শেষ রাত

শেষ রাত

নিশ্চুপ শহরের স্তব্ধ রাত। মাঝে মাঝে কিছু কুকুরের কান্না ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এক ফাকা পীচ ঢালা রাস্তায় শুয়ে ছিল আব্দুল বারেক। গৃহহীন বারেকের ঘুম ভেঙে গেল এক বিকট চিৎকারের শব্দে। চোখ খুলেই দেখলেন তার পাশে পড়ে আছে এক লাশ। রোড লাইটের আলোতে লাশ দেখে সে ভয়ে পাথর হয়ে গেল। লাশের গলায় চাকু এখনো গেথে আছে। কিছু দূরে এক লোক চলে দৌড়ে চলে গেলো।দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে চলে যেতে লাগলো বারেক। পুলিশের ঝামেলায় জড়াতে চায় কে? কিন্তু বিধি বাম। সামনেই আসছিল পুলিশের টহল ভ্যান। কি আর করা। তাদের কাছে যেয়ে এই খুনের কথা বলে দিল বারেক। পালাতে দেখলে যে পুলিশ তাকেই সন্দেহ করবে এতটুকু জ্ঞান অবশ্য আছে তার। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেলে সকালে খবর দেয়া হয় লাশের পরিবার বর্গকে। লাশের শনাক্তিকরন

পুলিশই করে ফেলেছে। লাশ এলাকার স্কুল শিক্ষক আ হ ম খলিলের। পরিবারের লোকজন এসে লাশ নিয়ে গেলো আর একটা কেস করে গেল। এর বেশি কিছু না। মনে কোনো দুঃখ নেই দেখে মনে হলো থানার ইনচার্জ শফিকউল্লাহর। এতে প্রথম সন্দেহটা পরিবারের দিকেই যায়। তখনই শফিকউল্লাহ সাহেব পুরাতন বন্ধু আজাদকে ফোন করে। আজাদ একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সম্প্রতি বেশ কয়েকটা কেসে কাদের অনেক সাহায্য করেছে।

জার্নালিজম নিয়ে পড়ালেখা করলেও সাংবাদিক না হয়ে হয়েছে গোয়েন্দা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়া লেখা শেষ করে ফিরে এসেছে। নিজ শহর ফরিদপুরে। তখনি ফরিদপুরে ট্রান্সফার হয় শফিকুল্লাহ শফিকের। আজাদের গোয়েন্দাগিরীর শখের কথা আগের থেকেই জানতো শফিক। স্কুল লাইফে ছোটখাটো গোয়েন্দাগিরী এক সাথেই করেছে তারা। ফোন করার আধা ঘন্টার ভেতরেই চলে এল আজাদ। আজাদ আসতেই কেসের কথা বুঝিয়ে দিল শফিক। সে জানে আজাদ এই কেসের সমাধান করে ফেলবে।

থানা থেকে বের হয়েই খলিল সাহেবের বাসায় চলে গেল আজাদ। খলিল সাহেব আজাদের পরিচিতই। তার স্কুলের পাশেই আজাদের বাসা। খলিল সাহেবের বাসাও পরিচিত। একসাথে গত বিকালেও মানিকের দোকানে চা খেয়েছে। চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। আর কাল ভোর রাতেই তার খুন। মৃত্যুটাও আজব জিনিস। কিন্তু এত ভোরে বাসার থেকে কেনো বের হয়ে ছিলেন তা প্রথমে জানা দরকার। এসব ভাবতে ভাবতেই আজাদ খলিল সাহেবের বাসায় পৌছে গেল। বাসা টায় এর আগে আসা হয়নি আজাদের। শুধু ঠিকানাটাই জানতো। এই এলাকাতে

