা মায়ের অভাব আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। সাথের ছেলে মেয়েরা তাদের বাবা মায়ের গল্প বলত। বাবা মা’কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাইতো। আর আমি ঘুমাইতাম আমার দাদীকে জড়িয়ে ধরে। দাদীই আমাকে গল্প শুনাতো, চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিত।
২০০৭ সালে আমার দাদার কেন্সার ধরা পড়ে। এর দুই মাস পরই দাদা মারা যায়। আমারতো আর কাকা, ফুফু কেউ নেই। তাই আমার এসএসসি পরীক্ষারর পর দাদী বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিল আমাকে। সম্পূর্ণ অচেনা, অপরিচিত একটি জায়গা। যে খুলনার নয়দিন অতিথী ছিলাম আমি।
খুলনার কলেজে ভর্তি হলাম। মনমরা থাকতে হত সারাদিন। বাবা মা আমার সাথে কেমন যেন ব্যবহার করত। মাঝে মধ্যে মনে হত বাবা মা মনে হয় এমনই। যেহেতু আমি ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের কাছে ছিলামনা তাই বুঝতে পারছিনা। কিন্তু আমার কাছে ভালো লাগতনা। কোন আদর নেই, মমতা নেই। দায়সাড়া কথা বার্তা আর বিরক্তিকর অনিচ্ছাকৃত চলাফেলা দিয়ে কীকরে আমাকে আপন করে নিবে? রাত হলেই আমি দাদীর জন্য কান্না করতাম। অন্তত দাদীকে জড়িয়ে ধরে রাজ্যের ঘুম নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে পারতাম।
২০১২ সালে আমার মায়ের বড় একটি অপারেশন হয়। হাসপাতালে দীর্ঘদিন ছিলেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের ব্যবহার সম্পূর্ণ বদলে গেল। আমাকে আপনের চেয়েও বেশি আপন ভাবতে শুরু করল। অনেক ভালোবাসত। এই প্রথম মনে হয় মা তার হারানো সন্তানকে খুঁজে পেয়েছে। একদিন মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু আমার কাছে ভালো লাগেনি। নয়দিন তার কোলে আমার জায়গা হয়েছিল। সে এত বছর পর আমাকে বুকে টানে। আমার ভালো লাগেনি, একটুও ভালো লাগেনি।
২০১৪ সালে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। স্বামী অনেক ভালো, তাকে নিয়ে গর্ব করা যায়। কিন্তু শ্বাশুড়ী আর ননদ আমাকে দেখতেই পারতনা। শত শত অভিযোগ তৈরী করত তারা আমার নামে। ননদ শ্বাশুড়ীকে শিখাত, আর শ্বাশুড়ী তেমন করেই সংসার চালাত। আমার স্বামী আমাকে বুঝাতেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার সন্তান হয়না বলে শ্বাশুড়ী প্রতিনিয়ত কথা শুনাতেন। আমি রাতদিন কান্না করে আল্লাহর কাছে সন্তান চাইতাম। আল্লাহ আমার ডাক কবুলও করেছেন।
হাসপাতালে যখন আমার ছেলে সন্তান হল তখন আমার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। আমার স্বামী আর আমার বাবা মা প্রচন্ড ভয় পেলেন আমাকে নিয়ে। এই বাঁচি তো ঐ মরে যাই। অথচ আমার শ্বাশুড়ী আর ননদ একটিবার আমাকে হাসপাতালে দেখতে যায়নি। শ্বশুর গিয়েছেন আমাকে দেখতে। আমার স্বামী সার্বক্ষনিক আমার পাশে থাকত বলেই আমি সব কষ্ট ভুলে থাকতে পারতাম।
সন্তান হবার পর বাবা মায়ের কাছে ছিলাম। আমার স্বামীই থাকতে বলেছে। কারণ সে তো জানত তার মা কেমন। কিন্তু আমার সে গর্ভধারিণী মায়ের ব্যবহার আবার পাল্টাতে শুরু করল। মায়ের অপারেশনের পর কিছুদিন কত ভালোবাসত আমাকে।
আমার স্বামী আমার সকল ভরন পোষনের খরচ বহন করে। তবুও আমাকে আমার মা বোঝা মনে করে। পৃথিবীর মা গুলোতো এমন হয়না। মায়ের আদর না পেলেও আশে পাশে তো দেখি, লেখাপড়াতো করেছি। বাবা মায়ের
ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত সেটাতো বুঝি অন্তত। নিজের মায়ের ব্যবহার এমন, শ্বাশুড়ী মায়ের আচরণও এমন। এই জীবনে আমার আর মায়ের আদর ভালোবাসা পাওয়া হল না।
আমার শ্বশুর এসে আমাকে বাবার বাড়ি থেকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেলেন। আমার শ্বাশুড়ী চায়না আমি বাবার বাড়ি যাই। আমি বাবা বাড়ি গেলে সংসারের এত কাজ করবে কে? বাবার বাড়ি গেলেওতো বোঝা ভাবে। তাই আর তেমন একটা যাইনা। আমার জানা হয়ে গেছে, এই জনমে আর আমার মায়ের আদর ভালোবাসা পাওয়া হবেনা।
তবে আমি আমার ছেলেকে আপ্রাণ চেষ্টা করি আদরে রাখতে। আমি জানি বাবা মায়ের আদর না পেলে কেমন লাগে। আমার ছেলের আদর ভালোবাসার অভাব যেন না থাকে। “একদিন অন্তত আমার ছেলে বলবে, ‘আমার মা আমাকে ভোলবাসত।’ কিন্তু আমি কোনদিন বলতে পারিনি।