প্রিয় সুষমা,
জানি আমাদের সম্পর্কটা ঘরে কেউ মেনে নেবে না। বাবার অগাধ সম্পত্তি থাকার কারণে আমি অসহায়। কেনো জানো? কারণ একমাত্র ছেলে হিসেবে আমাকে বাবার ব্যাবসায় বসতে হবে। তবুও আমি তোমাকে হারাতে চাই না। গভীর এ সম্পর্ক যে কখনো ম্লান হবার নয়। জানি তুমি দু সপ্তা ধরে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু আমার যে এই মুহুর্তে এতো বিশাল একটা পৃথিবী ছেড়ে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ভরসা রাখো একদিন তোমাকে নিয়ে টোনাটুনির সংসার পাতবোই এবং এই সন্তান আসার আগেই।
-তোমার নিশো।
চিঠিটা পোস্ট করে ফেরার সময় নিশোর মনে হলো সে পৃথিবীর জঘন্যতম পাপটা করেছে। একটা মেয়ের সবচেয়ে দামী জিনিস তার সতীত্ব। আর সেই সতীত্বে সোহাগের ভাগ বসাতে পারে শুধু তার স্বামী। কিন্তু নিশো আর সুষমার ভেতর যা আছে তা শুধু অবৈধ সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঘরে ঢুকে বুঝতে পারলো আবহাওয়া মোটেই ভালো নয়। মামা, চাচী এবং ফুফি মায়ের সাথে কথা বলছে। সে প্রবেশ করতেই ঘরে একটা নিস্তব্ধতার ছায়া নেমে এলো। বুঝতে পেরে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
দুদিন পর।
-নিশো ওয়েক আপ।
-কি? সমস্যা কি?
– আজ তোমার বিয়ে।
-মানে?
যা বলছি তাই। যাও গোসল করে লিভিং রুমে আসো।
মাথায় যেনো হাজারটা বাজ পড়লো। কি হবে সুষমার? বাচ্চাটার কি হবে?
আজকে আট মাস তেরো দিন হয়ে গেছে নিশোর আংটি বদল হয়ে গেছে। কিন্তু সে তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে নি। মফঃস্বল এর সুষমার কাছে ফিরে এসেছে। তার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা যে সুষমাই! বিয়ে থা করে গোটা পাঁচেক দিন থাকলো একসাথে
মোবাইলে ভাইব্রেট হতেই দেখলো তার বোনের মেসেজ। “কাম ইমারজেন্সি, ড্যাড ইজ সিক।”
-কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছো তুমি?
-বাবা অসুস্থ। শহরে যেতে হবে।
-আমার যে সামনের সপ্তায় ডেট
-চলে আসবো বিষ্যুদবার নাগাদ।
কিন্তু সে কি জানতো তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর দেখা সে কোনদিনই পাবে না?
একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি হলো তার পরিবার। যতই পরকে আপন বলেই চেঁচাক না ক্যান, তাদের কাছে বাবা মা অতি আপন। এমনই যদি হয়, তবে একে জিনগত ভাবে আকর্ষন বলা যায় না। বলা যায় এটি পৃথিবীতে বেচে থাকার আদি ও অকৃত্রিম মৌখিক সার্টিফিকেট। চাই তার সংসারে যতই ঝড় আসুক না কেনো এটাই নির্জলা সত্য যে কোনো মানুষ পরিবার ছাড়া বেচে থাকতে পারেনা।
আমাদের গল্পের নিশো তার বাবার অসুস্থতারর খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখে তার বাবা দিব্যি সুস্থ হয়ে আছেন। পুরো আলিশান বাড়ি জুড়ে আলোর ঝিলিমিলি।
-এসব কি হচ্ছে?
– কাল তোর গায়ে হলুদ। পরশু তোর বিয়ে।
-ফাজলামির একটা সীমা আছে।
-ওরে আমার হিরোগিরি।
ভাবনায় ছেদ পড়তে আবরার ইসলাম নিশো দেখেন তার মিটিং টেবিলজুড়ে গিজগিজ করছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী জারা রহমান, ছেলে ফরমান ইসলাম সহ সবাই এসে গেছে। পঁচিশ বছর আগের সেই সব কথা মনে করছিলেন এতোক্ষণ। বিয়ের সময় অজ্ঞাত কারণে তার প্রথম স্ত্রী সুষমাদের বাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ার পর সুষমারা কোথায় যেনো চলে যায়। ভাবনায় ছেদ পড়তেই দেখলেন জারা হাত ধরে মৃদু ধাক্কা দিচ্ছে।
ডায়াসের উপর দাড়িয়ে পড়লেন নিশো,
-লেডিস আ্যান্ড জেন্টেলম্যান।
আই আ্যাম হিয়ারবাই টু আ্যানাউন্স এ বিগ সিক্রেট টু অল অফ ইয়ু হুইচ আই হ্যাভ নেভার টোল্ড ইয়ু। দ্যাট আমার আগেও বিয়ে হয়েছে এবং আজকের নতুন চেয়ারম্যান ঘোষণাটি রদ করাপ হলো যা আমার প্রথম ঘরের সন্তানটি জনসম্মুখে না আসা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
সুষমাকে রেখে যেদিন নিশো শহরের উদ্দ্যশ্যে রওনা হয়ে যায় সেদিন রাতে কোন এক অজ্ঞাত কারণে সুষমাদের বাড়িতে আগুন লেগে যায়। বিধ্বস্ত বাড়ির ছায়া আর মাড়ানো হয়নি সুষমার। একজন স্কুল শিক্ষকের আদর্শবান মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে এই কথা হিন্দুপাড়ায় রটবার ভয়ে মা বাবা তাকে আলাদা ঘর নিয়ে দেন। যাতে করে নিশো ও সুষমা একসাথে থাকতে পারে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বাড়িতে আগুন লাগার কিছুদিন পর যখন সুবল চন্দ্র রায় অন্য জায়গায় চলে যেতে চান তখন সুষমাও নিশোর কথা মাথায় না রেখে পরিবারের সাথে স্থানান্তরিত হয়ে যায়।
আজ ঠিক পঁচিশ বছর পর সেই রহস্যের উদঘাটন হলো যেখানে আগুন লাগানোর পেছনে দায়ী নিশোর দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সাথে মূল ইন্ধনদাতা নিশোর মামাই।
কিন্তু আজও নিশোর জানা হয় নি তার প্রথম স্ত্রী সুষমার ঘরে ছেলে না মেয়ে জন্মেছিলো। শুধু এই কারণে নয়, ভালোবাসার ফসলটিকে এক পলক দেখতে চাওয়ার আকুলতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে নিশোকে। সাথে ফরমানও কিছুটা মুষড়ে পড়েছে তার বাবার এই অতিগোপনীয় ঘটনায়। আর ওদিকে জারাও পঁচিশ বছর ধরে চেপে যাওয়া ক্ষোভকে ক্রোধে রুপান্তর করলো ঘরে ফিরে।
-বাস্টার্ড!
-মা থামো।
-কিসের থামা? ঐ মহিলাকে আমি খুন করবো! আর তাদের সন্তান, ওটাকে এই বাড়ির ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে দেবো না। লাশ আঠারো টুকরো করবো!
-ভুলে গুণে সবাই তো মানুষ। বাবা একজনকে ভালোবাসতো সেটা কি ঐ মহিলার দোষ?
আর কিছু না বলে ফরমান বেরিয়ে চলে আসে মায়ের রুম থেকে। বাবার স্টাডিতে ঢুকে চিন্তিত মুখে বাবাকে দেখে বললো,
-কি ব্যাপার এতোবড়ো একটা কথা গোপন করে রেখেছো, আমাদের বলো নি কেনো?
-আই আ্যাম স্যরি।
-স্যরি দিয়ে তো কোনো ব্যাপার পরিমাপ করা যায়না। উনাদের খুঁজে বের করা দরকার।
-পারবি তোর বড় মাকে খুজে বের করে আনতে?
-তোমার কথা কোনোদিন কি ফেলে দিয়েছি?
-তাহলে যা আজই বের হ ওদের খুঁজতে।
আজকে উপমার জন্য একটা বিশেষ দিন। আজ সারাজীবনের ইচ্ছাটা পূরণ করা যাবে যদি সে তার বাবাকে খুঁজে বের করতে পারে। কিন্তু এতোবড়ো শহরে বাবাকে খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, হাতে সেই পরিমাণ টাকাও নেই যে গোটা শহরে খুঁজে পাবে তার বাবাকে। তবুও সে এই দুর্বিষহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিনগুলিতে ঢাকা শহরে নিত্য খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবাকে।
একটা বাসে উঠলো সে। মহিলা সীটে উঠে বসে পড়লো ভীত সন্তস্ত্র হয়ে। না জানি কখন বোমা এসে পড়ে। মহাখালী ফ্লাইওভার পেরিয়ে সমতল রাস্তায় চলার পথে জানালা ভেংগে কি যেনো বাসের ভেতরে এসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ আগুন, সেই সাথে চিৎকার চেঁচামেচি। হঠাৎ করেই কি যেনো একটা ব্লাস্ট করলো বাসের ভেতর। ইতিমধ্যে প্রায় সবাই বেরিয়ে গেছে। দুটো কিশোরীর ওড়নায় আগুন লাগার পরই তাদের ধাক্কা দিলো উপমা, বাঁচানোরর জন্যে।
গাড়িতে আগুন যখন পুরোপুরি বিস্তার লাভ করলো তখন উপমার সারা শরীরের অর্ধেকটা আগুনে ঢেকে গেছে। জানালা দিয়ে সে স্পষ্ট দেখতে পেলো যারা পেট্রোল বোমা ছুড়ে মেরেছে। অদ্ভুতভাবে বাস থেকে নেমে পড়লো। ঝড়ের বেগে সামনের দিকে দ্রুত ভেসে ভেসে মোটর বাইকের সামনে দশ গজ দুরে দাঁড়ালো। দু হাত প্রশস্ত করে বললো, “এবার মর”।
সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ চিরে গেলো। অদ্ভুত সে ইশারায় লোক দুটো জীবন্ত কাবাব হলো।
সমস্ত ট্রাফিক থেমে গেছে বহু আগেই। নিশো গাড়ি থেকে সে দৃশ্য দেখছিলেন। অদ্ভুত ব্যাপার উপমাও সেদিকে তাকালো। চিৎকার করে বললো, “বাবা, আমি তোমার মেয়ে বাবা”।
নিশো অদ্ভুত হয়ে চেয়ে রইলেন। উপমা গাড়ির কাছে এসেই বললো, “বাবা আমি তোমাকে খুজছিলাম এতোদিন।” ব্যাগ থেকে একটা ফটো বের করে দিলো যেখানে নিশোর তরুন বয়সের ফটো ছিলো। প্রায় সবটাই পুড়ে গেছে। শুধু নিশোর মুখটা দেখা যাচ্ছে। সেকাল আর একালের পার্থক্য শুধু এটুকুই। বলিরেখার বলিহারি।
নিশো আতংকগ্রস্থ অবস্থায় বসে রয়েছে। ড্রাইভিং সিটে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে থাকা ফরমান জিজ্ঞেস করলো, “এই মেয়ে কে তুমি?”
উপমা জোর গলায় বলে উঠলো, “আমি আবরার ইসলাম নিশোর প্রথম ঘরের একমাত্র কন্যা সন্তান উপমা। আমি অগ্নিকন্যা”।