সুরের দেবতা

সুরের দেবতা

মানুষ তার হারানো ভালবাসাকে ফিরে পেতে কত কিছু করে, খুন থেকে শুরু করে আত্মহত্যা পর্যন্ত।

কেন করে?

মৃত্যুর পর দেখা হবে সেই আশায়?

হা হা! আমি অতটা বোকা নই। বেঁচে থাকতেই আমার ফারিয়াকে চাই।

কিন্তু ফারিয়া আমাকে সহ্যই করতে পারে না।

আমি শুধু জানতে চাই কেন? কিভাবে একটা মানুষ এতটা বদলে যায়? কিভাবে ভুলে থাকতে পারে সে আমাদের একান্ত মুহুর্তগুলো। হঠাৎ বলে দিলেই হলঃ ভালবাসিনা! ভুলে যাও আমাকে!

দিনগুলো আমার কোন একভাবে কেটে গেলেও, অসহ্য রাতগুলো কাটতেই চায় না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে খাটের এক কোনায় পড়ে থাকি। মনে মনে ডাকতে থাকি, ফারিয়া তুমি এসো। ফারিয়া, ফারিয়া, ফারিয়া।

বৃথা এই আহবানে কেউ সাড়া দেয় না।

আমি ফারিয়াকে ফিরিয়ে আনবোই, আনতেই হবে।

এক রাতে কি মনে করে আবারও বেহালাটা হাতে নিলাম। এই সেই বেহালা যার সুর শুনে ফারিয়া আমাকে ভালবেসেছিল। এর সুরে সুরে আমরা শপথ নিয়েছিলাম আমৃত্যু একসাথে থাকার।

বাতি নিভিয়ে আমি বেহালা বাজানো শুরু করলাম। তীব্র করুন সুরের মুর্ছনায় আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। না না জল নয়, রক্তবিন্দু।

স্রষ্টায় আমার বিশ্বাস নেই, তার উপেক্ষা আমি সহ্য করতে পারিনা।

আমি উপাসনা করি ইফ্রিতের। সুর দিয়ে। তিনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন কি করে ডাকতে হবে তাকে।
আজ আমি তাকে ডাকছি, এসো প্রভু! হে ইফ্রিত! আমার ডাকে সাড়া দাও।
কতক্ষন এভাবে তাকে ডেকেছি জানি না।

যেদিন তিনি আসেন সময় স্থির হয়ে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ তিনি আমার ডাকে সাড়া দেবেনই।

বেহালার তার বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল আমার আঙুল কেটে।
এমন সময় আমি শুনতে পেলাম অপার্থিব সুরে কেউ বেহালা বাজাচ্ছে।
যেন দুঃখের দেবতা।

আমি থামলাম, সারা ঘর আঁধারে ঢেকে গেল। এল আমার দেবতা ইফ্রিত।
তিনি দেখতে কেমন?

এ কথা তো বলা যাবে না। কঠিন নিষেধ আছে। কারন তিনি মাঝে মধ্যেই এই রুপে পৃথিবীর সুর সাধকদের সাথে দেখা করেন।

তার সুর অবহেলা করার ক্ষমতা কারো নেই।
আমি তার সাথে বাজাতে লাগলাম চোখ বন্ধ করে।
অপার্থিব কোন এক জগতে হারিয়ে যাওয়া,
কিংবা; সুরের অনুভূতিটা চাপা কষ্টের, শূন্যতার, হাহাকারময় মাদকতার।
মাথার ভেতর তরলের ছন্দময় অনুভূতি।

যেন মহাকালের গর্ভে তলিয়ে যাওয়ার মত, অথবা শ্বাস বন্ধ হয়ে আসা মৃত্যুর। কোন এক পর্বতের চূড়া থেকে শূন্যে ভেসে, সসীম থেকে অসীমে ঠাই খুঁজে ফেরার।

অনুভূতিটা এমন, যেন আমি হারিয়ে গেলাম ফারিয়ার স্বপ্নে। আমি নিয়ন্ত্রন করছি
তাকে, তার অনুভূতি, তার স্মৃতি, তার ভাবনাগুলোকে। আমার সুর পৌছে গেল আত্মার জগতে।

আমি ফারিয়কে খুঁজে বের করলাম। তার শরীর থেকে আত্মা বের হয়ে সুরের পিছু পিছু এসে হাজির হল আমার ঘরে।
আমি ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলাম। দেহের কোন ক্ষমতা নেই আত্মাকে স্পর্শ করার। আমি প্রভুর দিকে তাকালাম। তিনি তরল মৃত্যুর সুর তুললেন।
যন্ত্রনা! তীব্র মধুর যন্ত্রনা।

আমি ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। বহুদিন পর, বহুদিন পর।

আমি চিৎকার করে কান্না করছিলাম। তার দুচোখে চুমু দিয়ে কানে কানে বললামঃ কেন আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে কেন? ভালবাসি, ভালবাসি।

ফারিয়া কাঁদছে। নিশ্চুপ। আমার ফারিয়া।
আমি ফারিয়ার চোখে তাকালাম। সেখানে গভীর মায়া।
হঠাৎ সেটা পাল্টে গেল তীব্র ভয়ে।

আমার কানে আসছে প্রভুর বেহালার শব্দ। এ এক ভিন্ন সুরের আহবান। প্রভু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন ফারিয়ার দিকে।

আমি অবিশ্বাসে প্রভুর দিকে তাকালাম। ফারিয়া আমায় ছেড়ে প্রভুকে জড়িয়ে ধরল। তার ঘাড়ে অধর ছোঁয়াল।
ওহ যন্ত্রনা! না প্রভু না! এর চেয়ে মৃত্যু ভাল।

আমার আত্মা ফিরে এল দেহে।
ধীরে ধীরে সুর মিলিয়ে গেল। শূন্যে হারিয়ে গেল আমার ফারিয়া।

ক্রিং ক্রিইইইইং!!!
টেলিফোনের শব্দে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। ঘোরের ভেতর কতক্ষন ছিলাম কে জানে। মাথাটা ভার ভার লাগছে।
মেঝে থেকে উঠে ফোনটা ধরলাম।

জানতাম এই সংবাদ ই শুনব। ফারিয়া মারা গিয়েছে, মৃত্যুর কারন অজানা, হা হা হা।
মূর্খের দলকে কে বোঝাবে জীবন মৃত্যু বলতে কিছু নেই।
এখন আমার ফারিয়াকে আমি যখন খুশী কাছে ডাকতে পারব।
বেহালাটা হাতে নিলাম।

একী! আমি মনে করতে পারছিনা সেই সুর, যা দিয়ে প্রভুকে ডাকতে হয়।

গভীর রাতে এই শহরের এক জীর্ণ-শীর্ণ বাড়ি থেকে আজো ভেসে আসে বেহালার সুর। একজন হাড়জিরজিরে সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ সেই বেহালা বাজান। এক সুর কখনও দুবার বাজতে শোনা যায় না।

সে সুরে থাকে আর্তনাদ। সে সুর ঝড় তোলে বরষায়, যে সুরের আহবানে নামে জোছনা কিংবা অমাবস্যা, সে সুরে থাকে ফিরে আসার আহবান।

সুর ক্ষনে ক্ষনে বদলায়। বেলা বেড়ে চলে, কেউ ফিরে আসেনা।

একটানা ফিনফিনে বাতাস বইছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আকাশে চাঁদ নেই। তবুও জায়গাটা তেমন অন্ধকার নয়। অগ্নিকুণ্ডের আবছা আলোয় চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

আসেপাশের পাহাড় শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢাকা। যেকোন সময় তুষার ঝড় শুরু হতে পারে।

আগন্তুকেরা অপেক্ষায় বসে আছে। চুপচাপ। চাপা উত্তেজনা স্বত্বেও তারা নিঃশ্বাস এমনভাবে ফেলছে যেন এই পবিত্র নীরবতার কোন ক্ষতি না হয়।

অপেক্ষা কখন মহান সুর সাধক দেখা দেবেন। তার আহবানেই আগন্তুকেরা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এখানে এসে জড় হয়েছে। মহান সাধক নিজ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন।
কেন?

সুরের দেবতা ইফ্রিতের উপাসকদের জন্য এটা নিষিদ্ধ। ইফ্রিতের উপাসকরা কেউই কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। তাদের সমস্ত সুর ইফ্রিত কেড়ে নিতে পারে এমন অপরাধের জন্য। কিন্তু এই পৃথিবীতে যাকে মানা হয় ইফ্রিতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসক, যাকে ইফ্রিত নিজের ক্ষমতার কিছু অংশ অনুগ্রহ করেছে। সেই তিনি যখন তীব্র আহবানের সুর দিয়ে কাছে ডাকেন, কারো কি সাধ্য আছে অগ্রাহ্য করার?

মহান সাধক এলেন! তার পরনে চামড়ার তৈরি কালো আলখাল্লা। বাতাসে আলখাল্লার সাথে সাদা এলো চুলও উড়ছে। হাতে সেই বেহালা যার সুর উৎপন্নকারী সুতোগুলো প্রস্তুত হয়েছে সুর প্রেয়সী দেবী লিলিথ এর চুল দিয়ে। দেবী লিলিথ তার সুরে মুগ্ধ হয়ে নিজের চুল উপহার দেন ভালবাসার নিদর্শনস্বরুপ। সাধক ভালবাসার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও উপহার ফিরিয়ে দেননি। ভাল যে একজনকেই বাসা যায়, সে যেই হোক, যত অবহেলাই করুক, ভাল সে একবারই বাসা হয়। সে ভালবাসা নিজের না হলে, অন্যদের মাঝে সে না পাওয়া মানুষকেই খুঁজে ফেরা হয় সারা জনম।
আগন্তুকের দল উঠে দাঁড়ালো শ্রদ্ধার সাথে। তারা মোহগ্রস্থ। এই সেই কিংবদন্তী সাধক যার কথা তারা শুনে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। সাধকের ইশারায় একজন পাশের মশালগুলতে আগুন ধরাল। প্রত্যেক আগন্তুক একটা একটা মশালের পাশে গিয়ে বসল।

সাধক দাঁড়িয়েছেন তাদের চেয়ে উঁচু একটা পাথরে। আগন্তুক এবং মহান সাধক এমন ভাবে বিন্যস্ত হয়ে অবস্থান নিয়েছেন যেটা অতি প্রাচীন একটা ভাষার লিপি দিয়ে তৈরি বাক্যের মত মনে হচ্ছে।

আগন্তুকরা সকলে বেহালা নিয়ে প্রস্তুত। সাধক চোখ বন্ধ করে বেহালা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মনে করার চেষ্টা করছেন তার হারানো ভালবাসার চেহারা, তার চোখ, তার হাসি, তার স্পর্শ… ছুঁয়ে গেল যেন আলতো করে ফারিয়া…

সুর তুললেন তিনি বেহালায়। সুখের সুর, যেন অপার্থিব আদরমাখা সুরে তিনি আহবান করছেন কাউকে। সুরের মায়ায় প্লাবিত হয়ে গেল পৃথিবী।

আগন্তুকেরা বেহালা তুলে নিল, তাদের চোখ অশ্রু স্বজল। সুরে আকুতি, আহবান, প্রার্থনা। এসো প্রভু এসো!!!

আতন্তুকেরা জানে না সেই দিনের পর থেকে ইফ্রিত আর আসেনি সাধকের সাথে দেখা করতে।
তবে সাধক কাকে আহবান করছে?

খানিক পরপর ছন্দ পরিবর্তন হয়, সুর পাল্টায়। ব্যর্থ আহবান ফিরে ফিরে আসে।

সুর গভীর থেকে গভীরে পৌঁছাল। সুরের আহবানে মশালের জ্বলন্ত আগুন যেন ওঠা নামা করছে। সাধকের চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে।

আগন্তুকরা সবাই বিশ্ময় নিয়ে আবিষ্কার করল ঠিক সাধক এর মত শত শত প্রতিচ্ছায়া যেন তাদেরকে ঘিরে ধরেছে। কে আসল তা বোঝার কোন উপায় নেই!

সবাই মিলে একজন, এক হতে অসীম।

এ এক বাস্তব ভ্রম। সুর যত রুহ এ ঝড় তুলে, সাধকের প্রতিচ্ছায়া তত বাড়ে-কমে ছন্দ অনুসরন করে।
আসবেন! প্রভু আসবেন! এমন আহবান অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। অন্ধকার যেন ঘনীভূত হল। মশালের আগুন নিভে নিয়ে। সেই আগুন শূন্যে ভেসে কুণ্ডলী পাকিয়ে এক স্পষ্ট প্রতিমূর্তি তৈরি করল।
একি!!!

এ যে দেবী লিলিথ। যিনি সুরের প্রেয়সী। তিনি তো কখনও আপন রুপে সামনে আসন না!

তবে কি সাধক এতক্ষণ তাকেই ডাকছিল?

লিলিথ সাধকের চারপাশে একবার কুণ্ডলী পাকিয়ে তার পাশে দাঁড়াল। তাকে জড়িয়ে ধরে অনুনয় করে থামাতে চাইল। বলতে চাইল, আমার জানা নেই এই সাধনার ফলাফল। কিন্তু তিনি থামলেন না।

দেবী লিলিথ একটু ইতস্তত করে সাধকের শরীরে মিশে গেল।

সাথে সাথে সুর পাল্টে গেল। এ এক তীব্র বেদনার সুর। হাহাকার, আর্তনাদের এক করুন বাণী ছড়িয়ে পড়ছে কাল থেকে মহাকালে।

আগন্তুকদের কেউ কেউ বাজানো বন্ধ করে বিশেষ ভঙ্গিতে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। যেন দেবতার উপাসনা করছে।

বাকীরা খেয়াল করল তারা আর নিজেদের ইচ্ছেমত বেহালা বাজাতে পারছে না। তাদের হাত, মস্তিষ্ক যেন সুরের অধীন। সুর দিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রন করছেন তিনি, যেমনিভাবে এখানে ডেকে এনেছেন। তাদের মনে হল এখন ভয়ানক অশুভ কিছু ঘটবে। সাংঘাতিক অশুভ।

যারা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ছিল তারা মোহগ্রস্থের মত উঠে দাঁড়াল।

ওহ না!!!

এই সুর বিদ্রোহের! এই সুরের সৃষ্টি জানাশোনা কোন জগতে হয়নি। দেবতা ইফ্রিতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে দেবী লিলিথ ও মহান সাধক।

অগন্তুকদের বাদকদের আঙ্গুল কেটে রক্ত বেহালা বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে।

দেবী লিলিথ সাধকের আত্মার সাথে মিশে গেল। সাধকের নাক বেয়ে গলগল করে রক্তের ধারা বের হয়ে তার সাদা দাঁড়ি ভিজিয়ে দিল।

ওহ যন্ত্রণা! তীব্র যন্ত্রণা!!
এর নামই বুঝি মৃত্যু?

সুর থেমে গেল। প্রশান্ত নীরবতা। একপাশে ঢলে পড়ল সাধকের নিথর দেহ। উপস্থিত আগন্তুকের দল চাপা আর্তনাদ করে উঠল।

এক মূহুর্তপর সাধকের দেহ থেকে ধোঁয়ার মত আবছা একটা অবয়ব বের হয়ে এল। সেটাকে ঠিক সাধকের আত্মা বললে ভুল হবে। অবয়বটা যেন দেবী লিলিথ আর মহান সাধকের সংমিশ্রণ। সেই আবছা অবয়ব হাত বাড়িয়ে তুলে নিল সাধকের পাশে পড়ে থাকা বেহালা।
আগন্তুকরা সম্মোহিত! তারা বিশ্বাস করতে পারছে না তাদের সামনে মুহুর্তকাল আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা। দেবী লিলিথ স্থায়ীভাবে তার ক্ষমতা ত্যাগ করেছেন। অনেকটা স্বেচ্ছা মৃত্যু। মানব আত্মার সাথে দেবীর আত্মার সংমিশ্রণে এক নতুন দেবতা সৃষ্টি হল। দেবতা আঁলিয়ান। যার কোন স্থায়ী রুপ নেই।

লিলিথ স্থায়ীভাবে মহান সাধকের আবেগে বসবাস করবেন এখন থেকে। সাধকের আত্মা যাই চাইবে, লিলিথ তাই করবে। তার কোন স্বাধীন ইচ্ছে নেই। মহা শক্তিধর দেবী লিলিথ শুধুমাত্র সুরের ভালবাসার মোহে সুর সাধকের গোলাম হয়ে গেল। মানব রুহ আর পরাধীন দেবীর ক্ষমতায় সম্মিলিতভাবে তৈরি হল দেবতা আঁলিয়ান। যার মানুষের দুঃখ কষ্ট বোঝার ক্ষমতা আছে, যিনি দেবতা হয়েও মানুষের আবেগ ধারন করেন।

আগন্তুকরা তাদেরকে ব্যবহার করে সেই প্রাচীন ভাষায় লেখা বাক্যটার অর্থ বুঝতে পারল। যার শুরুটা দেবতা আঁলিয়ান দিয়ে, শেষটা একপ্রকার বিশেষ প্রার্থনা।

সুর উঠল আঁলিয়ানের বেহালায়, নতুন সুর। এই সুরে একই সাথে তীব্র বিষাদ, আর তীব্র সুখের স্মৃতি মিশে আছে। আগন্তুকের দল চোখ বুজে নেশাগ্রস্থের মত দুলছে, আর আঁলিয়ানকে অনুসরণ করছে। তারা কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে বহু আগের এক পৃথিবী, যেখানে একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পাগলের মত ভালবাসত। তার একটু ছোঁয়া, আলতো স্পর্শ, বুকে জড়িয়ে ধরে, ভেজা চোখে, মৃদু কণ্ঠে বলাঃ ভালবাসি তোমাকে, শুধু ভালবাসি যে; শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত দিন, মাস, বছর, মহাকাল। সব ঠিকঠাক যাচ্ছিল তারপর! তারপর হঠাৎ সব এলোমেলো…

কি করে একটা মানুষ এত সহজে বলে ফেলে, ভুলে যাও আমাকে। আমি তোমার নই, ছিলাম না কখনও। কেন? কি কারনে সে এমন করবে?

অসহ্য! অসহ্য যন্ত্রণা! যেন মহাকাল থমকে গেল। প্রতিটা মূহুর্তই এক একটা মহাকাল।

আগন্তুকদের হৃদয় গভীর বিষাদে ছেয়ে গেল, বুকের এক পাশে কষ্টের চিনচিনে অনুভূতি। তাদের সবাই যেন বুঝতে পারছে মহান সাধকের ব্যাথা। অনুভব করছে তার কথা, ফারিয়া! ফারিয়াকে আমার চাই। এই জনমেই। এখুনি!
সুর পাল্টালো বিষাদ, আর তীব্র সুখের মিশ্রণ।

দেবতা আঁলিয়ান এর চারপাশে ঘুর্নিঝড়ের মত করে সুরের মূর্ছনা চক্রাকারে পাক খাচ্ছে। সেই চক্রের বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যেন শুষে নিচ্ছে সব সুর। দেবতা এই চক্রের সাথে মিশে গেলেন।

সব আগন্তুক একসাথে চোখ খুলল। ধীরে ধীরে খোলা চোখ বেয়ে তাদের আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে এল। পরিতৃপ্ত মৃত্যু যন্ত্রণা! স্বেচ্ছা মৃত্যু।

একে একে তারা ঘুর্নিপাকে মিশে গেল। সেই ঘুর্নি নতুন এক আকৃতিতে রূপান্তরিত হল। যার ক্ষমতা আছে মহাকালের সময় স্রোতে ভ্রমণ করার।

অনন্তকালের জন্য সময় স্থির। নেই কোন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।

তিনি ফিরে গেলেন অতীতে।

(সুরের দেবতা-১ম পর্ব পড়া আবশ্যক)
মহান সাধক অনুরোধের দৃষ্টিতে দেবতা ইফ্রিতের দিকে তাকিয়ে আছে। ইফ্রিত খানিক ইতস্তত করে তরল মৃত্যুর সুর তুললেন। যন্ত্রনা! তীব্র মধুর যন্ত্রনা।

সাধক ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরল। বহুদিন পর, বহুদিন পর। ফারিয়া চিৎকার করে কান্না করছিল। তার দুচোখে চুমু দিয়ে ইফ্রিতের উপাসক কানে কানে বললঃ কেন আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে কেন? ভালবাসি, ভালবাসি। ফারিয়া কাঁদছে। নিশ্চুপ। সাধক ফারিয়ার চোখে তাকাল। সেখানে গভীর মায়া।

হঠাৎ সেটা পাল্টে গেল তীব্র ভয়ে।

দেবতা ইফ্রিত ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে, তার ফারিয়াকে অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারে না, কেউ না। ফারিয়াকে তার বর্তমানের সাথেই থাকবে অনন্তকাল।

যেখানে সময়ের শুরু অথবা শেষ নেই। যেখানে জীবন মৃত্যু নেই।

মহান সাধকের কানে ভেসে আসছে প্রভুর বেহালার শব্দ। এ এক ভিন্ন সুরের আহবান। প্রভু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন ফারিয়ার দিকে। সে অবিশ্বাসে প্রভুর দিকে তাকাল। ফারিয়া তাকে ছেড়ে প্রভুকে জড়িয়ে ধরল। তার ঘাড়ে অধর ছোঁয়াল। ওহ যন্ত্রনা! না প্রভু না! এর চেয়ে মৃত্যু ভাল। সাধকের আত্মা ফিরে এল দেহে। ধীরে ধীরে সুর মিলিয়ে গেল। শূন্যে হারিয়ে গেল ফারিয়া।

গভীর রাতে এই শহরের এক জীর্ণ-শীর্ণ বাড়ি থেকে আজো ভেসে আসে বেহালার সুর। একজন হাড়জিরজিরে সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ সেই বেহালা বাজান। এক সুর কখনও দুবার বাজতে শোনা যায় না। সে সুরে থাকে আর্তনাদ। সে সুর ঝড় তোলে বরষায়, যে সুরের আহবানে নামে জোছনা কিংবা অমাবস্যা, সে সুরে থাকে ফিরে আসার আহবান। সুর ক্ষনে ক্ষনে বদলায়। বেলা বেড়ে চলে, কেউ ফিরে আসেনা।

দেবী লিলিথ এর আশংকাই সত্যি হল, তাদের সুর সাধনায় দেবতা আঁলিয়ান রুপান্তিত হয়ে সৃষ্টি করল সুরের দেবতা ইফ্রিত।

যিনি না থাকলে এই জগতে কোন সুরই সৃষ্টি হত না। যার ক্ষমতা আছে সময়ের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে ভ্রমণ করার।

তিনি বাঁধা পড়ে গেছেন এক চক্রে, যেখানে এক জীবনে ফারিয়া কখনোই তার হবে না। অন্য জীবনে ফারিয়া অনন্তকাল তার হয়েও তার নয়।

এ এক অনন্ত বিষাদময় সুখ।

………………………………………………………………..সমাপ্ত………………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত