আবীরের সাথে আমার ডিভোর্সের ঘটনা পরিচিতমহলে এতটা রসালো বিষয়বস্তু হিসেবে পরিচিতি পাবে জানা ছিল না।কাছের বান্ধবীরা ফোন করে,
– অন্য কারো সাথে ভাইয়ার অ্যাভেয়ার ছিল?
-না। আর থাকলেও আমার জানা নেই।
– লাভ ম্যারেজ, কি দারুণ কাপল ছিলি। এভাবে তোদের রিলেশন ভেঙে যাবে ভাবতেও পারি নি।অাই অ্যাম সরি, ইমা।
-মিউচুয়াল ডিভোর্স।দুজন একসাথে সিদ্ধান্ত নিছি।দুঃখিত হবার কিছু নেই, রাখছি এখন।
ঠিক এভাবে আমি প্রতিটা ফোনকলের উত্তর দেই। আত্মীয়স্বজনের ফোন পারতপক্ষে রিসিভ করি না।তারা ফোন করেই আবীরের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার শুরু করে। ব্যাপারটা অসহনীয়। আবীর আহমেদ, পাঁচ বছর ধরে যে মানুষটা আমার ভিতর বাহির জড়িয়ে ছিল সম্পর্কে ফাটল ধরাতে তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ চলে যাবে, এমনটা ভাবার কোনো মানে নেই।
ডিসেম্বরের প্রচণ্ড শীতে আবীরের সাথে আমার পরিচয়। সে বছর অসহনীয় শীত পরেছিল।মানুষটা শীত ভালোবাসত।শীতের প্রকোপে পাতলা টিশার্ট গায়ে একটু একটু কাঁপত। ঘুম ঘুম শীত ভোরে শহরের গণ্ডি পেরিয়ে দুজন গ্রামের রাস্তায় রিকশায় ঘুরতাম। অপরিচিত পথিক ডেকে প্রশ্ন করত,
-আচ্ছা ভাই, খেজুরের রস কই পাওয়া যাবে কন তো? এবছর এখনো খেজুরের রস খাওয়া হল না!
ঠিক ২৪ বছর বয়সে আমি ওর প্রেমে পরলাম।যাকে বলে কিশোরীর মত অন্ধ প্রেম।আবীর আমার চেয়ে ঠিক পাঁচ বছরের বড় ছিল। বিয়ের আগে দুজনের দিনগুলো কাটত বেশ। গৎবাঁধা আরসব প্রেমিকের মত সে বলত না ভালোবাসি, বিয়ে করব। মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁকফোকর এড়িয়ে সে আমার চোখে চোখ রাখত। আমি সেই চোখে ভালোবাসা খুঁজে পেতাম।
দেড় বছর পর দুজনের শোবার ঘর এক হল। এক চিলতে ঘর, একফালি বারান্দা, একটা ছোট্ট সংসার। সারাদিনের অফিস শেষে সে আর অামি ক্লান্ত থাকতাম। সকালে হুটোপুটি করে অফিস যাবার জন্যে তৈরি হতাম।ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় শাড়ি ঠিকঠাক করতাম, পিছন দিক থেকে এসে ফর্মাল পোশাকেই আবীর জড়িয়ে ধরত।
-আমাদের দুজনকে মানায় কিন্তু।
-হুম। দারুণ মানায়।
এইসব খুনসুটি মলিন হতে সময় লাগে নি। বিয়ের তিনবছরের মাথায় আবীরের মনে হতে লাগল, আমাদের মাঝে ভালোলাগা টুকু আর অবশিষ্ট নেই। কথার মারপ্যাঁচে ও চমৎকার বোঝাতে লাগল, আমাদের মাঝে চিড় ধরেছে। দ্বিমত করি নি। যেখানে ঝগড়া নেই সেখানে প্রেম নেই। অতএব দুজনের ঘর আলাদা হল।
ডিভোর্সের কয়েকদিন পর জানতে পারলাম, আবীর কানাডা চলে গেছে। শুনে হেসেছিলাম, কখনই ওর প্রবাস জীবনের সঙ্গিনী হতে চাই নি।ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত এক প্রকার শাপেবর হল।ঠিক তার সপ্তাহখানেক বাদে আমার শরীরে ছোট্ট আরেকটা শরীরের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। নাভির নিচে আলতো করে স্পর্শ করলে বুঝতে পারি, এইখানটায় কেউ একজন জানে। ছোট্ট অথচ প্রাণের স্পন্দন ধিকিধিকি জানান দেয়।
শুরু হল একা এবং আমার সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই। বাবা-মা চাইছিল না ও পৃথিবীর আলো দেখুক। পরিচিত মুখগুলো নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করত, যে সম্পর্কটা ভেঙে গেছে তার চিহ্ন বহন করে কি লাভ। মা মাথায় হাত রেখে বোঝানোর চেষ্টা করত,
-দেখ মা, বাচ্চাটা কোনদিন বাবার আদর পাবে না। মেয়েমানুষের পক্ষে একা একটা শিশুকে বড় করে তোলা অনেক কষ্টের। আমাদের সমাজ সিঙ্গেল মাদার দেখে অভ্যস্ত নয়।তাছাড়া তোর সামনে গোটা জীবন পরে আছে।
হ্যা বা না কিছুই বলতাম না। অফিসের সময়টুকু ছাড়া নিজের ঘরে বন্দী জীবন কাটানো শুরু হল। বন্দী বলা ভুল, ছোট্ট একটা শরীর আমাকে সঙ্গ দিয়ে বেড়াচ্ছে। রাতে ঘুমানোর সময় পেটের কাছে হাত রাখলে আবীরকে কেমন পরাজিত মনে হত। ও আমার কাছ থেকে পালিয়ে অনেক অনেকটা দূরে চলে গেছে।সত্যি কি যেতে পেরেছে! এই এখানটা জুড়ে ওর ছোট্ট একটা অংশ আমায় ঘিরে বেঁচে থাকার স্বাদ পায়।
ঘর ঝাট দিতে গিয়ে ওর পাসপোর্ট সাইজ ছবি পেলাম।দেখলেই বোঝা যায়, অনেক বছর আগের তোলা ছবি। ছবিটা বড় করে ফ্রেমে বাঁধাই করে বেডটেবিলে রেখে দিলাম। সকাল,বিকাল ওর মুখ দেখব। বাচ্চাটা ওর বাবার গঠন পাক। কিছুদিন পর ছোট্ট হাতপায়ের নড়াচড়া জানান দিত, সে বড় হচ্ছে। বাবুটা ওর বাবার গল্প শুনতে চাইত। চোখ বন্ধ করে বর্ণনা দিতাম,
– বেশ লম্বা। বুকভর্তি লোম। নাকের ডগায় তিল আছে। পেটের কাছে লাল তিল, পিঠে কয়েকটা লাল তিল। চশমা পরলে একরকম চশমা খুললে আরেকরকম।
-তোমাকে বকত খুব?
-উহু । রেগে গেলে নিশ্চুপ হয়ে যেত।তিন-চারদিন আমার সাথে কথা বলত না।সে সময় খারাপ লাগত খুব।
-আর কি করত?
-ভীষণ বই পড়ত। বই পড়ার সময় ডাকলে ভীষণ বিরক্ত হত।
মে মাস। গরমে সারারাত হাসফাঁস করে কাটাতাম। আমার এত গরম ছিল না। বাচ্চাটা পেটে আসার পর প্রচণ্ড ঘাম হয়। ও হয়ত বাবার মত হবে। আবীর ফ্যানের নিচে দরদর করে ঘামত। আয়নায় তাকিয়ে দেখি, চোখের নিচে কালি জমছে। তলপেট একটু একটু করে ফেঁপে উঠার সাথে সেনসেটিভ অঙ্গগুলোতে মেদ জমা শুরু হয়েছে।মায়েদের চেহারায় এক প্রকার সুখী সুখী ভাব খেলা করে সেই সুখের কাছে দুনিয়ার আর সব সুখ বৃথা।
ছয়মাসের মাথায় অঘটন ঘটল। আমাদের পুরানো আমলের বাথরুম। মেঝেতে সারাক্ষণ পিচ্ছিল থাকে। আমি পা টিপে টিপে যতটা সম্ভব সাবধানে বাথরুমে ঢুকি। তারপরও একদিন পা হড়কে পরে গেলাম।
জ্ঞান ফিরল ২৮ শে জুলাই।মাঝখানে ৩৬ ঘণ্টা কেটে গেছে। স্যালাইন চলছে। হাত-পায়ে জোর নেই।হাসপাতালের সাদা বেডে শুয়ে অনুভব করলাম, ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগছে।
ছোটখাট গড়নের হাসিখুশি চেহারার মহিলা ডাক্তার। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আমার জ্ঞান ফিরেছে শুনে দেখতে এল। পালস দেখে বললেন,
-ইয়াং লেডি, তুমি আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। দুই ব্যাগ রক্ত লেগেছে। এই বয়সে এত দূর্বল শরীর! ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবে এখন থেকে ।
-আমার বাচ্চাটা?
কপালে হাত রেখে বললেন,
-আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করো যে তোমার জ্ঞান ফিরেছে। বেঁচে থাকলে বেবি নেবার অনেক সময় পাবে, মা।
উনি চলে গেলে মনের অজান্তে কয়েক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পরল,
-আবীর,আমি পারলাম না।