Loading...
মাঝরাতে পাশের রুম থেকে ফিসফিসানির শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো এনামুল হকের। ঐ রুমে থাকে তার বড় মেয়ে রুমা আর ছোট মেয়ে নীলা। বিছানা থেকে উঠে ঠিকমতন কান পেতে শুনলেন ফিসফিসানিটা আসলে কান্নার। আবার শুয়ে পড়ে মাথার উপর শব্দ করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকালেন। অন্ধকারে ফ্যান দেখা না গেলেও বিকট শব্দ করে ঘুরতে থাকা ফ্যানটাই তার মধ্যবিত্ত জীবনের পরিচয় বহন করে। মাঝেমধ্যে এই ফ্যানের বিকট শব্দ তার কাছে অসহ্য মনে হলেও এখন তার কাছে ভালো লাগছে। ফ্যানটা যদি আরেকটু শব্দ করে ঘুরত তাহলে পাশের রুম থেকে আর কোনো কান্নার শব্দ শোনা যেতো না।
একটা অফিসে সামান্য বেতনের চাকরী করে এনামুল হক। মাসে আট হাজার টাকার বেতন। এবার ঈদ বোনাস সহ বারো হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রত্যেক মাসে তিন হাজার টাকার বাসা ভাড়া আর চারজন মানুষের খাওয়া থাকা মিলে কিভাবে যে মাস পার হয়ে যায় এনামুল হকের মাথায় ঢোকে না। এ মাসে বাড়ি ভাড়া, রমযানের মুদির দোনাকের বাকি এছাড়া বড় মেয়ের পরীক্ষার ফির জন্য পাশের ঘরের আনিচুর শেখের কাছে থেকে চার হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন সেটাও পরিশোধ করতে হয়েছে। শেষমেশ এনামুল হকের কাছে ছিল এক হাজার টাকা। এই টাকায় চারজন মানুষের জন্য জামাকাপড় হয় না। তাছাড়া ঈদের দিনে সেমাই চিনির জন্যেও তো কিছু টাকা রাখা দরকার।
আজ রাতে ঘরে ঢোকার সময় এনামুল হক লক্ষ্য করেছেন। ঘরের সবাই তার হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। এনামুল হক সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সবাই হয়তো অনেক আশা নিয়ে ছিল এনামুল হক তাদের জন্য ঈদের জামা আনবেন। কিন্তু এনামুল হক সেটা পারেনি। ছোট মেয়েটা ছয়টা রোযা রেখেছিল। প্রত্যেকবার রোযা থাকার সময় বলেছে ” মা বলেছে এবার রোযা করলে তুমি নতুন জামা কিনে দিবে, কবে দিবে বাবা”?
শেষরাতে আবার কান্নার শব্দে এনামুল হকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। এবার তার স্ত্রী পাশে শুয়ে কাঁদছে। মেয়েটাকে বিয়ে করার পর থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। লাল রং মেয়েটার খুব প্রিয়। বিয়ের পর কয়েকবার লাল শাড়ী এনে দিয়েছিলেন এনামুল হক। কিন্তু সময়ের স্রোতে প্রিয় রং গুলো হারিয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত মানুষ গুলো খুব বেশি কাঁদে, কারণে অকারণে কাঁদে। এনামুল হক একবার ভাবলেন স্ত্রীকে ডেকে কান্না থামাবেন । কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে নিজেকে সামলে নিলেন। কাঁদুক, কেউ কাঁদতে চাইলে তাকে কাঁদতে দিতে হয়।
আজ ঈদ, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল করে
এনামুল হক ঘর থেকে বের হলেন। মুদির দোকান থেকে চুপিচাপি এসে মেয়েদের ঘরে ঢুকে দেখলেন কেউ নেই। সবাই মনে হয় গোসল করতে গিয়েছে । তাড়াতাড়ি করে হাতের ব্যাগের মধ্যে থেকে দুই মেয়ের জন্য কেনা দুইটা নতুন জামা বের করে বিছানার উপর রাখলেন। মেয়েদের চমকে দিবেন বলে। স্ত্রীর জন্য কেনা শাড়ীর ব্যাগটা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকেই বিছানার দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেলো তার। বিছানায় নতুন ধবধবে সাদা একটা পাঞ্জাবী রাখা। এতো সুন্দর পাঞ্জাবি এলো কোথায় থেকে! স্ত্রী শাড়ীর ব্যাগটা পাশে রেখে এনামুল হক পাঞ্জাবীটা গায়ে দিলেন। একদম খাপেখাপে মিলে গেছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পাঞ্জাবীরটার দিকে।
একটুপর তার স্ত্রী ঘরে ঢুকেই স্বামীর দিকে তাকালেন। আজ অনেকদিন পর এনামুল হককে সাদা পাঞ্জাবীতে দেখছেন। কেউ কোনো কথা বলছে না। একটুপর তার স্ত্রীই বললেন, কিছুদিন আগে মেয়ে একটা টিউশনি ধরেছিল। কাল মাসের টাকা পেয়ে তোমার জন্য পাঞ্জাবীটা কিনে এনেছে। দেখছ মেয়ের দরদ। মায়ের জন্য না নিয়ে বাবার জন্য এনেছে। স্ত্রীর কথা শুনে এনামুল হক বিছনায় বসে পরলেন। স্ত্রী দিকে তার শাড়ীর ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললেন এটা তোমার জন্য, পরে এসো।
স্ত্রী চলে গেলে দুই মেয়ে এসো দাঁড়ালো ঘরের মধ্যে। দুই মেয়ে নতুন জামা পরে এসে দাঁড়িয়ে আছে বাবার সামনে। মনে হচ্ছে যেন দুটো পরী। এনামুল হক নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলেন না। দুই মেয়েকে নিজের দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। মেয়েরাও বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। পাশের ঘর থেকে আরেকজন দৌড়ে এসে তিনজনার সাথে তাল মেলালেন। চলল কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলা। মধ্যবিত্তরা লুকোচুরি খেলতে জানে। এরা লুকোচুরি খেলতে জানে বলেই এরা মধ্যবিত্ত।
