গল্পের শুরুটা সেদিন বিকেলের পর থেকে। এইচ, এস, সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে দু মাস হল। স্বপ্নটা অনেকদিনের ছিল, আমি ইঞ্জিনিয়ার হব। স্বপ্নটাকে লালন করেছি খুব যত্নে। তাই পরীক্ষা শেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং-এ ভর্তি হয়েছিলাম। সেদিন কোচিং শেষ করে যখন বাসায় ফিরলাম বিকেলটা পড়ন্ত ছিল। দরজা খুলে মা তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেলেন। মাকে বেশ উদ্বিগ্ন লাগছিল। ভেতরে ঢুকে দেখলাম পারমিতা বিছানায় শুয়ে আছে। যে মেয়েটিকে ছোটবেলা থেকে আমি কখনো সামান্য জ্বরে পড়তে দেখি নি সে ব্যাথায় এমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। কাল রাত থেকে ওর বুকের নিচে ব্যাথা শুরু হয়েছে। প্রথমে মা ভেবেছিলেন হয়ত সামান্য ব্যাথা সকালে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সকাল থেকে ব্যাথাটা আরো বেড়েছে। যে মেয়েটা পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে তার এই অবস্থায় পুরো বাড়িটা যেন থমকে আছে। ওর সেবার এস,এস,সি পরীক্ষা দেবার কথা। আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম। আমাকে দেখে ও হেসে বলল দাদাভাই আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে? আমার ব্যাথা কিন্তু এখন অনেকটা কমেছে, তোরা শুধু শুধুই চিন্তাই করছিস। যে মেয়েটা ব্যাথায় কথাটাও ঠিকমত বলতে পারছে না সে কিনা বলছে তাঁর ব্যাথা কমে গেছে। বাবা ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন। সন্ধ্যার পর ওকে নিয়ে যাবেন।
আমি যখন নিজের ঘরে এসে ফোনটা হতে নিলাম ফোনের স্ক্রীনে তখন সাতটা মিসড কলের নোটিফিকেশন। নীলা ফোন করেছিল। আমাদের সম্পর্কটা দু বছরের। আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা খুব চমৎকার। আমরা একই কলেজে পড়েছি। ও তখন মেডিকেল কোচিং শেষ করছে, পরীক্ষার তখন আর মাত্র তিনদিন বাকি। তাই আমরা তখন কথা বলা বেশ কমিয়ে দিয়েছি। কারণ আমরা দুজনই নিজেদের কেরিয়ারের ব্যাপারে খুব সেনসেটিভ ছিলাম। আমরা জানতাম ভাল সময় কাটাবার জন্য আমাদের কাছে গোটা একটা জীবন বাকি রয়ে গেছে। তাই তখন দুজনই শুধু নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে ভাবছিলাম।
বাবার পারমিতাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরতে বেশ রাত হল। যখন ফিরলেন, বাবার মুখে আমি এক অন্য রকমের স্তব্ধতা দেখতে পেয়েছিলাম। মা বারবার জানতে চাইছিলেন ডাক্তার কি বলেছে। বাবা কোন উত্তর দিচ্ছিলেন না। অনেক্ষণ নিস্তব্ধ থাকবার পর শুধু কাপাস্বরে বললেন, পারমিতাকে মেডিকেলে ভর্তি করতে হবে। আমি সেদিন প্রথমবারের মত বাবার চোখে এক ধরণের অশ্রহীন কান্না দেখতে পেয়েছিলাম, যে কান্নার মধ্যে ছিল আশঙ্কা, আর তার জন্য ভয় আর বেদনার ছাপ। পারমিতাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। চিকিৎসাও চলতে থাকল। কিন্তু অবস্থা যেন কোনভাবেই ভালর দিকে এগুচ্ছিল না। মা সারাক্ষণই মেডিকেলে থাকতেন, বাবাও অফিস থেকে বাসায় ফিরে ছুটতেন আবার মেডিকেলে। আমিও পড়ার ফাঁকে যতটা সময় পেতাম সেই পুরোটা সময়ই থাকতাম পারমিতার পাশে। আমাদের গোছানো সংসারটা একটু একটু করে অগোছালো হতে থাকল। জীবনটাও যেন বড্ড অপরিচিত হতে শুরু করল। কিন্তু তবুও থেমে থাকতে পারি নি। আমাদের পরিবারটা ছিল মধ্যবিত্ত, তাই জীবনে নিজেকে দাড়াতেই হবে সব ধরণের প্রতিকূল বাস্তবতার ভেতর দিয়ে। সেই সময়টাতে আমাকে সব থেকে বেশী সাপোর্ট দিয়েছিল নীলা। ও ততদিনে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। হয়তো ঐ সময়টাতে ঐ মেয়েটাই আমাকে থেমে থাকতে দেয় নি।
বুয়েটের রেজাল্ট যেদিন বের হল সেদিন রাতে আমি পারমিতার বিছানার পাশে বসে আছি। ও ততদিনে চলবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ডাক্তাররা তখনো ওর আসল রোগটা ধরতে পারে নি। শুধু নতুন নতুন টেস্ট আর মেডিসিন দিয়ে যেন এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছিল মেয়েটার ওপর। শুধু আশঙ্কা আর আশ্বাসকে আকড়ে ধরে আমরা দিন পার করছিলাম। রাহাত ভাই ফোন করে জানাল আমার চান্স হয়েছে। ২৭ তম হয়েছি। সেটা আমার জীবনের সাফল্যের অন্যতম একটা অংশ ছিল। কিন্তু আমার সেদিন নিজেকে হেরে যাওয়া মানুষগুলোর দলের একজন মনে হয়েছিল। আমার বোনটা তখনো অনিশ্চয়তার সাথে লড়াই করছে। ওর এস,এস,সি পরীক্ষা দেওয়া হয় নি সেবার। ও খুব কান্না করেছিল আমার বুকে মাথা রেখে। আমি ওর চোখ মুছিয়ে বলেছিলাম সামনের বছর ও অবশ্যই পরীক্ষা দেবে। ও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, দাদাভাই আমি আবার হাটতে পারব তো? আমি ওকে প্রমিজ করেছিলাম ও পারবে। কিন্তু সেদিন আমার স্বপ্ন পূরণের দিনে নিজের কাছে মনে হয়েছিল আমি পারব তো পারমিতাকে করা প্রমিজ রাখতে? মানুষের সামর্থ্যই বা কতটুকু? তখন মনে হয়েছিল এভাবে অনিশ্চয়তার মাঝে ভাল থাকবার অনুসন্ধান করবার নামই কি জীবন?
বাবা যখন আসলেন বাবাকে রেজাল্টের কথা বললাম। মানুষটা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই দুঃসময়টাতেও আমার সাফল্যে তাঁর সেই আনন্দটুকু ছিল দেখবার মত। বাবা তখনই ছুটলেন মিষ্টি আনতে। যে মেয়েটা উঠে বসতে পারে না, সেই পারমিতা সেদিন আমার হাত ধরে আনন্দে উঠে বসল। ওর চোখে মুখে প্রচন্ড ব্যাথার মাঝেও সে কি আনন্দ। আমরা চারজন অনেকদিন পর সেদিন আবার আগের মত একটা রাত কাটালাম কিন্তু হয়তো শেষবারের মত। ক্ষণিকের জন্য মনে হল এইতো জীবন, এইতো জীবনের পরিপূর্ণতা।
সেদিন শেষ রাতেই পারমিতার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। ওয়ার্ডের দায়িত্বে যে ডাক্তার ছিলেন তিনি ঘুমুচ্ছিলেন দরজা লক করে। ছুটলাম ইমার্জেন্সিতে। ইমার্জেন্সি তে কোন ডাক্তার পেলাম না। নার্সরা এসে শুধু দেখে আবার চলে যাচ্ছে, তাদের নাকি কিছুই করবার ক্ষমতা নেই ডাক্তারের অনুমতি ছাড়াকিন্তু অনুমতি দেবার জন্য ডাক্তার যে ছিল না। সে যে কি দুর্বিষহ আর অসহায় মুহূর্ত ছিল, কল্পনাতেও আমি আর কখনো আনতে চাই না। আচ্ছা একটা জীবন কি এতটাই মূল্যহীন? আর যারা জীবন বাঁচানোর সাধনায় ব্রতী হন তাদের মাঝেও কি জীবন নিয়ে খেয়ালি চিন্তা আসতে পারে? সেদিন এই প্রশ্নটা আমার মনের ভেতর কোন একটা জায়গায় ভীষণ বাজছিল। পরে সেই মুহূর্তে ওকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসলাম। তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। ডাক্তাররা আবার অনেকগুলো টেস্ট করল। বলল পরদিন সন্ধ্যায় রিপোর্ট দেওয়া হবে। পরদিন সন্ধ্যায় আমি আর বাবা, মাকে পারমিতার কাছে কেবিনে রেখে গেলাম ডাক্তারের রুমে। ডাক্তার সেদিন আমাদের যা জানালেন তা শুনে অনেকদিন পর অনিশ্চয়তার বেড়াজাল ছিন্ন করে আমরা এক সহজ নিশ্চয়তার খোঁজ পেলাম যার শেষ গন্তব্য মৃত্যনগর। পারমিতার ম্যালিগন্যান্স ক্যান্সার ধরা পড়ল, লাস্ট স্টেজ। হাতে হয়তো আর বড়জোর দুটো সপ্তাহ।
১৭ নভেম্বর, সকালবেলা। আমি বসে আছি পারমিতা যে বিছানায় শুয়ে আছে তার সামনে একটা চেয়ারে। আমার ছোট্ট বোনটার একটা হাত আমার হাতে ওপর। মা আর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন ওর বিছানার পায়ের কাছে। ওর নাকি আমাকে অনেক কিছু বলবার আছে। ওর মুখে অক্সিজেনের মাস্ক। হাত দিয়ে ও সেটা খুলবার চেষ্টা করল। নার্সরা বাধা দিচ্ছিল, আমি নিষেধ করলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিল সেদিন ওর কথাগুলো শোনাটা আমার খুব দরকার। ও আমাকে সেদিন বলেছিল, দাদা আমার পরীক্ষাটা আর দেওয়া হবে না, হবে না নিজের পায়ে আবার কখনো আগের মত চলার ক্ষমতা। ও সেদিন আমার কাছে আর একটা জিনিস চেয়েছিল। ও বলেছিল, “দাদাভাই আমার বাঁচার খুব ইচ্ছা ছিল, হয়তো আরো আগে চিকিৎসা করলে আমি সুস্থ হয়ে যেতাম। কিন্তু ডাক্তাররা আমাকে সুস্থ করতে পারল না। জানি এটা তোর স্বপ্ন নয় তবুও চাইছি, তুই যদি কখনো সুযোগ পাস তাহলে একজন পারমিতাকে বাঁচার সুযোগ করে দিবি?” সেটা ছিল আমার কাছে করা ওর শেষ আবদার। ঘড়িতে সময় দুইটা দশ। ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে পারমিতার স্পন্দন আর তখন চলছিল না, ওর হাতটা তখনো আমার হাতের ওপর, আমার দিকে ও তখনো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। হয়তো আরো কিছু বলতে চেয়েছিল। শোনা হয়নি সেদিন, আজো নয়।
পারমিতার আবদারটা পূরণ করবার জন্য নিজের নামের সামনে আর ইঞ্জিনিয়ার শব্দটা লাগাতে পারি নি। পারমিতা যখন চলে যাবার পর সব রকম দেদনা আর হতাশার সাথে যুদ্ধ করে মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হই। নীলা আমার থেকে এক বছর এগিয়ে যায়। ওর কেরিয়ারে কোন জটিলতা বা পিছুটান থাকুক সেটা আমি চাই নি। তাই স্বার্থপরের মত ওর কাছে খুব দামি একটা জিনিস চেয়ে বসেছিলাম। ও যেন আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ না করে। খুব অভিমানী ছিল ও, হয়তো আমিও। তাই আর কখনো যোগাযোগ হয়নি। জানি না ও কেমন আছে, হয়তো ভাল আছে, কিংবা নেই। দুবছর আগে খবর পেয়েছিলাম ও অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল করেছে। আর বাকি থাকলাম আমি। এখন এ দেশের কয়েকজন প্রথম সারির ডাক্তারের নামের মাঝে আমার নামটা জুড়ে গিয়েছে। আমি বেঁচে আছি। বাঁচার প্রয়োজনে বেঁচে আছি, আমার পারমিতার স্বপ্নটাকে পূরণ করবার জন্য বেঁচে আছি।
আজ ১৭ নভেম্বর, আমাকে একটা অপারেশন করতে হবে। যে মেয়েটার টিউমার অপারেশন করব তাঁর নাম পারমিতা। পারমিতা, পারমিতার বয়সী। চিকিৎসক হবার পর এমন অনেক অপারেশন করেছি, কোনদিন এতটা চিন্তা হয় নি। আজ হচ্ছে। তবে তার নাম হয়তো ঠিক চিন্তা নয়, তার নাম ভয়। একটা কথা বারবার কানে বাজছে, “একটা পারমিতাকে বাঁচার সুযোগ করে দিবি?” পারমিতা যেদিন আমাকে রেখে চলে গিয়েছিল সেদিন আমি একটুও কান্না করি নি। কিন্তু আজ আমার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছা করছে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
কেন করছে?