নীলক্ষেতের ফুটপাতে দাড়িয়ে খুব মনোযোগের সাথে একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি । বই কেনার ইচ্ছা নেই, পকেটে টাকা আছে একশর আশেপাশে । হাতের হুমায়ুন আহমেদের ” দেখা না দেখা ” বইটার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৮, অর্থ্যাৎ আট ফর্মার বই। পাঁচ মিনিটে ঝড়ের বেগে আমি প্রায় আট – নয় পাতা পড়ে ফেলেছি । দোকানদার ইতোমধ্যেই বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে । আমি ভাবছি আর তিন চার মিনিট তার চাউনি সহ্য করে এক ফর্মা পড়ে ফেলে, ” নাহ, ভাই ভালো লাগলো না । ভুয়া বই! ” বলে আরেক দোকানে গিয়ে আরেক ফর্মা পড়বো কিনা । স্পিডে পড়তে পারলে আর হাতে সময় থাকলে নীলক্ষেতে আট দোকান ঘুরে একটা বই শেষ করা একটু কষ্টকর হলেও অসম্ভব কিছু না । এডভেঞ্চারও হলো একটু!
অভিযান চালিয়ে যাওয়া গেলো না । কারণ পাশ থেকে হঠাৎ আমার উদ্দেশ্যেই বলা ” এক্সকিউজ মি ” কানে আসা ।
ইংরেজি এই ভদ্রতার একটু সমস্যা আছে । যাকে বলা হয়েছে তিনি চাইলে ” ইউ আর এক্সকিউজড ” বলে নাক উঁচু করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন। আমি পারলাম না। কারণ যিনি বলেছেন তিনি আমারই বয়সী একজন মেয়ে; দেখতে মনে রাখার মতো খুব বেশী আহামরী সুন্দরী নন, কিন্তু চেহারায় বেশ একটা স্নিগ্ধতা আছে যা চোখে পড়ে । হাজার বছর ধরে তপস্যা করা মুণী – ঋষিগন পর্যন্ত রমনীদের আহ্বানে তপস্যা ভেঙ্গে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেন, সেখানে আমি তো কোথাকার কোন খালিদ রহমান!
– ” জ্বী ” ।
– ” আপনার নাম খালিদ রহমান না “?
আরি্ব্বাস! রাস্তাঘাটে মানুষ চেহারা দেখে চিনে ফেলবে – এতোটা বিখ্যাত হওয়ার মতো কিছু এই জীবনে এখন পর্যন্ত করেছি বলে তো মনে পড়ছে না ।
– ” হ্যা…. আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ” ।
– ” আপনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন ” ।
আমার মধ্যে কিছু অতি ক্ষুদ্র ব্যাপারে শিশুসুলভ হাইপার ইগো কাজ করে । আমার মুচকি হেসে বলা পরের কথাটা তার একেবারে জ্বলজ্যন্ত প্রমান ।
– ” আমি আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে আছি, নাকি আপনি আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন? ”
– ” ঐ একই তো হলো ….. একটা উপকার করতে পারবেন? ”
– ” কি ধরনের? ”
– ” আমার এক ফ্রেন্ডের জন্যে ভালো একটা বই কেনা দরকার । গিফট করবো । আপনি পছন্দ করে দিন না একটু! ”
এই অপরিচিত মেয়ে ইতোমধ্যেই আমার সাথে যথেষ্ট প্রগলভ আচরণ করে ফেলেছে । এবার আমার ফেরত দেওয়ার পালা ।
মুখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – ” কেমন ফ্রেন্ড? পার্মানেন্টলি জোর করে ধরে বেঁধে বানিয়ে রাখা বড় ভাইয়া, নাকি ইন ফিউচারে পদ পরিবর্তনের সম্ভবনা আছে ? ”
মেয়ে চোখ কপালে তুলে বললো – ” তা জেনে আপনার কি কাজ? আপনি ভালো দেখে একটা বই পছন্দ করে দিলেই তো হয়! ”
– ” কাজ আছে…. দুই পোস্টের জন্যে আলাদা আলাদা বই ” ।
– ” দ্বিতীয়টা ” ।
তারমানে সম্ভাব্য প্রেমিক। সেই ছেলে খুব বেশী বই পড়ে না শুনে হুমায়ুন আহমেদের কৃষ্ণপক্ষ আর ময়ুরাক্ষী বই দুটো থেকে একটা কিনতে বললাম। দোকানদারের থেকে বই দুইটা চেয়ে সে একটু উল্টে পাল্টে দেখলো। তারপর বোধহয় ময়ুরাক্ষী একটু মোটাসোটা আর শক্ত পোক্ত দেখে ওটাই কিনলো। চয়েজ খারাপ হয় নি, কারণ কৃষ্ণপক্ষ বইটা চমৎকার একটা প্রেমের গল্প হলেও একটা মৃত্যু থাকায় পুরো কাহিনীটা বিষাদময়। আর ময়ুরাক্ষী তে হিমু রুপার প্রেম অপ্রেমের গল্প যে কোন ছেলেকে আকৃষ্ট করবেই । বিশেষত শেষের পাতাটা …
বই কেনা শেষে মেয়েটা আর দাড়ালো না। ভালো থাকবেন বলে হাসি দিয়ে বিদায় নিলো এবং আমার খেয়াল হলো আমি তার নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি ।
প্রাচীন ভারতের গ্রন্থ বোধিসত্ত্বাবদান-এ মেয়েদের সম্বন্ধে চমৎকার একটা কথা আছে – ” ত্রিভূবনে নারীগনের অসাধ্য কিছুই নাই । ইহারা জল হতে অগ্নি এবং অগ্নি হইতে জল সৃজন করতে পারে । আমি মেয়েটির প্রেমে পরি নি। তবুও পরের কয়েকদিনে তার কথা কেন যেন বেশ মনে পড়তে লাগলো। ইনবক্সে কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করলাম তাদের কারো সাথেই আমার দেখা হয়েছিলো কিনা। তাদের কেউ-ই না।
নীলক্ষেতের ফুটপাতে দাড়িয়ে মাথা নিচু করে বই দেখার সময় আমি মনে মনে প্রায়ই অপেক্ষা করি হুট করে শ্যামলা গায়ের রঙের, গোলগাল চোখে মুখে কথা বলা সেই মেয়েটি আবারও হুট করে একদিন উদয় হবে আর আমি তাকে ভ্রু নাচিয়ে হাসিহাসি মুখে প্রশ্ন করবো – ” তারপর? কি খবর আপনাদের? আজ কি প্রেম চলাকালীন সময়ের বই খুঁজছেন নাকি? “