আমি খোলা জায়গায় ঘুমাতে পারিনা।
খোলা জায়গায় আমার এমনিতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তবুও আমি খোলা জায়গায় ঘুমাই না। কারণ সে আসবে।
পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে তাইনা?
অবশ্য আশ্চর্য হবারই কথা। আমি নিজেও হই।
আমার বাবা বলতেন যে, “সেক্সপিয়ার বলেছেন দেয়ার আর ম্যানি থিং ইন হেভেন এন্ড আর্থ…………।
তারপরেরটুকু আমার আর মনে নেই।
বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। মা মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলাতেই। বাবাই কোলেপিঠে করে মানুষ করছিলেন আমাকে। তখন বান্দরবান থাকতাম আমরা। বাবার খুব প্রিয় ছিল পাহাড় জঙ্গল এসব। প্রকৃতি প্রেমী ছিলেন তিনি।
ছোটবেলার দিনগুলো প্রায়ই খুব বেশী বেশী মনে পড়ে আমার। বাবার সাথে বনে আর পাহাড়ে ঘুরতে যেতাম আমি। হয়তো বন পাহাড়ের প্রতি এই টানটা বাবার কাছে থেকেই পেয়েছিলাম। বাবা আমার আঙুল ধরে থাকতেন। নানা রকম পশুপাখি আর গাছপালার নাম শেখাতেন আমাকে। খরগোশ, শেয়াল, বানর, টিয়ে, কাক, চড়ুই, টুনটুনি। কত বকম গাছ, বট, হিজল, দেবদারু, মেহগনী, সেগুন, কাঠবাদাম।
আমাদের ছোট্ট বাংলো ধরণের বাড়িটার চারপাশেও অনেক গাছ ছিল। বাবাই লাগিয়েছিলেন। নানা জাতের আর রঙের ফুল ফুটতো সেগুলোতে। সবই অসাধারণ ছিল শুধু একটা জিনিষ বাদে। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হওয়া মানা ছিল। জানিনা কেন। সন্ধ্যের পর বাবা আমাকে বাসার বারান্দাতেও বসতে দিতেন না। পুরো গ্রামটা খালি হয়ে যেত সন্ধ্যার পর থেকে।
বয়স কতই বা হবে আমার? আট বা দশ। সে যাই হোক। বাবার হঠাত প্রমোশন হল। তিনি হেডমাস্টার হয়ে গেলেন স্কুলের। একদিন টিফিনের সময় আমার বন্ধু আবিদ শুরু করলো ভুতের গল্প। এই বনে নাকি এক অপদেবতা থাকে। অপদেবতা মানে বুঝতাম না তবে ধরে নিয়েছিলাম। দুষ্টু ভূত বা এজাতীয় কিছুই হবে। সে নাকি প্রতি রাতে শিকার খুজতে বের হয়।
সে শিকারটা কিভাবে করে?
শীষ দেয় সে। কিছুক্ষণ পর পর থেমে থেমে। সেই শীষের জবাব যদি কেউ দেয় । তাহলেই নরক ভেঙে পড়ে। ভয়ংকর মৃত্যুর শিকার হয় জবাবদানকারী।
অদ্ভুত ব্যাপার। আমি স্বীকার করলাম। কিন্তু বিশ্বাস করলাম না। বাবা বলেন, “ভূত প্রেত বলতে কিছুই নেই”।
অনেক বছর আগে এক শিকারী বনে গিয়ে করুণভাবে মারা পড়েছিল। তারই আত্না এই অপদেবতা। দাঁতাল শুকরের হামলায় গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল সে। গোটা একটা রাত ভয়ানক যন্ত্রণা পায় সে। তার আর্তনাদ গ্রামে পৌছেছিল। কিন্তু গভীর রাতে বনে গিয়ে আহত শিকারীকে কেউ উদ্ধার করে আনেনি। হয়তো সাহস পায়নি।
দিনের বেলায় গিয়ে মৃত শিকারীর লাশ উদ্ধার করে আনে গ্রামবাসী। দাঁতাল শুয়োর তার দুপা চিরে ফেলেছিল। শরীরের মাংস খুবলে খেয়েছিল শেয়ালেরা। বেচারা শিকারী হয়ত বেঁচে ছিল তখনও। জ্যান্ত অবস্থায়ই শেয়ালেরা ছিড়ে খেয়েছে তাকে।
তারপর থেকে তার আত্না প্রতিরাতেই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। শিস বাজিয়ে ডাকে। কেউ উত্তরে শিস বাজালেই তাকে ভয়ানকভাবে খুন করে এই অপদেবতা।
বলাই বাহুল্য আবিদের কথা আমি গালগপ্পো ভেবেই উড়িয়ে দিলাম।
হয়তো এটাই ছিল আমার ভুল। এভাবে পাত্তা না দেওয়াটা উচিত হয়নি আমার। সেখানেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করলাম আমি।
বাবা স্কুলের হেডমাস্টার হবার সুবাদে তাকে ফিরতে হত অনেক রাতে। প্রায়ই আটটা নয়টা বেজে যেত তার ফিরতে ফিরতে।
সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পড়তে বসেছিলাম আমি। আমার টেবিলটা জানালার কাছে ছিল। গরমের দিন বলে জানালা খুলেই রাখতাম। তখনই হঠাত শুনলাম শব্দটা। খুব কাছেই বসে কেউ শিস দিচ্ছে। নিজের মনের অজান্তেই শিস বাজিয়ে উত্তর দিলাম আমি। জানালা দিয়ে ভাল করে তাকাতেই গাছের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা জমাটবদ্ধ আধারের মত একটা অবয়ব চোখে পড়ল আমার। আবার শিসের আওয়াজ পেলাম। পুনরায় জবাব দিলাম আমি। এভাবেই চলছিল। হঠাত বাবার গলার আওয়াজ পেলাম, “রাতুল?”
পেছনে ঘুরতেই বাবাকে দেখলাম। বাবার মুখ রক্তশুন্য। আতংকিত গলায় বলল, “কি করছিস তুই?”
-বাবা দেখ কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ওইযে আম গাছটার নিচে শিস দিচ্ছে।
এটুকু বলার সময়ই আবার শিসের আওয়াজ পেলাম আবার প্রতিউত্তর দিলাম আমি। বাবা ছুটে এসে মুখ চেপে ধরলেন আমার। আমি মুখ থেকে বাবার হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম, “কি হয়েছে বাবা?”
বাবা দ্রুত হাতে জানালাটা লাগালেন। কাপা গলায় বললেন, “বাবা শোন। কোন অবস্থাতেই জানালা খুলবি না। সর্বনাশ হয়ে যাবে নাহলে……..
বাবার কথা না শেষ হতেই ভয়ংকর এক হুংকার শুনতে পেলাম বাইরে। নরকের গহীন থেকে বেরিয়ে আসা আর্তনাদও হয়তোবা এত করুণ আর ভয়ানক হয় না। মনে হতে লাগল যেন ভয়ানক যন্ত্রণা আর ক্রোধে চিৎকার করছে অসংখ্য মানুষ! না! না! মানুষ না! এমন শব্দ করা পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম হল আমার। বাবা আমার দুহাত আমার দুকানের ওপর দিয়ে বললেন, “কান চেপে ধর। আমি বাইরে যাচ্ছি। কোন অবস্থাতেই জানালা বা কোন দরজা খুলবি না”।
-তুমি কই যাবা?
-তুই এখানে বস।
বাবা আমার কথা কানেও নিলেন না। ছুটে বের হয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তার পিছনে ছুটলাম আমি। সদর দরজা একটানে খুলে বের হয়ে গেলেন বাবা। পরক্ষণেই দুম করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। বাহিরে থেকে তালামারার শব্দ পেলাম আমি। দরজার গায়ে আছড়ে পড়লাম। চিৎকার করে ডাকলাম বাবাকে। সদর দরজার পাশে একটা জানালা ছিল। সেটার ভাঙা প্রান্ত দিয়ে উঁকি দিলাম।
বাসার সামনে একচিলতে উঠানটায় দাঁড়িয়ে আছেন বাবা। একটু পরপর তীব্র শিস বাজাচ্ছেন তিনি। আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা একচিলতে অন্ধকার অবয়বটা এখন বাবার সামনে। আকৃতিতে বড় হচ্ছে সেটা। কোন নির্দিষ্ট আকৃতি না। শুধুই ঘণ কাল আঁধার। মুহুর্তে সেটা গ্রাস করে নিল বাবাকে। বাবার মরণ চিৎকার আর গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই পৈশাচিক হুংকার আবার একবার শুনলাম আমি।
সেটাই বাবাকে শেষবারের মত দেখেছিলাম আমি।
আমার আর কিছুই মনে নেই। বাবা বলে একবার চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি।
পরদিন বাবার স্কুলের টিচাররা আমাকে দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করেন। বাবাকে খুজতে সেনাবাহিনী পুলিশ আর ফরেস্ট গার্ডদের সার্চপার্টি গিয়েছিল। গ্রামের লোকেরাও অনেক খুজেছে। কিন্তু বাবাকে আর পাওয়া যায়নি।
অনেকদিন হাসপাতালে ছিলাম। খোলা জায়গায় থাকতে ভয় পেতাম। বন্ধ ঘরে তালা মেরে রাখতে হত। আমার চাচা ঢাকা থেকে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। আমার নতুন জীবন শুরু হল চাচা চাচীর সাথে। ঢাকায়।
অনেক বছর পেরিয়ে গেছে আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতই আমি এখন। সুস্থ্য হয়ে গেছি পুরোপুরি। ভার্সিটিতে যাই। ক্লাস করি বন্ধুদের সাহে আড্ডা মারি। কিন্তু মাগরিবের আজানের পর কখনোই বাইরে থাকি না আমি। বাসায় ফিরে আসি। আমার ঘরে লোহার একটা আলমারি আছে। সেটার ভেতরে কিছুই রাখি না আমি। সন্ধ্যার পর থেকে সেটার ভেতর ঢুকে বসে থাকি। আমাকে ঢুকিয়ে তালা মেরে রাখেন চাচা। তিনি করতে চান না কাজটা কিন্তু আমার অনুরোধেই তাকে কাজটা করতে হয়। তিনি ভাবেন যে আমার মাথায় গন্ডোগল আছে আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবেন তিনি রবিবারে।
কেন আমি আলমারির ভেতরে ঢুকে বসে থাকি এটা তো চাচা জানেনা। আলমারিতে লুকিয়ে থাকি কারণ, আমি জানি সে আসবে আমাকে নিতে। প্রতিরাতেই সে তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে আমাকে ডাকে। অপেক্ষা করে আমার জবাবের।
কি সর্বনাশ! লক্ষ্যই করিনি কখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে লিখতে লিখতে! দেরী হয়ে যাচ্ছে। আলমারিতে ঢোকবার সময় হয়ে গেছে। যাই চাচাকে ডেকে নিয়ে আসি।