সাযযাদ কাদির
ছেলেমেয়ের ভাবগতিক ভালোই বোঝেন নির্মলা। পাখা গজাবার পর থেকে মা-বাপকে চেনে না আর। সব সময় মগ্ন ও মত্ত নিজেদের নিয়ে, বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে। ঘরে পরিবারে থেকেও ঘর-পরিবারের ধার ধারে না, কারও প্রতি আবেগ-অনুভূতি নেই এতটুকু। ইচ্ছা-খুশি মতো চলে চরম স্বার্থপরের মতো- এমন সন্তানের কথা ভাবা যায়! যায় না, কিন্তু নিজেই এখন দেখছেন, সইছেন কুপুত্রকন্যার যাবতীয় নষ্টতা আর ধৃষ্টতা। কী আর করা! মুখ বুজে থাকেন, কখনও কিছু বলেন না কাউকে। কিন্তু একটা সীমাও তো আছে সহ্য করার! মেয়ের উদ্ধত দুর্বিনীত ভাবসাব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আত্মীয়-স্বজন কেউ পারতপক্ষে আসে না বাড়িতে। বাইরে কী করে কে জানে! আর ছেলের চলন-বলন বাড়িতেই এমন যে মা-বাপ হয়েও গা জ্বলে তাঁদের, আর বাইরের ব্যাপারস্যাপার তো ভাবাই যায় না! কোথায় কখন কী যে করে সে!
কী যে করে সে সব নির্মলা শোনেন মাঝেমধ্যেই। লঘু-গুরু মান্য নেই, যার তার সঙ্গে যেমন তেমন ব্যবহার করে, বলতে গেলে রীতিমতো দুর্ব্যবহারই করে কথায়-কথায়। বাড়িতে মুখ গোঁজ করে থাকলেও বাইরে চ্যাটাং-চ্যাটাং করে সব সময়। স্বামী ভবনাথকে কিছু বলা বৃথা। তিনি বলেন, সব দোষ তোমার! কোনও দিন ধমক দিতে, শাসন করতে দিয়েছো ছেলেমেয়েকে? এখন শূয়রের দাঁত বেরিয়ে গেছে, ও আর ঢোকানো যাবে না!
নির্মলা সিনেমা-থিয়েটারের দজ্জাল গিন্নীদের মতো ঝঙ্কার দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন- তোমার কোনও দোষ নেই! কোনও দিন দেখভাল করেছো ওদের, খোঁজখবর রেখেছো কিছু?
হা হয়ে যান ভবনাথ, আমি ঘুরবো ওদের পিছু-পিছু? কোথায় যায়, কী করে- সব দেখবো? তাহলে হাঁড়ি চড়বে তোমার?
ও কাজকম্ম বুঝি তুমি একাই করো? আর কেউ করে না?
ওগুলোর একটাকে বিয়ে করলেই পারতে! ওই যে একটা লোক… নিম্মি-নিম্মি বলতো তোমাকে… দেখলেই ‘জিয়া বেকারার হ্যায়’ গাইতো, আর তুমি বলতে ‘দুনিয়া মেঁ সব চোর হ্যায়…’
‘লোক’ বলবে না! সে দেশের একজন মানী-জ্ঞানী মানুষ। সেদিনও ‘লোকটা-লোকটা’ করে কী সব বলছিলে! ও সব শুনেই তো তোমার ছেলে তোমার মতোই হয়েছে!
এভাবে কর্তা-গিন্নী বাতচিত চলতেই থাকে সেকালের ৪৫ আরপিএম, এলপি রেকর্ড ছাড়িয়ে। কিন্তু সেদিন অচেনা কণ্ঠে ‘এটা ভবা পণ্ডিতের বাড়ি?’ জিজ্ঞাসা শুনে চুপ হয়ে যান তাঁরা। দরজা খুলে দেখেন ষণ্ডামতন এক ছোকরা। বলে, এই আপনাদের ছেলে?
এরপর যাকে সে গাড়ি থেকে বের করে আনে তাকে চেনাই যায় না ভালো করে। মাথায় পুরু ব্যাণ্ডেজ, তাতে রক্তের ছিটে, নাক-মুখ ফোলা, গায়ের জামা ফালা-ফালা…।
ছোকরা বলে, চেনা যায় না? কীভাবে চিনবেন? মেরে পাট-পাট করে দিয়েছো তো! এ আপনাদেরই ছেলে গবা।
গবা! গোবরা! গোবর্ধন! সিনেমা-থিয়েটার হলে ‘মা… বাবা… আমি তোমাদের গবা’ বলে কি একটা সিন করে ফেলতো, কিন্তু সে সব না। গাঁ-গাঁ করে কি সব বলার চেষ্টা করে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে চলে যায় নিজের ঘরে। ছোকরা বলে, কড়া ওষুধ… ইনজেকশন দিয়েছে। বেহুঁশের মতো শুয়ে থাকবে এখন। কিছু বলবেন না, ঘুমাতে দিন।
কিন্তু ঘটনা কী?
বলতে গেলে তেমন কিছুই না। এগুলো প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার গবা’র।
পাড়ার ও মাথায় চা-কফি’র দোকান। খুব চালু দোকান। এ-পাড়া ও-পাড়ার আশপাশের অনেকেই সকাল-সন্ধ্যা জমিয়ে বসেন সেখানে। গবাও যায় প্রায়ই। গিয়ে, তার যা স্বভাব-চরিত্র, ঠ্যাং তুলে বসে চেয়ারে, ফুক-ফুক করে সিগারেট খায় আর গলগলিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে অন্যদের মুখের ওপর। গণ্যমান্য লোকজন থাকে আশপাশে, কিচ্ছু মানে না গবা। ক’দিন আগে ভানু মশাই বাবা-সোনা বলে অনুরোধ করেছিলেন সরে বসে সিগারেট টানতে। অমনি গর-গর করে ওঠে গবা- এটা দোকান… এখানে সবাই সমান। যার অসুবিধা হয় সে চলে গেলেই পারে!
এমন ঘটনা ঘটে আরও। কাতু মশাই, খগা মশাই… আরও কার-কার সঙ্গে করেছে এ সব ফকরামি। আজ কাতু মশাইয়ের ছেলে, ও পাড়ার দুঁদে মাস্তান, কার কাছে কী শুনে দোকানে গিয়ে ধরেছে গবাকে। তার সঙ্গেও ফকরামি করতে গিয়েছিল, তখন ধরে সাইজ করে দিয়েছে উলটেপালটে।
নির্মলা ও ভবনাথ একসঙ্গে জিজ্ঞেস করেন ঠাণ্ডা গলায়- তারপর?
ছোকরা বলে, তারপর দোকানের লোক রাস্তার ও-পারের ছোট এক ক্লিনিকে নিয়ে ওইটুকু চিকিৎসা যা করিয়েছে, আর আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের কাছে।
নির্মলা জানতে চান, আমরা কী করবো?
কেস খুব জটিল।
কেন?
মারপিটের ঘটনা। পুলিশ কেস। কেস না করলে ডাক্তার-নার্স রোগী ছুঁয়েও দেখবে না। ওই ক্লিনিকে অনেক বলেকয়ে তবে ওইটুকু ফার্স্ট এইড। বলে দিয়েছে, এক্স-রে… স্ক্যান কি-কি করতে হবে…!!!
কেস করতে হবে?
করুন না! দুঁদে মাস্তান ঢিঢ হোক একটু। চিকিৎসার খরচপাতি দিক। আপনারাও সেবাযত্ন করতে পারবেন ভালভাবে।
নির্মলা বলেন, কেস করলে ঢিঢ হবে? তা ঢিঢ কেন করতে হবে?
ছোকরা বলে, করতে তো হবেই। এই মাস্তানদের অত্যাচার থেকে নইলে বাঁচা যাবে না। এরা পাড়ার কুসন্তান!
নির্মলা কেন যেন রেগে যান হঠাৎ- এই চোপ! কুসন্তান বলছো? বাপের প্রতি যার এত ভক্তি-শ্রদ্ধা সে কুসন্তান? বাপের মান-সম্মান বাঁচাতে দু’একটা চড়-থাপড় মেরেছে, তার নামে কেস করতে হবে?
ভবনাথ কাঁধে হাত রাখেন নির্মলার- থাক। ভেতরে চলো।
ছোকরার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করেন দু’জনে।