এক শিকারী তার তীর ধনুক হাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল গভীর জঙ্গলে। সতর্কতার সাথে পা টিপে টিপে শিকারী বনের ভেতর পায়চারী করতে লাগল শিকারের খোঁজে। বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে শিকারী ক্লান্ত হয়ে গেল। তার কপাল থেকে ক্লান্তির ঘাম ঝরতে লাগল। কিন্তু কোনো শিকারই খুঁজে পেল না। অবশেষে আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়েই কপালের ঘাম মুছে নিল। তীর ধনুক রেখে দিল মাটিতে। এদিক ওদিক তাকাল। কোত্থাও কোনো শিকার দেখতে পেল না। এমনকি একটা পাখিও আকাশে উড়তে দেখা গেল না। ক্ষোভে দুঃখে গরগর করে শিকারী বলতে লাগল: ‘আজকের দিনটাই মাটি। এত বড় বন অথচ একটা শিকারেরও দেখা মিলল না। কোথায় পালিয়ে গেল সব’।
হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল শিকারী। সহসা ঘাসের ভেতর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল তার কানে। শিকারী দ্রুত তার তীর ধনুক মাটি থেকে তুলে নিল এবং আড়ালে লুকাল। তবে চোখ কান খাড়া করে রাখল। আবারও শুনতে পেল ঘাসের ভেতরের শব্দ।
ঘাসের দিকে তাকিয়ে দেখল বেশ বড় বড় ঘাস। হঠাৎ ওই ঘাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা হরিণ। দেখতে বেশ সুন্দর এবং নাদুস নুদুস। হরিণের অন্যদিকে কোনো খেয়ালই নেই। আশেপাশে যে শত্রু থাকতে পারে সেই খেয়ালও নেই তার। আনমনে পার্থিব চিন্তায় মগ্ন সে। একরকম গর্বের সাথে গটগট করে চলছিল সে। শিকারী আনমনা ওই হরিণের কাণ্ড দেখে বাঁকা চাঁদের মতো আলতো একটা হাসির রেখা টেনে ধরল তার ঠোঁটে। মনে মনে বলল: ‘আজব শিকার বটে! তাকে পালাতে দেয়া যাবে না কোনোভাবেই’।
অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শিকারী তার তুণ থেকে একটা তীর বের করে ধনুকে জুড়ল। শিকারী জানে সামান্য শব্দ হলেও শিকার পালিয়ে যেতে পারে। তাই নিঃশব্দে ধনুকটাকে উপরে তুলে হরিণকে টার্গেট করল শিকারী। দেরি করে লাভ নেই তাই দ্রুত সমস্ত শক্তি এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে হরিণকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারল। একেবারে পাকা শিকারী। লক্ষ্যচ্যুত হলো না, ঠিক ঠিক হরিণের বুকে গিয়ে বিঁধে গেল তীর। বেচারা হরিণ বিন্দুমাত্র নড়াচড়াও করল না। মাটিতে পড়ে গেল।
শিকারী দ্রুত দৌড়ে গেল হরিণের কাছে। শিকারের বুকে বিঁধে যাওয়া তীরটা টেনে বের করল। শিকারের হাতিয়ার গুছিয়ে নিয়ে শিকারী এবার মৃত হরিণটাকে কাঁধে নিয়ে ফিরে চলল বাড়ির দিকে। তার কণ্ঠে তখন প্রশান্তি আর আনন্দের প্রকাশ প্রাণখোলা গান: আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে….
গান গাইতে গাইতে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেল শিকারী। খুব একটা দূরে নয় বনের কাছেই ছিল শিকারীর বাসা। মনের আনন্দে হেঁটে হেঁটে বাসায় যাবার পথে আবারও তার কানে ভেসে এলো খস খস শব্দ। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল। মনে মনে ভাবল: ‘আরেকটা হরিণ নয় তো! হতেই তো পারে। তাহলে তো সতর্ক হতে হয়! কোনোভাবেই শব্দ করা ঠিক হবে না। কিন্তু একটা হরিণ তো পেলাম। আরেকটা কি শিকার করব’?
কিছুক্ষণ ভাবল শিকারী। একটু পরেই মনে মনে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে বলল: ‘একটা পেয়েছি তো কী হয়েছে! বিক্রি করে দেব! বিক্রির টাকা দিয়ে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনব’।
যেই চিন্তা সেই কাজ। ঘাড় থেকে মৃত হরিণটাকে মাটিতে রাখল শিকারী। আবারও তীর ধনুক প্রস্তুত করল। তার কানে খস খস শব্দ পুনরায় ভেসে এল। শিকারী কিন্তু ততক্ষণে পুরোপুরি প্রস্তুত। হরিণ দেখার সাথে সাথে তীর মারবে। আগের মতোই একেবারে সোজা বুকে মেরে দেবে।
চিন্তা করতেই জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা বুনো শূকর গরগর শব্দ তুলে দৌড়ে গেল শিকারীর সামনে দিয়ে। শিকারীও কম যায় না। সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ে মারল তীর। অভিজ্ঞ শিকারীর তীর লক্ষ্যভেদ করল। শূকরের ঘাড়ে গিয়ে বিদ্ধ হলো তীর। কিন্তু না। শূকর হরিণের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়লো না। তার ঘাড় থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছিল তখনো।
তবু থামল না বরং আরও হিংস্রভাবে দৌড়তে লাগল। শিকারী তাই আরেকটা তীর প্রস্তুত করল। এই তীরটি লক্ষ্যভেদ করল হয়তো শূকর মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। কিন্তু ততক্ষণে তীরবিদ্ধ শূকর শিকারীর কাছে এসে গেল। কাছ থেকে শূকরের আহত অবস্থা দেখে শিকারী তার কষ্টটা অনুভব করল। তীর আর ছোঁড়া হলো না। শূকর পাল্টা হামলা চালাল।
শিকারী এবং শিকারের মধ্যে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যে জিতবে সে-ই বেঁচে যাবে। কিন্তু সহজে যুদ্ধ থামল না। দীর্ঘক্ষণ ধরে ব্যাপক সংঘর্ষের ফলে উভয়েই মারাত্মক আহত হলো। শূকর এবং শিকারী উভয়ের শরীর থেকেই ভয়াবহরকমের রক্তক্ষরণ হলো। তারা এতোই দুর্বল হয়ে পড়লো যে,কারুরই আর উঠে সোজা হবার জো রইলো না। মৃত হরিণের পাশে শূকর এবং শিকারী লুটিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মরে গেল। যুদ্ধে কেউই জিততে পারল না। মৃত শিকারীর হাতে তখনও তীর ধনুক এমনভাবে প্রস্তুত ছিল যে দেখলে মনে হবে এক্ষুণি বোধ হয় ছুঁড়ে মারবে। কিন্তু ছুঁড়ে মারার সেই শক্তি আর কোথায়।
একটি হরিণ, একটি শূকর আর একজন শিকারীর লাশ পাশাপাশি পড়ে আছে। রক্ত ঝরছে। কী করুণ দৃশ্য তাই না! একটু আগেও তারা সবাই জীবিত ছিল। নিঃশ্বাস নিতো। অথচ সামান্য সময়ের ব্যবধানে সবাই এখন মৃত। তাদের নিঃসাড় দেহগুলো পড়ে আছে মাটিতে। ঠিক সেখানেই মাংসের গন্ধ শুঁকে শুঁকে এল বিশাল এক নেকড়ে। ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিল সে। খাবারের সন্ধানেই ঘুরছিল। হঠাৎ নাকে রক্তমাংসের ঘ্রাণ পেয়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে এসে এতো এতো খাবার দেখে তো নেকড়ে হতবাক। বিশ্বাসই হচ্ছিলো না তার। তিন তিনটে শিকার একসাথে,বিনা পরিশ্রমে! খুশিতে হাঁক দিয়ে মৃতদেহগুলোর চারদিকে বৃত্ত রচনা করছিল ঘুরে ঘুরে। উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলল: ‘হে ক্ষুধার্ত নেকড়ে! তোর খাবার তো প্রস্তুত রে! খা! পেট পুরে খা’!
হঠাৎ নেকড়ের মনে একটা বুদ্ধি এলো। ভাবল: ‘সব খাবার একদিনে না খেয়ে আজ কেবল একটা খাব। বাকি দুটোকে লুকিয়ে রাখব কোথাও। কটা দিন ভালোভাবেই কাটবে। বিনাশ্রমে মজার মজার খাবার খাব, মন্দ কী! কিন্তু কোথায় লুকানো যায়। এমন জায়গায় লুকাতে হবে কেউ যাতে খেয়ে ফেলার সুযোগ না পায়। আগে দুপুরের খাবারটা সেরে ফেলা যাক, তারপর লুকানোর চিন্তা করা যাবে।’
এই বলে নেকড়ে প্রথমেই গেল মৃত শিকারীর লাশের কাছে। তাকে দিয়েই দুপুরের খাবার সারবে বলে ভাবল। দেখেই মনটা জুড়িয়ে গেল নেকড়ের।
একেবারে তরতাজা। এখনো রক্ত ঝরছে। নাকটা লাশের কাছে নিয়ে শুঁকল আর পায়ের পাঞ্জা দিয়ে নাড়া দিয়ে দেখতে চাইল সত্যিই মরা কিনা! কিন্তু পাঞ্জা দিয়ে নাড়া দিতেই মৃত শিকারীর হাতের প্রস্তুত তীরটা বেরিয়ে গিয়ে সোজা বিঁধে গেল একেবারে নেকড়ের বুকে। কোত্থেকে কী হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারছিল না নেকড়ে। শুধু টের পেল তার চোখ দুটো বুঁজে আসছে।
ঢুলুঢুলু চোখে টলমল দেহে পায়চারী করতে করতে মৃতদেহগুলো থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল নেকড়ে। মনের গহীনে তার পড়ে রইল দুপুরের খাবার, যেমন ছিল ঠিক তেমনি। ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের জন্য গোপন জায়গাটিও আর খোঁজা হলো না তার।