মুক্তি

মুক্তি

শরতের সকাল। একটু আগেই একপশলা কান্নাকাটি করে আকাশ এখন বেশ ফুরফুরে। হালকা তুলো তুলো মেঘ ছড়িয়ে সে যেন হাসিমুখে দেখছে মেহুলিকে। মেহুলি নিজেও আজ দিব্যি ঝরঝরে। গতকালের কাউন্সেলিং সেশনে ডক্টর সান্যাল বলে দিয়েছেন, আর খুব বেশি হলে একটি বা দুটি সিটিং। তারপর আর ওকে যেতে হবে না কাউন্সেলিং করাতে। এখন প্রায় পুরোপুরি সুস্থ ও।

সকাল ৯টায় ঘর আলোয় ভেসে যাচ্ছে। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে ঘরের সাজসজ্জা একটু উল্টে পাল্টে দিচ্ছিলো ও আর গুনগুন করে গান করছিলো, “ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে”। কচি আমপাতা রঙের মিষ্টি মুখটায় একটা চাপা হাসির আলো খেলা করছে। সদ্য স্নান করা পিঠময় ছড়ানো ভেজা চুলগুলো আকাশনীল কুর্তিটাকেও খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে। নিজের মনের ভিতর ডুব দিতে দিতে মাঝে মাঝে গেটের কাছ থেকে ভেসে আসা ছাতিমের গন্ধে আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে মেহুলি।

মিউজিক প্লেয়ারে জগজিৎ সিং চালিয়ে দিয়ে ডিভানে একটু গড়াতেই সুরেলা শব্দে বেলটা বেজে উঠলো। উঠে দরজাটা খুলতেই দেখলো উজান এসেছে। উজান মেহুলির স্কুলের বন্ধু। স্থানীয় থানার সাব-ইন্সপেক্টর। আজ অবশ্য ও সিভিল ড্রেসেই এসেছে। মাঝে মাঝেই আসে ও। ঘরে ঢুকেই মেহুলিকে আলতো হাতে জড়িয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিল উজান। অন্য হাতে এগিয়ে দিল একটা কাগজ ভর্তি ফাইল। মেহুলি জানে ওর মধ্যে কি আছে; প্রীতমের ডেথ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য জরুরি কাগজপত্র।

উজান আর ওর বউ নীতি গত ১০ দিন ধরে আগলে রেখেছে ওকে। গত ১৪ই জুন শনিবার ভোরবেলা স্পেয়ার কি দিয়ে লক খুলে অন্য সবদিনের মতই বাড়িতে ঢোকেন নার্স মায়াকাকিমা। মাস্টার বেডরুমে ঢুকে উনিই প্রথম দেখেন প্রীতমের ঠান্ডা, শক্ত হয়ে যাওয়া দেহটা। তারপর ছুটে গিয়ে ডাকেন মেহুলিকে। প্রীতমের রাইগর মরটিস শুরু হয়ে যাওয়া দেহটা আবিষ্কার করে প্রথম ফোনটা মা’কে করার পরই ও নীতির ফোনে ফোন করে খবরটা দিয়েছিল। পাশের পাড়াতেই থাকে ওরা। প্রীতমদের পৈতৃক বাড়ির পাশেই। আসার সময় ওরা তুলে এনেছিল প্রীতমের বাবা-মা’কেও। ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছিল মেহুলির মা আর দাদাও, আর কয়েকজন নিকট প্রতিবেশী। তারপর তো একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে এই কটা দিন।

উজানকে বসতে দিয়ে কফি আনতে গেল মেহুলি। ফাইলটাকে টেবিলে একবার ডাক্তারের সার্টিফিকেট টায় চোখ বুলিয়ে নিল ও। কজ অফ ডেথ কার্ডিয়াক এরেস্ট। দীর্ঘশ্বাস পরে ওর। পাশের ঘরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানো মেহুলি টেরও পায়নি কখন কষ্টে ছটফট করতে করতে শেষ হয়ে গেছে প্রীতমের দশমাসের যুদ্ধ। কথাও বলতে পারতো না, নড়তে চড়তেও পারতো না। শুধু বুঝতো সবই। আর তাকিয়ে দেখতো। কষ্টের মুহূর্তেও ডাকতেও পারেনি কাউকে প্রীতম। এটাই আরো যন্ত্রণার।

কফি নিয়ে এসে বসতে উজান বললো যে মায়াকাকিমাকে কিছুটা জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ ক্লিনচিট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। প্রায় ৫৮ বছরের বিধবা, নিঃসন্তান মহিলা, এককালের ট্রেইন্ড স্টাফ নার্স শুধু শুধু কেন পাশের বাড়ির পঙ্গু যুবকের ক্ষতি করতে যাবে তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য মোটিভ পুলিশ খুঁজে পায়নি। দশমাস আগে মন্দারমনি থেকে ফেরার সময় হাইওয়েতে একটা ভয়ঙ্কর এক্সিডেন্টে পঙ্গু হয়ে যায় প্রীতম। তখন পাশের সিটে বসে ছিল তমসা। পাশের বাড়ির বাসিন্দা মায়াকাকিমার ভাড়াটে। প্রীতমই চাকরি দিয়েছিল ওকে। কাকিমার অনুরোধে। ওই দুর্ঘটনায় তমসা মারা যায় ঘটনাস্থলেই। কাকিমা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। কারণ তমসার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকে কাকিমার সাথেই থাকতো ও। দুজনে দুজনের অবলম্বন ছিলো। একমাস হসপিটালের বেডে লড়াই করার পর যখন প্রীতমকে বাড়ি নিয়ে আসা হয় তখন কাকিমাকেই ওর আর মেহুলির দেখাশোনার ভার দেন মেহুলির মা আর শাশুরিমা। সেই থেকেই এই সংসার উনার হাতে। আজ এতমাস পর হঠাৎ শত্রুতা বা কর্তব্যে অবহেলা কেন করবেন উনি তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য কারণ খুঁজে পায়নি পুলিশ।

উজান এবার পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো, “দেখ মেহুল, কাকিমা বললেন অত করে, তাই একটু নাড়াচাড়া করলাম। তাও কোনো অফিসিয়াল কমপ্লেন করিসনি তোরা কেউ। দুজন ডক্টর দেখেও সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট ছাড়া কিছুই পাননি। আর প্রীতম যেভাবে, যে কন্ডিশনে বেঁচে ছিলো, তাতে এটাই তো স্বাভাবিক। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে এভাবে কতদিন চলে? কড়া কড়া ওষুধ, দিনে 4/5 টা করে ইনজেকশন, শরীরে কোনো সাড় নেই। এভাবে কতদিন বা বাঁচতে পারতো? জানি তোর কষ্ট হবে, হচ্ছে। তবু সামলে তো নিতেই হবে। আমরা সকলে তো আছিই। দেখিস ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নীরবে সায় দেয় মেহুলি। এই নিয়ে আর কথা বলতে ভালো লাগছে না একদম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। গতকাল ডক্টর সান্যালের কাছ থেকে ফেরার পর একরকম জোর করেই মা কে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ও। একটু একা থাকবে বলে, একটু একা ভাববে বলে। গত দেড় বছর ধরে একিউট ডিপ্রেশনের পেশেন্ট মেহুলিকে কেউ এক ছাড়তে চায়না। ভয় পায় সকলে। কিন্তু গতকাল মা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছে। তাই বাড়ি পাঠাতে পেরেছে ও। সকলেরই তো ধকল যাচ্ছে। ওর গায়ে কেউ আঁচ লাগতে দেয়নি এই কয়দিন। দশমাস আগেও সেই এক্সিডেন্টের সময় পুলিশ, মিডিয়া সব সামলেছিল মেহুলির মা-দাদা, শশুর-শাশুড়ি, উজান-নীতি। আগলে রেখেছিল ওকে। প্রীতম আর তমসার এক গাড়িতে মন্দারমনি থেকে ফেরা সব স্পষ্ট করে দিয়েছিল সবার কাছে। দিনের আলোর মত। তাই আরো প্রোটেক্টিভ হয়ে গেছিল সকলে ওর প্রতি।

উজান এবার উঠে পড়ে। দরজার দিকে এগোতে এগোতে ওকে বলে ওদের বাড়ি যেতে। নীতি অনেকবার বলে দিয়েছে। সায় দেয় মেহুলি। দরজাটা বন্ধ করে এসে আবার এলিয়ে পরে ডিভানে। কি ভারহীন, নিশ্চিন্ত লাগছে ওর। আবার ও বাঁচবে, নিঃশ্বাস নেবে, গান গাইবে। “দিল ঢুন্ডতা হ্যায়, ফির ওহী, ফুরসৎ কে রাতদিন” গুনগুনিয়ে ওঠে ও। এখন শুধুই ফুরসৎ। আহা। দেড়বছর আগে ঠিক এরকমই খুশিতে মাতোয়ারা হয়েছিলো ও, যখন জানতে পেরেছিলো যে ও মা হতে চলেছে। প্রীতমকে জানাতেই ও জানিয়েছিলো যে ও এখন বাবা হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। বাচ্চাটা এবোর্ট করতে হবে। এরই একসপ্তাহের মধ্যে তমসার সাথে প্রীতমের এফেয়ারটা জানতে পারে মেহুলি। লজ্জায়, যন্ত্রনায় কাউকে কিছু বলতে পারেনি চিরকালের শান্ত-নরম মেহুলি। শুরু হয় একিউট ডিপ্রেশন।

প্রীতমই নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখায় ওকে। কারণ মেহুলিকে পাগল প্রতিপন্ন করতে পারলে সুবিধা ওরই। সহজেই ডিভোর্স পেয়ে যাবে। একিউট ডিপ্রেশনের সাথেই বাই-পোলার ডিসঅর্ডার ধরা পরে। কড়া কড়া সাইকিয়াট্রিক মেডিসিনের ঘোরের মধ্যেই একদিন ওর বাচ্চাটাকে ছেঁটে ফেলে দেয় ওরা। কোনো প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ জানানোর পরিস্থিতিতেই ছিলনা মেহুলি। একটু একটু করে প্রতিদিন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছিলো ও। একদিন শুধু

মায়াকাকিমা কে সব বলে ফেলেছিলো। কাকিমা সেদিন দেখতে এসেছিলেন ওকে। বলে ফেলার পর কাকিমার নৈঃশব্দ্য ওকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে উনি সবই জানেন। অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ও। অনেকক্ষণ।

তারপর আসে দশ মাস আগের সেই দিন। প্রীতমের সাথে মন্দারমনির প্রমোদভ্রমন থেকে ফেরার সময় এক্সিডেন্টে স্পট ডেড হয় তমসা। হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকে প্রীতম। ওর চিকিৎসা চলাকালীন নীতি একদিন

মেহুলিকে নিয়ে যায় ওই হসপিটালের আউটডোরে অন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর সান্যালের কাছে। নতুন করে শুরু হয় মেহুলির চিকিৎসা। পিতৃপ্রতিম মানুষটা

দ্রুত ওকে ফিরিয়ে আনতে থাকেন জীবনের দিকে। উনার কথাকে বেদবাক্য করেই এগিয়েছে মেহুলি। “বাঁচো। বাঁচা তোমার অধিকার। আর কেউ যেন তোমায় এই বেঁচে থাকার , হেসে ওঠার, ভালো থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে।”

অনেক ভেবেছে মেহুলি। ঠিক। ডক্টর সান্যাল একদম ঠিক। ওর বাচ্চার, ওর নিজের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিচ্ছিল প্রীতম। তাহলে প্রীতম কী করে বাঁচবে? কেনই বা বাঁচবে? বাঁচা ঠিক হবে ওর?

রোজই মায়াকাকিমা রাত ৯টায় নিজের বাড়ি চলে যান প্রীতম আর মেহুলিকে রাতের খাবার, ওষুধ সব দিয়ে, নিজের রাতের খাবারটুকু গুছিয়ে নিয়ে। ১৩ই জুন শুক্রবার নিয়মটা একটু পালটে নিয়েছিল মেহুলি। নিজের ওষুধগুলো তখনই খায়নি। কাকিমার দরজার লক টেনে দিয়ে বাইরের গেটে তালা দেওয়ার আওয়াজ শুনেছিল নিজের ঘরে বসে। মিনিট পাঁচেক পর উঠে গিয়েছিল প্রীতমের ঘরে। হাতে পরেছিল চুল রং করার প্লাস্টিক গ্লাভস। ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়েছিল একটা ব্যবহৃত ইনজেকশন। খালি ইনজেকশন টেনে হাওয়া ভরে নিয়ে বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় প্রীতমের রক্তবাহিকায় পুশ করে দিয়েছিল 100 মিলি হাওয়া হাতের চ্যানেল দিয়ে। বিশুদ্ধ বাতাস। পরিচ্ছন্ন এয়ার এমবলিসম এর প্রয়োগ। তারপর নিজের ঘরে এসে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ভোরবেলায় মায়াকাকিমার ঝাঁকুনিতে ও চিৎকারে ঘুম ভাঙে ওর। তাড়াহুড়ো করেনি বেশি। আলুথালু, নড়বড়ে ভাব নিএকরে গেছিলো পরপর কাজগুলো। কান্না, ফোন, চিৎকার সব।

ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় মেহুলি। সামনে পুজো। আকাশে-বাতাসে শিউলি আর ছাতিমের গন্ধ মাখামাখি হয়ে আছে। ধোয়া মোছা তকতকে আকাশে তাকিয়ে না জন্মানো বাচ্চাটার মুখ দেখতে পেল মেহুলি। একটা বাউন্ডুলে হাওয়া বয়ে যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলে গেল “থ্যাংকু মা”। হেসে উঠলো ও একাই। ঘরে তখন জগজিৎ সিং প্রাণ ঢেলে গাইছেন, “তুম ইতনা জো মুসকুরা রহি হো..

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত