মনে পড়ে, সেই প্রথম দিনের কথা। এই মুচকি হাসি দেখে আমি হারিয়েছিলাম প্রেমের নদে। সেই নদের ভরা পানিতে লুটোপুটি খেতে খেতে তোমাকেও সেই ভরা জলে নামিয়ে নিলাম। আমি তোমার হাসিতে না হয় ফেসেছিলাম আর তুমি? তুমি ফেসেছিলে আমার চঞ্চলতায়। তোমার মন খারাপের দিন মুহূর্তেই তোমার মন ঠিক করে দিতে পারতাম। শুধু “বন্ধু” সম্পর্কিত কেউ কি এটা পারে? — না, পারে না। যখন বুঝতে পারলে তখন? তখন তুমি আমার প্রিয়া, আর আমি তোমার প্রিয়।
মনে পড়ে, প্রথম তোমায় যেদিন বলেছিলাম আমার ভালবাসার কথা? চুপটি করে তুমি নত মাথায় মুচকি হেসে শুনছিলে। তোমার ভাষা বুঝি সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলো। কি করে উত্তর দিবে সে কথা গুছিয়ে উঠতে পারোনি। ইতস্ত হয়ে বলেই দিলে শেষে। সেই মুখের কথায় বিশ্বাসের সুতো দিয়ে বেধে রেখেছিলাম— তোমার, আমার আর আমাদের “ভালবাসা”।
মনে পড়ে প্রথম তোমার কুসুমকোমল ছোট্ট হাতটি ধরার কথা। অনেক ভয়ে ছিলাম; হাতের তালু ঘেমে তেলে গেছিলো। টিস্যু দিয়ে হাতটা আবার মুছে, সাপের মতো ছোবল গতিত তোমার হাতটা ধরেই ফেললাম। আর তুমি প্রথম ভয় আর চমকের বিস্মৃতি কাটিয়ে উঠে মুচকি হেসে উঠলে। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে মুখটি ঘুরিয়ে আমিও আনন্দের হাসিতে ফেঁটে পড়লাম।
সেই কথা মনে পড়ে, রিক্সায় হুড তুলে দুজন বসে নতুন শহর ঘুরে বেড়ানো। মনে পরে, তুমি শূন্য আকাশের নিচে চুল খুলে হাত দুটো উচিয়ে চোখের পাতা দিয়ে চোখটি ঢেকে অনুভব করতে প্রকৃতি। আর আমি দাড়িয়ে দেখতাম তোমার এলোমেলো চুলের চপল দোলা।
মনে পরে, প্রথম চাকুরী হওয়ার পর তোমায় জানাতে এসছিলাম। তুমি আমার সেই প্রিয় জবা ফুলটি আমায় উপহার দিলে। আর আমি দিয়েছিলাম তোমার প্রিয় সেই দশ টাকার চকলেট।
মনে পড়ে, আমাদের বিয়ের মুহূর্তগুলো। তোমায় আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসার পর। তুমি সে যে লজ্জায় পদ্ম ফুলের মতো ফুলে ছিলে। এক ছাঁদের নিচে বাসর সাজানো বিছানায় শুধু দুইজনের ঠাই হয়েছিলো— “তুমি আর আমি”। আমিও যে কি লজ্জায় পড়েছিলাম। কি করবো বুঝতে পারিনি। এভবেই আমাদের ছোট ব্যাথা সুখ দুজন দুজনার করে নিলাম। রোজ তোমার বাকা ছোট ঠোটে মিশে থাকতাম, থাকতাম তোমার দীর্ঘ চুলে মিশে। তোমার দেহের ঘ্রাণ আমার নাকে লেগে থাকতো। তোমার নেশায় পড়ে পেশার প্রতিই মনোযোগ কমে গিয়েছিলো। বড্ড সংসারী হয়েছিলাম। তুমিও আমার বাবা-মা’র আদুরে হয়ে উঠলে। আমরা বেষ্ট ফ্রেন্ডের মতো খুনসুটি আর দুষ্টুমিতে স্বামী স্ত্রী মেতে থাকতাম।
মনে পড়ে, প্রথম যখন আমাদের দুলাল তোমার কোলে এলো। তুমি যেনো আত্মহারা; যেন পেয়েছো খুজে চাঁদকে তোমার কোলে। আমার মুখ কেউ কি আর দেখেছিলো! “বাবা হয়েছি”– এলাকাজুড়ে উৎসবে বলে বেড়িয়েছি। তুমি সারাদিন ইমুকে কোলে নিয়ে চেয়ে থাকতে। সেই ছোট্ট ইমু তার মা’র মুখে যেন দেখেছিলো চাঁদের হাসি। “ইমু”কে কোলে নিয়ে আমি তাকে শিখাতাম। বলো— বাবা — বলো।
মনে পড়ে, প্রথম যেদিন আমাদের ইমু কথা বলে। সেদিন বাবা নয় “মা” নামটিই আগে বলেছিলো। তোমার চোখে আনন্দে পানি এসে পড়েছিলো। আর আমি ইমুকে জরিয়ে ধরে আদর করা শুরু করি। এভাবেই এক সন্তান আর আমরা দুই মিলে সংসারে ব্রত ছিলাম।
মনে পড়ে, আমাদের দুলালাটি অনেক বড় হয়ে আমাদের মুখ খানা উজ্জ্বল করেছিলো। এভাবে তার জীবনও চলতে শুরু করে নতুন গতিতে। আর আমরা যৌবন হারিয়ে পৌঢ়ত্বে। সব কেমন আবার অগোছালো হতে থাকে। তুমি প্রায় তখন আমার সাথে কম কথা বলতে। কখনো বুঝতেই পারিনি, তোমার মরণদশা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো।
মনে পড়তেই বুকের ভিতরটা গভীর শোকে নাড়া দিয়ে উঠে। সেদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি তুমি ঘুমিয়ে। বুঝতে পারিনি তুমি সত্যিই চিরনিদ্রায় চলে গেছো। যখন বুঝলাম তখন, আমার বাকরুদ্ধ হয়ে শরীর কাঁপতে শুরু করে।
দুইচোখ বেয়ে ঝরনার মতো অশ্রু প্রবাহ হতে শুরু করোছিলো। আমাদের ইমু আমাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। আমাদের বৌমা এসে আমার আর তোমার আদুরে দুলালের কান্না থামতে ব্যস্ত ছিলো।
এমন নিঃসঙ্গ জীবনের প্রত্যাশা কখনো করিনি। আজ হারিয়ে গেলে তুমি। হারিয়ে গেলো জীবনের সুখ, হারিয়ে গেলো জীবনের মায়া, হারিয়ে গেলো আর ক-দিন বাঁচার আশা। হয়তো এই ডাইরিটা লিখা শেষে আমিও যাবো হারিয়ে। ডাইরিটা পড়ে থাকবে অতীতস্মৃতির সাক্ষী হয়ে।