আসেপাশে আর কোনো বাসা নেই। নির্জন এলাকা। এলাকার নাম বায়তুল আমান। শহরের থেকে একটু ভেতরেই বাসাটা। পুরাতন জমিদার ধাচের। খলিল সাহেবের দেয়া তথ্য মতে তার দাদা ইন্ডীয়া থেকে এখানে এসে হিন্দু জমিদারের সাথে জায়গা পরিবর্তন করেন। অর্থাত তাদের ইন্ডিয়ার জায়গা সেই হিন্দু জমিদারদের এবং তাদেরটা খলিল সাহেব দের। ভালোই চলছিল। কিন্তু তার বাবার বে হিসাব চলার কারনে সব জমি খোয়াতে হয়। সম্পত্তি বলতে শুধু এই বাড়ীটাই অবশিষ্ট রয়েছে। দরজায় নক করতেই বাসার কাজের লোক দরজা খুলে দেয়। খুলেই বলে “ভেতরে যায়ে বসেন। খালুর ব্যাপারে আইছেন তো। বসেন। খালা আইতাছে।” আজাদ অবাক হয় তার কথা শুনে। সে কীভাবে বুঝলো আজাদ খলিল সাহেবের কাছেই এসেছে? খালু বলতে সে খলিল সাহেবকেই বুঝিয়েছে। কারন কাজের লোকরা সাধারনত বাড়ির মালিককেই খালু বলে থাকে। সোফায় বসে আজাদ চারপাশে লক্ষ করলো আজাদ।

একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে দারূন সৌখিন খলিল সাহেব। ড্রইং রুমে নানা রকম এন্টীক জিনিস দিয়ে ভরা। তার এন্টিক কালেকশন দারূন এটা মানতে হবে। তখনই কাজের বুয়া এসে আজাদকে স্টাডিতে যেতে বললো। তার ‘খালা’ আজাদের সাথে সেখানেই দেখা করবেন। দ্বিতীয় তলার প্রথম ঘরে চলে গেল। সেখানে যেয়ে চক্ষু ছানাবড়া আজাদের। পুরো রুম ঠাসা বইতে। নিশ্চিত ১ লক্ষের উপরে বই আছে সেখানে। আজাদ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন তাকের কাছে যেতে লাগলো। এক কোনার এক তাকের বই দেখে আজাদের মনে একটু খটকা লাগলো। ব্লাক ম্যাজিকের বই। একজন স্কুল শিক্ষকের ব্লাক ম্যাজিকের উপর ইন্টারেস্ট থাকার কি মানে হয়। বইটা নিয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখে এক মধ্যবয়স্কা নারী দাঁড়িয়ে এছে। ইনি নিশ্চই কাজের বুয়ার ‘খালা’ অর্থাৎ খলিল সাহেবের স্ত্রী।

-বসুন।

তার কথা মতো পাশের রাখা চেয়ারে বসে পড়ে আজাদ। আর সামনে বসেন মহিলা।

-আপনি নিশ্চই খলিল সাহেবের স্ত্রী।

-জ্বি। আপনিও নিশ্চই উনার কাছে টাকা পান? কত টাকা?

-জ্বি? না আমি টাকা পাবো কেন? আমি পুলিশ থেকে এসেছি।

-ও। তাই বলেন। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত দশজন পাওনাদার এসেছে। প্রায় বিশ হাজার টাকা দেনা। রত্না ভেবেছে আপনিও পাওনাদার।

এবার আজাদ বুঝতে পারলো কিভাবে কাজের বুয়া রত্না আজাদের উদ্দেশ্য বুঝেছে। ভুল বুঝেছে তাও সে।

-আপনি কি বলতে পারেন খলিল সাহেব কেন এতো ভোরে বাসার বাইরে গিয়েছিলেন?

-রাত বারোটার দিকে বের হয়েছিলেন। প্রতিদিনের মতো ঐ সময় বাসায় আসেন প্রতি দিন। কাল হয়তো বাসায়ই আসছিলেন। তখন সময় বুঝে মেরে দিয়েছে। আজাদ অবাক হয়। এই মহিলার স্বামী মারা গিয়েছে আর ইনি কিনা এভাবে কথা বলছে। শফিকের কথা ঠিকই ছিল। স্বামীর মৃত্যুর কোন দুঃখ দেখা যাচ্ছে না। আজাদ নিজের কৌতুহল দমাতে পারেনা। প্রশ্ন করেই ফেলে।

-উনার মৃত্যুতে আপনি কষ্ট পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না?

-কষ্ট পাবো কেন? শয়তানের মৃত্যু হয়েছে। এতে কষ্টের কি আছে? এটা তো খুশির ব্যাপার।

মহিলার হালকা কান্না মিশ্রিত কথা শুনে ‘টাস্কিত’ হয় আজাদ। নিজের স্বামীকে বলছে কিনা শয়তান? কি আজব মহিলারে বাবা।

-মানে?

মানে প্রশ্নের উত্তরে যা বললেন খলিল সাহেবের তাতে প্রথম বারের চেয়েও বড় টাস্কি খায় আজাদ। তিনি যা বললেন তার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো খলিল সাহেব শয়তানের উপাসক, কালো জাদুকর ছিলেন। প্রতিদিন রাতে যেতেন তার দেবতার মন্দিরে পূজা দিতে। আর ভোরে ফিরে আসতেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি শয়তানের উপাসক। তার স্ত্রীকেও সাথে জড়াতে চেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য যাননি। তখন থেকেই স্বামীকে ঘৃনা করতে শুরু করেন। মন্দিরের অবস্থানও বলে দিয়েছেন আজাদকে। কানাইপুর সিকদার বাড়ির অন্ধ কুটির। একথা শুনে আর সে বাসায় থাকে নাই আজাদ। শহরগামী একটা অটোতে উঠে চলে আসে। মাথায় একটাই চিন্তা। খলিল সাহেব শয়তানের উপাসক?

বিশ্বাস হচ্ছে না। তাছাড়া এত দ্রুত সে কানাইপুর যেতই বা কীভাবে? বায়তুল আমান থেকে কানাইপুরের দূরুত্ব ২ ঘন্টার। আর রাত বারোটার পর তো যাওয়া অসম্ভব। সে সময় শহরে যাওয়ার মতো অটোও পাওয়া যাবে না। তাহলে কী অতিপ্রাকৃত শক্তি ছিল তার মাঝে? অতি প্রাকৃত শক্তি থাকলে তো তার এভাবে মৃত্যু অসম্ভব।অতিপ্রাকৃত শক্তিধারীকে গলা কেটে হত্যা? পুরোপুরি অসম্ভব। আজাদ যতটুকু জানে এসব সম্পর্কে তা হলো শয়তানের উপাসকেরা হয় অসম্ভব শক্তিশালী। তাদেরকে হত্যা করা সাধারন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাহলে কি নিজের মানুষের হাতেই খুন হয় সে? কিন্তু কেন? তবে কী সে শয়তানেরর উপাসনা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল? কিছুই মাথায় ধরছে না আজাদের। বাসায় যেয়ে একটা ঘুম দরকার তার। এরপর পরিষ্কার মস্তিস্ক নিয়ে চলে যাবে কানাইপুর সিকদার বাড়ি, অন্ধকুটির। রহস্যের সমাধান হবে সেখানেই।

২.
রাত একটা। আজাদ অন্ধ কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতর থেকে শব্দ আসছে ‘দেবতা আনুবিসের জয়,’ ‘hail god Anubis.’ আজাদ বাইরে দাঁড়িয়ে এসব পাগলামির কথা শুনছে। এদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে এরা আনুবিসের উপাসক। আনুবিস মৃত্যুর দেবতা। প্রাচীন ইজিপশিয়ান সভ্যতায় অন্তত তাই মনে করা হতো। এর অস্তিত্ব আছে নাকি তা নিয়ে অবশ্য আজাদ সন্দিহান। আজাদ ছাত্র জীবনে এসব নিয়ে অল্প পড়াশোনা করেছে। তাও বেশি না। আজাদের পছন্দ হয়নি এসব। শফিকের অবশ্য এসব নিয়ে পড়তে খুব ভালো লাগে। এখানে শফিকের সাথেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ কি এক কাজে শফিকের ঢাকায় যেতে হয়েছে। কাজের সময় এই পুলিশেরা খালি পালানোর রাস্তা খোঁজে। সব ভিতুর ডিম। সে যখনই পুরো ঘটনা খুলে বললো শফিককে, শফিক তখনই ঢাকায় মিটিং এর কথা শুনিয়ে দিল। যত্তসব…

ভেতর থেকে একটা আওয়াজ শুনে চিন্তায় ছেদ পড়ে আজাদের। নারী একটা কন্ঠে বলছে দেবতা আনুবিসের উদ্দেশ্যে আমাদের নরবলি সফল হোক। ভেতরে কি মানুষ জবাই হচ্ছে? তাছাড়া কন্ঠটাও কেমন যেন পরিচিত লাগছে? কার কন্ঠ এটা? হ্যা,এটা রত্নার কন্ঠ, খলিল সাহেবের কাজের বুয়া। রত্না এখানে কি করবে? এ কথা মনে করতেই মাথায় একটা আঘাত অনুভব করে আজাদ। পেছনে তাকিয়ে চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে একটাই চেহারা দেখে, খলিল সাহেবের স্ত্রী পায়েল!

চোখ খুলেই নিজের হাত পা বাঁধা অনুভব করলো আজাদ। অদ্ভুত রকম এর শব্দ কানে আসছিল। এরকম শব্দ এর আগে শুনেনি সে। অদ্ভুত লাগছিল। মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছিল। চারদিকে তাকাতেই দেখলো কালো আলখাল্লা পড়া লোকেরা আজাদকে কেন্দ্র করে ঘুরছে আর বিড়বিড় করে অদ্ভূত ভাষায় সুর তুলে কি যেন বলছে। হঠাতই তারা ঘোরা বন্ধ করে দিল। মাঝ থেকে একজন মহিলা আজাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। আজাদ চিনতে পেরেছে তাকে। সে পায়েল, খলিল সাহেবের স্ত্রী।

-আজ তুমি মহান আনুবিসের উদ্দেশ্যে কুরবানি হবে। প্রস্তুত হও হে নর, মহান আনুবিসের চরনে বলি হতে! বলি হওয়ার পূর্বে কোন ইচ্ছে আছে কি তোমার?

আজাদ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। শুধু এতটুকু বোঝে যে তার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু আজাদ কাল খেপন করার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
-মহান আনুবিসের চরনে বলি হবার ভাগ্য পেয়ে আমি ধন্য। কিন্তু আমি খলিলের মৃত্যু রহস্যটা জেনে নিতে চাই।

-খলিল। অনেক অভাগা ছিল সে। আমি আর সে একই সাথে উপাসনা করতাম। কিন্তু হঠাতই সে মহান আনুবিসকে অস্বীকার করে শয়তান সেট এর উপাসনা করতে শুরু করে। মূর্খ মানব। আনুবিস নিজেই তাকে হত্যা করেছে।

অর্থাৎ পায়েল তাকে মিথ্যা বলেছে, আর ইচ্ছে করেই এখানে আসার ঠিকানা বলেছে। শুধু মাত্র তাকে বলি দেয়ার উদ্দেশ্যে। আজাদ কিছু বলতে যাবে, তখনই অন্ধ কুটিরে ঝড়ের মতো শুরু হয়। এর মাঝেই দুটো মুখ দেখতে পায় সে। একজনকে কোথায় যেন দেখেছে। ও হ্যাঁ, থানায়। কাদের, খলিল হত্যার সাক্ষি, কিন্তু অন্যজন কে? অন্যজনকে চিনতে পেরে দ্বিতীয় বারের মতো চেতনা হারায় আজাদ। সে যে তারই বন্ধু শফিক।

৩.
চেতনা ফিরলে নিজেকে নিজের বাসাতেই আবিস্কার করে আজাদ। পাশে বসে শফিক আর কাদের। তারা না থাকলে আজ হয়তো আজাদ থাকতোই না।

-কীভাবে পেলি আমাকে?

-মহান দেবতা সেটের মাধ্যমে দোস্ত।

-মানে?

-আমরা দুজনই সেটের উপাসক।

-কি?

-হ্যাঁ সত্যিই। অবশ্য আমি জানতাম না খলিলও সেটের উপাসনা করা শুরু করেছিল। কাদের প্রথমে ভয়ই পেয়েছিল। সে বৈরাগ্য গ্রহন করে সারাদিন সেটের উপাসনা করতো। ও খুনটা দেখে আমার কাছেই আসছিল, তখন পুলিশ ভাবে, ও পালাচ্ছিল। তুই আমার কাছে ফোন করতেই আমি সব বুঝে যাই। এরপর তো তোকে বাঁচাতেই চলে যাই।

আজাদের কাছে সবই কেমন যেন ঘোরের মতো লাগছিল। সে এসবের কিছুই বিশ্বাস করে না। কিন্তু চোখের সামনে সব ঘটতে দেখে কেমন বিশ্বাসযোগ্য লাগছে। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে কেমন যেন অদ্ভুত অবয়ব ফুটে উঠতে লাগলো। পাশের থেকে শফিক বলে উঠলো আপনার জন্য বলির নর প্রস্তুত আমার দেবতা। hail my god set. একথা শুনে তৃতীয় বারের মতো মূর্ছা গেল আজাদ। হয়তো শেষ বারের মতো জীবনের শেষ রাতে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত