প্রতিক্ষা

প্রতিক্ষা

প্রতিদিন বিকাল বেলার এই সময়টাতে, বেলকনিতে আসা,আমার নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে।

এখন সময় ৫ বেজে ০৭ মিনিট। আমি রকিং চেয়ারে একটা বই হাতে নিয়ে বসে আছি। চোঁখটা আমার বইয়ের দিকে নয়,আমাদের সামনের রাস্তার উপারের,ওই চারতলা বাসাটার গেটের দিকে।

প্রতিক্ষা আর অপেক্ষা দুটি আলাদা নিয়ম মানলেও,আমার সাথে কেন যেন,প্রতিক্ষা শব্দটির নিয়মটাই মিলে যায়। ছেলেটি চশমা ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসে। রাস্তার কাছে এসে দাড়াঁয়। অপেক্ষা করতে থাকে রিক্সারর জন্য। আমি এক মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি,বইয়ের ফাঁক দিয়ে। কিছুটা অপলোক দৃষ্টিতে দেখতে থাকি তাকে। দেখতে থাকি চমশা খুলে চোঁখ মুছা। কখনো প্রচন্ড রৌদে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে, তার কপালের ঘাম মুছা।তখন খুব ইচ্ছা হয় আমার ওড়না দিয়ে তার কপালের ঘামগুলো মুছে দিতে।

রিক্সা তার পাশে এসে দাড়াঁয়। সে কিছু কথা বলে ওঠে বসে। আমি ঘাড় বের করে যতদূর চোঁখ যায়,তার চলে যাওয়া দেখতে থাকি।

আমি রুপন্তী। এইবার অনার্স ১ম বর্ষে পড়ছি। আর যার কথা বলছিলাম তার নাম মুহিব রহমান। সে মাস্টার্সে পড়ছে। একই ভার্সিটি হওয়ার তাকে আমি চিনি। কিন্তু এত লোকের ভিড়ে এসে আমাকে চিনে নাকি যানি নাহ্। মুহিব নামের ছেলেটি আমাদের বাসার সামনের রাস্তার,উপাশে চারতলা বাসাটিতে টিউশনি করার। সপ্তাহে তিনদিন শনি,সোম,বুধ। ৩টা ২০-৪০এর মধ্যে আসবে ৫টার দিকে চলে যায়।

মেয়ে আর ছেলের প্রপোজ বিষয়টি কেমন যেন,সবচেয়ে কালো মেয়েটিও ২-৩টা প্রপোজ পেয়ে যায়। কিন্তু একটা সুন্দর দেখতে ছেলেও হয়ত একটা প্রপোজও পায় নাহ্। এই বেলকনিতে আসি বলেই কত ছেলে বাইক নিয়ে আসে,কেউবা রাস্তার ওইপাশে খুটির মত দাড়িয়ে থাকে।

কি আজব এই দুনিয়া, যার জন্য চেয়ে আছেন? সে একবারও তাকায় নাহ্। আর অন্যরা কেবলার মত তাকিয়ে থাকে। তাদের বুঝাবে কে? আমি অন্য কারও প্রতিক্ষার বসে আছি।

ওই মুহিব ছেলেটির সাথে আমার দেখা হয়েছিল,বৃষ্টিস্নাত এক বিকালে।আমি শপিং করে,রিক্সা করে বাসার আসছিলাম। প্রচন্ড বৃষ্টি,ছাতাও আনা হয়নি। বাসার কাছে রিক্সা থামতেই ভাড়া দিয়ে,ওই চারতলা বাসাটার গেটে কাছে আশ্রয় নিতে যেয়েই সব ওলট-পালট হয়ে গেল।

ছেলেটি চেয়েছিল আমার দিকে,এক স্থস্থির আভা নিয়ে। তার চশমার নিচের ওই চোঁখদুটো কতটা শিতল আর মুগ্ধতার মায়া, তা আমি বলতে পারব নাহ্। আমি তার চোঁখের দৃষ্টিতে অবিরত,ভিজতে ছিলাম। কেন যেন তখন মনে হচ্ছিল,এই বৃষ্টিতে আমার সারা জীবন ভিজা দরকার। সেই থেকে শুরু….

আজ শনিবার।এখন ৪টা বেজে ৫৮ মিনিট। আজ আর বেলকনিতে যায়নি,কিছুটা হালকা সেজেঁ দাড়িয়ে আছি,চারতলা বাসাটার গেটের সামনে। অপেক্ষা হয়ত করছি রিক্সার জন্য। কিন্তু আমি তো জানি, আমি প্রতিক্ষা করছি কার জন্য।

মুহিব অস্থির ভাবে এসে রাস্তার দাড়াঁয়। সে কিছু একটা টের পেয়ে স্থবির হয়ে দাড়ায়,তাকায় আমার দিকে। আমিও বেহারার মত চেয়ে আছি তার দিকে। এত কাজ থেকে ভালো লাগার মানুষটির দিকে, না তাকিয়ে থাকা যায়? সে চোঁখ নামিয়েই নেয়, আমি চেয়েই থাকি।

ঘোর ভাঙ্গল “এই যে আপা “ডাক শুনে। তার পাশে এক রিক্সা ওয়ালা দাড়িয়ে আছে,সেই ডাকছে। আমি রিক্সাওয়ালার দিকে তাকালাম। সে বলল,কোথায় যাবেন?আমি বললাম-শাহবাগ। সে বলল-ওঠেন। আমি ওঠে বসলাম। খুব রাগ লাগছিল রিক্সা ওয়ালার প্রতি আর একটু পর আসলে কি এমন ক্ষতি হত। আরেকটু সময় নিয়ে ভালোলাগার মানুষটিকে দেখতে পারতাম।

বরাবরের মতো আজও বেলকনিতে বসে, গেটের দিকে তাকিয়ে আছি। মুহিব ছেলেটিকে আজ কেন যেন,বিভ্রান্ত মনে হল। সে আজ হেঁটেই চলে গেল কোন প্রকার অপেক্ষা করল নাহ্ রিক্সার জন্য।

শনি,সোম, বুধবার চলে গিয়ে শনিবার আবার আসে,আমার ভালো লাগা মানুষটি আর ওই রাস্তার ওপাশে এসে দাড়ায় নাহ্। ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি,মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার পরিক্ষা চলছে। আমি ভেবেছিলাম হয়ত পরিক্ষার পর আবার আসবে সে। তখন প্রান ভরে দেখবো তাকে। চশমা খুলে নিলে তাকে কিরকম দেখতে লাগে সেটাও খুব দেখায় ইচ্ছা আমার। কিন্তু এক ফাইনালের পর অন্য ফাইনাল প্রায় এসে পড়ে,তার আর দেখা মিলে নাহ্।

ভালোবাসাটা এতে ঝুকেঁ পড়েছিল আমার উপর তা আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলাম তাকে দেখতে না পেয়ে। দিনপরে দিন যায় মুহিব ওই রাস্তার এসে দাড়াঁয় নাহ্।

যতবার আমি বেলকনিতে গিয়েছি আমার চোঁখ চলে গিয়েছে রাস্তার ওপাশে। কিছুটা চাতক পাখির মত খুঁজেছি তাকে। আমি বারবার কেঁদে ওঠি তাকে দেখতে না পেরে।

সময় চলে যায়,ছায়া আবছায়ার মত করে । নিজেকে গুছিয়ে নেই,কিছুটা মানিয়ে নিতে শিখে যাই,বেলকনিতে যেতে ভুলে যাই,পড়াশুনার মনোযোগী হয়ে ওঠি।

আমার অনার্স ৩য় বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হয়েছে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে পারিবারিক ভাবে। বাবা একদিন ডেকে নিয়ে বলল-তোর পছন্দের মানুষ আছে?
আমি কিছুক্ষন নিরব হয়ে ছিলাম-আসলেই কি আমার পছন্দের মানুষ আছে?তার উওর আমার জানা নেই। আমি নিরবতা ভেঙ্গে বলছিলাম -নাহ্। বাবা একটা ছবি দিয়ে বলল-দেখতো পছন্দ হয় কিনা?বিসিএস কেডার (প্রশাসন)। দেখতে গিয়ে ম্নান হয়ে যাই। বাবা বলতে থাকে -কাল দেখা করে আসবি। আমার রাগ ওঠে। আমি উচ্চস্বরে বলতে থাকি ছেলে আমার পছন্দ হয়নি। কাল আমি যেতে পারবনা।

কিছুটা ইচ্ছা আর অনিচ্ছা ভেড়াজাল ভেঙে দাড়িয়ে প্রতিক্ষা নয়,অপেক্ষা করছি বাবার দেওয়া ছবিটির মানুষটার জন্য। খুব বৃষ্টি তাও আমি রেস্টুরেন্টে যায়নি,রাস্তার দাড়িয়ে আছি। মানুষটি কাক ভেজা হয়ে আমার সামনে এসে দাড়াঁয়। আমি দুচোঁখ ভরে দেখতে থাকি। মিলাতে থাকি আমার ভালোলাগা মুহিব ছেলেটি আর বিসিএস কেডার মুহিব ছেলেটির সাথে। সুন্দর-খুদ সবই ধরা পড়ে আমার চোঁখে। মোটা হয়েছে খানিকটা,চশমার গ্লাসটিও আগের থেকে অনেক মোটা। আগের সেই বড় বড় চুল নেই, ছোট ছোট করে কাঁটা।সুন্দরও হয়েছে খানিকটা।

সে বলতে শুরু করে-জানো তোমাকে দেখেছিলাম যেইদিন কি এক ভালোলাগা ছুয়ে গিয়েছিল,তা আমার জানা নেই। আমি চারতালা বাসার তিনতলাতে,রাস্তার পাশের রুমে আমি পড়াতাম। জানলা দিয়ে তোমাকে দেখতাম,পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে। গেট দিয়ে বের হতে হতে,চশমা ঠিক করতে করতে, তোমার দিকে তাকাতাম। তুমিও আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে। একদিন দেখলাম তুমি আজ আসনি বেলকনিতে,আমি জানি কেমন,অস্থির হয়ে গেলাম। গেটে বের হয়ে বেলকনির দিকে তাকালাম,তাও তুমি নেই। পরে বুঝতে পারলাম,কেউ কাছেই দাড়িয়ে আছে। তোমার স্বচ্ছল চেয়ে থাকা দেখে,আমি বুঝতে শুরু করি-আমাকে তোমারও ভালো লাগে।

কিছুদিন পরই আমার প্রিলির রেজাল্ট দিল। আমি অকৃতকার্য হলাম। পরে বুঝতে পারলাম,এভাবে চললে হবে নাহ্। তাই টিউশনিটা ছেড়ে দিলাম।

-আমি নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে তার কথা শুনছি। বৃষ্টির শব্দ আর তার কথা কেন যেন, আমার নিশ্চুপতা শুষে নিচ্ছে।

সে আমার কোন উওর না পেয়ে আবার বলতে শুরু করে-আমার কাছে ভালোবাসাটা হল,ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে জীবনে শেষ অধ্যায়টা লেখা। তাই সব কিছু বাদ দিয়ে আমি পড়াশুনার মনোযোগী হই। তৃতীয় বারের সময় আমি সফল হই।

-তখন আমি নিশ্চুপ কিছু বলছি নাহ্। সে ধীর পায়ে এসে কাছে দাড়ায়। আমি তার চোঁখে চোঁখ রাখলাম ,তার চোঁখের কুটরে বিষ্ময়ের আভা ।

সে নিঁচু স্বরে বলল,আমাকে তোমার করবে?কেবলই তোমার?

-আমার এমন একটা ভাব যেন তাকে চিনিই নাহ্। আমি মৃদু স্বরে হেসে বললাম,উম্মাদ
নাকি?

মানুষটা মাথা নিঁচু করে বলল,নাহ্।

-আমি বললাম,ইচ্ছে হলে এভাবে অন্যের
হওয়া যায় নাকি?

সে বলল, চেষ্টা করলে মনে হয়
পারবে?

-অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললাম,আমি
চেষ্টা করব কেন?

সে অতি আগ্রহের সহিত
বলল,ভালোবাসি তাই।

প্রতিক্ষার কল্পনাগুলো আমাকে চেপে ধরেছে। অামি উওর দিলাম নাহ্।

সে আবার বলল,এই যে শুন?

-জি বলেন?

আমাকে একটু ভালোবাসা দিবে?

আমি যে খুব ক্লান্ত।

-আমি কেবল স্বচ্ছ চাহনি নিয়ে
তাকিয়ে ছিলাম।মনে হচ্ছিল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি।

সে যে নাছর বান্দা, তাই বলতেই
থাকল, ভালোবেসে ফেলেছি
কন্যা তোমার খুব করে।

আমার চোঁখে নোনা জল ছলছল করে। পলক ফেলার অপেক্ষা করছে জলগুলো।
তার চোঁখ লাল হয়ে যায়। চশমা ঝাপসা হয়ে যায়। তারপরও সে আলতো স্বরে বলল- খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে,তাই নাহ্?

তার কষ্ট আর আমার সহ্য হয় না। আমি আর আমাকে ধরে রাখতে পারি নাহ্। জড়িয়ে ধরি তাকে। দুজনের চোঁখের জল বৃষ্টির জলের সাথে মিশে যায়। প্রহরের অন্তিমে অবসান হয় প্রতিক্ষার। শুরু হয় নতুন একটি অধ্যায়,নতুন চাওয়া পাওয়া গল্পের সূচনা।

ভালো থাকুক ভালোবাসা,

ভালো থাকুক ভালোবাসার মানুষগুলো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত