আমি আড়চোখে মিহিকে দেখি। সে আজ বেশ সেজেছে। কালো শার্ট আর কালো জিন্সে ওকে দারুন মানিয়েছে। তারউপর চোখে গাঢ় কাজল,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক এবং বাম গালে পাহারাদার হিসেবে থাকা ছোট্ট তিলটা যেন ওর সমস্ত মুখে অদ্ভুত সুন্দর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সমস্ত মুখটা যেন আলোয় আলোকিত করে রাখছে। আমি ওর চেহারার এমন সৌন্দর্য দেখে বেশ মুগ্ধ হই। আমার ভীষণ ইচ্ছে হয় এই মেয়েটার প্রেমে পড়তে। অবশ্য আমি ওর প্রেমে এ যাবত কতবার যে পড়েছি সেটা আমি নিজেও ঠিক জানি না। আমি হাঁটতে হাঁটতে মিহিকে বলি,
-তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আমি লক্ষ্য করলাম যে ওর চেহারাটা খানিকটা লাল হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত মুখ রক্তিম হতে বেশি সময় নিল না। আমি একটু অবাক হলাম এবার। ওকে এই অবস্থায় আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ও মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলে,
-আজ সুন্দর লাগছে? কেন, কাল কিংবা পরশু বা এর আগে আমাকে সুন্দর লাগতো না?
আমি খানিকটা থতমত খেয়ে বলি,
-না, ঠিক তা না। তোকে সব সময়ই সুন্দর লাগে। তবে আজ একটু ভীন্ন লাগছে।
মিহি যেন আরেকটু লজ্জা পায়। লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে,
-তাই- না!
আমি বলি,
-হ্যাঁ তাই। তা কোন ক্যাফেতে যাবো আমরা?
-তোর যেটাতে পছন্দ।
-আচ্ছা তা না হয় যাওয়া যাবে। কিন্তু আজ এমন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কফি খাওয়ার ইচ্ছে হলো কেন তোর বলতো?
-এমনিই। তোর সাথে কফি খাওয়ার ইচ্ছে হলো খুব। তাই চলে এলাম।
আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তার আগেই আমার চোখ গেল সামনে। আমি বেশ অবাক হই। মীরা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! আমি প্রচন্ড অবাক হই।মীরাও! যে বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মীরা কিছু সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আরে সাদিক! দোস্ত! তোর কি অবস্থা! কত দিন পর তোকে দেখলাম!
একেবারে জড়িয়ে ধরেই কথা গুলো বলে ও। ওর এমন আগমনে আমি খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। তবুও পুরনো বন্ধু তারউপর প্রায় তিনচার বছর পর দেখা,তাই আমিও বেশ আবেগি হয়ে বলি,
-এই তো ভালো! তোর কি অবস্থা! কোথায় যাচ্ছিস। তোকে কতদিন পর দেখলাম!
ও ততক্ষণে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
-এই এদিকে একটু আসলাম। কাজ ছিল একটা। তুই? আর এই মেয়েটা কে! জিএফ বুঝি!
আমি হাসলাম এবার। বলি,
-আরে নাহ! জিএফ হতে যাবে কেন? ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ভার্সিটির প্রথম দিন থেকে তোর সাথে পরিচয়। আমার খুব ভালো বন্ধু, নাম মিহি।
তারপর মিহির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আর মিহি, এই হচ্ছে মীরা। আমার ছোট বেলার ফ্রেন্ড। তোকে বলেছি না ওর কথা! ওই যে ক্লাস ওয়ান থেকে ইন্টার পর্যন্ত আমার একটা মেয়ে বন্ধু ছিল। ও-ই সেই।
মিহিকে দেখলাম ওর দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসলো। ওর হাসিতে কোন প্রান ছিল না। আমি বেশ অবাক হলাম। একটু আগে মিহির মুখ যেমন প্রসন্ন ছিল, বেশ হাস্যজ্বল ছিল,আলোকিত ছিল, সেই আলোকিত আভাটা আর নেই। সেটা দ্রুতই মিলিয়ে যাগ। সাথে মিহির জোর করে দেওয়া হাসিটা বেশ দ্রুতই মিলে যায় দূর অজানায়। সেখানে একঝাঁক বিষন্নতা এসে বাসা বাঁধে। মিহির মুখটা দ্রুতই কালো হয়। মীরা ওর দিকে তাকিয়ে খানিকটা হেসে বলে,
-হাই আমি মীরা!
মিহি হাসলো না এবার। কেবল রসকসহীন ভাবে বলে
-মিহি।
আমি চরম পর্যায়ে অবাক হই। এই মেয়ে এমন করছে কেন? কি হয়েছে ওর। এতক্ষণ তো ভালোই ছিল। আমি সেদিকে ধ্যান না দিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে বলি,
-তারপর! কি অবস্থা? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
-এই যাচ্ছে আরকি! তোর খবর কি? একেবারে যে চলে এলি আর খবরই তো নিলি না।
-বিশ্বাস করবি না, তোকে আমি কত যে খুঁজেছি! তোর নাম্বার খুঁজেছি! কোথাও পাই নিই। কেউ নাম্বার দিতে পারে নিই। পুরনো নাম্বারটাও বন্ধ। তারউপর তোরাও বাসা চেঞ্জ করেছিস। আচ্ছা তোর ফেবু আইডির কি হইছি! তুই তো চাইলেও যোগাযোগ করতে পারতি।
কথাটা বলে আমি মিহির দিকে আড়চোখে তাকাই। দেখি সে বেশ রুক্ষ মেজাজ নিয়ে,ভ্রু কুছকে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এখনই আস্ত গিলে খাবে। আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকলো না। মীরা তখন বলল,
-সে অনেক কথা দোস্ত। তোকে অন্য একদিন সব বলবো। আজ থাক।
-আচ্ছা ঠিকাছে। বলিস। এখন চল কফি খাই।
-না না দোস্ত। এখন না, এখন না। আমাকে এখন যেতে হবে। জরুরি একটা কাজ আছে। ওই কাজটা শেষ না করতে পারলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।
-আরে ধুরর। এসব বাদ দে। চল কফি খাই। কতদিন পর তোর সাথে দেখা!
মীরা এবার আমার হাত ধরে বলে,
-দোস্ত প্লিজ! একটু বুঝার ট্রাই কর। ব্যাপারটা অন্য রকম। আমি যাই। – চলে যাবি!
– হ্যাঁ রে। ও ভালো কথা, তোর নাম্বারটা দে তো।
-আচ্ছে নে!
-বল
আমি নাম্বার দিয়ে মিহির দিকে তাকালাম। সে তখনো মীরার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল। মীরা চলে যাওয়ার পর মিহিকে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বলি,
-চল যাই। কফির তেষ্টা পেয়েছে খুব।
মিহি কিছু বলে না। চুপ করে হাঁটতে থাকে।
মিহি চুপচাপ বসে আছে। কথা বলে না। হাঁসে না। ঠাট্টা করে না। আমি অবাক হই। আশ্চর্য! এমন হলো কেন? আসার সময় তো সব ঠিকই ছিল। এখন এত নির্জীব হয়ে গেল কেন? সে খুব দ্রুতই কফি খাওয়া শেষ করে ফেলে। তারপর ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমি কেবল বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বলি,
-আরে যাচ্ছিস কই? দাঁড়া আমিও যাবো তো!
মিহি দাঁড়ায় না। বিল পে করে বের হয়ে যায়। আমি কফি খাওয়া বাদ দিয়ে বেরিয়ে আসি। দৌড়ে মিহির কাছে যাই। বলি,
-এই তোর কি হয়েছে বলতো? এমন করছিস কেন?
মিহি কিছু বলে না। হাঁটতে থাকে। আমিও ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটি। ভাবতে থাকি আসলে কেন ও এমন করছে। কি করেছি আমি। আমি আবার ওকে বলি,
-আচ্ছা আমি কি কোন ভুল বলেছি? ও আচ্ছা মীরা তোকে আমার জিএফ ভেবেছে এই বলে তোর মন খারাপ! আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি। ও আর জীবনেও যেন তোকে আমার জিএফ না ভাবে এটা ওকে বলে দিব আমি। ঠিক আছে?
মিহি চট করে দাঁড়িয়ে যায়। বেশ আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি অবাক হই। ওর চোখে জল খেলা করে। কি একটা কারনে ওর চেহারায় প্রচণ্ড রাগ দেখি আমি। ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকায় । আমি আবার বলি,
-প্লিজ রাগ করিস না। ও এমনই!
মিহি দাঁড়ায় না আর৷ দ্রুত হাঁটতে থাকে। আমিও তাল মিলিয়ে হাঁটি। বলি,
-আরে বল না কি হয়েছে? এমন করছিস কেন আমার সাথে?
ও এবারেও কিছু বলে না। বাস স্টপে এসে দাঁড়ায়। আমিও ওর পাশে দাঁড়াই। মুখটা বেশ নিষ্পাপ করে মোলায়েম কন্ঠে বলি,
-প্লিজ বল কি হয়েছে? বল না?
মিহি এবারেও আমাকে প্রচণ্ডরকমে এভয়েড করে। আমার খারাপ লাগে। কষ্ট হয়। এত সুন্দর একটা সময় হুট করেই কত বাজেতে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমি ভাবতেও পারি নি যে এমন হবে। আমার প্রচন্ড কষ্টে পানির তেষ্টা পায়। আমি মিহির দিকে আমার ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বলি,
-একটু ধর তো। আমি এক বোতল পানি নিয়ে আসি। আর শুন বাস এসে গেলে আমার জন্যে তোর পাশে সিট রাখবি। ঠিক আছে?
মিহি বেশ অনিচ্ছা নিয়ে আমার ব্যাগটা নেয়। আমি ঠিল বুঝে উঠতে পারি না। এই মেয়েটা এমন করছে কেন? কি হয়েছে ওর? আমি আনমনে রাস্তার মাজ দিয়ে যাই। হঠাৎই যদি কোন দ্রুতগামী গাড়ি যদি আমার দিকে তেড়ে আসতো আমি টের পেতাম না। গাড়ির নিচে চাপা পড়তাম। আচ্ছা তখন কি হতো? এই অদ্ভুত বালিকা কি আমার মৃত্যুর সংবাদ শুনে খুব কাঁদতো। অনেক দিন ধরে মন খারাপ করে থাকতো? আচ্ছা ও কি কোন দিন ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বলতো, আম্মু আমার আমার সাদিক চাই। সাদিকে ছাড়া আমি
ভালো থাকি না। সাদিক ছাড়া ভালো থাকা হয় না আমার। ও কি বলতো? জানি না। মাথা হ্যাং হয়ে আসছে। অদ্ভুত চিন্তা করছি। এসব চিন্তা অপার্থিব। অপ্রয়োজনীয়। মিহি কেন আমাকে নিয়ে এসব বলবে। ও তো রেগে আছে ভীষণ। আমি পানির কিনে পিছন ফিরে থাকাতেই দেখি বাস চলে এসেছে। দ্রুত দৌড়ে যাই। কি যে গভীর চিন্তায় হারিয়ে গেলাম। আশ্চর্য কি হচ্ছে এসব। আমি বাসে উঠি। মিহিকে দেখি পিছনের একটা সিটে বসে আছে৷ ওর পাশে অন্য কেউ। পিছনের সিটে আমার ব্যাগটা প্রচন্ড অবহেলা নিয়ে পড়ে আছে। আশ্চর্য ও এমন করলো কেন? ও চাইলেই তো ডাবল সিট নিতে পারতো। নেয় নি। কেন নেয় নি? বাস চলতে শুরু করেছে। আমার মন খারাপ হয়। কেন আমার সাথে এমন করছে ও? কেন এত অবহেলা? আমি ব্যাগ নিয়ে বাসের দরজার সামনে যাই। পিছন ফিরে মিহিকে দেখি একবার। সে তখনো মুখ কালো করে ছিল।অদ্ভুত কান্ড! আমার মন খারাপ হয়েছে সেটা দেখার একটু ইচ্ছেও নেই ওর? আমি ড্রাইভারকে থামাতে বলি। সে থামায় না। কড়া ভাষায় কথা বলে। আমি দরজার সামনে চলে
এসে অনেকটা নেমে যাই। বাস থামাতে বলি। এবার কড়া স্বরে বললাম। প্রচুর মেজাজ খারাপ। এ সময় কেউ ত্যাড়ামি করলে গা জ্বলে। বাস থামলো। আমি নেমে পড়লাম। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিলো। আমি নেমে হাঁটা দেই। বাস চলতে শুরু করেছে। আমি ফুটপাতে উঠে হাঁটতে থাকি। আর অদ্ভুত সব চিন্তা করতে থাকি। আমার চিন্তা খুব অদ্ভুত হয়। মিহি প্রায়ই বলেছিল এ কথা। মিহি! নামটা মনে হতেই কষ্ট লাগে। এমনটা না করলেও পারতো। অন্তত কি হয়েছে সেটা তো বলতে পারতো। বলে নি। রাগ করে বসে আছে। তারউপর আমার জন্যে সিট রাখে নিই। অথচ আমি সিট রাখতে বলেছি। সে শুনে নিই। আমাকে তীব্রভাবে অবহেলা করছে। আমার সহ্য হয় না। আপন কেউ অবহেলা করলে সে কারোই কষ্ট হত। তীব্র কষ্ট। আমি হাঁটতে থাকি। হঠাৎই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে হলো আমায়। সেই বাস থেমে গেছে। সেখান থেকে মিহি নেমে আসলো। নেমেই দ্রুত হেঁটে ফুটপাতের কাছে এসে বসে পড়ে। আমি অবাক হই। কি হয়েছে আবার। নেমে পড়লো কেন? আমাকে আরো অবাক হতে হলো। মিহি ওখানে বসেই কাঁদতে থাক্র। তীব্রবেগে কাঁদতে থাকে। আশপাশের বেশ কিছু উৎসুক জনতা তা বেশ অনন্দের সাথে দেখতে থাকে। মিহি এবার মুখে দুহাত দিয়ে ঢেকে শরীর কাঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। আমার প্রচন্ড মায়া জন্মে এই মেয়েটার জন্যে। তবে এই অবহেলা প্রাপ্ত মন কি এক অভিমানি স্বরে বলে উঠে,
-ওর কাছে যাওয়ার একদম প্রয়োজন নেই। সে আমাকে ভীষণরকম অবহেলা করেছে। আমার যাওয়া ঠিক না।
আমি মিহিকে পাশ কাটিয়ে যাই। সত্যি বলতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ওর কান্নার শব্দ আমার হৃদয়ে অদ্ভুত মায়ার সৃষ্টি করছিল। আমি অন্যরকম একটা টান অনুভব করি।এই মেয়েটিকে এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া একদমই সম্ভব না। তবুও আমি এগিয়ে যাই। পিছন ফিরে তাকাই না। আমার কষ্ট হয় তখন। মেয়েটা আমার সাথে এমন না করলেও পারতো। কেন এমন করলো? কেন আজকের এত সুন্দর দিনটা এমন মাটি করে দিলো? আমার কান্না পায় এবার৷ অদ্ভুত ভাবে চোখ ভিজতে থাকে। আমি ওকে পিছনে ফেলে যতদূর যাই আমার কষ্ট গুলো যেন ততদ্রুত বাড়তে থাকে। চোখ ভিজতে থাকে। জলের ফোটা গাল বেয়ে পড়ে৷ আমি থমকে দাঁড়াই। আর যেতে পারি না সামনে। কি এক অদ্ভুত আকর্ষণ আমাকে সামনে এগুতে দেয় না। পিছনের দিকে টানতে থাকে। আমি সামনে যাই না আর। পিছন ফিরে তাকাই। অবাক হই। মিহি দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। চোখ ভর্তি জল। ফুলে গেছে চোখ দুটো। আশ্চর্য! এত কান্নার কি হলো। আমি নির্বাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ও ধীর পাঁয়ে আমার দিকে আসতে থাকে। একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। ও তখন মাথা নিচু করে ছিল। আমি তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। দেখি মেয়েটা কাঁদছে। আবারো সেই শরীর কাঁপিয়ে কান্না করছে। আমার বুকটা কেঁপে উঠে যেন। অদ্ভুত কষ্ট হতে থাকে৷ আমি বেশ শান্ত ভাবেই বলি,
-কাঁদছিস কেন? আচ্ছা আমার ভুলটা কি বল তো। কি করেছি আমি যার জন্যে তুই নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস আমাকেও কষ্ট দিচ্ছিস?
ও এবারেও কিছু বলে না। আমার দিকে আরেকটু সরে আসে কেবল। আমি একটু পিছন ফিরে যায়। ও আমার শার্ট খামছে ধরে। একেবারে কাছে নিয়ে আসে। আমি পিছনের দিকে যাই আবারো। ও এবার আমার চোখের দিকে তাকায় বলে,
-আমার কি হয়েছে আমি জানি না। একদমই জানি না। তোকে ওই মেয়েটার সাথে এভাবে মিশতে দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। যেন তুই হারিয়ে যাচ্ছিস। কোথাও চলে যাচ্ছিস। প্লিজ তুই হারিয়ে যাস না। অন্য কোথাও চলে যাস না। আমার কষ্ট হবে। দম বন্ধ হয়ে আসবে। বাঁচবো না। প্লিজ যাস না।
এই বলে কান্না করতে থাকে ও। তারপর চট করেই আমাকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরেই বাচ্চাদের মতো কান্না করতে থাকে। শব্দ করে কাঁদে ও। আমি অবাক হই। সাথে বুকটাও যেন দ্বিগুণ কেঁপে উঠে। এই মেয়েটা কান্না করছে কেন? সে কি জানে না যে সে কান্না করলে আমার একদমই সহ্য হয় না! মিহি বেশ কাঁন্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
-ওই মেয়ের সাথে তোকে এমন ভাবে দেখে আমার একদমই সহ্য হয় নি। বিশ্বাস করবি কি না জানি না তবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন। কেবল মনে হচ্ছিলো ওই মেয়েটা তোকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে৷ আমার অল্প ক’বছরের বন্ধুত্ব হার মেনে যাবে তোর পুরনো বন্ধুত্বের কাছে। সে তোর হয়ে যাবে৷ আমি এটা মানতে পারি না। তোকে এতদিন নিজের করে আগলে রেখেছি। নিজের মতো তৈরি করেছি। সেখানে আজ যদি পুরনো কেউ এসে ভাগ বসায় তাহলে কেমন লাগবে? আমার প্রচন্ড খারাপ লাগবে। আমি তোর ভাগ কাউকে দিবো না৷ তুই শুধু আমার। আমার আমার আমার।
এই বলে মেয়েটা আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে। অদ্ভুত এক আনন্দে আমার চোখের জল বাধাহীনভাবে নামে। হায়! কি হচ্ছিলো, আর কি হচ্ছে। আমি বলি,
-আমি তোর? কিভাবে তোর হলাম?
-জানি না। তুই আমার হয়েছিস। কেবল আমার। কখন কিভাবে হয়েছিস এসবের প্রয়োজন নেই৷ তুই কেবল কথা দে যে জীবনেও কোন মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলবি না। অন্য কারো হাত ধরবি না। আর…
-আর…
-কেউ যেন তোকে জড়িয়ে না ধরে। তোকে কেবল আমি জড়িয়ে ধরবো। অন্য কেউ ধরলে তাকে খুন করবো আমি। আর তোর ওই ফালতু মেয়ে বন্ধুটাও বলে দিস। যেন তোর কাছেও না ঘেঁসে।
আমি মিহিকে সামনে টেনে নিয়ে এসে বলি,
-খুব জেলাস ফিল হইছিলো না?
মিহি লজ্জ্বা পায়। কেবল মাথা নেড়ে বলে,
-হু। খুব। বিশ্বাস করবি না, আমার কি যে অস্বস্তি লাগছিল! খুব ইচ্ছে হইছিল ওর নাকের উপর ক’টা দেই। ওকে ওখানেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে হইছিল আমার। কিন্তু কিছুই করতে পারি নিই। কেবল রোবটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম।
-আচ্ছা তাই বলে আমার সাথে এমন করবি?
-তোর কারনেই তো ও তোকে জড়িয়ে ধরেছে। আচ্ছা তোর একটু লজ্জাও করে নিই ওকে জড়িয়ে ধরতে? ইশ! তুই কি নির্লজ্জ! কিভাবে দু’হাত বাড়িয়ে দিলি আর সে এসে তোকে জড়িয়ে ধরলো। আর মেয়েটাও কি! লজ্জাশরম কিচ্ছু নেই।
-তুই তো আমাকে জড়িয়ে ধরেছিস! তোরও তো…
কথাটা বলতে পারি না আমি। মিহি আমার ঠোঁট আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে। বলে,
-আমার অধিকার আছে এখানে?
আঙ্গুল ছাড়তেই বলি,
-কিসের অধিকার শুনি?
ও যেন লজ্জা পেলো৷ হাসলো খানিকটা। তারপর চট করেই আবার জড়িয়ে ধরে বলল,
-ভালোবাসার -ভালোবাসার -ভালোবাসার -ভালোবাসার অধিকার।
আমার মনটা অদ্ভুত শান্তির আবেশে ভরে গেলো। আমার কেবল মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত শান্তি যেন এই ছোট্ট বাক্যটির মাঝে লুকিয়ে ছিল। আমি বললাম,
-ভালোবাস-ভালোবাসিস?
-সন্দেহ আছে?
-আগে বলিস নি কেন?
-আজ বলতাম। কিন্তু ওই মেয়েটা সব বিগড়ে দিল।
আমি হাসলাম এবার। মিহি কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে,
-আমি আর রিক্স নিতে চাই না সাদিক। মেয়েটাকে আমার সুবিধের মনে হলো না।
আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে বললাম,
-মানে?
মিহি কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
-আমি তোকে বিয়ে করে ফেলবো।
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি বললাম,
-এখন?
-হ্যাঁ এখনই! দেখ আর একমাস পর আমাদের ভার্সিটি জীবন শেষ হয়ে যাবে। তারপর তো চাকরিবাকরি করবিই। আমি এখন আর রিক্স নিতে চাচ্ছি না। আমার মনটা একদমই শান্ত হচ্ছে না। আমার কেবল মনে হচ্ছে তুই আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবি। দূরে কোথাও চলে যাবি। আমি এসব একদমই চাই না।
-তাই বলে এখন?
-হ্যাঁ এখনই। চল।
-কোথায়?
– কাজী অফিসে।
-আরে করছিস কি?
-গেলেই দেখবি কি করছি। তোর জড়িয়ে ধরা জলদিই বন্ধ করবো। আয়। আয় আমার সাথে।
অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেল। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সব কমপ্লিট। এই মীরার সাথে একবার দেখা হওয়াতেই বিয়ে হয়ে গেলো। আবার দেখা হলে যে কি হবে সেটা আল্লাহই ভালো জানে।