উপাসনা

উপাসনা

উকিল ভদ্রলোক আমাকে বললেন, “সাইন করেন।”

আমার হাতে একটা ম্যাটাডর পিন পয়েন্ট কলম। কলমটার রঙ নীল। নীল গায়ে কালো অক্ষরে খোদাই করে লেখা আছে ম্যাটাডর পিন পয়েন্ট। নিবটা রুপালী। কলমের ক্যাপটা খুলে টেবিলের ওপর রেখেছেন উকিল সাহেব। টেবিলে কিছু কাগজপত্র। সাদা টেবিলক্লথে বাদামী একটা দাগ। বেশ কিছুদিন আগে চা পড়ে এই দাগটা পাকাপাকি ভাবেই টেবিলে বসে গেছে। তারপর আর টেবিল ক্লথটা বদলানো হয়নি। টেবিলে এক সারি পিপড়া এক মাথা থেকে আরেক মাথার দিকে যাচ্ছে। কালো পিঁপড়া। মুসলমান পিঁপড়া। ছোটবেলায় আশফাক বলতো যে, কালো পিঁপড়াগুলো হচ্ছে মুসলমান পিঁপড়া। এরা কামড়ায় না। নিরীহ গোছের। লাল পিঁপড়ারা হচ্ছে হিন্দু। এরা উগ্র। পেলেই কামড়ায়। এই তথ্য আশফাক কোথা থেকে পেল সেটা জানার আগ্রহ আমার কখনোই হয় নি। ওর কথাই সবসময় মেনে নিতাম।

উকিল সাহেব মনে হয় অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। তিনি গলা খাকারি দিয়ে বললেন, “কি হল? কি ভাবছেন? সাইন করুন।”

আমি কাগজটা টেনে নিলাম। একটা স্ট্যাম্প। তালাকনামা।

আমি অকম্পিত হাতে সাইন করলাম। নিজের নাম লিখলাম। সবাই পেঁচান সাইন করে। আমি তা পারি না। আমি গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নামটা লেখলাম। আসাদুল্লাহ মুরাদ।

উকিল মনে মনে তুষ্ট হলেন বোঝা গেল। আমি আমার স্টকের কিছু ভয়ংকর গালি দিলাম ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে। অবশ্যই মনে মনে। কারণ সমাজে থাকতে চাইলে আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। মনের কথা মনে চেপে রাখা কতটা কঠিন এটা মানুষ মাত্রই জানে। এই যেমন আমার এখন উকিল সাহেবকে বলতে ইচ্ছে করছে, “তুই যে তোর সুদর্শন ইন্টার্ন ছেলেটার সাথে প্রায়ই বিছানায় যাস, এইটা কি তোর বউ জানে?”

মজার ব্যাপার হচ্ছে এটা আমার নিজেরও জানতে পারার কথা না। কিন্তু আমি জানি। জন্ম থেকেই এই অভিশাপটা বয়ে বেড়াচ্ছি আমি।

উকিল সাহেব চলে যেতে আমি ক্লান্ত পায়ে ব্যালকনীতে এলাম। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি হবে বলেই মনে হচ্ছে। ছোটবেলায় আমি ফাঁক পেলেই বৃষ্টিতে ভিজতাম। কত বকা আর মার খেয়েছি এজন্য হিসাব নেই। অবশ্য আমি বুঝতাম। আমার খুব জ্বর হত বৃষ্টিতে ভিজলেই। এজন্যই মা মারতেন। সেদিনও এমন বৃষ্টি ছিল। যেদিন থেকে আমার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে যায়।

অন্য সময় হলে এমন দিনে রোজ গরম কফি নিয়ে আসতো। এক্সপ্রেসো কফি। আমরা দুজন লিভিংরুমে কাউচের ওপর এক কম্বলের ভেতর ঢুকে শুধু মাথাটা বের করে কফি খেতাম আর ভুতের ছবি দেখতাম। কি কি সব ছবি! মিররস, ইভিল ডেড, দ্য আই, শেষ যেটা দেখেছিলাম সেটার নাম সম্ভবত ওইজা। কয়েকটা টিনেজ ছেলে মেয়ে প্ল্যানচেট করে ভূত নিয়ে আসে। ফালতু ছবি। রোজ কি মজা পেত তা ওই জানে। ভৌতিক দৃশ্যের সময় আমাকে খামচে ধরে রাখতো। আমার শার্টের হাতা গোটালে দুবাহুতে ওর নখের আচড়ের অসংখ্য দাগ পাওয়া যাবে। সেই সংসার আজ ভেঙে দিলাম। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেটে আগুন দিলাম।

