ক্ষমতা

ক্ষমতা

হা করে বসে আছি। সামনে রুবি ম্যাডাম। আমাদের বাংলা ব্যাকরণের ম্যাডাম। সমাস বোঝাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর আগা মাথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সেই ছোটবেলা থেকে সমাস পড়ছি। অথচ বুঝতে পারিনি এখন পর্যন্ত। ঘুমাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এই ম্যাডাম অনেক রাগি। যদি দেখে ঘুমিয়ে পরেছি তখন কপালে যে কি আছে টা ভাবতেই আমার ঘুম চলে গেল। এসব ফালতু জিনিস বইয়ে দেবার কি দরকার তাই বুঝতে পারি না। আর পড়াশুনা তো দুরের কথা।

হঠাৎ মনে হল কেউ যেন ডাকছে আমাকে। অনেক গভীর ভরাট কণ্ঠ। আগেও শুনতাম। তখন শুধু আস্তে আস্তে শুধু আমার নামটা ডেকে যেত। নামের বেশি কিছু শুনতে পারতাম না। আজকাল শুনতে পাই। কণ্ঠটা নামের সাথে সাথে বলে, ‘ভয় পাবেন না। আপনি জেগে উঠুন। আমরা আপনার সাথে আছি। আপনার কোন বিপদ হবে না। আপনার সব দায়িত্ব আমাদের।’

কথাগুলোর মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতাম না। খালি বলে ভয় পাবেন না! আজিব! আমি ভয় পাব কোন দুঃখে? আমার তো আরও ভাল লাগে । নিজেকে কেমন জানি আলাদিনের মত মনে হয়। আশেপাশে জিন ঘুরঘুর করে। একটু পর পর অভয় দেয়। বাহ মজাই মজা। আবার সবসময় বলে জেগে উঠুন। আরে ভাই আমি কি সারাদিন ঘুমাই নাকি? যে জেগে উঠবো? তবে এ ব্যাপারটা কারো সাথে শেয়ার করি নি। আসলে ইচ্ছা করে নি। বলতে গেলেই মনে হয় ‘কি দরকার? থাক না গোপনে! হা হা হা . . .’

‘ওই হাসল কে রে? কার এতো বড় সাহস? ক্লাসের ভিতর হাসাহাসি করে! ওই তুই হেসেছিস? তুই?’

‘জি ম্যাম।’

‘নাম কি তোর?’ গলায় ১০৪ ডিগ্রি রাগ বোঝাই যাচ্ছে ।

‘সিফাত।’

‘হাসছিলি কেন?’
‘এমনি।’

‘কি? এমনি এমনি হাসছিলি? কেন তোর মাথায় কি ভুত ভর করেছে নাকি?’

‘না ম্যাম।’

‘তাহলে হাসলি কেন?’

‘বললাম তো ম্যাম এমনি।’

‘একটা থাপ্পড় দিয়ে উড়াইয়া একদম মাঠে ফালায়া দিমু। আমার ক্লাসে ফাজলামি করস! দাড়া, তোর অবস্থা আমি কি করি দেখ। হাত পাত আমি ব্যাগের ভিতর থেকে স্টিলের স্কেলটা বের করলাম। ম্যাডাম মনে হয় ভয় পেয়েছেন। সাথে সাথে বললেন, ‘তুই স্কেল বের করলি কেন?’

‘কারন ওই কাঠের স্কেল দিয়ে বেশি মজা পাবেন না। তাছাড়া ২য় বার স্কেলটা ভেঙ্গে যাবে। তাই এটা নিন, বলেই স্কেলটা ম্যাডামকে দিলাম।’

ম্যাডাম আগের চেয়ে আরও বেশি ভয়ঙ্কর চেহারা দেখিয়ে বললেন, ‘জ্যোতিষ নাকি তুই? ২য় বার স্কেল ভাঙ্গবে এটা তোকে কে বলল?’

‘আমার মন বলছে।’

‘তোর জ্যোতিষগিরি ছুটাইতাছি দাড়া । আমার সাথে বেয়াদপি! মুখে মুখে কথা! বলেই মারা শুরু করলেন।’

সবাই জানে রুবি ম্যাডাম খুব রাগি! কিন্তু রাগের সময় যে তাঁর ভাষায় আঞ্চলিক টান এসে পরে তা কেউ জানত না। ম্যাডাম নিজেও জানে না মনে হয়। কেননা বেশি রাগের সময় ব্রেন কাজ করে না। সরকার শিক্ষার্থীদের উপর শারীরিক নির্যাতন আইনত অপরাধ ঘোষণা করে দিয়েছেন। তবে সে কথা কে বলবে এখব রুবি ম্যামকে! কার ঘাড়ে কয়টা মাথা শুনি?

কাকতালীয় না কোকিলতালীয় সেটা জানি না তবে ২য় বার স্কেলটা ঠিকই ভেঙ্গে গেল। ম্যাডাম সহ সবাই একবার স্কেলটার দিকে তাকাচ্ছে আর একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি নিজেও অনেকটা আশ্চর্য হয়ে গেলাম।

ম্যাডাম যখন মারতে আসছিল তখন শুধু মনে হয়েছে যে স্কেলটা ভেঙ্গে যাবে। মনের ভিতর কেউ একজন বলছিল ভেঙ্গে যাবে। কাঠের স্কেল তাই হয়ত মনে হচ্ছিল। মার যাতে একটু কম খাই তাই বলেছিলাম ২য় বার ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু তা যে সত্যি হবে আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। স্কেল ভেঙ্গে যাবার পর ম্যাডাম কিছুক্ষন হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তবে কোন কথা বলল না। চুপচাপ কিছুক্ষন ডেস্কে গিয়ে বসে থাকল। তারপর উঠে চলে গেল। এই প্রথমবার ম্যাডাম ক্লাস টাইম ওভার হবার আগেই চলে গেল। কেন চলে গেল তা কেউ জানে না। তবে চলে গেছে এতেই সবাই খুশি! যদিও খুশিদের দলে ক্লাসের আঁতেল মার্কা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টগুলো যে নেই তা গ্যারান্টি দিতে পারি।
২.
বাসায় বসে আছি। বসে আছি বললে ভুল হবে। Sniper Ghost Warrior 2 খেলছি। তবে মাথায় একটা কথা ঘুর ঘুর করছে। ম্যাডামের কথা। ছুটির পর ম্যাডাম আমাকে ডেকে বললেন, ‘বেশি ব্যাথা পেয়েছিস?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘না ম্যাম, ঠিক আছে। ব্যাপার না।’
‘মাথাটা খুব গরম হয়ে গিয়েছিল। তাই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। মন খারাপ করিস না। ম্যাডামরা মায়ের মত। সন্তানকে মা তো মারতেই পারে তাইনা?’ আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। ম্যাডাম আর কোন কথা বললেন না। চুপচাপ চলে গেলেন। আমিও আর দাড়িয়ে না থেকে চলে আসলাম। তবে এসব কিছুই ভাবার মত না। ভাবার মত ব্যাপারটা হল ম্যাডাম অনেক ভয় পেয়েছেন। তাঁর চোখ দেখে আমি তা বুঝতে পেরেছি। এক অজানা ভয় তার দু চোখ জুড়ে খেলা করছিল। ম্যাডাম কি তাহলে আমাকে ভয় পাচ্ছে? কিন্তু কেন? আমি কি ভয় পাবার মত কিছু করেছি? যদি ক্লাসের ব্যাপারটার জন্য ভয় পেয়ে থাকে তবে তাঁর বদলে আমার ভয় পাওয়া উচিত। কেননা ঘটনাটি ঘটায় আমি নিজেই অনেকটা আশ্চর্য বোধ করছি। এটা কি ভাবে সম্ভব হল! এই প্রশ্নটা আমার মাথায় সকাল থেকে আর না হলেও ১০০০০০ বার এসেছে। কিন্তু কেন জানিনা এতে কোন ভয় পাচ্ছি না। বরং আরও ভাল লাগছে। বিশেষ করে ম্যাডামের ভয়ার্ত চোখগুলো দেখে কেমন জানি একটা আত্মতৃপ্তি পাচ্ছি। আবার কিছুক্ষন পর সব খারাপ লাগছে!
ধুর কিচ্ছু ভাল লাগছে না। সব কিছু কেমন জানি অচেনা! আবার কিছুক্ষন পর সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আজকাল সেই গম্ভীর শব্দটা আরও বেশি স্পষ্ট ভাবে শুনতে পারি। যেন আমার সামনে বা কানের কাছে এসে কথা বলছে। তবে এখনো তা কাউকে বলিনি। আসলে কাউকে বলতে ইচ্ছা করছে না। জিনিসটা আমিও উপভোগ করছি। পাশের বাসায় থাকেন এক অবসর প্রাপ্ত আর্মি আংকেল। তাঁর আবার শখ কুকুর পোষা। তাঁর বাসায় গেলে বা তাঁর বাসার সামনে দিয়ে গেলে আমি নিশ্চিত প্রথমে কেউ বাড়ির দিকে তাকাবে না। তাকাবে বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকা বিশাল কালো কুকুর দুটোর দিকে। চেহারা দেখিয়ে যে কারো আত্মার পানি শুকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে কুকুর দুটো। তবে সেই কুকুরগুলো দেখে কেন জানিনা আমার ভয় লাগে না। উলটো কুকুরগুলো আমাকে দেখে কেন জানি না ভয় পায়! আজিব না? তবে এতেও আমার খুব মজা লাগে। আবার মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে। কেন তারা আমাকে দেখে ভয় পায়? ভয় তো আমার পাবার কথা তাদের হ্যান্ডসাম চেহারা দেখে! কিন্তু কিসের কি! মাঝে মাঝে আমি গিয়ে কুকুরগুলোকে ধমক দেই। কিন্তু আমাকে ওরা কিছুই বলে না । অথচ অন্য কেউ হলে যে তাঁর কিমা বানাতে কুকুরগুলো দুবার ভাবত না তা কারো অজানা নয়।
৩.
দুপুরে খাচ্ছি। এমন সময় আম্মা বলল ‘বাবা, চুপচাপ যে?’
‘না আম্মা, তেমন কিছু না।’
‘ও’
‘জানো আম্মা, আজ একটা মজার ঘটনা হয়েছে।’
‘তাই! কি হয়েছে?’
‘ম্যাডাম আমাকে স্কেল দিয়ে মারতে এসেছিল তখন।’
‘কেন? কি করেছিস ক্লাসে? আম্মার মনে হয় রেগে গিয়েছেন।’
‘আরে না। তেমন কিছু না। হঠাৎ কেন জানিনা হেসে উঠলাম। আর তারপর ম্যাডাম রেগে মারতে আসলো। তবে আসল কথা তো বলিই নি।’
‘কি কথা?’
‘আমি ম্যাডামকে বললাম, ম্যাম ২য় বার কিন্তু স্কেল ভেঙ্গে যাবে। আশ্চর্য ব্যাপার! সত্যিই ভেঙ্গে গেল।’
আম্মার কি হল বুঝলাম না। হঠাৎ খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল । তারপর সারা বিকাল আর আমার সামনে আসলো না। আমিও ঠিক বুঝতে পারলাম না। আম্মা কি কোন কারনে রাগ করেছে? করলে সেটা কি কারনে? আম্মাকে কখনো এমন তো করতে দেখিনি! একবার আম্মার দরজায় টোকা দিলাম। কিন্তু আম্মা কোন শব্দ করলেন না । আমি ভাবলাম আম্মা হয়ত একা থাকতে চাইছেন! কিন্তু হঠাৎ কি এমন হল?

রাতে পড়ছি। আম্মা এসে কখন যে আমার রুমে ঢুকল তা বুঝতে পারলাম না। আম্মা হঠাৎ বললেন, ‘সিফাত, তুমি কি কোন রকম আওয়াজ শুনতে পাও? যেমন ধর কারো কথা? মিথ্যা বলবা না। তুমি কিন্তু আমার সাথে কোন দিন মিথ্যা বল নাই।’

আমি বুঝলাম না আম্মা হঠাৎ এতো সিরিয়াস কেন হয়ে গেল । আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, ‘না আম্মা। মিথ্যা বলব না। আমি শুনতে পাই।’

আম্মার চোখে স্পষ্ট ভয়। তবে ভয়ের কারনটা বুঝতে পারলাম না। আম্মা হঠাৎ আমাকে জরিয়ে ধরল আর বলল, ‘তোমার কিছু হবে না বাবা। আমি কিছু হতে দিবো না। তুমি স্বাভাবিকভাবেই বাচবে।’

আমি আরও বেশি কনফিউজ হয়ে গেলাম। আম্মা এসব কি বলছে! আমার কিছু হতে যাবে কি জন্য? আমি আবার হেসে ফেললাম। বললাম, ‘আমার আবার কি হবে!’

আম্মা কোন কথা বলল না। আবার নিজের রুমে চলে গেল। সেদিন রাতে আম্মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করতে হল। আম্মার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সব কিছু কেমন জানি লাগছে। আমি জানতাম আম্মার হার্টে সমস্যা ছিল। কিন্তু এভাবে হঠাৎ এমন অ্যাটাক হবে তা কেমন জানি খাপ ছাড়া লাগছে। রাতে আমি বাসায় এসে পড়লাম। হাসপাতালে আব্বা আছেন। তিনিই আমাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন।

৪.
রাতে শুয়ে আছি। হঠাৎ সেই কণ্ঠটা শুনতে পেলাম।

‘আপনি কি জেগে আছেন?’

‘কি সমস্যা কি? ফাইজলামি? কে?’ মাথা তখন গরম হয়ে গিয়েছে।
‘রাগ করবেন না। আপনি রাগ করলে আমাদের ক্ষতি হবে। আপনি রাগ করবেন না। আপনি কি চান বলুন,’ কিছু চাই না। আমার থেকে দূরে থাকবেন। ঠিক আছে?’

‘সেটা তো সম্ভব না। আমরা আপনাকে একা ফেলে কোথাও যেতে পারি না।’

‘আমরা মানে?’

‘আমরা মানি আমি একা নই। আমরা এখানে অনেক জন। আপনার নিরাপত্তার জন্য। আগেরবারের মত ভুল করব না। অনেক কষ্টে আমরা আবার আপনাকে পেয়েছি।’

‘কি ভালতু কথা বলছেন! আপনি কে? সামনে আসেন।’

‘আমাদেরকে তো এখানে দেখতে পারবেন না। আপনি কষ্ট করে ছাদে আসুন। সেখানে আমাদের দেখতে পারবেন।’

কিছুক্ষন ইতস্তত করে ছাদের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। রাতের বেলা অদৃশ্য কারো কথায় ছাদে যাচ্ছি! যদিও ভয় লাগছে না। বরং এক অদ্ভুত টানে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছি। ছাদে গিয়ে আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমাদের ছাদটা ছোট। কিন্তু সেই ছাদেই মনে হচ্ছে শত শত মানুষ টাইপের বসে আছে। আর যারা বসার জায়গা পায়নি তারা শূন্যে ভেসে আছে। সবাই দেখি এসাসিনের মত কাল কাপড় দিয়ে নিজেদের মুখ ঢেকে রেখেছেন। কারো মুখই দেখা যাচ্ছে না। সবাই আমাকে দেখেই মাথা নিচু করে থাকল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হিসেব অনুযায়ী এতক্ষনে আমার ভয়ে চিৎকার করার কথা বা অজ্ঞান হবার কথা। কিন্তু কিছুই হচ্ছি না। বরং আমার এসব আরও ভাল লাগছে। একবার মনে হল এরা আমাকে এতো সম্মান দেখাচ্ছে কেন? আমি তো সম্মান দেখানোর মত কেউ না। তবে কি? আমি আসলে কে?

হঠাৎ সামনের দিকের একজন বলল, “প্রভু পিটারের জয় হোক। পৃথিবীর বাদশার জয় হোক।”

আমি কিছুক্ষণ চোখ কুচকে দাড়িয়ে থাকলাম। বলে কি এরা! তারপর চিৎকার করে উঠলাম। সালারা তো আমাকে কাফের বানিয়ে দিবে দেখছি।

কিন্তু প্রথমবার ভয় পেলাম যখন দেখলাম আমার মুখ থেকে বের কোন চিৎকার বের হল না। বরং আমি স্পষ্ট শুনলাম যে আমি বললাম, ‘আজ থেকে তোমাদের কোন ভয় নেই। আমি আমার পূর্ণ শক্তি পেয়ে যাব। আজ থেকে আমি হব স্বাধীন। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান, শক্তিশালী। আমি পিটার…হা হা হা হা হা…’

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এসব কি বলছি। আমি সিফাত। পিটার হব কেন? পিটারই বা কে?

৫.
দর দর করে ঘামছি। কি হচ্ছে আমার সাথে তা আমি বুঝতে পারছি না। নিজের ভিতর অনেক অহংকার বোধ করতাম কারন আমার ভয় টয় কম। নেই বললেও একেবারে ভুল হবে না। সেই আমিই ভয় পাচ্ছি। অন্য সময় হলে তাও দেখা যেত। কিন্তু এখন কি করব?

হঠাৎ নিজের শরীরের ভিতর অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ করতে পারছি। কেমন যেন মনে হচ্ছে নিজের ভিতর অনেক শক্তি। কিন্তু কেন? আমি কি এই শক্তি চাইতাম? নাকি চাই? হঠাৎ আব্বাকে দেখলাম। ওনাকে দেখে আমার মনে অনেক শক্তি পেলাম। যেকোনো সন্তানই তাঁর বাবাকে দেখে আলাদা এক রকম শক্তি অনুভব করে। আমিও তার বাইরে নই। আব্বাকে বললাম, ‘আব্বা আপনি এসেছেন! আমি অনেক ভয় পাচ্ছিলাম।’

তবে আব্বাকে অনেক খুশি দেখাচ্ছিল। আমাকে বলল, ‘তোমার ১৮ বছর পূর্ণ হবার পর আজকেই প্রথম পূর্ণিমা। আজ তুমি পেয়ে যাবে অফুরন্ত শক্তি। শয়তানি শক্তি।’

‘শয়তানি শক্তি?’ চেচিয়ে উঠলাম আমি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আব্বা এসব কি বলছে! আব্বা কি পাগল হয়ে গেল নাকি?

‘হ্যাঁ, শয়তানি শক্তি। আজ থেকে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান। সবচেয়ে শক্তিশালী। এতক্ষণে আপনার মনে পরে যাবার কথা সব কিছু, প্রভু পিটার।’

‘আব্বা, কি বলেন এসব? কিসের প্রভু? আমি মানুষ। মানুষ প্রভু হয় কিভাবে?’

আব্বা আমার কথা শুনলেন কিনা জানিনা। উনি কি সব বলা শুরু করলেন। অনেকটা মন্ত্র টাইপ। ওনার দেখা দেখি বাকিরা সবাই আব্বার সাথে সাথে সুর করে ওই মন্ত্রই বলা শুরু করলেন। আস্তে আস্তে গলার আওয়াজ বাড়ছে। সেই সাথে সেই মানুষ টাইপগুলোর সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। হঠাৎ দূরে কোথাও কুকুর বা শেয়াল ডেকে উঠল। রাতের দিকে প্রতিদিনই ওরা ডেকে ওঠে। তবে আজ ওদের ভয়েসটা অন্য রকম। কেমন জানি নেকড়ে, বাঘ আর সিংহের গর্জনের একত্রে মিলে এক ধরনের আওয়াজ। শুনে যে কারো আত্মার পানি শুকিয়ে যেতে বাধ্য। ছাদে থেকেই স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম পাশের বাসার আংকেলের সেই কুকুর দুটো ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করছে। আকাশের পূর্ণিমার চাঁদটা কাল মেঘে ঢেকে গেল। হঠাৎ পরিষ্কার আকাশে মেঘ আসলো কোথা থেকে তাও জানি না। কিছুই বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ নিজের ভিতর একটা পরিবর্তন বুঝতে পারলাম। অমানুষিক যন্ত্রণা অনুভব করছি নিজের ভিতর। মনে হচ্ছে শরীরের ভিতরের শিরা উপশিরা মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। সব পেশিগুলোতে টান অনুভব করছি। হঠাৎ শরীরটা শূন্যে ভেসে উঠল। শরীরে এখন আর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আব্বা আর ওইগুলো এখনো মন্ত্র পড়ছে। কোন রকম ভাবে বুঝে ওঠার আগেই শরীরটা মুচড়ে উঠল। অমানুষিক একটা চিৎকার দিলাম। মেরুদণ্ডটা মনে হয় ভেঙ্গেই গেল। তারপর আবার নিচে নেমে আসলাম। শরীরে কোন ব্যথা অনুভব করলাম না। বরং অনেক শক্তি অনুভব করছি। শয়তানি শক্তি, বা আমার তপস্যার শক্তি।

হা হা হা হা হা হা হা। মনে পড়ে যায় আমার সব।

৫০০ বছর আগে। হ্যাঁ , ৫০০ বছর আগে আমি তপস্যা করতাম। শয়তানের তপস্যা। শয়তান লুসিফারের তপস্যা। শয়তান লিলিথের তপস্যা। একটার পর একটা মানুষ বলি দিয়েছি। প্রত্যেকের হৃৎপিণ্ড থেকে চুষে চুষে রক্ত খেয়েছি। অসিম ক্ষমতা পাবার জন্য যা যা করা দরকার করেছি। শুধু মাত্র একটা ছোট্ট ভুলের জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। দু এক বছর না। পুরো ৫০০ বছর। গত ৫০০ বছর ধরে আমার অনুসারিরা খুজে গেছে সেই শিশুকে যে আমাকে ধারন করার ক্ষমতা রাখে। বিশ্বের কানায় কানায় খুজেছে এমন শিশুকে। অবশেষে ৫০০ বছর পর সিফাতের শরীরে আমি আশ্রয় নেই। ছেলেটা আমাকে তার শরীর দিয়েছে। কিন্তু তার শরীরটা নিয়ে তেমন কোন লাভ হল না আমার। উলটো ক্ষতিই হয়েছে। ওর জন্য আমার ক্ষমতা কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি শয়তানের উপাসক অথচ এই ছেলে হলো মুসলমান। খাস মুসলমান। এর জন্য নিজের ক্ষমতা অনেকটা হারাতে হচ্ছে আমাকে। তাছাড়া আমি প্রথমে শয়তান ‘লুসিফারের’ উপাসনা করতাম। তার পর ক্ষমতার জন্য করি শয়তান ‘লিলিথের’ উপাসনা। লুসিফারের উপাসনাকারি যখন লিলিথের উপাসনা শুরু করি তখন তা লুসিফার সহ্য করতে পারেনি। তাই তাঁর দেওয়া সকল ক্ষমতা সে নিয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে তপস্যার বলে অনেক ক্ষমতাই নিজের করে নিয়েছি। তাছাড়া লিলিথের উপাসনা করার কারনে লিলিথও আমাকে অনেক ক্ষমতা দেয়। না দিয়ে উপায় আছে? নিজের সবচেয়ে বড় শত্রুর ভক্ত যখন নিজের ভক্ত হয়ে যায় তখন না চাইলেও শক্তি দিতে বাধ্য।

এখনকার যুগের ছেলেপেলেরা তো সময় পেলে প্রেম করে। আর নাহলে তিন গোয়েন্দা পড়ে। প্রাচীন মিথলজি সম্পর্কে কোন ধারনা আছে কারো?

৬.
আব্বা নড়ে চড়ে উঠলেন। ওনাকে এখন আর আব্বা বলা যায় না। উনি হলেন সিফাতের আব্বা। যদিও ওনার কাছ থেকে গত ১৮ বছর বাবার স্নেহ পেয়েছি। তাই আব্বা বলাই যায়। তাইনা? আমাকে বললেন, ‘পৃথিবীতে স্বাগতম আপনাকে। আমি আপনার সেবা করেছি বছরের পর বছর। আপনার দেখাশোনা করেছি। তাই আপনার দেওয়া কথা আপনি রাখবেন বলে আশা করি। আপনি আমাকেও কিছু ক্ষমতা দিবেন।’

এই সালায় বলে কি। সব ধারনা মাটি করে দিল। একে বাবার সম্মান দেওয়া যায় না। স্রেফ ক্ষমতার জন্য আমার সেবা করেছে। সিফাতের শরীরে থাকতে থাকতে আমার ভিতরও ওর কিছু বৈশিষ্ট্য ঢুকে গেছে। যেমন আমি হলাম লুসিফার বা লিলিথের উপাসক। কিন্তু ও ছিল মুসলিম। একমাত্র আল্লাহর এবাদাত করত। যার কারনে তিনি আমাকে দেওয়া শয়তানের সকল ক্ষমতা নিয়ে গেছেন। এখন আছে শুধু আমার তপস্যায় পাওয়া ক্ষমতাগুলো। যদিও তা কম কিছু না।

এই মুহূর্তে সিফাতের বাবার উপর আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আমি স্পষ্ট বললাম, না। কিন্তু তাতে সে মনে হয় রেগে গেল। আমার উপর রাগ দেখান হচ্ছে! নিজের মনের শক্তির বলে ওকে শূন্যে ভাসিয়ে তুললাম। তারপর ছাদের কিনারায় নিতে গেলাম। ব্যাটা এতক্ষণে মনে হয় বুঝতে পেরেছে কি ভুল করেছে। সাথে সাথে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন।’

আমি কোন কথা কানে নিলাম না। এই লোকও ছিল শয়তান লিলিথের উপাসক। আমি যখন সিফাতের শরীরে আশ্রয় নেই তখন সবই বুঝতে পারে। আমাকে চিনতে তার এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। শুধু ও না। যারা যারা লুসিফার বা লিলিথের উপাসনা করে তারা সবাই আমাকে এক নামে চেনে। পিটার। একমাত্র আমিই শয়তান লুসিফার ও লিলিথের উপাসনা একসাথে করতে পেরেছি। এতকিছু জানা সত্যেও আমাকে কিছুই বলে নি সে। উলটো আমার সেবা করে গেছে দিনের পর দিন। শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য। আমি আর কিছু বললাম না। চোখটা বন্ধ করলাম। সাথে সাথেই ধপ একটা শব্দ পেলাম। ক্ষমতার লোভে নিজের স্ত্রীকে হাসপাতালে খুন করে এসেছেন, মনে করেছেন আমি তার কিছুই জানি না। যদিও এটাকে খুন বলে না এ লাইনে। একে বলে বলি। তপস্যার জন্য বলি। ক্ষমতা লাভের জন্য বলি। বলি না দিয়ে আর কোন উপায়ও ছিল না। সিফাতের মা, সিফাতের বাবার এই কাজ সম্পর্কে জানতেন। অনেক চেষ্টা করেছেন স্বামীকে এ পথ থেকে সরিয়ে আনতে। কিন্তু পারে নি। একমাত্র সন্তানকে শেষ সম্বল করে বেচে ছিলেন তিনি। কিন্তু যেদিন জানতে পারেন তাঁর ছেলেও কোন না কোন ভাবে এসব ব্যাপারে জড়িয়ে গিয়েছে সেদিন আর ঠিক থাকতে পারেননি। অতিরিক্ত মানুষিক চাপে করলেন হার্ট অ্যাটাক। আর তাঁর আদর্শ স্বামী সেই সুযোগটা গ্রহন করে। একই সাথে প্রমানও লোপাট করেন, নিজের রাস্তার কাঁটা সরিয়ে ফেলেন আর বলিও দেন। কি প্লান! ক্ষমতার লোভ! স্ত্রীর সাথে সাথে ওনাকেও পার্সেল করে দিলাম ওপারে। খুব একটা ভাল মানুষ ছিল না। স্ত্রী আর সন্তানকে শাসনের নামে নির্যাতন করাকেই পুরুষত্ব মনে করতেন। এবার মর শালা।

<< পরিশিষ্ট >>
সিফাতের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বেচারা জানেও না। তার মা আর বাবা দুজনেই পরপারে চলে গেছে। নিজের শক্তি বলে ওই খারাপ আত্মাগুলোকেও শেষ করে দিয়েছি আমি। এখন থেকে আমি মুক্ত। স্বাধীন। গত ৫০০ বছরে আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বুঝতে পেরেছি আমার ভুলটা। শয়তানের উপাসনা থেকে সরে এসেছি। তাই সেই সালারাও তাদের দেওয়া ক্ষমতা নিয়ে গেছে। লুসিফারের দেওয়া ক্ষমতা নিয়ে যাবার পর আমি বুঝতে পারলাম ক্ষমতা যেমন দেওয়া যায় তেমন ফিরিয়ে নেওয়া ও যায়। তখনি সাবধান হয়ে যাই যদিও ক্ষমতা নিয়ে গিয়ে ভাল করেছে। না নিয়ে গেলে আমারই সমস্যা হত। হয়ত কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল তা বুঝতে পারতাম না।

একা রাস্তায় হাঁটছি আমি। মানুষ ক্ষমতার জন্য কত কিছুই না করে! নিজের আপনজনদেরকেও মুক্তি দেয় না। কি নিষ্ঠুর! কি নিষ্ঠুর! অজান্তেই চোখ থেকে পানি পড়ছে। কি ব্যাপার! আমি কাদছি কেন? আমার তো কাদার কথা না। তবে কি সিফাত কাদছে? কিন্তু সিফাতের তো কোন অস্তিত্ব নেই এখন আর। তাহলে কাদছি কেন? কান্না যেন থামাতেই পারছি না। মাথায় বজ্রপাত হয়েছে এমন ভাবে দাড়িয়ে আছি। তবে কি…তবে কি সিফাত আর আমার আত্মা একসাথে মিলে গেছে?

এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। জানিনা এই প্রশ্নের উত্তর কখনো পাব কিনা। হেঁটে চলছি আমি পৃথিবীর পথে। অনেকদিন নিজের ইচ্ছায় হাঁটা হয় না। এতদিন হেঁটেছিল সিফাত। এখন থেকে হাঁটব আমি। নিজের মত করে।

অথবা…দুজনে মিলে।

……………………………………………………………সমাপ্ত……………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত