‘স্যর, ওখানে সিট হবে?’
মহিলাকন্ঠের ডাক শুনেই বুকের বামদিক ডানদিক পালা করে ধড়পড় করতে শুরু করেছিল৷ অবশ্য পিছুডাকের দিকে ঘুরে তাকাতেই কেমন যেন গোটা শরীর জুড়ে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল৷ মনে হল বাসটার জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে বাইরে নামি! কিন্তু চলন্ত বাস থেকে ঝাঁপ দেওয়ার নিয়ম জানিনা৷ তাই আপাতত সামনের জনের পিছনে গিয়ে সিটের আড়ালে মাথা গুঁজে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলাম৷
আসলে ব্যাপারটা কি একটু বলি, নাহলে ঠিক বুঝতে পারবেন না আমার এত ভয়ের কারন কি৷ ও, ভুল বললাম! ভয় শুধু আমার নয়, আমাদের৷
আমাদের বাসে আমরা বেশ কয়েকজন নিয়মিত স্কুল, অফিস যাই৷ নিজেদের মধ্যে আড্ডা, গল্প, বদমায়েশি প্রভৃতিতে মেতে থাকি, ছিলামও এতদিন৷ কিন্তু মাস তিনেক আগে থেকেই পুরো পরিবেশটা হঠাৎ করে কেমন যেন বদলে যায়৷ আমাদের স্টপেজের দুটো স্টপেজ পরই একজন দিদিমনি ওঠেন৷ নিজের মতই থাকেন, আমরা কোনদিন তাঁর সাথে আলাপ জমানোর ইচ্ছে বা চেষ্টা করিনি৷ কারন তিনি বেশ গুরুগম্ভীর, আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে এমন শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন মনে হয় যেন আমরা সব আসামী, জেল ভেঙে সদ্য বেরিয়ে এসেছি৷ অবশ্য আমাদেরও দোষ কম নেই, এতবড় ভারি ধেড়ে চেহারা নিয়েও আমরা সবসময় হাসিঠাট্টায় মেতে থাকি৷ শুধু যে নিজেরাই আনন্দ করি তা নয়, মাঝে মধ্যে বাসের কন্ডাক্টর আর পিছনের গেটের হেল্পারকেও দলে নিয়ে নিই৷ এমনও হয়েছে, কন্ডাক্টর দুএকজনের ভাড়া মিস করে গেছে, বা হেল্পার স্টপেজে গেট খুলতে ভুলে গেছে৷ আরও মজার ব্যাপার হল, আমরা যে পিছনের সিটে বসি সেখানে আরও যারা প্যাসেঞ্জার থাকেন, কখনও কখনও তারাও যোগ দেয় আমাদের সাথে৷ কিন্তু সময়চক্রে সুখ আর দুঃখ তো প্রতিনিয়ত আবর্তিত হয়, আমাদের সুখের দিনের ভ্যালিডিটি বোধয় ফুরিয়ে গিয়েছিল৷ তাই যেদিন ঐ ম্যাডামের স্টপেজের একটি স্টপেজ পর আরও একজন ম্যাডাম উঠতে শুরু করলেন, সেদিন থেকেই আমাদের কপালে শনির দশা শুরু হল৷
নতুন ম্যাডামটি আসলে ঐ আগের ম্যাডামটির স্কুলেই ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সীতে রিক্রুট৷ না, এটা সমস্যা না৷ সমস্যা এটা যে এই নতুন ম্যাডামটি যেদিন পুরানো ম্যাডামের সঙ্গী হলেন সেদিন থেকেই আমাদের এতদিনের পাপের ফল সুদে আসলে তুলতে শুরু করলেন দুজনে৷ সে এক মহাপ্রলয় শুরু হল আমাদের বাসে!! আমরা এর পর থেকেই কেবলমাত্র দর্শকের ভূমিকায়৷
পুরানো ম্যাডামের কথা বলি! তিনি বাসে উঠেই প্রথমে কুরুক্ষেত্র বাধান সিট নিয়ে৷ এতদিন একটা সিটেই সেঁটে যেতেন, কোন সমস্যা ছিলনা৷ কিন্তু এখন সবার প্রথম খোঁজ করেন একসাথে দুটো সিটের৷ বাসে উঠেই প্রথমে যদি দুটো সিট একসাথে খালি দেখেন, তাহলে উসেইন বোল্টের চেয়েও দ্রুত গতিতে একটা সিটে বসৈ আরেকটায় ব্যাগ রেখে দুটো সিটই দখল করে নেন৷ আগে থেকে সিট রাখা নিয়ে বহুবার ঝামেলা হয়েছে অন্য প্যাসেঞ্জারের সাথে৷ নিয়ম মেনে প্রতিবারই অদ্ভুত দক্ষতায় দিদিমনি সকলকে হারিয়ে দিয়েছেন! যাইহোক, যদি একটা সিট খালি থাকে তাহলে দিদিমনি সেই একটা সিটে নিজের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে আরেকটা সিটের খোঁজে বাস তোলপাড় করে ফেলেন৷ ধরে ধরে প্রতিটি প্যাসেঞ্জারের প্রায় কান টেনে জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি কোথায় নামবেন! তারপর কোন একজন নিকটবর্তী স্টপেজের ফিক্সড্ হলেই সেখানে সেঁটে গেলেন, এবং সেখান থেকেই ব্যাগ ফেলে রাখা সিটে সজাগ দৃৃষ্টি৷ দূর্ঘটনাবশত কেউ সেই ব্যাগে হাত দিলে বা সরিয়ে বসার চেষ্টা করলে দক্ষযজ্ঞ শুরু হত৷ না, নাটক এখানে শেষ নয়, এরপর নতুন দিদিমনিটি তার স্টপেজে উঠলে বাকি অংশটুকু শুরু হত৷ পুরানো নতুনকে সেই সীটে বসতে বলবেন, নতুন পুরানোকে সেই সিটে বসতে বলবেন৷ আর কে প্রথম বসবে সেই নিয়ে চলবে তুমুল ভালবাসাবাসি৷
—না না, তুমি বোসো, তুমি বোসো৷
—না, আপনি এতক্ষন দাঁড়িয়ে আছেন, আপনি বসুন! আমি ঐ টায় বসে নেব৷
— না না! তা হয় নাকি! তুমি কত কষ্ট করে বাসে উঠলে বলোতো?
—না না! আপনি কতক্ষন দাঁড়িয়ে আছেন !
—না না….তুমি
—না না…আপনি
—না না…
—না না………..!
এভাবেই পারদ ক্রমশ উর্দ্ধমুখি হয়৷ পরের দৃশ্য বাস ভাড়া সম্পর্কিত৷
দুজনে এককাছে বসেই কম্পিটিশন করে টাকা বের করেন, আর তারপর
—এই, আমি না তোমারটা দিয়ে দিচ্ছি! তুমি একদম কোরবেনা কিন্তু!
—না না, আপনি তো আগের দিন দিলেন! আজ আমি দেব প্লিজ৷
—একদম না! আজ আমি, তুমি বরং…
—না না, আজ আমি দিই৷
—না না আজ আমি
—না না আজ আমি
—না না
—না না….
এই ‘না না’ ঝামেলা মিটলেই ভালবাসার চরম মুহুর্ত তৈরী হয়৷ মোটামুটি কোনও না কোনভাবে দুজনে এককাছেই বসেন সবদিন৷ আর এককাছে নিতান্তই সিট না পেলে দুজনে দুজনের সিটে ব্যাগ রেখে দিয়ে এককাছে দাঁড়িয়ে ‘না না’ শুরু করেন৷ আর এককাছে হলে এরপর শুরু হয় খোলাখুলি, টিফিন বক্স৷
—এই আজ একদম সময় পাইনি গো, আজ শুধু একটু রাইস আর পনীর বানিয়েছি৷ একটু খেয়ে দেখো তো৷
—আমিও না একদম সময় পাইনি, একটু পোলাও বানিয়েছি! কেমন হয়েছে একটু দেখুন তো!
—আরে, না না! আগে তুমি আমারটা খাও তারপর আমি তোমারটা
—না না! আগে আপনি আমারটা খান তারপর আমি আপনারটা৷
—না না, আগে তুমি..
—না না, আগে আপনি..
—না না
—না না
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল৷ আমরাও সমৃদ্ধ হচ্ছিলাম৷ না, খাবারের ভাগ বা ভাড়া কোনটাই আমাদের কপালে জোটেনি কোনদিন৷ কিন্তু ওনারা ছাড়া বাকি দিদিমনি এবং হেডদিদিমনি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারতাম৷ কার হাসব্যান্ড কিরকম, কে ফোনে কার সাথে বেশি কথা বলে, কে আসলে কেন সিসিএল নিচ্ছে….শাড়ি গহনা চুল বাঁধার স্টাইল সোনা এমিটেশন লাঞ্চ ডিনার …. হ্যাঁচ্ছোওও..!
হঠাৎ ছন্দপতন৷
গত সপ্তাহ থেকেই এই ব্যাপারটা লক্ষ করছি৷ চরম ভালবাসাবাসিটা কেমন যেন থুক্কুম করে থমকে গেছে৷ সিট রাখা, ভাড়া দেওয়া, টিফিন ভাগ…সব বন্ধ! এই দিদিমনি সামনের গেটে উঠলে সেই দিদিমনি পিছনের গেট ধরেন৷ এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ৷ আর এই হঠাৎ দুর্ঘটনায় যখন দুর্ঘটনা স্থল থেকে কেউ ‘স্যর, ওখানে সিট আছে?’ বলে ডাক দেয়, কোন শ্লা ভয় না পেয়ে থাকে৷ আমি আরও ভয় পেলাম এই যে নতুন ম্যাডাম ডাকলো ঠিক আছে, পুরানো ম্যাডাম কিভাবে এর শোধ তুলবে কে জানে!!
যাইহোক, এই ছন্দপতনের পিছনে কারনটা না জানা পর্যন্ত আমারও ভীষন অস্বস্তি হচ্ছিল! তাই আপাতত সাড়া দিলাম৷ অবশ্য দেখে নিয়েছি, পুরানো ম্যাডাম অনেক দুরে৷
না না! ব্যাপার তেমন গুরুতর নয়৷ দুইজনের ভালবাসাবাসিটা শুধু বাস নয়, ক্লাস অবধিও দিব্যি চলছিল৷ কিন্তু একটা পাকা_চুল এসে সব গন্ডগোল ঘটিয়ে দিয়েছে৷ টিফিন আওয়ার্সে সেদিন স্টাফরুমে নানা আলোচনার মাঝে কে যেন বলেছিল, পুরানো দিদিমনির মাথার চুল পেকেছে৷ আর তারপরই বেঁধেছিল কুরুক্ষেত্র৷ পুরানো ম্যাডাম তার একমাত্র সাক্ষী হিসেবে ভীষণ আস্থা রেখেছিলেন নতুন ম্যাডামের ওপর
—এই ইয়ে, ভাই ভাল করে বলোতো! এটা পাকা চুল?
—হ্যাঁ ম্যাডাম! একটা নয়, আরও কয়েকটা….
আর ঠিক তারপরই সব শেষ!