কান্নার আওয়াজ শোনা মাত্রই ঘুম ভেঙ্গে যায় নীলিমার। প্রতি রাতের মত আজকেও তার সন্তান অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। আশ্চার্যের বিষয় প্রতি রাতে ঠিক এই সময়েই সে কেঁদে উঠে আর ঠিক এই সময়েই নীলিমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কান্নার শব্দ শোনা মাত্রই ছটফট করতে থাকে নীলিমার বুক। হাজারো হলেও নীলিমা যে মা আর একজন মা তার সন্তানের কান্না শুনে কখনোই স্থির থাকতে পারে না।
নীলিমা তার পাশে শুয়ে থাকে নিবিড়কে এক নাগাড়ে ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু নিবিড়ের কোনো সাড়া শব্দ নেই। নিবিড় অবশ্য অনেক ঘুম কাতুরে। ঘুমের মধ্যে যদি চোর পুরা বাসার সবকিছু চুরি করে নিয়ে যায় তাও তার ঘুম ভাঙ্গে না। এতে নিবিড়েরও অবশ্য কোনো দোষ নেই। সারাদিন বেচারার উপর বহু ধকল যায়। অফিস এবং বাসা প্রায় দুটাই তাকে সামলাতে হয়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কখন যে চোঁখ লেগে যায় কিছুই বুঝতে পারে না।
নীলিমা বারবার নিবিড়কে বলছে আমাদের বাবুটা কাঁদছে। ওর বোধ হয় একা একা ভয় লাগছে। চলো না ওর কাছে যাই। নীলিমার কথা সম্পূর্ণ না শুনেই নিবিড় ঘুম কাতুরে চোঁখেই নীলিমাকে বলতে লাগলো উম্ম ঘুমাও তো। মাঝ রাতে আবার
কি শুরু করলা।
নিবিড়ের উপর নীলিমার প্রচন্ড রাগ উঠছে। আগে নীলিমা যখন গর্ভবতী ছিলো তখন নিবিড় নীলিমাকে বার বার বলতো আমাদের বাবুটাকে আমরা কখনোই কান্না করতে দিবো না। তাকে কখনোই কষ্ট পেতে দিবো না। দুই জনে সারাক্ষণ ওর যত্ন নিবো। আর আজকে এই তার যত্ন নেয়া??
এমন কেয়ারলেস বাবা হলে চলে??
ওই দিকে সন্তান কাঁদছে আর এই দিকে বাবা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
নিবিড় এবং নীলিমা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করে।ঠিক ভালোবেসে বললেও ভুল হবে। নিবিড় এবং নীলিমার পরিবারের মাঝে আত্নীয়তার সম্পর্ক থাকায় ছোট থেকেই তাদের বিয়ে ঠিক করা হয়। যার ফলে ছোট থেকেই তারা মনের মাঝে একে অপরকে নিয়ে কল্পনা করতে থাকে। যা পরবর্তীতে ভালোবাসায় রূপ নেয়। বিয়ের ঠিক কিছুদিন আগেই বিশাল এক পারিবারিক সমস্যার কারণে তাদের বিয়ে ভেঙ্গে যায়। যার ফলে দুই পরিবার তাদের সম্পর্কের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় পরিবারের অমতেই তারা পালিয়ে বিয়ে করে নেয়।
নীলিমা অত্যন্ত পাগলী স্বভাবের মেয়ে। সারাদিন কাছের মানুষ গুলার সাথে পাগলামী করতেই তার দিন চলে যায়। তার কাজ গুলা ঠিক ছোট বাচ্চার মত। ছোট বাচ্চারা যেমন করে কাছের মানুষগুলাকে জ্বালাতন করে নীলিমাও ঠিক তেমনি করে তার কাছের মানুষগুলাকে জ্বালাতন করে। নীলিমার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা হলো তার মুখের হাসি। যখনই কেউ তার দুষ্টামিতে বিরক্ত হয়ে উঠে ঠিক তখনি অদ্ভুত মায়ায় ভরা হাসি দেয় সে। আর সবাই তার দুষ্টামিগুলা সাথে সাথে ভুলে যায়।
নীলিমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলো তার মা। নিজের সুখ দুঃখের সব কথাই সে তার মায়ের কাছে শেয়ার করতো। নিবিড়ের পরিবারের সাথে নীলিমাদের যখন ঝামেলা হয় নীলিমা তখন ভেবেছিলো আর কেউ না বুঝলে অন্তত তার মা তাকে বুঝবে। কিন্তু তার মাথায় আকাশ তখনি ভেঙ্গে পড়ে যখন তার মাও তার বাবার সুরে তাল মিলিয়ে তাদের বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চায়। নীলিমা তার মাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু তার মা তার কোন কথাই শুনেনি। একদিকে ছোট থেকে মনের মাঝে তিল তিল করে গড়ে তোলা ভালোবাসা অন্যদিকে বাবা মায়ের জেদ। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকা নীলিমা এক পর্যায়ে তার ভালোবাসাকেই বেছে নেয়।
সময়ের সাথে সাথে নীলিমার সন্তানের কান্না যেন আরো তীব্র হতে থাকে। সন্তানের এক একটা কান্নার চিৎকার নীলিমার নিউরনে কাল বৈশাখী ঝড় তুলতে থাকে। নীলিমার শান্ত মনকে অশান্ত করে তোলে। কান্নার শব্দে নীলিমা যেন তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। বুকের মানিকের এমন কষ্ট যেন তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।তার এমন কষ্টে যেন বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে নীলিমার।
নীলিমা অনেক চেষ্টা করেও তার সন্তানের কান্না থামাতে পারছে না।অনেক বুঝানোর পরেও প্রতিবারের ন্যায় সে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। বারবার অভয় দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাকে কোনোভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না যে এবার মা তার সাথে আছে এবার আর কোনো বিপদ হবে না। মা তাকে একা ছেড়ে আর কখনো কোথাও যাবে না। সারাক্ষণ তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়েই থাকবে।
নীলিমা ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে তার বুকের মানিক আর কাঁদছে না। হয়তো কাঁদতে কাঁদতে হাপিয়ে গেছে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তাই হয়তো ঘুমিয়েছে। কিন্তু চোঁখ খুলেই যখন আবার নিজের মাকে দেখতে পাবে না তখন তো আবার কান্না শুরু করবে। না আর চুপ করে থাকলে চলবে না,এখনই কিছু একটা করতে হবে। সোনা বাবুটা যেন একা একা আর কষ্ট না পায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নিবিড়ের না হয় হুশ নেই কিন্তু সে তো মা তার অন্তত উচিৎ সন্তানের কাছে যাওয়া, যাতে সে আর ভয় না পায়।
নিবিড় এবং নীলিমার পুরা বাড়িতে একা থাকলেও একাকীত্ব কখনোই তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। যখনই সময় পেতো দুজন দুজনার কাছাকাছি থাকতো। মনে হাজারো স্বপ্ন পুষে সেগুলা পূরণ করার হাজারটা উপায় বের করতো। ছোট্ট সংসটা নিজেদের স্বপ্নের মত করে সাঁজাতে লাগলো। অবসর সময়ে খুনসুটি ঝগড়া,অল্প একটু অভিমান আর অনেক খানি ভালোবাসায় তার দিন গুলি আনন্দের সাথে কাটতে লাগলো।
আনন্দের পরিমাণটা আরো বেড়ে গেলো যখন তারা জানতে পারলো তারা বাবা মা হতে চলছে। সেই সাথে আরো একটা স্বপ্ন যোগ হতে শুরু করলো তাদের মনে। হয়তো তাদের এই সন্তানের মুখ দেখেই তাদের উভয় পরিবার তাদের বিয়েটা মেনে নিবে। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকেই নিবিড় নীলিমার আলাদা যত্ন নিতে থাকে। যদিও এইসব বিষয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না তারপরেও নেট ঘেটে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নীলিমাকে নিয়মের মধ্যে রাখার চেষ্টা করতো নিবিড়। নীলিমাও নিবিড়ের এমন ভালোবাসা দেখে অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতে থাকে।
নীলিমা এবং নিবিড়ের ঘর আলোকিত করে ফুটফুটে পরীর মত একটা মেয়ে তাদের ঘরে আসে। তারা তাদের মেয়ের নাম রাখে নিশিতা। আর আদর করে ডাকে নিশু বলে। নিশুকে ঘিরেই তাদের সব সুখ দুঃখ গড়ে উঠে। নিবিড় যখন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে নীলিমা তখন পুরাটা সময় নিশুর সাথেই কাটায়। বাবা মা মেনে না নিলেও তার কোনো কষ্ট নেই কারণ নিশুর দিকে যখনি তাকায় তখনি সব কষ্ট সে ভুলে যায়। মাতৃত্বের স্বাদ নীলিমা যেন খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে।
হঠাৎ করেই অজানা কোনো এক কারণে ঘুম ভেঙ্গে যায় নিবিড়ের। চোঁখ মেলে তাকাতেই দেখে নীলিমা তার পাশে নেই। সারা বাড়ী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নীলিমাকে কোথাও খুঁজে পেলো না নিবিড়। তাহলে কি তার ধারণাটাই সত্যি হচ্ছে। একবার তো নীলিমা তাকে ডেকেওছিলো যে নিশু কাঁদছে। তার হয়তো ভয় করছে, কথাগুলা মনে পড়তেই সাথে সাথে নিবিড় বেরিয়ে পড়ে নীলিমার উদ্দেশ্যে।
নিবিড় এগিয়ে যেতেই দেখে নীলিমা নিশুর কবরের উপর শুয়ে এক নাগাড়ে বক বক করেই যাচ্ছে। নীলিমা নিশুকে বলছে ভয়ের কিছু নেই সোনাপাখি। এইতো মা তোমার কাছেই শুয়ে আছে। মা তোমার জন্য অনেক গুলা খেলনা নিয়ে এসেছে, দেখো এগুলা পছন্দ হয়েছে?? মা এরপর থেকে আরো অনেক খেলনা নিয়ে আসবে তাও কেঁদোনা। তুমি আমার লক্ষ্মী মেয়ে হওনা। নিবিড় নীলিমার কাছে যেতেই নীলিমা আবার বলে উঠে এইতো বাবাও চলে এসেছে। এখন বাবা, তুমি আর আমি খেলবো কেমন। অনেক মজা হবে তাই না মামণি? নিবিড় নীলিমার কথা গুলা শুনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না, নীলিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিশুর কবরের পাশে বসেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে আর নীলিমাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে।
প্রতিদিনকার মত সেদিনও নিবিড়ের ঘুম নিশুর দুষ্টামিতে ভেঙ্গে যায়। নিবিড় ঘুম থেকে উঠে দেখে তার রাজকন্যা তার বুকের উপরে উঠে তার নাক কান ধরে টানাটানি করছে। দু বছরে নিশু অনেকটাই শিখে গেছে। বাবা মা সহ অনেক কিছুই বলতে পারে সে। সাথে নতুন পায়ে হাটাহাটি তো আছেই। নিবিড় নিশুর সাথে খেলা করে তার অফিসে চলে যায়। নীলিমা নিশুকে বিছানার উপর এক গাদা খেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখে রান্না ঘরে যায় তরকারীটা নাড়িয়ে দেয়ার জন্য। নিশুর চুপ চাপ থাকা দেখে নীলিমাও তার কাজ গুলা আস্তে ধীরেই করতে থাকে। কাজ শেষে রুমে আসতেই দেখে রুমে নিশু নেই। সারা ঘর খুঁজেও যখন নিশুকে পাওয়া গেলো না তখন তার মনে পড়ল বাথরুমের কথা কারণ নিশু সুযোগ পেলেই বাথরুমে যেতো পানি নিয়ে খেলা করতে।
নীলিমা এক দৌঁড়ে বাথরুমে যায়। যেয়ে দেখে নিশু পানি ভর্তি বালতির মাঝে উপর হয়ে পড়ে আছে। নীলিমা সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে নিশুকে বের করে আনে। কিন্তু ততক্ষণে যে অনেক দেরী হয়ে গেছে। নিশু শ্বাসবন্ধ হয়ে চলে গেছে ওপাড়ে। সেই সাথে নিয়ে গেছে নিবিড় এবং নীলিমার জমানো সব আশা, ভরসা এবং বেঁচে থাকার সব সাহস টুকুও। নিশুর মৃত্যু নীলিমাকে এতটাই শকড্ করে যে সে আস্তে আস্তে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে প্রতি রাতেই সে নিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পারে এবং তার কবরের পাশে এসে অদ্ভুত আচারণ করতে থাকে। এক দিকে কলিজার টুকরা একমাত্র মেয়েকে হারানোর বেদনা আবার অন্যদিকে নীলিমার এমন পাগলামী সাথে বাবা মায়ের অভিমান করে দূরে থাকা সব মিলিয়ে বাঁচার আশা যেন হারিয়েই ফেলেছে নিবিড়। কানে শুধু ভেসে উঠছে একটাই কথা, বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখি হতে পারে না,কেউ না।