ফেলে আসা কিছু স্মৃতি

ফেলে আসা কিছু স্মৃতি

জানালার শিক ধরে একঠায় দাঁড়িয়ে আছে দুটি বাচ্চা ছেলে মেয়ে, একজনের বয়স বছর ছয়েক আর অন্যজন তার নয় বছর বয়সের বড় জ্যেঠতুতো দিদি।

দুটো গভীর আগ্রহে ভরা চোখ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে বাইরের অঝোরে নেমে আসা জলের ধারার দিকে।
বৃষ্টির জলে টইটম্বুর হয়ে উঠেছে বাড়ির গা ছুঁয়ে যাওয়া কর্পোরেশনের পাকা ড্রেনটা, পাশের বাড়ির পাঁচিলের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল ফুলের গাছটা যেন একেবারে ধুয়ে মুছে আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দুই সাঙ্গাতেরই ভারি ইচ্ছে এক নিমেষে ছুটে যেতে ওই অঝোর ধারার মাঝে, কিন্তু বাড়ির কড়া নিষেধ “আবার ঠাণ্ডা লাগালে তখন ?” তাই অগত্যা কোনমতে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দুই খুদে আপ্রান চেষ্টা করে চলেছে কার্ণিশের গা বেয়ে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা জলটুকুকে ছোঁয়ার।

আজ থেকে প্রায় কুড়ি বাইশ বছর আগের একটা ছবি, কিন্তু আজো যখন আকাশ কালো করে ঝেঁপে বৃষ্টি নামে এই দৃশ্য যেন বড্ড জীবন্ত হয়ে জেগে ওঠে দুই চোখের সামনে। মনের ক্যানভ্যাসে ফুটে ওঠে বহু বছর আগের ফেলে আসা কিছু স্মৃতি

ফেলে আসা পুরোন বাড়িতে তখন থাকতাম আমরা, একতলায় আমরা আর দোতলায় জেঠুরা। আর আমার

সর্বক্ষনের ঝগড়ার সাথী ছিল আমার তিন বছরের বড় দিদি। কী ভয়ংকর টিক টিক যে রাতদিন করে বেড়াত, তা বলে শেষ করা যাবেনা।

আবার ঝগড়া করে এক বেলা কথা বন্ধ হলেও দুজনেরই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়!

আর হাজার মারামারির মধ্যেও দুই ভাই বোনের কমন ইন্টারেস্ট ছিল একটাই, একতলার পুব দিকের জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ ভেঙে নেমে আসা ঠাণ্ডা জলের ধারার সাক্ষী হওয়া,

-“এই ভাই দ্যাখ কচুপাতায় কিভাবে জল জমছে, জানিস কচুপাতা কিন্তু কক্ষন ভিজে যায়না”

“ছোড়দি দ্যাখ, দ্যাখ পাশের মাঠটা কিভাবে পুকুর হয়ে গেছে , এই এখানে মাছ আসবে না রে ? কি কি মাছ বলত, ইলিশ আসবে রে ইলিশ? জ্যাঠার জালটা ফেললে কেমন হয় ?”

-ধুর বোকা, এই জলে কখন ইলিশ মাছ আসে, আমি স্কুলে পড়েছি ইলিশ মাছ সমুদ্রে পাওয়া যায়, এখানে কিভাবে আসবে। রুই কাতলা আসতে পারে। তুইও যেমন একটা হাঁদা গঙ্গারাম।“

-আমি হাঁদা? আর তুই কি তুই তো পেত্নী!

-কি এত বড় কথা, আমি না তোর বড় দিদি, তোর গুরুজন।

-গুরুজন না ছাই, তুই গরুজন।

-কি? ওহ ছোটমা, শিগগীর আস দ্যাখ ভাই আমাকে কি অপমান না কচ্ছে। আমি আর কক্ষন তোকে লুকিয়ে আচার এনে দেবনা। কক্ষননা।

-হ্যাঁ, কি এমন এনে দিস, সবটাই তো নিজে সাবাড় করিস। সেই দিন ছাদ থেকে তেঁতুল চুরি করে আনলি , আমাকে দিয়েছিলি ? একা একা তো দিব্যি খেয়ে নিলি। আমার কথা মনে ছিল? জানিসনা আমি কত ভালবাসি খেতে।

-এই কাঁদিস না, তোর তো গলা ব্যথা ছিল তখন, কিভাবে দিতাম বল? আচ্ছা আর রাগ করিসনা, মা ভাল চালতার আচার করেছে, বিকেলে নিয়ে আসবখন, খাস কেমন। এই ভাই দ্যাখ ,দ্যাখ রামদার চায়ের দোকানের এসবেস্টাসের ছাদ উড়ে গেছে, ওমা কি হবে রে ?

– হ্যাঁ, তাই তো, বেচারা রামদা! কিভাবে চায়ের দোকান খুলবে রে?বিকেলে কি সুন্দর পেঁয়াজী ভাজে। আর ভাজবেনা, অ্যাঁআআআআআ”

-এই সবেতেই কান্না শুরু, হয়েছে এক ছিঁচকাঁদুনে, রাত দিন খালি প্যাঁ প্যাঁ করে যাচ্ছে। এই দ্যাখ, পিসিবাড়ীর কালো গরুটা কোত্থেকে পাশের মাঠে এসে জলে একে নাগাড়ে ভিজে যাচ্ছে। ‘

“এই ও অত ভিজছে কেন রে, ওর জ্বর হয়না? আর হলে ওই পচা ওষুধটা খেতে হয়না ওদের। ইয়াক কি গন্দ, মা জানিস জোর করে আমার গলায় ঢেলে দেয়। কি বিচ্ছিরি খেতে।“

-তুই বেশি বেশি করিস, অত বাজে গন্দ ও নয়। আচ্ছা আমি এরপর থেকে মিষ্টি মৌরি নিয়ে আসব খন তোর জন্য। “

-মৌরি ভাল খেতে রে ? ঝাল ঝাল নয়ত?”

– না না একদম মিষ্টি, বাবা সেদিনকে অফিস থেকে নিয়ে এল, তোকে আমি লুকিয়ে দিয়ে যাবখন।

– এই ছোড়দি আমার পায়ে কি এসে পড়ল রে, এটা কি সাদা সাদা ? কী ঠাণ্ডা!

– এটা কী রে ? কী ঠাণ্ডা, ওহ ছোটমা, শিগগীর এসে দেখ কি সব পড়ছে আকাশ থেকে কি শব্দ! একমুখ হাসি নিয়ে এসে দাঁড়ান বাচ্চা ছেলেটার মা, “কি হয়েছে রে মুন, ওমা এত শিল পড়ছে আকাশ থেকে! কতদিন পর রে! সেই কবে যেন লাস্ট পড়েছিল, হ্যাঁ মুনের বয়স তখন বছর চারেক হবে। বাপরে কত শিল পড়ছে আজকে।  এমা ভয় পাচ্ছিস কেন, এত ভাল জিনিস, ডিপ ফ্রিজে বরফ দেখিসনি? এ তাই। আকাশ থেকে পড়ছে। নে তোরা দ্যাখ, আমি গিয়ে কাজ সারি, রাজ্যের কাজ এখন পড়ে আছে।“

-এই ছোড়দি, মা কি বলে গেল রে ? আকাশেও কি ডিপ ফ্রিজ আছে নাকি রে ?

-তাই তো মনে হয়, কিন্তু আকাশে কি আর কারেন্ট আছে রে, চলে কিসে ?

– কেন বাজ পড়ছেনা, ওই তো আবার পড়ল, কি শব্দ রে, ভয় লাগে।“

-ধুর বোকা ছেলে ভয় পাসনা, আমি তো আছি। বাপ রে সত্যি কি শব্দ রে। হুম ঠিক বলেছিস ওতেই চলে বোধহয়।“

-এই শোননা ওতেও আইস্ক্রিম হয় নাকি রে ? লাস্টবার মা কি সুন্দর করেছিল মনে আছে। আহা আবার যে কবে করবে !

-এই ভাই শোননা, এগুলো আইস্ক্রীম নয় তো ? চল খেয়ে দেখি একবার।

-হ্যাঁ, চল জানালার ধার থেকে কুড়িয়ে নিই।

-এই এই কি হচ্ছে এটা, এক মুহূর্তের জন্য সরেছি, আর দুটো মিলে নোংরা বরফ তুলে মুখ পুরছে। কি রে তোরা কবে বড় হবি? আর কতদিন এই রকম বলদ থাকবি বলতো দুটোয়?

অনেক হয়েছে আর দেখতে হবেনা বৃষ্টি , নেমে আয়, আয় বলছি ওখান থেকে , আমি জানালা বন্ধ করছি।

কত কতগুলো বছর যেন সময়ের উজান স্রোত বেয়ে ছুটে হারিয়ে গেছে। মানুষ দূরে সরে যায়। এক জগত থেকে পা রাখে অন্য দুনিয়ায়।

বড় হতে হতে একটা সময় সত্যি সে বলদ থেকে চালাক হওয়ার পথে পা রাখে, পিছনে রয়ে যায় সমস্ত কিছু, শুধু এক নীরব যাত্রী হয়ে তার সাথে পাড়ি দেয় ফেলে আসা সময়ের কিছু অমূল্য স্মৃতি!

আজ আর চাইলেও সেই ঝরে পড়া শিল মুখে পোড়ার উপায় নেই, কেউ হয়ত বারণ করবেনা, কিন্তু সেই ইচ্ছেটাই যেন পাড়ি দিয়েছে কোন অজানা রাজ্যের পথে।

সেই পুঁচকে মহাজ্ঞানী দিদি আজ নিজেই এক পুঁচকের মা, তাকে সামলাতেই আজ তার জীবন নাজেহাল।
খুদে দস্যুকে সামলাতে সামলাতে সেও কি আজো হারিয়ে যায় কাল মেঘে ভরা আকাশের দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে?

রাম দার চায়ের দোকান, পাশের বাড়ির ভেঙে পড়া সুপারি গাছ, জলে ভিজে পুকুর হওয়া সবুজ মাঠ, বাপীদা দের বকুল গাছ সব কিছুকেই এইভাবে হারিয়ে যেতে হয় মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে!

সত্যি আজ এর উত্তর আমার কাছে নেই।

শুধু এইটুকু জানি অফিসের কাজের মাঝে সেন্ট জন চার্চের চূড়ায় একটুকরো কাল মেঘ জমতে দেখলে জানিনা কত দূর থেকে একটা কচি গলার সুর যেন আজো ভেসে আসে কানে

“বল ভাই বল

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে”

“আয়না রে বৃষ্টি ছোড়দি কখন থেকে বলছে, বলি এখনো কি তোর আসার সময় হয়নি ? কবে আবার ফিরে আসবি, কখন থেকে ডাকছি তোকে, আয়না রে!

…………………………………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………………………………

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত