আমার বয়স যখন মাত্র ৪ বছর। এই চার বছর বয়সে আমার আম্মু আমাকে আমাদের নানু বাড়িতে দিয়ে আসেন। আমি অনেক কান্না করেছিলাম আমি যাব না আমি যাব না কিন্তু আম্মু আমার কোনো কথা ওই শুনেন নি। সেদিন আমি আমার আম্মুর হাতে অনেক জোরে কামড় দিয়েছিলাম। আম্মু আমাকে সেদিন অনেক জোরে একটা থাপ্পড় দিয়েছিলেন। সেদিন আমি আবার আমার আম্মুর শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে কান্না করেছিলাম। কি বোকা ছিলাম। আম্মু আমার নানু কে বলেন আমি যদি আমাদের বাসায় যেতে চাই তাইলে আমাকে যেন ধরে মারেন। নানু মুচকি হাসি
দিয়ে বলেন ” দূর পাগলি নানু ভাই কে কেন মারব। আমার নানু ভাই টা কত ভালো। তারপর আম্মু রাস্তা দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে আসতে লাগলেন। আমি কত খুশি। আমার নানু কে পেয়ে। রাতে নানু আর আমি ঘুমিয়ে আছি। আমার এতো প্রসাবে ধরছে। নানু কে অনেক ডাক দিলাম কিন্তু নানু আমার কথা শুনতে ওই পান নি। শেষে আর কি করব বিছানাপত্র ভিজিয়ে দিলাম। সকালবেলা নানু আমাকে অনেক বকা দিলেন। আমি হেসে হেসে বলে দিলাম ” নানু আমাকে রাগাতে এসো না নইলে রাতের বেলা তোমার উপরে প্রসাব করে দিব। ” নানু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন এসব পারে না গাধা। আমি নানুকে বললাম ” নানু আমি এখানে কেন এসেছি?
নানু বললেন বেড়াতে। আমি নানু কে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরলাম। নানুর কাছে প্রায় একমাস থাকলাম। তারপর বাসায় চলে আসলাম । আম্মু আমাকে দেখেই আমাকে কোলে করে হাসতে লাগলেন। আব্বু আমাকে দেখে বললেন আমার বাবু টা চলে এসেছে। আমাকে একটা আদর দিলেন।
আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। তখন মা আমাকে মাত্র একদিন দশ টাকা দিলেন। স্কুলে যাওয়ার পর দেখলাম একটা মেয়ে বার্গার খাচ্ছে। কিন্তু আমি সেটার নাম চিনি না। আমি মেয়ে কে বললাম ” আমাকে দিবে? ”
মেয়ে টা কান্না করে তার আব্বু কে ডাক দিল। তার আব্বু আসার পর মেয়ে কে বললেন ” এসব ছেলেদের কাছে যাবে না। এসব ছেলে রাক্ষস। এরা কিছু খেতে পারে না। ” আমি আমার আম্মুকে এসে জিজ্ঞাস করলাম ” আচ্ছা আম্মু রাক্ষস কি? যারা অন্যর খাবার চুরি করে খায় তারা রাক্ষস। আমি বললাম আম্মু জানো আমাকে একটা লোক রাক্ষস বলেছেন । আম্মু বললেন ” কেন বাবা? ”
আমি বললাম আম্মু একটা মেয়ে কে দেখলাম ” কি যেন একটা খেতে। মেয়েটা খুব মজা করে খেয়েছিল। তাই আমিও খেতে চাইলাম। মেয়েটাকে বলতেই মেয়েটা তার আব্বু কে ডাক দেয়। পরে উনি আমাকে রাক্ষস বলছেন। আম্মুর চোখে সেদিন পানি দেখেছিলাম। আমি সেদিন হেসে বলছিলাম ” আম্মু তোমার চোখে বৃষ্টি এসেছে। ” আম্মু খিলখিল করে হাসি দিয়ে আমাকে জুড়িয়ে ধরে ছিলেন। তারপর আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার মাথার কাছে অনেক খাবার। আমি আম্মুকে ডাক দিয়ে সব খাবার খেয়ে নিলাম। আম্মু এসে আমাকে মারলেন। আমি কান্না করছিলাম। আর আম্মু কে বকা দিয়েছিলাম। আম্মু তুমি পঁচা। আম্মু তুমি পঁচা। তারপর আম্মুর সাথে কথা বলে নি।
দুই দিন পর আম্মু কে বললাম আম্মু আমাকে ব্যাগ কিনে দিবে আমি স্কুলে নিয়ে যাব। আম্মু আমার গাল টা হাতিয়ে বললেন আগামী মাসে তোর আব্বু বেতন পেলে কিনে দিব। আমি খুশি হয়ে স্কুলে যেতে লাগলাম। রাস্তায় দেখি আমার সাথে ওই মেয়েটার দেখা হলো। মেয়েটার নাম আনিকা। দেখতে খুব সুন্দর। আমি মেয়েটাকে বললাম ” তোমার ব্যাগে আমার বইগুলা রাখবে?
মেয়েটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আমি সেদিন রাস্তায় পড়ে হাতে রক্ত বের হয়েছিল। আমি কান্না করে করে স্কুলের ভিতর ঢুকলাম। মেয়ে টা আমাকে বলে ” বাবা বলছেন তুই গরীব আমার সাথে কথা বলবি না। আমি তো মাত্র ওয়ানে পড়তাম। তখন গরীব শব্দ কি বুঝতাম না। তাই স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাসায় গিয়ে আম্মুকে বললাম আম্মু গরীব কি? ” আম্মু তখন বুঝতে পারলেন আমাকে কেউ স্কুলে গরীব বলেছে। আম্মু কপালে চুমু দিয়ে বলেন যাদের টাকা নেই। তারা গরীব। আমি আম্মু কে বললাম ” আম্মু আমাদের গাড়ি নেই কেন? ওই মেয়েটার গাড়ি আছে। ও প্রতিদিন গাড়ি দিয়ে স্কুলে আসে। ” আম্মু আমাকে একটা থাপ্পড় দিলেন। তুই প্রতিদিন স্কুল থেকে কিছু একটা দেখে এসে আমাকে বলিস কেন? আমাকে আর কোনো দিন কিছু বলবি না। আমি তখন রাতে কান্না করে ঘুমিয়ে
গিয়েছিলাম। আমি তখন বুঝতাম না আম্মু কে এসব কথা বললে আম্মু নিজে কষ্ট পান। আম্মুর খুব কষ্ট হয়। আম্মুর নিজের জন্য না আমার জন্য। একদিন আমি স্কুলে যাওয়ার সময় আম্মু কে বললাম আম্মু আমাকে ৫০ টাকা দেও। আম্মু আমাকে ৫ টাকার নোট দিয়ে বলেছিলেন এই নে ৫০ টাকা।
তারপর আমি একটা দোকানে গিয়ে ৩০ টাকার মিঠাই খেয়েছিলাম। যখন টাকা দিয়ে ছিলাম তখন দোকানদার বলে আমার আর পঁচিশ টাকা কোথায়? আমি দোকানদার কে বললাম আম্মু তো বললেন এই টা ৫০ টাকা। দোকানদার আমার আম্মু কে বলে আম্মু নাকি মিথ্যাবাদী। আমার তখন রাগ উঠে গিয়েছিল। আমি দোকানদার কে বকা দিয়ে দৌড় দিয়ে স্কুলের ভিতর চলে আসি।
আমি যখন ক্লাস অষ্টম শ্রেণীতে উঠি তখন দেখতে পেলাম আনিকার বাবা আনিকাকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। আগে অন্য স্কুলে পড়ত। আনিকা আমাকে দেখে প্রথম ওই চিনতে পারে। কিন্তু কথা বলে নি। আমরা যখন ছোট বেলায় এক সাথে পড়তাম তখন মা বলছিলেন আনিকার সাথে কথা না বলতে কারণ তাদের অনেক টাকা আছে। তারপর থেকে আমি আনিকার সাথে কথা বলি নি। এখন আমরা দু’জন এক ক্যাম্পাসে থাকি। আনিকার দুই একটা ছেলে বন্ধু আছে। ওরাও আনিকার মতো বড় লোক। কিন্তু আনিকা আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার সাথে আনিকার মাঝে মাঝে দেখা হয় কিন্তু আমি চুপ থাকি। একদম কথা বলি না। একদিন আমি ক্লাস রুমে ঢুকতে ছিলাম এমন সময় দেখি আনিকা আমার সামনে দিয়ে আসছে। এমন সময় আমি লুকিয়ে যাই। কিন্তু আনিকা আমার দিকে আসছে না কেন? আমি তা দেখতে লুকিয়ে তার দিকে তাকালাম। আনিকাকে দেখতে পেলাম সেও লুকিয়ে আমাকে দেখছে। তারপর আমি বুকে সাহস নিয়ে তার দিকে যেতে লাগলাম। মনে মনে একটু একটু ভয় পেলাম। তারপর তার কাছ থেকে আমি রক্ষা পেলাম। তার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেলাম।
আনিকা আর তার বন্ধুরা মিলে অনেক হাসিহাসি করতাছে। আমি একটা গাছের নিচে বসলাম। আমার হাতে একটা বই ছিল। আমি বই দিয়ে মুখ টা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে শুরু করলাম। এক সময় আমি মুখের সামনে থেকে বই সরিয়ে রাখতেই আনিকা কে দেখতে পেলাম আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি খুবি অবাক হলাম। আমার দিকে এভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে কেন? তারপর আমি বই ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে চলে আসি।
আমি যেই স্কুলে পড়তাম কিন্তু সে স্কুলে আমার আর পড়া হয় নি অন্য স্কুলে টান্সফার হয়ে চলে যাই। বাবা মার সাথে। সেখানে যাওয়ার পর আনিকার কথা আমার অনেক মনে পড়ত। তাকে ভুলার অনেক চেষ্টা করতাম কিন্তু পারি নি।
আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। একটা ভার্সিটি তে হিসাববিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হলাম। প্রথম দিন ক্লাস করতে গেলাম। আমার অনেক দেরি হয়ে গেল। ক্লাস রুমে ঢুকতেই একটা মেয়ের সাথে দরজার সামনে ধাক্কা গেলাম। আমার এতো টাই রাগ উঠেছিলি বলতে চাইছিলাম ভালো ছেলে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না বুঝি। কিন্তু আমি বলতে পারি নি। কারণ মেয়েটা ছিল আনিকা। তখন আমি এতো টাই লজ্জা পাচ্ছিলাম নিজের বই খাতা সেখানে ফেলে এসেছিলাম। আমি ক্লাস রুমে ঢুকে একটা রুমে এসে চুপ করে বসে রইলাম। আমি একটা সময় দেখতে পেলাম আনিকা আমার রুমে এসে প্রবেশ করল। আমি তো পুরাই থমকে রইলাম। চশমা টা ভালো করে ঠিক করলাম আরে এইটা তো টিকি আনিকা।
আনিকা কে দেখলাম কিছু ছেলেরা হাই হ্যালো বলল। আনিকাও বলল। আনিকা খুব হাসাহাসি করল। আমি দূর থেকে বসে বসে দেখলাম। তারপর আমার কি জন্য খারাপ লাগলো নিজেও বলতে পারলাম না। তবে এতো টুকু বলতে পারব আনিকার জন্য। আনিকার জন্য তার বাবার গাড়িটা নিয়ে ড্রাইভার হাজির হলো। আনিকা গাড়িতে উঠে বসে রইল। ড্রাইভার আমার কাছ দিয়ে গাড়িটা নিয়ে গেল। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তারপর চশমা টা ঠিক করে হাটতে লাগলাম।
আমার তো ছাতা নাই। তাই আমি ছাতা ছাড়া ভার্সিটিতে গেলাম। ভার্সিটি ছুটির পর অনেক বৃষ্টি আসল। আমি ভিজে ভিজে বাসায় আসতে লাগলাম। কিন্তু আনিকা কোথায় থেকে এসে আমাকে ভিজিয়ে গেল। আমি প্রথম জানতাম না এইটা আনিকার গাড়ি। তাই আমি আমার ব্যাগ টা গাড়ির উপর ফেলে দিলাম। আনিকা গাড়ি টা থামিয়ে আমার দিকে আসতে লাগল। আমি ব্যাগ টা হাতে তুলে একটা দৌড় দিলাম। আনিকা আমাকে ডাক দিয়েছিল কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে থাকিয়ে নি। আনিকা একটা জল্লাদনি। ছোট বেলায় আমার উপর কত অত্যাচার করেছে । সব আমার মনে আছে।
আমাদের ভার্সিটি তে আজ বড় ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমি একটা পাঞ্জাবি পড়ে গেলাম। আনিকা কে দেখতে পেলাম একটা শাড়ি পড়ে এসেছে। আনিকা চুল গুলো কত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। আমি মুক্ত হয়ে দেখতে লাগলাম। আমার ইচ্ছা হয় আনিকা কে বলতে আনিকা তোমাকে আমি বট ভালবাসি। তোমাকে নিয়ে আমি সাগরের সাথে তাল মিলিয়ে সাগরের মাঝে বসবাস করতে চাই। তোমাকে নিয়ে একটা রিক্সায় ছড়ে ঘুরতে চাই। তোমাকে নিয়ে এক কাপ কফি খেতে চাই। আমার অনেক ইচ্ছা হলো আনিকার সাথে কথা বলতে তাই তার দিকে যেতে লাগলাম। যেই দেখলাম আনিকার গাড়ি। তখন ওই আমার মন টা খারাপ হয়ে যায়। কারণ আনিকা প্রতিদিন গাড়িতে করে ভার্সিটি তে আসে। আর আমি কি করে আসি রিক্সায় করে। আমি ভাবতে লাগলাম আনিকার সাথে আমার হবে না তাই আমার সব ইচ্ছা আকাশের দিকে উড়িয়ে দিলাম। আমার চুল টা উড়ছে। আমার যে কি ভালো লাগছে। যা চাই আমরা তা সব সময় পাই না । হয়তো আমার ইচ্ছা টা আমার যোগ্যতা থেকে অনেক বেশি ছিল।