লোকটা মেট্রো থেকে নামার সময় যেন আমার মধ্যে দিয়ে চলে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার। ঠিক সেভাবে যেন কোনও ধাক্কাই অনুভব করতে পারলাম না। লন্ডন প্যাডিংটন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন। সারাক্ষণ এখানে স্টেশনে যাত্রীর ভিড় থাকে। এটাকেই বলা যায় লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রধান স্টেশন। লন্ডন মেট্রোর ও ইংল্যান্ডের বাকি দূরগামী ট্রেনের সংযোগস্থল।
মেট্রোর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে দরজা বন্ধ হওয়ার সময় খেয়াল করলাম লোকটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক লোকের মধ্যে দিয়ে চলে গেল। অন্যরা যেন কিছু বুঝতেও পারল না। লোকটাকে ঘিরে কীরকম যেন কুয়াশা। দেখা গেলেও খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। যেতে-যেতে শুধু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকাল। লোকটা আফ্রিকান। কালো মুশকো মতো চেহারা। সাড়ে ছ’ ফুটের মতো হাইট৷ জিনসের প্যান্টের উপরে একটা চামড়ার জ্যাকেট। হাতে একটা পুরনো ছেঁড়া ব্যাগ। চোখের মণিটা কীরকম যেন সবুজ রঙের। অদ্ভুত শীতল সে দৃষ্টি অন্যরা কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না? আমি কী করে ওকে দেখতে পেলাম!
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল। তাই লোকটা কোথায় গেল। আর দেখতে পেলাম না।
ট্রেনের ভিড়ের মধ্যেই যেন শরীর কাঁপতে শুরু করল। গলা শুকিয়ে এল। এ আমি কী দেখলাম? এরকম কি সত্যি সম্ভব? চোখের সামনে যেন বারবার ফিরে আসছিল সেই এক জোড়া সবুজ চোখ।
এর পরের ঘটনাটা ঘটল ঠিক তিনদিন বাদে। বন্ধুদের সঙ্গে অফিসের পরে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ একটা রেস্তারাঁয় খেতে গিয়েছিলাম। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় একটা নামকরা রেস্তরাঁ। এখান থেকে রানির বাকিংহাম প্যালেসও বেশি দূরে নয়। হঠাৎ খেয়াল করলাম দরজা দিয়ে এক মাঝবয়সি মহিলা এসে ঢুকল।
চোখে পড়ার মতো সুন্দরী। আমাদের টেবিলের থেকে কিছু দূরে একটা ফাঁকা টেবিলে এসে বসল। সোনালি চুল। গায়ে একটা ভেলভেটের নীল রঙের লং ড্রেস। একেও যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। একেও ঘিরে কুয়াশা। রেস্তরাঁয় বেশি আলো ছিল না। তার মধ্যেও লক্ষ করলাম এরও চোখের রং সবুজ। একবার চোখাচোখি হতে মুচকি হাসল। কোনও খাবারের অর্ডার দিল না। চুপচাপ বসে রইল। যেন আমাকেই দেখার জন্য এখানে এসেছে। যারা খাবারের অর্ডার নিচ্ছিল, তারাও কেউ মেয়েটাকে যেন লক্ষ করছিল না। খানিক বাদে পাঁচজনের একটা গ্রুপ এসে ওই টেবিলে বসল। মেয়েটা তখনই উঠে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম কেউ ওকে দেখতে পায় নি।
অ্যান্ডি আমার উলটোদিকে বসে ছিল। আমি অনেকক্ষণ কোনও কথা বলছি না দেখে আমাকে লক্ষ করে বলে উঠল, “তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? কীরকম যেন লাগছে তোমাকে। এভরিথিং অলরাইট?”
হেসে উঠে মনের ভাব লুকোনোর চেষ্টা করলাম। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। খানিকক্ষণের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ভুলেও গেলাম ওই মহিলাকে দেখার কথা।
কিন্তু রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়েই আবার প্রশ্নটা ফিরে এল। আমি কি তা হলে কোন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছি? এরকম কেন হচ্ছে?
পরের দিন মেট্রো থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি ব্যস্ত রাস্তায় একটা দাড়িওয়ালা কালো লোক লিফলেট বিলি করছে। আমাকে দেখে একটা লিফলেট এগিয়ে দিল। নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ লেখাটা পড়ে অবাক হয়ে গেলাম। এ তো আমার সমস্যার কথাই লিখেছে।
লিফলেটে লেখা আছে যদি কেউ কোনওরকম মানসিক রোগে ভোগে, হঠাৎ করে অদ্ভুত কোনকিছু দেখতে শুরু করে, তা হলে ফ্রি কনসালটেশনের জন্য যেন অবিলম্বে ডাক্তার ক্রিস বেনেটকে যোগাযোগ করে। নীচে নাম্বার,
চেম্বারের ঠিকানা দেওয়া। ডাক্তারের বেশ লম্বা-চওড়া ডিগ্রি। এখানকার হেলথ সার্ভিস দ্বারা স্বীকৃত।
এখানে চট করে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্
ট পাওয়া বেশ দুরূহ ব্যাপার। তাই সঙ্গে-সঙ্গে ঠিক করে নিলাম অফিসের মাঝে কোন একসময় ওঁর কাছে ঘুরে আসব।
যেদিন গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে সেদিন বেশ কয়েকজন রোগী ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যেই দেখলাম ঠিক একই রকম কুয়াশায় ঘেরা একটা লোক বসে আছে। গায়ে একটা দামি লেদারের লংকোট। মাথায় হ্যাট। দেখার মতো তাগড়াই গোঁফ। ভাবলাম একবার কাছে গিয়ে দেখি। কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সাহসে কুলোল না। আড়চোখে দেখলাম লোকটা আমার দিকে সবুজ চোখে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তার আধঘণ্টা বাদে ডাকলেন। বেশ রাশভারী মানুষ। দেখেই অভিজাত পরিবারের মনে হয়। বেশ সুন্দর দেখতে। খুব মন দিয়ে আমার সব কথা শুনলেন। আমাকে নানান প্রশ্ন করলেন। কিছু টেস্টও করতে দিলেন। আশ্বস্ত করলেন এটা মনের ভুল। বেশি ষ্ট্রেসের, কম ঘুমানোর লক্ষণ। বাইরে বসা লোকটার কথা ডাক্তারকে বলব কী বলব না ভেবে শেষে আর বলা হল না। উনি তো আর দেখতে পাবেন না।
ওরা কি আমাকে কিছু বলতে চায়? আমাকে ঘিরে ওদের এত আগ্রহের কারণটা কী?
ডাক্তারের কথাই হয়ত ঠিক। দু’দিন ছুটি নিলাম। বাড়িতে বেশ খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে কাটালাম। আমি রান্না করতে ভালোবাসি। ছুটি পেলেই নানা ধরনের রান্না করার চেষ্টা করি। এটা খানিকটা আমার নেশার মতো। আর বলতে নেই বেশ ভালই করি। এখানকার অনেক ভারতীয় রেস্তরাঁর চেয়ে অনেক বেশি ভাল রান্না করি। দু’দিন বেশ আরামে কাটিয়ে অফিসে ফের যোগ দিলাম।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। সেটা বোধ হয় শুক্রবার ছিল। আমি ব্রিটিশ লাইব্রেরি গিয়েছি। এখানে আমি নিয়মিত যাই। বইয়ের সংখ্যায় এটা পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি। মধ্যযুগের রাজপরিবার নিয়ে একটা বইয়ের খোঁজে গিয়েছিলাম।
বইটা নিয়ে পড়ছি, খেয়াল করলাম আমার ঠিক উলটো দিকে একটা লোক এসে বসল। লোকটার মাথার সামনের দিকে চুল নেই। বড় টাক। দুপাশে আর মাথার পিছনের দিকে গোল করে ঘিরে সোনালি চুল। ভোঁতা মতো নাক। চওড়া ভুরু। ছোট ছোট কুতকুতে চোখ। বেশ খানিকক্ষণ একটা বই নিয়ে বসে রইল। একবার আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। মুচকি হাসল। সেই একই রকম সবুজ চোখ। প্রায় আধঘণ্টা বাদে ফের উঠে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় যেভাবে লাইব্রেরিয়ানের বসার জন্য নির্ধারিত জায়গার মধ্যে দিয়ে চলে গেল, বুঝতে পারলাম এ লোকটাও ওই একই দলের। যেন আমাকে দেখতেই এসেছিল।
এতদিন বাড়ির কাউকে এ সব কথা জানাই নি। সেদিন আমার স্ত্রীকে বললাম। নিশ্চয়ই একটা কিছু অসুবিধে হচ্ছে। ও হেসে উড়িয়ে দিল। বেশি আর কিছু বললাম না। এ উপলব্ধি কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।
কিন্তু কীই বা হতে পারে! অন্য কোনও অসুবিধে তো সত্যিই নেই। দিব্যি আছি। অফিস করছি। রোজ সকালে হাইড পার্কে দৌড়চ্ছি। দিব্যি ফিট।
এর এক সপ্তাহ পরের কথা। এর মধ্যে বলতে নেই, নতুন কাউকে দেখিনি।
সেদিন অফিস থেকে বেরতে সন্ধে সাতটা হয়ে গেল। আমার অফিসটা লন্ডনের হাই স্ট্রিট কেন্সিংটনের পাশে লন্ডনের অভিজাত পাড়ায়। বেশ কিছু নামী দোকান চারদিকে। ট্রেন ধরব বলে এগোচ্ছি, হঠাৎ খেয়াল হল সেদিন যে ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম, সেই ক্রিস উলটো দিক দিয়ে আসছেন। এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম।
ভেবেছিলাম উনি খেয়াল করতে পারবেন না। কিন্তু একবারেই চিনতে পারলেন। আমাকে দেখে জানতে চাইলেন কীরকম আছি। সেরকম অন্য কাউকে আর দেখেছি কিনা।
উল্লেখ করলাম ব্রিটিশ লাইব্রেরির কয়েকদিন আগের ঘটনাটা। মন দিয়ে শোনার পরে আমাকে বললেন, “কাছেই আমার বাড়ী। আপনার একটু সময় আছে কি? আপনার কেসটা কফি খেতে-খেতে একটু ভাল করে শোনা যাক। ইন্টারেস্টিং কেস।”
বলে রাস্তা পার হয়ে উলটো দিকে চলে গেলেন। তারপরে বেশ জোরে হাঁটতে শুরু করলেন। কোনওরকমে ওঁর সঙ্গে তাল রেখে আমিও ওঁর পিছু-পিছু হাঁটতে থাকলাম। এটা লন্ডনের পুরনো অভিজাত এলাকা। রাস্তার দু’ধারে আগেকার দিনের ভিক্টোরিয়ান বাড়ি। বেশির ভাগই একশো-দেড়শো বছর পুরনো। শীতের সন্ধে। এখন রাস্তায় লোক নেই বললেই চলে। দু’ধারে পাতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া গাছের সারি। ল্যাম্পের হলুদ আলো অন্ধকারের মধ্যে যেন শুধু নিজের অস্পষ্ট উপস্থিতিই বজায় রেখেছে।
মাথার উপরে কালো মেঘ চারদিক দিয়ে চাঁদটাকে ঘিরে ধরেছে। রাস্তার দু’ধারে বেশ কিছু অ্যান্টিকের দোকান। তবে সবই এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ক্রিস সেরকমই একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া অ্যান্টিকের দোকানের লাগোয়া বাড়িতে তালা খুলে ভিতরে ঢুকল। ঢোকার আগে কাচের মধ্যে দিয়ে দেখলাম অ্যান্টিকের দোকানে নানা ধরনের ঘড়ি, মূর্তি, কাপ প্লেট। ভিতর পৰ্যন্ত অবশ্য দেখা যাচ্ছিল না।
ক্রিস আমাকে দেখে বলে উঠলেন, “আমি এরই উপরের তলায় থাকি। এটা আমাদের বহুদিনের বাড়ি। দোকানটাও বহুদিনের। আমার ঠাকুরদার তৈরি করা।”
“আপনি এখানে একা থাকেন?”
“আমার ফ্যামিলি নেই। কয়েকজন কাজের লোক আছে। তা ছাড়া মাঝে মধ্যেই আমার কিছু পেশেন্ট আর অতিথিরা আসেন। এই যেমন এলেন।”
বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। ছোট একটা লবির পরে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। লবিতে দামি কার্পেট পাতা। পাশে একটা প্রায় ছ’ ফুট উচু গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। কীরকম যেন ছমছমে আবহাওয়া। একটা পচা গন্ধ।
বাঁ দিকে একটা ড্রয়িং রুম। ডান দিকে আর-একটা দরজা। আমাকে ওই দরজা দেখিয়ে ক্রিস বলে উঠলেন, “ওটা দিয়ে দোকানে যাওয়া যায়। তবে এমনিতে অ্যান্টিকের দোকানের দরজা আলাদা। রাস্তার উপরে।”
লবিতে একটা ছোট কাঠের টেবিল। সেখানে একটা চামড়ার খাতা রাখা।
“এখানে সই করবেন। যারা-যারা আসে, তাদের সই। এই খাতায় রেখে দিই। কে এসেছিল, খেয়াল থাকে।”
একটু অবাক হলাম। বাড়িতে অতিথিদের জন্য ভিজিটারস বুক!
সই করতে গিয়ে দেখলাম, অনেকেরই সই আছে। তবে তারিখ আর সময়ের জন্য শুধু একটাই জায়গা রাখা আছে। ঢোকার সময় লিখতে হবে? ঘড়ি দেখে লিখলাম সন্ধে সাতটা চল্লিশ।
মজা করে বলে উঠলাম, “বেরনোর সময় আবার সই করতে হবে না তো?”
“না-না, তার আর দরকার হবে না।” কথাটার মধ্যে কী ছিল জানি না, কিন্তু এই প্রথম যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হল।
ক্রিসের মুখ দেখে অবাক হলাম। মুখটা নির্বিকার। আমাকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলে ক্রিস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বড় ড্রয়িং রুম। এক দিকে ফায়ারপ্লেস। যদিও সেটা বন্ধ আছে। বিশাল লেদার সোফা। মাঝখানে একটা কারুকার্য করা টেবিলের উপরে বড় একটা দামি কাঠের দাবার বোর্ড। বোর্ডের গুটিগুলো দেখতে ভারী অদ্ভুত। রাজা, রানি, ঘোড়া, গজ, বোড়ে সবই এক-একটা মানুষের মুখ। প্রত্যেকটা প্রায় আধাফুট মতো উচু।
আর সেই মানুষের মুন্ডুগুলোর উপরে কাঠের কাজ। যেমন মুকুট দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সেটা রাজার। সে মুখগুলো এত নিখুঁতভাবে করা, যে দেখেই বোঝা যায় এই বোর্ড কোনও সাধারণ বোর্ড নয়। বেশ দামি। অবাক হয়ে সবকটা গুটি নেড়েচেড়ে দেখছি, এর মধ্যে একটা লোক কফি নিয়ে ঢুকল।
লোকটার কাছ থেকে কফিটা নিয়ে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে চমকে উঠলাম, এ তো সেই ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে দেখা লোকটা। সামনে বড় টাক। তিন ধার দিয়ে পাকা চুলে যেন পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা। সেই ছোট-ছোট চোখদুটো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর মুচকি-মুচকি হাসছে। লোকটাকে ঘিরে সেই একই রকম কুয়াশা। মুখটা যেন শরীর থেকে আলাদা হয়ে অন্ধকারে ভাসছে।
আমি চমকে উঠে কিছু কথা বলার আগেই আবার ঘরে ক্রিস ফিরে এলেন। বলে উঠলেন, “রবার্টকে আপনি আগেই দেখেছেন, তাই তো? ওই আপনার লাস্ট রাউন্ড ইন্টারভিউ নিয়েছে।”
“মানে?” অবাক হয়ে বলে উঠলাম।
ক্রিস হেসে উঠে সামনের সোফায় বসে বলে উঠলেন, “বুঝিয়ে বলছি। এ কী আপনি কাঁপছেন মনে হচ্ছে। ঠান্ডা লাগছে?”
একটু থেমে ফের বলে উঠলেন-“মেরি, ওঁর জন্য ফুটকেক নিয়ে এসো! রবার্ট ফায়ারপ্লেসটা চালিয়ে দাও।”
আমার হাত ঠান্ডা হয়ে আসছিল। ক্রিসের পিছনে দেওয়ালে আটকানো হ্যারিকেনের শেপের ল্যাম্পের আলোটা যেন দুলছিল। বাতাস ভারী লাগছিল। পা যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল। চেষ্টা করেও উঠতে পারছিলাম না।
এর মধ্যে একজন মহিলা এসে ঢুকল হাতে একটা ট্রে নিয়ে। টেবিলের উপরে ট্রেটা রেখে মহিলা আমার দিকে তাকাল। সে যেন রক্ত জল হয়ে যাওয়া দৃষ্টি। মুহুর্তে বুঝতে পারলাম। একেও আমি দেখেছি। সেদিন রেস্তারাঁয়। সেদিনের সেই মহিলা। এত সুন্দর দেখতে এক মহিলার মুখ যে এরকম ভীতিপ্রদ হতে পারে তা কথায় বোঝানো সম্ভব নয়। চোখের সবুজ দৃষ্টি যেন পাথরের মতো স্থির। কোনও অনুভূতি যেন তাতে নেই। আমার দিকে কফির কাপটা তুলে দিল।
কফি নিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। কথা আসছিল না মুখে। সামনের দাবার বোর্ডে বোড়েদের মুখ এত চেনা লাগছিল কেন বুঝতে পারলাম। ওর মধ্যে মেরির মুখ, রবার্টের মুখও আছে। সেদিন সেই ট্রেনে দেখা ওই লোকটার মুখও আছে। রাজার মুখ ঠিক ক্রিসের মুখের মতো।
কফিটার দিক লক্ষ করে ক্রিস বলে উঠলেন, “কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে। নিন, খেয়ে নিন। আচ্ছা, একটা কথা বলে দিই। বাইরের খাতায় ওদের সইও পাবেন। ওরাও আপনার মতোই এখানে এসেছিল। তারপর। বুঝতেই তো পারছেন কী হয়েছে” বলে হেসে উঠলেন ক্রিস।
ইতিমধ্যে ক্রিসের মুখের পরিবর্তন লক্ষ করলাম। চোখের জায়গায় কিছুই নেই। বড় গর্ত। খোলা মুখের জায়গায়ও কিছু নেই। শুধু জমাট অন্ধকার। রক্তশূন্য মুখ। ক্রিস ফের বলে উঠলেন, “কফি খেয়ে নিন। আপনাকে এবার কাজ বুঝিয়ে দেব। তার আগে চলুন। এক রাউন্ড দাবা হয়ে যাক। ওহো, কীভাবে খেলব, একটা বোড়ে তো কম পড়েছে আবার। যার জন্য আপনাকে নির্বাচন করা হয়েছে। নাহ, ওদের নির্বাচন ঠিক। ভালই মানাবে। জেমস পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে একটা গুটি কম পড়ে গিয়েছিল।”
দূর থেকে ক্রিসের বাকি কথাগুলো ভেসে এল। ঘরের মধ্যে সামনের বোর্ড আর আমাকে ঘিরে অনেকগুলো ছায়া এসে দাঁড়িয়েছে বেশ বুঝতে পারলাম। ল্যাম্পের আলো ওদের জন্যই বারবার কেঁপে-কেঁপে উঠছে।
“ভাল ভারতীয় রান্না খাওয়ার আমার বহুদিনের শখ। আপনাকেও রান্নার কাজেই রাখব ভাবছি। তারপরে নিজের হাতে আবার আর-একটা কাঠের বোড়ে তৈরি করতে হবে। এখন যেমন চুপ করে বসে আছেন, সেরকমভাবে বসে থাকলেই হবে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন আপনি ওদের দেখতে পাচ্ছিলেন। খানিকক্ষণের মধ্যে আরও স্পষ্ট দেখতে পাবেন। আর কোনও প্রশ্ন আছে?”
……………………………………………………………..(সমাপ্ত)………………………………………………………