এভাবে নিজের বিপদ ডেকে আনাটা বোধহয় ঠিক হলো না কলির। নাহলে এই অন্ধকার রাতে কেউ এ পথে আসে! কিন্তু কিবা করবে ও, ট্যাক্সিটা এমন জায়গায় খারাপ হয়ে নামালো ওকে, যে এই পথই ধরতে হলো ওকে। নয়তো ঘোরা পথে বাড়ি পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে ওর। আর ফেরার মতো কোনো গাড়িও পাবে না এখন। এমনিতেই এদিকে ট্যাক্সিগুলো আসতে চায় না। অনেক কষ্টে এই ট্যাক্সিটাকে রাজি করিয়ে ছিল কলি, কিন্তু সেও খারাপ হয়ে গেল। একে তো অফিস থেকে বেরোতে দেরি হলো, তার উপরে আবার এইসব। তাই অগত্যা এই প্রায় অন্ধকার পথ বেছে নিলো কলি। কিছুটা হাঁটার পরই একটা অজানা ভয় যেন জড়িয়ে ধরলো কলিকে। আর কিছুটা পথ গেলেই ওই জানোয়ারগুলোর আঁতুড়ঘর, একটা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি। ওখানেই ঠেক ওদের। ওই বাড়িটাকে এড়িয়ে যাওয়াই সবচেয়ে কঠিন। ওরা কাউকে একা পেলেই ছিনতাই করে। আর একলা পাওয়া মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করতেও ওদের বাঁধে না। কলির বুকে একটা আতঙ্ক জমাট বাঁধতে লাগলো। এরই মধ্যে জনশূন্য এই শুনশান রাস্তায় হঠাৎ আরো একজোড়া পায়ের শব্দ পেয়ে প্রচণ্ড উদ্বিগ্নতায় পিছনে তাকালো কলি। দেখলো অল্পবয়সি ফ্রক পড়া একটা মেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা সামনে এসে বললো,
— তুমি কলিদি না ?
কলি ওকে চিনতে না পেরে বললো,
— তুই আমায় চিনিস?
বছর পনেরোর মেয়েটা বললো,
— চিনি বৈকি,আমি শ্যামলী। তোমাদের বাড়িতে যে কমলা পিসি কাজ করে আমি ওর দুটো বাড়ি পাশেই থাকি, ওই একই বস্তিতে। তোমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে কতবার গেছি! তখন তোমায় দেখেছি।
— তা তুই এখানে কি করছিস এখন?
— শম্পা বৌদিদের বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরছি।
— এই রাস্তা দিয়ে ফিরতে ভয় লাগেনা তোর?
— কিসের ভয়গো দিদি! আমার কোন ভয়ডর নেই। আমি তো প্রায় রোজ ফিরি এই পথ দিয়ে।
— কেন তুই জানিসনা এই রাস্তায়…
— ও বুঝেছি ওই ছেলেগুলোর কথা বলছো? ধুর, ওদের আবার কেউ ভয় করে নাকি? আচ্ছা,তুমি চলো আমার সাথে ওদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় সে আমার জানা আছে। আসলে আমরা বস্তির জল হাওয়ায় বড় হই তো, তাই আমাদের সাহসটা একটু বেশিই হয়। আর তাছাড়া আমি ওদের এমন একটা গোপন কথা জানি, যে ওরা… থাক সে কথা।
কলি ওর কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে মনে মনে ভাবলো, এতক্ষণ শুধু নিজেকে বাঁচাতে হতো কিন্তু এখন আরও একটা প্রাণ। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে কলি হালকা আলোতে শ্যামলীর জামায় কাদা দেখে জানতে চাইলো,
— এগুলো কিভাবে লাগলো?
— আর বলোনা দিদি, কতগুলো কুকুরের পাল্লায় পড়েছিলাম। ছুটে পালাতে গিয়ে ওই যে দূরে পুকুরের পাশের কাদায় মুখ থুবড়ে পড়লাম আর তারপরই এই অবস্থা।
আরো কিছুটা পথ পেরিয়ে যখন ওই বাড়িটার কাছে এগোলো ওরা, ম্লান আলোয় দেখলো তিনটে লম্বা-চওড়া ছেলে দাড়িয়ে কথা বলছে আর বিকট আওয়াজ ক’রে হাসছে। আরেকটু এগোতেই দেখলো ছেলেগুলো এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। কলির পা থেমে যেতে চাইলো। কিন্তু শ্যামলী যেন ওকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কলি আবছা শুনতে পেল ওরা বলছে,
— দুটোকেই নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকা আগে।
এবার থেমে গেল কলি। ও বুঝতে পারছেনা কি করবে,উল্টোদিকে ছুটবে নাকি মুখোমুখি হবে ওদের। প্রচণ্ড ভয় আর উত্তেজনায় কলির সমস্ত শরীর যেন কাঁপতে লাগলো। এসব ভাবতে ভাবতেই দুটো ছেলে এসে চেপে ধরলো ওদের হাত আর মুখ, যাতে চিৎকার করতে না পারে ওরা। আর অন্য ছেলেটা ওদের মুখে টর্চের আলো ফেলতেই যেন চমকে উঠলো ওরা তিনজনই। বললো,
— শ্যামলী তুই ?
শ্যামলীর দৃষ্টিতে তখন আগুনের গোলা জ্বলছে। যেন মা কালীর চন্ডীরূপ। ওদের হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল। কি যেন বললো একে অপরকে আর নিমেষের মধ্যে যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেল ওরা।
কলির সম্বিত ফিরলে শ্যামলী বললো,
— চলো দিদি তোমায় বাড়ি পৌছে দিই।
কলির যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও জানতে চাইলো,
— কি করলি তুই , যে ওরা এভাবে…
— কিছুই তো করিনি, শুধু চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু ওরা রাখতে পারলোনা। তাই ভয়ে পালিয়ে গেল বজ্জাতগুলো। ওদেরকে এপথে আর কোনো দিন কেউ দেখতে পাবে না। শুধু একটাই আফসোস, এমনটা আগে যদি কেউ করতো !
কলিকে ওর বাড়ির গেটের সামনে ছেড়ে শ্যামলী বললো,
— তুমি একদম ভয় পেয়ো না দিদি।
কলি আলতো হেসে বললো,
— আচ্ছা ঠিক আছে।
তারপর শ্যামলীর মাথায় হাত দিয়ে বললো,
— এবার বাড়ি যা সাবধানে, আর এই কাদা ধুয়ে ফেল।
— তোমার হাতেও কাদা লেগে গেছে দিদি।
— ও ঠিকাছে।
শ্যামলী হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় নিলো।
কলি বাড়ি ঢুকতেই মা বললো,
— এত দেরি হলো মা তোর,কত চিন্তা হচ্ছিল জানিস?
— আর বলোনা মা,পোড়ো বাড়ির রাস্তা দিয়ে ফিরতে গিয়েই তো…
— কি বলছিস তুই! তুই ওদিক থেকে ফিরলি? তুই ঠিক আছিসতো মা?
— একদম ঠিক আছি। জানো মা…
— আগে আমার কথা শোন, আজ তোর কমলা পিসি এসে বললো দু’দিন আসতে পারে নি কারণ দু’দিন আগে ওদের পাড়ার শ্যামলী নামের একটা ছোটো মেয়েকে ওই রাস্তার শয়তানগুলো ছিঁড়ে খেয়েছে। পরদিন সকালে পুকুরপাড়ে কাদা মাখা শরীর পাওয়া গেছে মেয়েটার। তুই আর কখনও ওই পথ দিয়ে ফিরবি না।
কলি যেন আকাশ থেকে পড়লো। ওর মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোলো না। ও মাকে জড়িয়ে ধরলো আর ভীষণ কান্না পেল ওর। তারপর বাম হাতের লেগে থাকা কাদার দাগটায় হাত বুলিয়ে শ্যামলীর চলে যাওয়া হাসিমুখটা মনে পড়লো কলির। ও গেটের দিকে তাকাতেই, ওর মনে হলো যেন শ্যামলী এখনো হাঁটছে অনেক অনেক দূরের পথে। এভাবেই বোধহয় বারবার শ্যামলীরা নেমে আসে পথে, যাতে আর কোনো কলিকে শ্যামলী হয়ে উঠতে না হয়। শুধু ওদেরই আর ঘরে ফেরা হয় না।
(সমাপ্ত)