বাপু

বাপু

রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে আর এখন বাসা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। পকেট থেকে সিগারেট টা বের করে মুখে দিলাম। কিন্তু সাথে তো দিয়াশলাই নাই। এখন আগুন পাবো কোথায়?একটু সামনে একটা লোক কে দেখলাম দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তাই ওনার কাছেই গেলাম।
— আঙ্কেল আপনার সিগারেট টা দেন তো আমার সিগারেট টা ধরাবো।

লোকটি আমার দিকে ফিরে তাকাতেই হেব্বি শকড। এতো আমার বাবা কিন্তু বাবা তো জানতাম সিগারেট খায় না। যা ভাবার পরে ভাববো এখন পালাই। বাবা আমাকে দেখেই থ হয়ে গেল। আর আমি কোন রকমে বাবার সামনে থেকে পালিয়ে আসলাম।

এখন বাসায় ফিরতেই ভয় করছে। আজ আমার খবর আছে বাসায় ফিরলে। তাই বলে তো সারা রাত রাস্তায় কাটানো যায় না। কষ্ট হলেও ভয়ে ভয়ে বাসায় আসলাম। বাবা সোফায় বসে টিভি দেখছে। আমাকে দেখেই বলল…
— রাজ এখানে আয়।
— (চুপ চাপ সামনে গেলাম)
— তুই শেষ পর্যন্ত সিগারেটেরের নেশা শুরু করলি। দাঁড়া এখনই তোর মাকে বলছি।
— বাবা ও বাবা এমন করে না। তুমি না আমার দশটা না পাঁচটা না, একটা মাত্র বাবা। তোমারে কালকে এক প্যাকেট বেন্সন কিনে দিবো তবুও চুপ করো।
— কী? (ধমকের সুরে)

আজ মনে হয় সত্যি সত্যি মায়ের কাছেই বকা খেতে হবে। মানুষ তো বাপকে ভয় পায় আর আমি মাকে ভয় পাই। বাবা মাকে ডাকলো আর এইদিকে আমার পা কাঁপছে।
— জানো তোমার গুনধর ছেলে আজ রাস্তায় আমার সাথে কি করছে?
— কি?(মা ও মনে হয় রেগে আছে)
— তোমার ছেলে আজ আমার থেকে সিগারেট…..
বাবার কথা থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম…
— বলো বলো আমি তোমার থেকে সিগারেট কি হুমম?তুমি সেখানে কি করছিলে এটা তুমি বলবে নাকি আমি বলবো?
বাবা আমার কথায় চুপ আর মা একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। তখন মা একটু রাগি গলায় বলল…

— কি হয়েছে রাজ? সিগারেট নিয়ে কি বলছিস? তোর বাবা আবার সিগারেট খাচ্ছিল বুঝি?
মায়ের কথা শুনে বাবা আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো মনে হয় দুই বছরের বাচ্চার কাছ থেকে কেউ খেলনা নিয়ে গেছে। বাবার চেহারায় মায়া দেখা গেল তাই আমি বললাম…
— আরে না, বাবার থেকে আজকে জানতে চাইছিলাম সিগারেট খাওয়ার কুফল গুলো। আর এটাই বাবা বলতে চেয়ে ছিল। তাই না আমার বাপু। (বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলাম)
— হুমম হুমম (মাথা নাড়িয়ে)
— দেখলে রাজের বাবা, আমাদের ছেলেটা কত্তো ভাল। যা বাবা তুই হাত মুখ ধুয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি। আর যদি তোর বাবাকে সিগারেট খেতে দেখিস তাহলে আমাকে বলিস। বাসায় খাওয়া দাওয়াই বন্ধ করে দিবো।
মা কথা গুলো বলেই রান্না ঘরে চলে গেল আর আমি মাথা নাড়িয়ে চলেছি। তখন বাবা বলল…
— তোর মা তো জানে না তার ছেলে তার বাপের থেকেও এক কাঠি উপরে।
— আরে বাপু রাগো কেন? তোমারই তো ছেলে, একটু আধটু ভুল তো হবেই। নাকি পাশের বাড়ির ছেলে আমি হে…
— কী? ( বাবা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো)
— যাই ফ্রেশ হয়ে আসি।
বলেই চলে গেলাম। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি কারন আমি আমার মনের মত বাবা পেয়েছি। আমি বাবাকে বাপু বলে মাঝে মাঝে ডাকি। আমার বাবা আমাকে সব সময় সাপোর্ট দেয়।

সকালে কেউ কাঁধে হাত রাখা অনুভব করলাম তাই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘুমটা ভাঙ্গতেই দেখি বাবা আমার পাশে বসে আছে। আমি ঘুম চোখে বললাম…
— বাপু কিছু কি বলবে?
— আজ তো তোর অফিস নাই।
— না তো কেন?
— তাহলে এমন করে পরে পরে না ঘুমিয়ে বাজার করে নিয়ে আয় না।
— বাপু একটা দিন কি ঘুমাতে দিবে না?
— রাতে যদি জেগে থেকে ফেসবুক চালাস তাহলে তোকে সকালে কেমন করে ঘুমাতে দেই বল তো।
— হইছে যাচ্ছি তো।
আর বিছানায় থাকা যাবে না। তাই উঠেই ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। প্রায় ৩০ মিনিট পর রুমে এসে দেখি বাবা আমার মোবাইল চার্জে লাগিয়ে কি যেন চেক করছে। আমি তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বললাম…
— বাপু এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো মোবাইলে?
— তোর আর অপর্নার চ্যাট গুলো পড়ছিলাম রে।

কাম সাড়ছে নি। আমি দৌড়ে বাবার হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে নিলাম। আর বাবা জোরে জোরে হাসছে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যি অনেক গুলোই পড়া শেষ। কেন যে রাতে ফেসবুক চালাতে চালাতে ঘুমাই গিয়ে ছিলাম।

— রাজ এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু হয় নি। তোর বয়সে আমিও একটু আধটু মেয়েদের দিকে ঝুকতাম।
— ( কোন কথা না বলে মাথা চুলকাচ্ছি)
— তা মেয়েটা কিন্তু সুন্দর তবে কতদিন ধরে চলছে এইসব।
— বেশি না, মাত্র ২ বছর।
— বাব্বা এটা বেশি না। তাহলে বেশিটা কি রে। পালিয়ে বিয়ে করলে বুঝি বেশি হবে।
— বাবা আমি এইসব করতে পারি?
— চুপ কর তো। বাবা মায়ের সামনে সব ছেলে মেয়েই ভদ্র আর আড়ালে একেক একেকটা বিচ্ছু। তা মেয়েটাকে একদিন বাসায় নিয়ে আসিস তো।
— কিন্তু মা?

— ও টা আমি সামলে নিবো। এই যুগের ছেলে হয়ে তুই এতো ভয় পাস। আমি তো তোর বয়সে তোর মায়ের জন্য কত কিছু করেছি।

— কি করেছো বাপু?
— সে পুরান ইতিহাস।
— বলো না একটু শুনি।

— শুনবি, তাহলো শোন। তখন তোদের মত এতটা ক্লোজ হয়ে ছেলে মেয়ে চলতে পারতো না। আর মেয়েরা একটু বেশিই লজ্জা পেতো। আমি তখন ভার্সিটির ৩য় বর্ষের ছাত্র। গ্রাম থেকে ঢাকা এসে লেখাপড়া করছি। একদম বাংলা সিনেমার মত। জীবনটাও সাদা কালো রংয়ের চলছে। ভার্সিটিতে মেয়ের সংখ্যা কম তবু কাউকেই আমার ভাল লাগে নি। আমি সব সময় পড়ালেখা নিয়েই ছিলাম। একদিন সকালে বকুলতলায় বসে পড়ছিলাম ঠিক সেই অসময়ে বৃষ্টি শুরু হলো। আর উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। ঠিক তখন একটা মেয়ে শাড়ী পড়া,এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। মাথায় যে আমার বৃষ্টি পড়ছে সেটাই মনে নেই। আমি একবার মেয়ের দিকে তাকাই আবার মুখটা নামিয়ে নেই। প্রায় ৫ মিনিট এমন চলার পর খেয়াল করলাম বৃষ্টি পড়ছে না। সাধারন গল্প হলে মানুষ বলতো হয়ত মেয়েটি ছেলেটির মাথায় ছাতা ধরেছে। কিন্তু আমার গল্পে বৃষ্টিটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর তখনই মুখ ফসকে বলে ফেললাম ” এখনি থামার ছিল বৃষ্টি “। কথাটা একটু মুচকি হেসেই বলেছিলাম। আর তখন মেয়েটি পাশ দিয়ে হেটে গেল তবে মুচকি হেসে। কত্তো কিউট হাসিটাই না ছিল।

এরপর থেকে প্রতিদিন সেই হাসি দেখার জন্য গেটে অপেক্ষা করতাম। মেয়েটার নাম,ঠিকানা,কিসে পড়ে, কোন ডিপার্টমেন্টে পরে কিছুই জানতাম না। এভাবে প্রায় চোখের দেখায় এক মাস কাটিয়ে দিলাম। আমি মাঝে মাঝে বুঝতাম ও আমায় দেখে কিন্তু ওর দিকে তাকালেই সব শেষ। একদিন ডিসিশন নিলাম ওই মেয়ের পিছু নিয়ে ওর বাসায় যাবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। মেয়েটার থেকে কম করে ১০ মিটার দূরত্ব রেখে হাঁটতে লাগলাম। এক পর্যায় ওর বাসায়ও চলে আসলাম। তখন মনে হলো আমি মেয়েটাকে এতটা রাস্তা ফলো করলাম আর মেয়েটাও বুঝলো কিন্তু কিছুই বললো না। তার মানে ওর মনেও আমার জন্য ফিলিংস আছে।

এরপর থেকে আমার সাহস দিন দিন বাড়তে লাগলো। প্রতিদিন ফলো করতাম আর দূরত্বও কমছে। একদিন সাহস করে ওকে ডাক দিলাম। মেয়েটা আমার ডাক শুনে চারদিকে তাকিয়ে আমার সামনে আসলো।

— জ্বী বলেন।
— আপনার নামটা কি?
— নিরুপমা। আর আপনার?
— আমি রাজু।
— আর কিছু বলবেন?
— হুমম আমি না আপনাকে….
— আমি আসি। বাসায় দেরি করে গেলে মা বকা দিবে।
আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নিরুপমা চলে গেল আর আমি বুঝার চেষ্টা করছি মেয়েটা আমাকে কথা শেষ করতে দেয় নি কেন?

এভাবে মাঝে মাঝেই নিরুপমার সাথে আমি কথা বলতাম। এক পর্যায় আমি ওর জন্মদিন জানতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নেই রাত বারটায় ওকে শুভেচ্ছা জানাবো আর প্রপোজও করবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমি রাত বারটার দিকে নিরুপমাদের বাসার নিচে চলে গেলাম। কিন্তু এতো রাতে ওকে পাবো কেমন করে? ওদের বাসা ছিল টিনের। তাই দিলাম ঢিল মেরে। প্রথম ৩ টা ঢিলে কিছু হলো না। কিন্তু চতুর্থ ঢিলে দেখলাম তিনটা ছেলে লাঠি নিয়ে আসছে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে দিলাম দৌড়। দুই তিনটা ইটের ঢিলা অবশ্য আমার পিঠে পড়ছিল। যদি মাথায় পড়তো তাহলে তো হয়েই যেত। বাসায় এসে দেখি একটু একটু রক্ত। পড়ে বুঝলান ছিলে গেছে তাই ঔষুধ লাগিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
এরপর দিন নিরুপমা ভার্সিটি আসতেই ও আমাকে দেখে হেসে ফেললো। আমি ওর সামনে গিয়ে বললাম..
— হাসবেন না একদম। আর শুভ জন্মদিন।
— হুমম।
— আমাকে বিয়ে করবেন। অনেক ভালবাসি আপনাকে।
— কী?

ও কিছু না বলে মুচকি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। আর আমি বুঝে গেলাম আমার লাইন ক্লিয়ার। এরপর এমন ভাবেই চলছে আমাদের কথাবার্তা। আমি আমার বাসায় সব জানিয়ে দিলাম। তারপর আমার বাসা থেকে নিরুপমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব গেল। আর নিরুপমার বাবা বলল “যদি চাকরী পাই তাহলে তারা রাজি কিন্তু আপাতত কথাবার্তা বন্ধ রাখতে হবে “। এরপর সব কিছু যে চমৎকার ভাবে হয়ে গেল। একটা চাকরীও পেলাম আর বিয়েটাও করে নিলাম।

— ছেলেকে আর কত বানিয়ে গল্প বলবে?
দরজার সামনে মা খুনতি হাতে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল আর বাবা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
তখন মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল…
— যেমন বাপ তার তেমন ছেলে। যা বাজার করে নিয়ে আয়। আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে। এইসব আষাঢ়ে গল্প ছাড়া আর কিছু না। আজ পর্যন্ত ভালবাসি বলতে পারে নি আর ছেলের সামনে বুড়ো বয়সে ভীমরতী ধরছে।
কথা গুলো বলেই মা চলে গেল আর আমি বাবার দিকে তাকাতেই বাবা বলল…
— এমন করে তাকাইস না সোনা। আমি তো তোর সাহস বাড়ানোর জন্যই গল্পটা বললাম।
— হুমম বুঝছি এবার চলো এক সাথেই বাজারে যাই। নয়ত এখন তুমি বাসায় থাকলে মায়ের বকা ছাড়া আর কিছু কপালে জুটবে না।
— তাই চল।
এরপর বাপবেটা এক সাথে বাজার করতে বেড়িয়ে পড়লাম।

এভাবে আমার বাপুর ভালবাসা আর মায়ের শাষনে আমাদের পরিবার বিন্দাস চলছে কিন্তু আমার বাপু বিয়ের জন্য প্যারা দিতে লাগলো। ওনার কাছে নাকি মনে হয় ওনি বেশি দিন বাঁচবে না। আমি আমি এইসব হেয়ালি করে বাদ দিয়ে দেই।

একবার রাতে ঘুমাচ্ছি হঠাৎ মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মা খুব জোরে আমার নাম ধরে ডাকছে আর কান্না করছে। আমি তো ভয় পেয়ে দৌড়ে গেলাম মায়ের রুমে। গিয়ে দেখি বাবা বুকে হাত দিয়ে ছটফট করছে। তাই আর অপেক্ষা না করে তারাতারি ওনাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে চলে গেলাম। জরুরী বিভাগে যেতেই চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে আমার খেয়ালই নেই। তারপর ডাক্তার বলল, ওনার ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটার্ক হয়েছে। ওনাকে টেনশন দেওয়া যাবে না এমন কিছু না করতে। আমি ভেবে পাচ্ছি না আমাদের সুন্দর পরিবারে কিসের এতো টেনশন।

সকাল হতেই বাবাকে নিয়ে বাসায় আসলাম। বাবাকে ঔষুধ খাইয়ে দিয়ে আমি আমার রুমে ঘুমাতে চলে আসলাম আর ঘুমিয়ে গেলাম। কারন রাত প্রায় আড়াইটা থেকেই জেগে আছি। আমাদের বাড়িটা কিছুদিনের জন্য যেন চুপ হয়ে গেল।

বিকালে আমার ঘুম ভাঙ্গতে বাবাকে আমার মাথার কাছে দেখলাম। বাবা আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে।
— কিছু বলবে বাপু?
— এবার তো একটা বিয়ে করে নে?
— তুমি যখন বলছো তখন আমি মানা করবো না তবে…
— তবে আর বলতে হবে না। তুই অপর্নাদের বাসার ঠিকানা দে আমিই কথা বলে আসছি।
— তুমি তো অসুস্থ।
— ছেলের ঘটকালিতে কোন বাপই অসুস্থ না।
— লাভ ইউ বাপু।
— লাভ ইউ আনলিমিটেড সোনা।
বাপু আমার থেকে ঠিকানা নিয়ে চলে গেল ছেলের বিয়ে ঠিক করতে। এমন বাবা যেন সবার কপালেই জুটে। বাপু তোমায় খুব খুব খুব ভালবাসি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত