আজকাল আমরা যেরকম কল টিপলেই পানি পাই আগেকার দিনে সেরকম ব্যবস্থা ছিল না। প্রযুক্তর উন্নতির সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো খুব সহজ হয়ে গেছে। সে কারণেই আমরা এখন ঘরের ভেতরেই পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের মতো প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো হাতের কাছে পাচ্ছি। প্রাচীনকালে কিন্তু একই রকমের প্রয়োজনীয়তা মানুষের ছিল। প্রযুক্তি ছিল না বলে মানুষ অনেক কষ্ট করে সেসব প্রয়োজনীয়তা মেটাতো। যেমন- পানির প্রয়োজনীয়তা। পানি এত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান যাকে জীবনের সাথে তুলনা করা হয়। এই পানির চাহিদা মেটাতে আগেকার দিনের মানুষেরা খাল খনন করত বা কূপ খনন করত। অনেক অনেক দূর থেকে যেখানে পানি ছিল সেখান থেকে খাল কেটে কেটে মাঝে মাঝে কূপ বানিয়ে পানি জমিয়ে রাখত এবং সারা বছর ধরে সেই পানি ব্যবহার করতো। এর কোনো বিকল্প ছিল না।
তো এই খাল খনন করা কিংবা কূপ খনন করার কাজটাকে সমাজের দৃষ্টি অত্যন্ত নেক এবং পূণ্যের কাজ বলে মনে করা হতো। কেননা এরকম একজনের অবদানে পুরো এলাকার মানুষ উপকৃত হতো। সে কারণে যে-ই খাল খননের কাজ করত কিংবা করাতো তাকে সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধা এবং সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত।
অনেক অনেক দিন আগে অর্থাৎ ইরানে যখন এভাবে খাল খনন করার রেওয়াজ ছিল তখন এক পূণ্যবান লোক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল খাল খনন করবে, কূপ খনন করে মানুষের দোরগোড়ায় পানি পৌঁছে দেবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই ভদ্রলোক একজন দক্ষ খাল খননকারীকে নিয়োগ দিল। খননকারী তার কাজের সুবিধার্থে বেশ কয়েকজন শ্রমিককে দিয়ে কাজ শুরু দিল। ইরান পাহাড় পর্বতের দেশ, মরু এলাকাও কম নয়। এ কারণে ইরানে পানির স্তর মাটির অনেক গভীরে। তাই পানির নাগাল পাবার জন্য অনেক গভীর কূপ খনন করতে হয়। শ্রমিকেরা তাই করল। বহুদিন, বহু সপ্তাহ ধরে কূপ খনন করল। বেশ গভীর কূপই বলা যায়। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। পানির স্তরে পৌঁছানো গেল না। যে ভদ্রলোক কূপ খনন করাচ্ছিলেন তিনি প্রতিদিনই বিকেল বেলা একবার এসে কাজের খোঁজখবর নিতেন। তাদের মজুরি দিতেন এবং পানির নাগাল পাওয়া গেল কি গেল না জিজ্ঞেস করতেন।
কাজ শুরু হবার প্রথম কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ কূপ খননকারী ভদ্রলোককে আশাবাদী জবাব দিত অর্থাৎ বলত যে আর অল্প বাকি ইনশাআল্লাহ অচিরেই পানির স্তরে পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু এভাবে আরো বহুদিন যাবার পরও যখন পানির নাগাল পাওয়া গেল না তখন সে ভদ্রলোককে নেতিবাচক জবাব দিতে শুরু করল তবে সরাসরি বলল যে না, পানির নাগাল পাবার কোনো আশা নেই।
বেচারা কূপ খননকারী এত দক্ষ অথচ কোনোভাবেই পানিস্তরে পৌঁছতে না পেরে তার মনটাই ভেঙে গেল। কাজে একেবারেই মন বসছিল না তার। এতগুলো কূপ খনন করল অথচ একটা কূপেও পানির নাগাল পেল না-বেচারা একেবারেই হতাশ হয়ে গেল। ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার মুখ। কী আশ্চর্য! সাধারণত যতটা গভীর কূপ খনন করা হয় সে তারচেয়েও বেশি কূপ খনন করেছে। অথচ ভাগ্যে পানির দেখা মিলল না। দক্ষ কূপ খননকারী এখন কী জবাব দেবে! মজুরিও নেয়া হয়ে গেছে।
উপায়ন্তর না দেখে সে এখন মাটি এবং জায়গার দোষগুণ খুঁজে বেড়াতে শুরু করল এবং মালিককে বলতে লাগল: এখানে তো জায়গাটা টিলার মতো উঁচু… ওখানে মাটি বেশি শুকনো.. এটা সেটা…আগডুম বাগডুম…..ইত্যাদি। এমনও বলল: মালিক যদি আরো আগেই আশা ছেড়ে দিত তাহলে এরকম হতো না। কিন্তু মালিক যথারীতি সন্ধ্যে বেলা ঠিকই আসতেন এবং শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে যেতেন। সবাইকে বলতেন: আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে কাজ চালিয়ে যাও! অবশ্যই পানির নাগাল মেলবে। কী আর করা। দক্ষ কূপ খননকারী কাজ চালিয়ে যেতে লাগল।
একদিন সে মালিককে বলেই বসল: ‘আমার মনে হয় এখানে পানি পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমরাও লোহার সাবল মারতে মারতে জীবন ক্ষয় করছি তোমারও খামোখা আর্থিক ক্ষতি হয়েই চলছে। আমার মনে হয় এরচেয়ে বেশি ক্ষতি হবার আগেই এখানে কূপ খননের কাজ বাদ দিয়ে অন্য কোনো ভালো জায়গা বেছে নেয়া ভালো।’
মালিক বললেন: ‘না, এখানে টিলা বল আর যাই বল, জায়গাটা খুবই ভালো। এখানে বহু মানুষের বসবাস আছে। তাদের সবারই পানির প্রয়োজন রয়েছে। অতএব খনন কাজ চালিয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে। আর আল্লাহর অনুগ্রহের ব্যাপারে নিরাশ হওয়া ঠিক নয়, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে, তাঁর সাহায্যের ব্যাপারে আশাবাদী হতে হবে।’
কূপ খননকারী বলল: আমি এ পর্যন্ত দশটা খালের কাজ করেছি। কোনোটাতেই এতোদিন কাজ করতে হয়নি এবং এত সময়ও লাগেনি পানির স্তর পেতে। আমার মনে এখানে পানির সাক্ষাৎ পাবার ব্যাপারে আর কোনো আশা নেই।
পূণ্যবান সমাজসেবী বললেন: যে কূপে পানির স্তর একটু দেরিতে মেলে সে কূপ এবং সে পানি তুলনামূলকভাবে ভালো। কেননা সেই কূপে পানিও বেশি থাকে, ফলে বেশি বেশি মানুষের উপকারে আসে। নিরাশ হয়ো না, কাজ চালিয়ে যাও!
কূপ খননকারী বলল: হুজুর! আমার কাজই তো কূপ খনন করা। আমি জানি এই টিলায় যতোই খনন করি, কাজ হবে না। পানির দেখা মেলবে না হুজুর! আমরা বরং বাদ দেই। ক্লান্ত হয়ে গেছি।
সমাজসেবি বললেন: দেখ! আশার কোনো আলো না দেখেও আমি খরচ করেই যাচ্ছি, যদিও এখনও কোনো ফল পাইনি, তবুও চালিয়ে যাচ্ছি। ক্লান্ত হলে তো আমি হব, হতাশ হলে আমার হবার কথা, তোমরা কেন ক্লান্ত হচ্ছ, হতাশ হচ্ছ! পানি পাওয়া যাক বা না যাক তোমাদের কাজ তোমরা করছ এবং মজুরিও নিচ্ছ। নিচ্ছ না? তাহলে তোমরা অজুহাত খুঁজছ? কেন এরকম গরগর করছ? এই কূপগুলো থেকে আমার ভাগ্যে যদি পানি নাও থাকে, তোমাদের রুটির ব্যবস্থা তো হচ্ছে! তোমরা তোমাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাক! হতাশাজনক কথাবার্তা আর বলবে না।
কূপ খননকারী এবং তার শ্রমিকদের করার আর কিছুই ছিল না। অগত্যা কূপ খননের কাজ চালিয়েই যেতে হল।
পূণ্যবান সমাজসেবী লোকটি ঠিকই বলছিল। শ্রমিকদের তো কোনো ক্ষতি হচ্ছিল না। তারা তো ঠিকই তাদের মজুরি পেত। সে জন্যে তারা তাদের কাজ চালিয়ে গেল। খনন করতে করতে এক সময় ঠিকই পানির দেখা মিলল। প্রচুর পরিমাণ পানি। যেমন মিষ্টি তেমনি সুস্বাদু।
এই ঘটনার পর থেকে যখনই কেউ নিজের লাভ রয়েছে এমন কোনো কাজ না করতে টালবাহানা করে, তখনই বলা হয়: কেন কাজ করতে চাচ্ছ না! ‘আমার ভাগ্যে পানি না থাকলেও তোমার তো রুটির ব্যবস্থা ঠিকই আছে।