রোজের সাথে পরিচয়ের দিনটা আমার এখনও মনে আছে। যোগাযোগটা কাকতালীয় বলা যেতে পারে। আমি খালার বাসায় যাচ্ছিলাম। হাতে ছিল আধভেজা সিগারেট। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সিগারেট খাওয়াটা আমার অন্যতম পছন্দের একটা কাজ। সিগারেট ধরবার পর থেকেই আমি এইটা করি। তবে কাজটা খুব ঝামেলার। আগুনটা সামলে রাখতে হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।

আমাদের দেশের কবিরা বিভিন্ন ভাবে নারীদের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে তারা আরেকটা জিনিষ ব্যাখ্যা করেছেন। জিনিষটা হচ্ছে প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভুতি। অসংখ্য বর্ণণার মধ্যে তার বর্ণনাটাই বেস্ট। কবি বলেছেন, “বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা”।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে ওয়ার্কশপ। সেখান থেকে ভেসে আসছে গ্রিজের ধাতব গন্ধ। আমার হাতে পুড়তে থাকা সিগারেট সেখান থেকে তামাকপোড়ার সুবাস রাস্তার পাশের ড্রেন আর রাস্তার উল্টোদিক দেখে নাকে ধাক্কা দিচ্ছে আবর্জনার বিকট ঘ্রাণ। জায়গাটা প্রেমে পড়ার জন্য এপ্রোপ্রিয়েট না। তবুও আমি প্রেমে পড়লাম। সুখের মত ব্যাথা অনুভুতিটা নেহাতই খারাপ না। মিষ্টি একটা মেয়ে। দীর্ঘ কাল চুল। সোনালী ত্বক। সবচেয়ে যেটা বেশী আকৃষ্ট করল যেটা সেটা ছিল তার চোখ দুটো। ধুসর রঙা চোখ জোড়াতে দুই জাহানের সমস্ত মায়া এসে জমা হয়েছে। গোলাপী দুঠোটের ফাকে একটা সিগারেট। মেয়েটা আরাম করে একটা ভ্যানের ওপর বসে সিগারেট টানছে। অনেকেই বার বার ঘুরে ঘুরে দেখছে মেয়েটাকে। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মানুষ এত সুন্দর করে সিগারেট কিভাবে খায়? আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। অতিরিক্ত সৌন্দর্যের দিকে বেশীক্ষণ চেয়ে থাকতে নেই। দ্রুত হাঁটা দিলাম। খালার বাসার কাছে বেশ কয়েকটা মুদি দোকান আছে। এখানে দাঁড়িয়ে গন্ধ দূর করার জন্য আমি একটা সেন্টার ফ্রুট আরেকটা মাউন্টেন ডিউ মেরে দিলাম। খালা গন্ধ পেলে আমার চামড়া জ্যান্ত ছিলে নেবে। মোটামুটি যখন নিশ্চিত হলাম যে গন্ধ নেই তখন এপার্টমেন্টের ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম।

খালার বাসা দশতলায়। লিফটে উঠে ৯ বাটনে চাপ দিতেই লিফটের দরজা বন্ধ হতে শুরু করলো।তখনই একটা হাত দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। হরর মুভিগুলোতে এভাবেই ভুতেরা দরজার ফাঁক ফোকড়ে হাত ঢুকিয়ে দেয়। লিফটের দরজা খুলে যেতেই ভেতরে সেই মেয়েটা ঢুকলো। মেয়েটা এই বিল্ডিংয়েই থাকে? আগে কখনো দেখিনি তো। লিফট ঊঠছে। মেয়েটা কোন বাটন চাপলো না। দশতলাতেই যাবে? আমার হার্টবিট আবার বেড়ে গেল। বদ্ধ লিফটের ভেতরে মেয়েটাও শুনতে পাবে ভয় হল। লিফটের কুউউক শব্দে বুঝতে পারলাম। দশতলায় চলে এসেছি। খালার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেলে চাপ দিলাম। এমন সময় পেছন থেকে মেয়েটা বলল, “কলিংবেল নষ্ট”। তারপর নিজেই এসে দরজায় ভালরকম একটা থাবা দিল। এই থাবা খেলে যেকোন সুস্থ মানুষ মাথা ঘুরে শুয়ে পড়বে। দরজা খুললো ছোট খালা। খুলেই বললো, “কই গিয়েছিলি?”

আমি তব্দা। আসলামই তো মাত্র। গেলাম কখন? আর গেলামই বা কই? মেয়েটা উত্তর দিল, “এইতো একটূ নিচে গিয়েছিলাম চাচি।”

-ভেতরে আয়। তোর সাথের এই লোকটা কে?

দুঃখে পুরা গরীব হয়ে গেলাম। নিজের খালা আমারে চিনে না। মেয়েটা বললো, “দরজার বেল টিপছিল”।

-আপা দেখেন তো কে যেন আসছে।

দরজায় পরমুহুর্তে উদয় হল আমার কাজিন, “ভাইয়া তুই আসছিস? এতক্ষণ লাগলো?”

আমি কিছু বললাম না।

ছোট খালা বললেন, “দাঁড়ি রাখছিস কিজন্য? আমি তো চিনতেই পারি নাই।”

আমি হাসার চেষ্টা করলাম, “কেমন আছো খালা?”

হঠাত কে যেন ধুপধাপ শব্দে দৌড়ে এসে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। ধাতস্ত হয়ে বুঝতে পারলাম আমার খালাত ভাই আর বোন। এরা দুজনেই দেশত্যাগী হবার আগে আমার বেসম্ভব ভক্ত ছিল। দুজনের আবেগে পানি ঢালার জন্য এগিয়ে এলেন বড় খালা। এই ধর। নিচে যাবি আর আসবি। ফেরত আসার পর যেন মুখে দাঁড়ি না দেখি। আমার হাতে একটা ১০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে খালা আবার ভেতরে চলে গেলেন। আমি হতভম্ব। বড় খালার গলার আওয়াজ পেলাম রান্না ঘর থেকে, “রোজ, মা তুমি যাও তো ওর সাথে। কেউ না গেলে সে টাকা নিয়ে ভেগে যাবে।”

সিগারেটখোর রূপবতী তরুণী যার নাম রোজ সে আবার বের হয়ে এল। বলল, “চলুন।”

রোজ আমার ছোটখালুর বন্ধুর মেয়ে। পরিচয়ের তৃতীয়দিনে এই মেয়েটা আমার মেসে হাজির হয়। রাজাবাজারের ঘিঞ্জি গলিতে আমার মেস। সে চা সিগারেটের দোকানদার মামার কাছ থেকে আমার ঠিকানা পেয়েছে। জ্বলন্ত মোমের মত রূপবতী এক তরুণী আমার ঘরে ভাঙা টেবিলে বসে পা নাচাচ্ছে আর সিগারেট খাচ্ছে এই দৃশ্য দেখবার জন্য মেসের অন্যান্য বোর্ডাররা উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলো।

এই মেয়েটার ঢাকা গাইডের কাজ পেলাম আমি। তাকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিন ঢাকা দেখাতে বের হতাম। হুমায়ুন আহমেদের তোমাদের এই নগরে বইয়ের দশা। তবে আমি হিমু নই। আমি খুব দ্রুতই মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করলাম। ভ্যাগাবন্ডের মত ঘোরা বাদ দিয়ে মাস্টার্সের সার্টিফিকেটের সদ্ব্যবহার করে এক মাসের মাথায় একটা চাকরি যোগাড় করলাম।

দৈনিক দশটা পাচটা অফিস করি। সন্ধ্যেটা কাটাই রোজের সঙ্গে। একদিন হুট করে ছোটখালা ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘটনা কি রে?”

-কিসের ঘটনা?

-রোজের সাথে তোর কি?

-কিছু না তো।

-দেখ মিথ্যা বলবি না।

-খালা আসলেই কিছু না।

-রোজকে তুই পছন্দ করিস?

-এই প্রশ্ন কেন?

-তোকে খোলাখুলিই বলি। রোজের বাবা ওকে বিয়ে দিতে চান। ভাল পরিবারের বাঙ্গালী ছেলে খুঁজছেন। যদি তুই আর রোজ রাজি হোস তাহলে আমরা কথাবার্তা বলি।

-রোজ কি রাজি হবে?

-কেবল না বললি অমন কিছু না?

-না মানে……… ইয়ে……… মানে………।

-হইছে। বুঝা শেষ। দাঁড়া আমি রোজ আর ওর মা-বাবার সাথে কথা বলি।

অবাক ব্যাপার। রোজ রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্যখানে। রোজ আর তার মা-বাবা আমাকে স্টেটসে নিয়ে যেতে চাইছিল। আমি রাজি হলাম না। বললাম, “আমি দেশেই থাকবো। রোজ আমার সাথেই থাকবে।”

রোজের বাবা রাজি হলেন না। বিয়েটা ভেঙে গেল।

আমার আর রোজের গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু যিনি ওপর থেকে পুতুল খেলা খেলেন তার ইচ্ছেটা অন্যরকম ছিল। এয়ারপোর্টে আমিও গিয়েছিলাম। ছোটখালা আর রোজকে সি অফ করতে। ইমিগ্রেশন লাউঞ্জে ঢোকার আগমুহুর্তে রোজ আমার হাত ধরে বলল যে সে যাবে না।

সবাই অবাক। এয়ারপোর্টে কান্নাকাটি। রোজ একপর্যায়ে আমাকে বজ্রআটুনিতে জড়িয়ে ধরল। আমি একবার ওর বাবার দিকে আর একবার আমার খালার দিকে বেকুবের মত করে তাকাতে লাগলাম।

সেদিন রাত তিনটার দিকে ঢাকেশ্বরী এলাকার এক কাজীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল। বিয়ে পড়ানোর পর মোনাজাতের এক পর্যায়ে কাজী বসা অবস্থায়ই ঘুমিয়ে গেলেন। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন ছিল সেটা।

ফোনের রিংটোন শুনে বর্তমানে ফিরে এলাম। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কানে ধরতেই গম্ভীর পুরুষকন্ঠ ভেসে এল, “তোমার নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে?”

-হ্যাঁ।

-মন খারাপ কর না। ইউ ডিজার্ভ এ লট বেটার।

আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, “জাহান্নামে যা। দূরে গিয়া মর মাদারচোত।”

কিন্তু আমি চুপ রইলাম।

“আজ রাতে মিটিং হবে। তোমার বাসাতেই।” লোকটা আবার বললো।

-ঠিক আছে।

-রাত বারোটায় চলে আসবো আমরা। আজ ব্লাডমুন জানো তো?

-হ্যাঁ। চলে আসুন। সমস্যা নাই।

ফোন কেটে যেতে আমি চুপ করে বসে রইলাম।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আমার ছোটবেলাতে। আমি তখন জানতামও না ব্যাপারটা কি? আমার বড় ভাইয়ের নাম ছিল আশফাক। বাবাকে সবসময়েই আমি একটু অন্যরকম বলে জানতাম। কারো সাথে তিনি কথা বলতেন না। সবাই বলতো বাবা একটু পাগল কিসিমের। আমাকে ও আশফাককে খুবই ভালবাসতেন তিনি। হঠাত করে মনে পড়লো আমার। আজ তো মা আর আশফাকের মৃত্যুবার্ষিকী। আরেকটা কথাও মনে পড়ল। আজ আমার জন্মদিন।

আমার ষষ্ঠ জন্মদিনে আমার মা আর আশফাক একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। তারপর থেকেই আমি আর কখনোই আমার জন্মদিন পালন করিনি। কেউ উদ্যোগীও হয়নি পালন করবার জন্য। গত পাঁচ বছরের আগে। রোজ প্রতিবছর আমার জন্মদিন পালন করতো। শুধু আমি আর সে। ছোট একটা কেক আনতো। কেকের উপর একটা মোমবাতি। এক ফুঁতে মোম নেভালে নাকি সব ইচ্ছে পুরণ হয়। এটা মিথ্যে কথা। এমনটা হলে আজ হয়তো আমার সাথে রোজ এখনও থাকতো।

আমার গত জন্মদিনে আমরা ছিলাম তিনজন। আমি রোজ আর আমাদের অনাগত সন্তান। ভয়ংকর আনন্দময় ছিল দিনগুলি। কত স্বপ্ন ছিল চোখে। আমরা দুজনেই প্রতিজ্ঞা করে সিগারেট ছেড়ে দিলাম।

আমি একদিন মিটিঙে ছিলাম। বড় খালা ফোন করে বললেন রোজের হঠাত ব্যাথা উঠেছে। তাকে নিয়ে তিনি হসপিটালে যাচ্ছেন। আমি মিটিং ফেলে আক্ষরিক অর্থেই দৌড় শুরু করলাম। মিরপুর এক থেকে ধানমন্ডি। ইবনেসিনা হাসপাতাল। খোজাখুজি করে খালাকে বের করতেই উনি আমার হাতে একটা পোটলা ধরিয়ে দিলেন। পোটলাটার ভেতরে ঘুমন্ত এক দেবশিশু। আমার ছেলে। জ্ঞান হবার পর সেদিন প্রথম আমি কাঁদলাম। হসপিটালের সমস্ত স্টাফকে মিষ্টি খাওয়ানো হল সেদিন।

রাতে সেদিন হাসপাতালেই থাকতে হয়েছিল। আমি নার্সারির সামনের বেঞ্চে বসে আছি। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। আমি নাম্বারটা দেখে চমকে উঠলাম। ফোন রিসিভ না করেও উপায় ছিল না। আমি ফোনটা কানে নিলাম।

গম্ভীর কন্ঠটা বলল, “পুত্র সন্তানের জনক হওয়ায় তোমাকে অভিনন্দন।”

আমি শুকনো গলায় বললাম, “ধন্যবাদ।”

-সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার এই সুযোগটা হাতছাড়া করছো কেন? তোমার বাপের মত গাধামি তুমিও করতে চাও?

-আমি আর আপনাদের সাথে নেই।

-ব্রাদারহুডের সাথে বেইমানি করতে চাইছো?

-না। আমি আপনাদের তো কোন ক্ষতি করছি না। আপনারা আমাকে আর আমার পরিবারকে ছেড়ে দেন।

-ব্রাদারহুড তোমাকে সব দিয়েছে জীবনে। তোমার বাপ যেমন সব হারিয়েছে তুমিও কি সেভাবে সব কিছু হারাতে
চাও?

-আমি একটু ভাল থাকতে চাই।

-যা করার আজ রাতেই করতে হবে। চিন্তা কর না। ইউ ডিজার্ভ বেটার। অর্থ, নারী, ক্ষমতা সবটাই তুমি পাবে। তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমরাই করবো। উই নীড ইউ।

ফোনটা কেটে গেল। আমার কাছে সবসময় একটা হ্যান্ডগান থাকে। এটা কেউই জানে না। রোজও না। আমি পিস্তলটা হাতে নিলাম। ওরা আমার স্ত্রী ও সন্তানকে খুন করতে চায়। আই হোপ ওরা পারবে না। আমার ক্ষমতার কথা ওরা জানে। তবে ওরা এটা জানেনা আমার ক্ষমতা কতটা ভয়ংকর। পিস্তলটা প্যান্টের পেছনে গুঁজে শার্ট নামিয়ে দিলাম আমি। খালাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। রোজ আমাকে বলল, “তোমাকে এমন লাগছে কেন? এনিথিং রঙ?”

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম, “না সোনা সব ঠিক আছে। আমি আছি না?”

নার্সারিতে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিলাম। কি সুন্দর হয়েছে ছেলেটা! গোলাপের মত গায়ের রঙ। বড় বড় চোখ। আমি বুকের সাথে চেপে ধরলাম আমার আত্মজকে। ওকে শুইয়ে রেখে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাত বারোটা পর্যন্ত ঠায় বসে রইলাম নার্সারির সামনে। একটু ঝিমুনির মত আসলো। সামনে দিয়ে একজন ডাক্তার হেটে নার্সারীর ভেতর ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছি। এমন সময় করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলো একজন নার্স। নার্স বয়সে তরুণী। ডাক্তার সাহেবের নজর দেখে বুঝলাম উনার মধ্যে কিঞ্চিত লুচু স্বভাব আছে। হাই হিল ঠুকঠুক করে নার্স বাচ্চাদের ঘরে ঢুকে গেলেন। ডাক্তার সাহেবের দিকে আমি চোখ নাচাতেই উনি একটূ লাজুক হাসলেন, “চলুন কফি খেয়ে আসি।”

সারাদিনের অবসাদ আর চিন্তায় আমি ক্লান্ত। “চলুন।” ডাক্তার ভদ্রলোকের পিছনে রওনা হলাম আমি।

লিফটে উঠে সাত নম্বর বাটন প্রেস করলেন। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই তিনি বললেন “মুরাদ সাহেব একটা জিনিষ কি অড লাগেনি আপনার কাছে?”

-কোন জিনিষটা?

-নার্স মেয়েটা হাই হিল পড়ে ছিল। নার্সেরা ডিউটির সময় কখনো হাই হিল পড়ে না। এই মেয়েটা কেন পড়েছে কে জানে। তবে মেয়েটা অস্থির……………।

আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন তিনি। আতকে উঠে বললেন, “ওকি! আপনার চোখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”

লিফটের ভেতরটা মেটালের। তাতে আয়নার মত স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব দেখা যায়। আমি নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।

আমার চোখ!

আমার চোখ পুরো কালো কুচকুচে হয়ে গেছে! কোন মনি নেই তাতে। মনে হচ্ছে সেখানে শুধু কাল কুচকুচে দুটো গর্ত। আমি জানি এটা কিসের লক্ষণ। আরেকটা বলি মাত্র সম্পন্ন হল। ক্ষমতার শীর্ষে পৌছাচ্ছি আমি। তখনই লিফটের দরজা খুলে গেল। সাত তলা এসে গেছে। লিফট থেকে ছিটকে বের হয়ে ছুটতে শুরু করলাম সিড়ি বেয়ে। তিনতলায় ম্যাটারনিটি ওয়ার্ড। রোজের রুমে উঁকি দিলাম। মেয়েটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ছুটলাম নার্সারির দিকে। করিডোর ধরে দৌড়ে যাচ্ছি তখনই নার্স মেয়েটাকে নার্সারি থেকে বের হতে দেখলাম। সফলতার আনন্দ তার চোখে মুখে। সর্বনাশ কি হয়েছে বুঝতে আমার আর বাকি রইলো না। নার্স আমাকে দেখেই ছুটতে শুরু করলো উল্টো দিকে। আমি ওর ধার ধারলাম না। নার্সারিতে ঢুকে গেলাম।

আমার ছেলেটা এখন ঘুমাচ্ছে। এই ঘুম আর ভাঙবে না।

সব কিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হল আমার। মাথার ভেতরে বিস্ফোরণ হচ্ছে। হঠাত ভয়ংকর শব্দে বাজ পড়লো বাইরে। হাসপাতালের সব কয়টা বাল্ব একই সাথে ফাটলো। আঁধারে ঢেকে গেল পুরো হাসপাতাল। আমি বের হলাম নার্সারি থেকে। নার্স মেয়েটার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি আমি। অনেক গন্ধের মধ্যে এই একটা গন্ধ আলাদা করে ট্রেইল ধরে ছুটতে ছুটতে হাসপাতালের বাইরে চলে এলাম। নিকষ আধারেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। নিজের শরীরের প্রতিটি শিরায় অপার্থিব ক্ষমতার উপস্থিতি অনুভব করছি। শক্তির সর্বোচ্চ স্তরে থাকা অজেয় এক পিশাচ এখন আমি। অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা এখন আমার দেহে। আমি দ্রুত ছুটতে শুরু করলাম। মেয়েটার গায়ের ঘ্রাণ ধানমন্ডির লেকের দিকে চলে গেছে। বত্রিশ নাম্বার ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখলাম আমি মেয়েটাকে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে রাস্তা পার হচ্ছিল। লাভ নেই ওর মৃত্যু লেখা হয়ে গেছে। রাস্তার মাঝখানে থেমে গেল মেয়েটা। অনেক চেষ্টা করেও নড়তে পারছে না। ওর পা নিজের ইচ্ছেশক্তি ব্যবহার করে আটকে রেখেছি আমি।

অপর দিক থেকে একটা ট্রাক ছুটে আসছিল। ড্রাইভারের মাথায় ঢুকে গেলাম আমি। গাড়িটার গতি না কমে বেড়ে গেল। মেয়েটাও দেখছে গাড়িটাকে। চিৎকার দিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করল মেয়েটা। লাভ হল না। ট্রাকের চাকার তলায় পিষে গেল সে। কয়েকটা রাস্তার নেড়ি কুকুর ছুটে এল। ওদের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতাবলে আমিই ডেকে এনেছি। ওরা চার পাঁচজন মিলে টেনে নিয়ে গেল মেয়েটাকে।

বাচ্চাটা মারা গেছে। খবরটা শুনে রোজ পাগলের মত হয়ে গেল। আমার পাগলপ্রায় স্ত্রীকে নিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম মেয়েটাকে। রাতে আবার অভিশপ্ত নরকবাসী লোকটা ফোন করলো। আমি রিসিভ করে গালি শুরু করলাম, “খানকির পোলা, মাদারচোত। এইটা তুই কি করলি? আমার লাইফটা শেষ কইরা দিলি। কি ক্ষতি করছিলাম তোদের আমি?”

-লাভটা তোমারও ছিল। কাল রাতে কি টের পাও নাই কি পরিমাণ ক্ষমতা এখন তোমার? সবচাইতে ক্ষমতাবান এখন তুমি। যা ইচ্ছে মুহুর্তের মধ্যেই সেটা করতে পারবা। জিনিয়াকে মেরেছো কোন আফসোস নাই। মেয়েটা তোমাকে বিছানায় চরম আনন্দ দিতো তাই না? সমস্যা নাই আরেকটা মেয়েকে যোগাড় করে দেব। জিনিয়ার চাইতেও বিছানায় আগ্রাসী।

আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। ফোনটা কেটে দিয়ে নির্বাক ভাবে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে।

প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে পিশাচ সাধনা ছিল সাধারণ একটা বিষয়। অসংখ্য কাপালিক আর ডাইনিরা বিভিন্ন পিশাচের পুজা করতো। এই সব পিশাচের মধ্যেও নিকৃষ্টতম ছিল শর্বর। মৃত্যু, পাপ আর নরকের অধিকারী পিশাচ দেবতা। এরা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে কাপালিক আর ডাইনীরা পর্যন্ত এর পুজো করবার সাহস পেত না। শর্বরের পুজোর মূল উপকরণ হচ্ছে ঠিক ছয় বছরের বাচ্চা। সেই বাচ্চাটাকে জন্ম নিতে হবে যেকোন পবিত্র তিথিতে। শর্বর সেই শিশুর দেহকে অধিকার করে নেয়। সে জন্য সেই শিশুর কোন নিকট আত্নীয়ের বলি দিতে হয়।

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমার জন্ম হয়েছিল তাদের উপাসনার জন্য আদর্শ এক সময়ে। আমার ক্ষেত্রে বলি দেওয়া হয়েছিল আমার ভাই আশফাককে। আমার মা আশফাককে বাচাতে গিয়ে শর্বর উপাসকদের হাতে মারা পড়েন। আমার বাবা কিভাবে এদের খপ্পরে পড়েছিলেন আমার জানা নেই। তিনিও ছিলেন শর্বরের উপাসক। আশফাকের হত্যাকান্ডে বাবার পূর্ণ সম্মতি ছিল। শর্বরদের ক্ষমতার কোন সীমা নেই। অস্বাভাবিক শারীরিক শক্তি সেই সাথে আছে যেকোন জড়বস্তু নিয়ন্ত্রণ ও মানুষসহ অন্য যেকোন প্রাণীর মনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। আমি রোজকে এভাবেই বাধ্য করেছিলাম দেশে থেকে যাবার জন্য।

দশ বছর বয়সে আমি আমার বাবাকে খুন করি। শর্বরের উপাসকরা আমাকে তাদের উপাস্য হিসেবে উপাসনা করে। অপদেবতা শর্বরের অবতার আমি। ছয়টা শিশুর বলি আমাকে আজ পূর্ণাঙ্গ শর্বরে বদলে দিয়েছে। শর্বরকে পূর্ণাঙ্গ করতে চাইলে শেষ বলিটা দিতে হবে অবতারের নিজের সন্তানের। বাবার ভুলের জন্য আজ এই করুণ পরিণতি আমার।

আমার সন্তানের মৃত্যুর পর রোজ আর আমার সাথে থাকতে চায়নি। আমাকে দেখলেই তার আমাদের বাচ্চাটার কথা মনে পড়ত। দূঃসহ স্মৃতি থেকে মুক্তি চেয়েছিল মেয়েটা। আমি চাইলে ওকে বাধ্য করতে পারতাম আমার সাথে থাকবার জন্য। কিন্তু করলাম না। আমি এখন শুধু নামেই ওদের উপাস্য। বাস্তবতা হচ্ছে ওরা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

রাত বারোটা বাজে।

বাইরে ঝড় হচ্ছে প্রচন্ড। সেই সাথে বজ্রপাত আর বৃষ্টি। প্রায় পঞ্চাশজন লোক আমাকে ঘিরে বসে আছে। মেঝেতে রক্ত আর চাল দিয়ে আঁকা হয়েছে একটা পেন্টাগ্রাম। পেন্টাগ্রামটা আছে একটা বৃত্তের ভেতরে। সেই বৃত্তের চারদিকে গোল করে বসে আছে সবাই। আমার গায়ে কোন কাপড় নেই। বাকি সবারও একই অবস্থা। বড় কক্ষটার ভেতরে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে। প্রত্যেক উপাসকের হাতেই একটা মোমবাতি। আমার বাসার লিভিংরুমে গাদাগাদি করে বসে আছে সবাই। বাইরে ঝড় হচ্ছে প্রচন্ড। এরা সবাই আমার উপাসক। অদ্ভুত একটা উল্লাস হচ্ছে মনে।

প্রধান পুরোহিত, সেই গম্ভীর কন্ঠের লোকটা মন্ত্র পড়ছে। লোকটার নাম আরফান খান। বেশ বড় মাপের একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। মাথা ভরা সাদা চুল। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি। ষাটোর্ধ বয়সেও নির্মেদ নিখুত বাঁধন লোকটার শরীরের। ক্রমে তার কন্ঠ চড়ছে। তার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ আমাকে যেন নতুন করে শক্তিশালী করে তুলল।

ভিড়ের মধ্যে থেকে অসাধারণ রূপবতী একটা মেয়ে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা সম্পুর্ণ নগ্ন। অসাধারণ দেহবল্লরী তার। পেন্টাগ্রামের ভেতরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। নিজেকে নৈবেদ্য দিচ্ছে আমার কাছে। আমি মেয়েটাকে টেনে নিজের নিচে নিয়ে এসে চড়াও হলাম মেয়েটার ওপর।

মন্ত্র উচ্চারণের গতি বাড়লো। আমি দ্বিগুণ উদ্যমে ক্ষুধার্ত বাঘের মত ঝাপিয়ে পড়লাম মেয়েটার ওপর। মেয়েটা দুহাতের নখ বসিয়ে দিচ্ছে আমার পিঠে। এমন সময় হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হল আমার রান্নাঘরে রাখা চারটে গ্যাস সিলিন্ডার।বাসার প্রতিটা জানালা দিয়ে লাফিয়ে বের হল আগুনের লেলিহান শিখা। ধ্বসে গেল দেওয়াল। প্রচন্ড শকওয়েভ আমাকে ছিটকে নিয়ে ফেলল উলটো দিকের দেওয়ালে।

উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চারদিকে একটাবার চোখ বুলালাম। ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার উপাসকদের লাশ। এই লোকগুলোর লোভের কারণে আমি সব হারিয়েছি। আমার পরিবার, ভালবাসা, সন্তান এমনকি আমার মানুষ হিসেবে বাচার অধিকারটূকুও কেড়ে নিয়েছিল এরা। নিজের দিকে তাকিয়ে করুণাই হল আমার। সমস্ত শরীরের মাংস ঝলসে গেছে অথচ একটূও যন্ত্রণা হচ্ছে না। মানবিক অনুভুতির লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই আর। নিজের পুড়ে যাওয়া হাত দুটো চোখের সামনে তুলে ধরলাম আমি। অদ্ভুত ব্যাপার! আমার দেহের ক্ষতগুলো দ্রুত সেরে যাচ্ছে। আমাকে অজেয় বলতে হয়তো এটাই বুঝিয়েছিল ওরা। কোন অস্ত্রেই আমার মৃত্যু নেই। চারটা গ্যাসের সিলিন্ডার আজই কিনে এনেছিলাম আমি। সবগুলোকে একত্রিত করে শুধু নিজের ইচ্ছেশক্তি খাটিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে হয়েছে। এতদিনের সাধের বাসাটা আমার এভাবে ধ্বংস করতে হবে এটা আশা করিনি। আধপোড়া একটা লাশকে আলাদা ভাবে দেখলাম আমি। আমার প্রধান উপাসক আরফান খান। কাছে এগিয়ে গেলাম। সুদর্শন বৃদ্ধকে চেনার উপায় নেই। আমার করুণ পরিণতির, আমাকে পিশাচ বানানোর, আমার জীবন থেকে সব ছিনিয়ে নেওয়ার পেছনে এই লোকটাই দায়ী। লোকটার মাথা দুহাতে প্রচন্ড চাপ দিয়ে পিষে ফেললাম আমি। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মুন্ডহীন ধড়টা মেঝেতে পড়ে রইলো। আমি ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

আকাশে মেঘ কেটে গেছে। উঁকি দিয়েছে ব্লাডমুন। আমি পুর্ণ নগ্ন অবস্থায় জোছনাধোয়া রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। গন্তব্য আজিমপুর গোরস্তান। আমার বাবুটা একা আছে সেখানে। খুব ভয় পাচ্ছে নিশ্চয়ই।

রোজ হাসপাতাল থেকে ফেরার পর একদিন ওকে আমার জীবনের সবটাই খুলে বলেছিলাম আমি। সে আরফান সাহেবকে বোকা বানানোর জন্য নিজের পরিচিত একজন উকিলকে দিয়ে ভুয়া তালাকনামা তৈরী করায়। আমি ওকে আমেরিকা চলে যেতে বলি। দেশে থাকলে আমার উপাসকেরা হয়তো ওর ক্ষতি করতে পারে সেই ভয়ে। আরফান খান আমার ওপর সবসময় নজরদারির ব্যাবস্থা করেছিল। খুব সাবধানে ডিভোর্সের নাটকটা সাজিয়েছি আমরা। সবকিছু যেন অথেনটিক হয় সেটা লক্ষ্য রাখতে হয়েছিল। অবাক হলাম একটা জিনিষ দেখে। আমি মানুষ না, পিশাচ, এটা জানার পরও রোজ আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমাকে সাপোর্ট করেছে। এটার খুবই দরকার ছিল আমার। উকিল সাহেব অনেক সাপোর্ট করেছেন আমাদের। লোকটা গে হলেও মানুষ ভাল।

আমার মনে হয় না যে ক্ষমতালোভী শর্বর উপাসকেরা আর কখনো আমার পিছনে লাগবে।

আজ আমেরিকা চলে যাচ্ছি।

উকিল সাহেব আর বড় খালা আমাকে সি অফ করতে এলেন এয়ারপোর্টে। চলে যাচ্ছি এই দেশ ছেড়ে। রোজ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে ওই দেশে। অতীতকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করবো আমরা। রোজ ছাড়া আর কেউ আমার আসল রূপটা জানে না। খালা এখনও ভাবেন যে তার বোন আর ভাগ্নের মৃত্যুটা হয়েছিল বাসায় আগুন লেগে। তার ভাগ্নের ছেলের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। আর গত পরশু রাতে আমার বাসার বিস্ফোরণটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। সত্যটা না জানাই সকলের জন্য ভাল। একেবারে যাচ্ছি না এদেশ ছেড়ে। আমার ছেলেটা এখনো এই দেশের মাটিতেই ঘুমিয়ে আছে। ওর জন্য তো আমাকে আসতেই হবে। ওর নাম আমি রেখেছি আনান। নামটার অর্থ হচ্ছে মেঘ। সুন্দর হয়েছে না নামটা?

…………………………………………………………..সমাপ্ত…………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত