চিমনির দরজাটা খুলে গেছে। চোখ ঝলসানো আগুনের হলকা এসে লাগল রজতেন্দ্রর মুখে। তারপর একটা শেষ ঠেলা। আর গেট পড়ে যাওয়া। ব্যাস, রজতেন্দ্র আর তিথির ইহলোকের যোগাযোগের দ্য এন্ড। পোড়া ভ্যাপসা গা গুলিয়ে ওঠা একটা গন্ধে তারপর একবার ছাই আর রজতেন্দ্রর দেখা হবে, সেটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা যে কোনওটাই হতে পারে। নির্ভর করে ডোমের সাথে আর্থিক সেটিং-এর ওপর। এসব বারবার শ্মশানে এসে তার জানা। কিন্তু আজ বড়ো ক্লান্ত লাগছে এসব বোঝাপড়া সারতে। সঙ্গে এমন কেউও আসেনি যে এসব ব্যাপারে করিৎকর্মা। আসলে রজতেন্দ্র আর তিথির জীবনে এমন করিৎকর্মা সহযাত্রী কমই ছিল। সবাই খামখেয়ালি, আধা পাগল, প্রতিভাবান, সংসারে বেমানান একগুচ্ছ বন্ধুবান্ধবই তো পেয়েছিল তারা গত বত্রিশ বছরের পরিচয় আর সাংসারিক জীবনে। তাই সরে যায় চুল্লিটার কাছ থেকে মাইল খানেক দূরে ওদেরই কাছে। সিগেরেট ধরায়। সিগেরেটটা আজও ছাড়া হলো না ওর। গত বাইশ বছর ধরে ও ভেবে আর বলে এসেছে এটা সে ছেড়ে দেবে আর রোজ ঐ টাকাটা রাখবে একটা ডিজিটাল এসেলারের জন্য। যেমন তিথি বিশ্বাস করে এল গত উনিশ বছর ধরে রজতেন্দ্র ছাড়তে পারেনি। ছাড়লেও একজনকে বিদায় দিয়েছে। তার কারণ তিথির মুখটা নয়। তাদের মনমালিন্য শেষ হয়নি বলে। নইলে রজতেন্দ্র তিথিকে ছেড়ে চলে যেত। এমনকি এখন থাকলেও একদিন সে চলে যাবে। এটাই তিথি আর রজতেন্দ্রর সম্পর্কের নিয়তি। ভুল হলো ভাবাটা __ সিগারেটের শেষ আঁচটা ঠোঁটে লাগতেই মনে হলো ওর। তিথি অনেক বছর হলো ওদের এক করে ভাবাটা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন চুল্লিতে মিশে না গেলে বলত ‘আমার নিয়তি’।
‘কী ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ইন্দু তোকে’ অদিতির চোখটা রজতেন্দ্রর চোখ মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে পরম সমব্যাথীর দৃষ্টিতে। ‘হ্যাঁ মাথাটা ধরেছে আবার। বাড়ি ফিরে একটা ওষুধ খেয়ে ঘুমাব। তোরা কি করবি দেখ! থাকলে থাক। ফ্রিজে কিছু থাকলে গরম করে নিস। আমি ঘুমাব।’ তারপর আর একটা সিগারেট ধরিয়ে জলের সামনে সরে দাঁড়ায় রজতেন্দ্র। আজ খুব ঠাণ্ডা তাদের শহরে । এ শহরের তাপমাত্রা অনেকবছরই তাদের মধ্যের তাপমাত্রার মতো বদলে গেছে। একটু একটু করে, বছরে বছরে। কত কারণ ছাপা হলো জার্নালে জার্নালে এইসব পরিবর্তনের। তাদের কথাটা অবশ্য কোথাও ছাপা হয়নি। সোশাল মিডিয়ার বন্ধুরা কেউ কেউ আঁচ করেছে তিথির স্ট্যাটাস পড়ে। কিন্তু তারা বড়োই ভদ্রলোক, চূড়ান্ত নেশা করেও কেউ উপযাজক হয়ে তাদের একান্তে প্রবেশ করেনি।
নরম সুডোল মাংসের স্পর্শ বন্ধ চোখ ছুঁয়ে নেমে আসছে ঠোঁটের অনুকূলে। সে চোখ খুলবে না। সেই খুঁজে নেবে ঠিকানা। তারপর উঁচু বাদামি কেন্দ্র থেকে সে শুষে নেবে চেনা স্বাদ। তার ভালো লাগবে খুব। তবু ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যাবে পরের ধাপে। চেনা জমিনে। যেখানে মুখ নামালে সে আর কিছু চায় না। এ তার স্পর্শে শক্ত হয়ে ওঠা জিনিসটার থেকেও আকর্ষক। এর নরম কোমল লোমশ অঞ্চল তাকে নিশ্চিন্ত করে অন্ধকার ঘরের সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়া কোনও দুরাত্মা এ নয় (যা সে ভাবে। ঘরে তাদের অচেনা আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। কথা শোনে। কথা বলে। এক বন্ধুদের আড্ডায় শুনেছে তারা মিলিতও হতে চায়। হয়। জোর জবরদস্তি। তখন গায়ে হাতে পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা ওঠে। সুখশ্রমের যন্ত্রণার মতো যোনিমুখ খুলে ফুলে ওঠে।) কিংবা অন্য কোনও পুরুষ। তারপর নিশ্চিন্তে সে ফোর-প্লেতে মন ঢেলে দেয়। আর তখনি আঞ্চলিক উষ্ণতা বাড়ে। গন্ধ ওঠে। ফেরোমোনের গন্ধ। এ গন্ধে তিথি জানে রজতেন্দ্র পাগল হয়ে যায়।
রজতেন্দ্র ছিটকে ওঠে গন্ধটা তাকে গ্রাস করলে। অন্ধকারটাতে ধাতস্ত হতে কয়েক সেকেন্ড লাগে। একযুগের বেশি সময় হয়ে গেছে এ গন্ধের সঙ্গে রজতেন্দ্রর কোনও যোগ নেই। সমীকরণ বদলে গেছে একটু একটু করে। যেহেতু তারা কেউই পেশাদার নয়, তাই খিদে পেলে ফ্রিজ খুলে খাবার মাইক্রোওভেনে চাপিয়ে নিতে পেরেছে কিন্তু শরীরে ডাক এলে এগিয়ে যেতে পারেনি পরস্পরের অভিমুখে কিংবা অন্য কোনও পেশাদার বিলাসে। দুটো শরীর ক্রমাগত শক্ত আর শীতল হয়ে খাটের দু’কোণাকে আশ্রয় করে নিয়েছে।
আজ খুব ঠাণ্ডা তাদের শহরে । তবু ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা জলের বোতল থেকে জল ঢালে গলায়। জলটা অনেক মাস পড়ে আছে, তাই একটা ফ্রিজের গন্ধ হয়েছে। বসে থাকে অনেকক্ষণ ঐ অন্ধকারেই জলটা আবার ফ্রিজে রেখে, দরজাটা বন্ধ করে। মাথার ব্যথাটা গ্রাস করছে ক্রমাগত। এটার সঙ্গে রজতেন্দ্র এখন সহবাস করে। তার মাথার মধ্যে বোমা ফাটে সারাক্ষণ। জ্বালা করে একটা ধার ধরে। তারপর ছড়িয়ে পড়ে গোটা মানুষটায়। তবু তার ছাপান্ন বছরের জীবনে এ নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো না একদিনও। তার বাবা-মা-দিদিও কোনওদিন চেষ্টা করেনি, তিথি-অদিতি-কুন্তল-দেবর্ষি-পরমা কেউই না। কিংবা তাদের চেষ্টা আর রজতেন্দ্রর গা ছাড়া ভাব __ দুটোই ছিল একইরকম। তাই তার নিজস্ব চিকিৎসাগুলো আজকাল আর তেমন কাজ দেয় না। ব্যথা যায় ব্যথা আসে; তার মধ্যেই রজতেন্দ্র কাগজের অফিসে যায়, কাজ করে, বাড়ি ফিরে লেখে, আড্ডা মারে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, খাবার খায়, ঘুমায়। হাসপাতালের চাপ বেশি থাকলে তিথি বাড়ি না ফিরলেও আজকাল সয়ে গেছে, কিন্তু মাথার ব্যথাটা না ফিরে এলে রজতেন্দ্র কেমন বেঁচে আছে বুঝতে পারে না।
কী পেল তিথি উনিশ বছর ধরে এই অখণ্ড লড়াইটা চালিয়ে গিয়ে? খুব জানতে ইচ্ছা করছে তিথির অ্যাকাউন্টের হাসিমুখের ছবিটার সামনে বসে রজতেন্দ্রর। তিথিকে তো সে সান্দাকফুর খোলা আকাশের নিচে বুদ্ধরূপী হিমালয়কে সাক্ষী রেখে পেয়েছিল। ওরা সেদিন দুটো আলাদা গ্রুপে একদিনের ব্যবধানে ওখানে পৌঁছেছিল। তারপর জ্যোৎস্না রাতে, কনকনে ঠাণ্ডায় রজতেন্দ্রর গলায় জর্জ বিশ্বাসের নিজস্বী ঘরানার রবীন্দ্রসংগীত আর তিথির অসংখ্য খোলামনে গল্প, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রজতেন্দ্রর নিজের কথা শোনার ধৈর্য তাদের গভীর বন্ধু করে তুলল মুহূর্ত দুদিনে। তাদের প্রাচীন নগরী, চেনা বন্ধুরা, প্রতিবেশ সব হয়ে গেল তিথি আর রজতেন্দ্রময়। মাঝের সূক্ষতম বিচ্ছেদও আর সয় না তাদের। নগর দেখল পাগল উত্তুঙ্গ প্রেম। ফেরোমোনের সুবাসে বুঁদ হয়ে ফিরল তারা বাড়িতে, আবার গ্রহণ করল দিনবদলেই দুজনের সময়।
নিজের শর্তে একদিন তারা থাকতে শুরু করল। নেই-বাড়ি বলে এগারো মাসের ব্যবধানে বাসা বদলালো আরও কয়েক বছর। তারপর এল স্থিরতা। একটা নির্দিষ্ট ঠিকানার অর্জন। আর সেটা হতেই তিথি কিনে আনল নীল রঙের একটা চিঠি ফেলার কাঠের বাক্স, তাদের ঠিকানা লেখা। কিন্তু যে প্রবলভাবে নতুন সমাজের কাছে উদাহরণ আর ব্যাঙাচির পূর্বজদের জীবনে আলোড়ন ফেলে তারা শুরু করেছিল, এক বিছানায়, এক ঠিকানায় এসে সেই তাপ কমে আসছিল। অন্তত তিথির একা থাকলেই কিংবা রজতেন্দ্রর সঙ্গে বসেও মনে হতো একথা। তারা যেন ঠিক সেভাবে বাঁচছে না, যা তারা হরেক বাধা ব্যবধানের দিনেও বেঁচেছিল। কিসের যেন একটা অভাব, একটা শূন্যতার বোধ, খালিখালি লাগা। একটা অনভিপ্রেত অপেক্ষা। সে অভাব পাগলের মতো মিলনেও মেটে না, ফোনে কথা শেষে সে অভাব, একসাথে ঘুরতে বেরিয়ে সে অভাব। দেখতে দেখতে বেখেয়ালে অভাব আর অভিযোগ এক সারণিতে নেমে এল। তিথির জীবনটা রজতেন্দ্রর সাথে জুড়ে গিয়ে জটিল হয়ে গেছে __ তিথি জ্ঞানে অজ্ঞানে তা বিশ্বাসে বাড়িয়ে নিল। সে ধরে নিল তার মা কিংবা শাশুড়ির মতোই তারও পরিণতি হতে চলেছে প্রেমহীন এক সাংসারিক জীবন। রজতেন্দ্রই তার এই পরিণতি ডেকে এনেছে।
ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি গুণিতকে বাড়ছিল। তার মাঝে এসে গেল কয়েকজন নারী। যাদের কাছে রজতেন্দ্র আশ্রয় পেল, আশ্রয় চাইল, যেমনটা সে তিথির কাছে চেয়েছিল। কিন্তু সে কালবেলা রজতেন্দ্রকে প্লেটোনিক প্রেমের দুনিয়ায় আটকে রাখল। এগোতে দিল না যেমনটা সে তিথিকে নিয়ে পেরেছিল অনায়াসে, নির্ভয় মুক্তিতে। তার মাঝে কেটে গেল উনিশটা বছর। কিন্তু তার জীবনের হাতে গোনা কয়েক মাসের অভিজ্ঞতাকে আঁকড়ে তিথি যুদ্ধ চালিয়ে গেল আমৃত্যু। সে এই বিশ্বাসটাকে কেবল আঁকড়ে ধরে রাখল তাদের প্রেমটা টিকলে তো রজতেন্দ্র বিদায় নিত। রজতেন্দ্র যে থাকল, থাকতে নতুন নতুন করে চেষ্টা করল, একত্রে বাঁচবে বারবার বলল, তাকে আঁকড়ে ধরল, ফেরোমোনের গন্ধে ভিজে উচ্চারণ করল ‘ভালবাসি, তোকে আজও ভালবাসি’; কিন্তু তিথির জীবনে ভালো থাকাটা ফিরে এলেই মনে হতো দয়া, কেবল মধ্যবিত্তের আটকে পড়া। আর সময়সময়ে তীব্র করে তুলত অশান্তি। যা বয়ে আনল কথাহীন জমাট বাঁধা নীল রক্তচাপ।
তবু যে কোনও কারণেই হোক তারা এতগুলো বছর একসাথে থেকে গেল। কোনও কমফোর্ট পরিধির স্বাদ পেয়ে, নাকি তাদের দুজনেরই আর কোথাও যাওয়ার ছিল না বলে, তা রজতেন্দ্র আজ আর ভাবতে পারে না। ভাবতে হলে যে আলোচনাটুকু তিথির সাথে করা দরকার ছিল তা আর করে উঠতে পারেনি সে। তিথির রাগ আর অভিমানের মুহূর্তের বাক্যগঠন এত তীব্র ছিল আর রজতেন্দ্র কিছু ভুলতে পারে না বলে তাদের আর কথা হলো না। সম্ভাবনার অপেক্ষাটা চিরতরে ক্লোজ হয়ে গেল। অথচ কথা ছিল অনেক। হয়তো ভালবাসাটাও।