শ্রাবণ মেঘের দিন

শ্রাবণ মেঘের দিন

ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো বাড়িয়ে এক পা দু’পা করে ও হেঁটে আসছে আমার কাছে। আধো স্বরে বা বা (বাবা) বলে ডাকছে।
আর আমি অপলোক দৃষ্টিতে আমারএকবছরের ছোট্ট মেয়েটাকে দেখছি।সত্যি আল্লাহর সৃষ্টির কোনো তুলনা হয়না ! একটি প্রাণের ভিতর থেকে আরেকটি প্রাণের সৃষ্টি !
পৃথিবীতে সন্তানের থেকে বেশি সুন্দর মনে হয় আর কিছুই হয় না।

শ্রাবণী আমার মেয়ের নাম।দেখতে অবিকল আমার মতো হয়েছে।ওর হাতের আঙ্গুলগুলো ওর মায়ের হাতের আঙ্গুলের মতো লম্বা।হাসিটাও নীলা’র মতো। তবে মেয়েটা আমার ভীষণ রাগী।অবশ্য, রাগটা আমারই পেয়েছে।
নীলা শ্রাবণীর মা।

গত দুবছর আগে আমি আর নীলা বিয়ে করি।আমাদের বিয়ে এবং দেখা হওয়াটা ছিলো বড্ড কাকতালীয়। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা।

১৯৯৩-১৪-০৭,

সময়টা ছিলো বর্ষাকাল।বৃষ্টির ফোটায় মুখরিতো চারপাশ।মনে হচ্ছে বর্ষার আবরণে গাছপালা ক্রমশ সতেজ হচ্ছিলো। অবশ্য বর্ষায় রাস্তাঘাটে চলাচল করাটা বড্ড অসুবিধাজনক।

সেদিন হালকা রোদ্দুর দেখে আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছাতা নিয়ে বের হইনি।আপনমনেই রাস্তাধরে হাঁটছিলাম,আর গুনগুন করে ঐ গানটি গাইছিলাম,

ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়োনা।
আমার এত সাধের কান্নার দাগ ধুয়োনা।
সে যেন এসেই দেখে,
পথ চেয়ে তার কেমন করে কেদেছি?

হঠাৎ আবার চারপাশ মেঘলা হয়ে বৃষ্টির আগমন ঘটলো।বুঝেন তো বর্ষার বৃষ্টি,যখন তখন ঝরে পড়ে।আমার মাঝরাস্তায় শুরু হলো বৃষ্টি।কোনো উপায় না পেয়ে একটা বাড়ির সামনে নিরাপদ স্থানে দাঁড়ালাম।যেনো বৃষ্টির ফোটাগুলো আমায় স্পর্শ করতে না পারে।কিন্তু বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দে বেশ উতলা লাগছিলো।বৃষ্টির ফোটাগুলোকে গায়ে মাখতে ইচ্ছে করছিলো।কিন্তু অফিসের কাজটা শেষ না করে এই বৃষ্টিতে ভিজা যাবেনা।তারপরেও বৃষ্টিতে হালকা ভিজে গিয়েছিলাম।আবহাওয়াটা ছিলো ভীষণ শীতল।অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি।বৃষ্টি অনবরত বাড়ছে বৈ কমছেনা।আমার ভীষণ ভালো লাগছিলো।কিন্তু কাজ শেষ করার আশা নিয়েই বৃষ্টির সমাপ্তি ঘটার অপেক্ষায় আছি।

হঠাৎ বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পরা একটা মেয়েকে দেখলাম।রিকশা থেকে নামছে।কিন্তু প্রায় অর্ধেকটা ভিজে গেছে।মেয়েটা রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে গিয়ে এবার পুরোটা ভিজে গেছে।ভাড়া মিটিয়ে আমি যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি তার বিপরীত পাশের বাড়িটাতে ঢুকে গেছে।

নাহ্, আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নাই।বৃষ্টি কমবে বলে মনে হয় না।অনবরত বেড়েই চলছে।একটা অটো ধরে অফিসে চলে গেলাম।যেভাবে হোক কাজটাতো শেষ করতে হবে।

তারপর প্রায় রাস্তাদিয়ে যাতায়াতের সময় ঐ বাড়িটার দিকে খেয়াল করতাম।যদি মেয়েটার সাথে আরেকবার দেখা হয়ে যায় ঐ আশায়।

আসলেই নারীদের শাড়িতেই বেশ মানায়।আচ্ছা, ঐ মেয়েটা কি সবসময় শাড়ি পরে? নাকি শখ করেই পরে? তবে সেদিন মেয়েটা কপালে টিপ পরেনি।এই ব্যাপারটা আমি ভীষণভাবে খেয়াল করেছি।টিপ পরলে হয়তো আরো বেশি সুন্দর লাগতো।আচ্ছা,বাসন্তী রঙের শাড়ির সাথে কোন টিপটা ভালো লাগতো? আর মেয়েটা চোখে গাঢ় কাজল দিয়েছিলো।শাড়ির সাথে গাঢ় কাজলটাই কি ম্যাচ করে? আসলে এই মিলকরন ব্যাপারটা বড্ড কঠিন।এই জিনিসগুলো আমি সহজে মিলাতে পারিনা।কোনটার সাথে কোনটার ম্যাচ হবে সেটা নিয়ে বড্ড বিব্রতবোধ হয়।এইসকল কথা আমি রাস্তায় হাঁটছি আর ভাবছি।

-ফারিয়া রিকশা ধরে বসো মা।নতুবা পড়ে যাবে।রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।এগিয়ে আসা একটা রিকশা থেকে কথাগুলো স্পষ্ট ভেসে এসে আমার কানে লাগছিলো।আমি নিচু মাথা উঁচু করে, চশমাটা হাত দিয়ে নাড়িয়ে চোখের উপর ঠিক জায়গায় বসিয়ে, রিকশায় তাকাতেই হঠাৎ মেয়েটাকে দেখলাম, একটা বাচ্চাকে পাশে নিয়ে রিকশায় করে বাসায় ফিরছে।আজও ওর পরনে শাড়ি ছিলো।আজকের শাড়িটার কালারের দিকে খেয়াল করিনি।আজ কেবল মেয়েটার চেহারায় প্রকাশিত ভাষা বুঝতে চেষ্টা করেছি।
তবে কি মেয়েটা বিবাহিত ? এটা ওর-ই বাচ্চা ?

আমার জাগ্রত কিছু ইচ্ছে হঠাৎ নুয়ে পড়লো।ওরাও বুঝতে পেরেছে আর আশা বাড়িয়ে লাভ নেই।মেয়েটাকে একঝলক দেখেই আমার ইচ্ছেগুলো পুরোপুরি জীবিত হওয়ার আগেই মৃত্যু তাদের বরণ করে নিয়েছে।আর আমি কেবল নীরব দর্শক হয়ে অনুভব করেছিলাম।খুব বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম।
আসলে ভালোবাসতে যুগ লাগেনা।ব্যাস,একটা মূহুর্তই যথেষ্ট।যার ফলে ঐ মেয়েটাকে মনের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

তারপর থেকে রোজ দেখতাম মেয়েটা বাচ্চাকে নিয়ে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরতো।বাচ্চাটা বোধহয় পাশে কোনো স্কুলে পড়তো।জানার আগ্রহ ছিলো মেয়েটার সম্পর্কে কিন্তু কোনো উপায় ছিলোনা।কারণ রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে অপরিচিত কোনো মেয়ের সাথে কথা বলাটা কেমন বখাটে টাইপের হয়! তাই কখনো মেয়েটার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি।তবে মেয়েটাকে আড়চোখে দেখতাম।আবার মাঝেমাঝে এড়িয়ে যেতাম।ভয় হতো।হয়তো মেয়েটা আমার লুকোচুরি ধরে ফেলবে।

এভাবে প্রায় বছর ঘনিয়ে আসলো।কিন্তু কেউ জানতেই পারলোনা, তাকে দেখার জন্য একটা ছেলে রোজ তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করতো।একটা ছেলে রোজ তাকে আড়চোখে দেখতো।তার এই দেখার মাঝে ছিলো অকৃত্রিম ভালোবাসা।

সময় তার নিজ গতিতে চলছে, আর তার স্রোতে ভেসে যাচ্ছি আমরা অসহায় মানুষেরা।আমার মনে হয় পৃথিবীতে সময়ের চেয়ে বেশি স্বার্থপর আর কিছুই হয়না।

-বাবা,
চোখটা বন্ধ করোতো।(শ্রাবণী)
-কেনরে মা? হঠাৎ চোখ কেন বন্ধ করবো?
-আহা বাবা,চোখটা বন্ধ করো।এত্ত প্রশ্ন করো নাতো।
-চশমা খুলে বন্ধ করবো নাকি চশমা পরা অবস্থায়?
-না বাবা,মোটা ফ্রেমের চশমাটা তুমি খুলোনা।এটা মায়ের দেওয়া উপহার।এটা পরেই চোখ বন্ধ করো।তাহলে মাও তোমার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করবে।
-মেয়েটা আমার কান্নাভেজা গলায় কথাগুলো বলছিলো।মেয়ের কথামতো মোটা ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়েই তার মাঝে লুকিয়ে থাকা অশ্রুসিক্ত চোখদুটো আমি বন্ধ করি।
হঠাৎ আমার হাতে শ্রাবণী একটা ডায়েরি তুলে দিলো।আমি চোখ খুলে ডায়েরিটা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখলাম আর ভাবলাম এটাতো নীলার ডায়েরি।
আমি কৌতুহল দৃষ্টিতে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে আছি।জানার ইচ্ছা দুচোখ বিদ্ধমান।শ্রাবণী এই ডায়েরি কোথায় পেলো?
মেয়ে হয়তো আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছে।কিন্তু আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছে। আর বলছে,
-বাবা,এই ডায়েরি কোথায় পেয়েছি, সেটা তোমাকে পরে বলবো।আজ একদম কাদবেনা।কারণ আজ তোমার আর মায়ের ২৩তম বিবাহবার্ষিকী।

হ্যাঁ। আজ ২৩ট বছর অতিবাহিত হলো।নীলার সাথে আমার সংসার জীবনের ২টি বছরের স্মৃতি নিয়ে আমি ২৩টা বছর পার করলাম।আমার ছোট্ট শ্রাবণী আজ কত বড় হয়ে গেলো।কিন্তু নীলার মতো হলোনা মেয়েটা।শুনেছি মেয়েরা নাকি বাবার মতো হলে ভীষণ লক্ষী হয়।আমার মেয়েটাও অনেক লক্ষী।

শ্রাবণী হয়তো আজকের দিনটাতে আমায় অনেক সারপ্রাইজ দিবে তাই নিয়ে ব্যস্ত।
আর আমি আবার বারান্দার ছোট্ট বেতের চেয়ারটাতে বসে, মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখে মোটাফ্রেমের চশমাটা সরিয়ে গড়িয়ে পড়া দুফোটা অশ্রু মুছে চশমাটা ঠিক জায়গায় বসিয়ে আবার ভাবনার সাগরে ডুব দিলাম।

বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা মেয়েটার একটা নাম দিয়েছিলাম।নামটা ছিলো “বাসন্তী “।
হঠাৎ বাসন্তীকে রাস্তায় আর দেখলাম না।ভাবলাম হয়তো অসুস্থ, তাই আজ আর বের হয়নি।ভাবছি,
আচ্ছা মেয়েটা কি খুব অসুস্থ? ওর নিশ্চয় খুব কষ্ট হচ্ছে? আমি কি ওকে দেখতে যাবো? ধুর,কি ভাবছি? কিন্তু আমার এতো উতলা লাগছে কেন?

ঐ দিনটি আমার খুব খারাপ কেটেছিলো।তারপর থেকে আর বাসন্তীকে আমি দেখতে পেলাম না।আমার এক একটি দিন মনে হচ্ছে এক একটি যুগ।দিনগুলো পার ই হচ্ছেনা।

বাসা থেকে ফোন আসলো।খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য মা ফোন দিয়েছে।উনারা নাকি আমার জন্য মেয়ে দেখেছে।সব ঠিকঠাক। আমি কেবল গিয়ে বিয়ে করবো।
বড্ড আজব, তাইনা? হু,আজব তো হবেই।কারণ আমি কেন পরিবারের কেউ মায়ের উপর কোনো কথা বলেনা। সুতরাং বিয়েতো করতেই হবে।যেখানে মা নিজে ফোন করে বলেছে সেখানে নিষেধ করার মতো আর কোনো উপায় নেই।
কিন্তু বাসন্তী?
ও তাহলে আমার ঝরে পড়া বর্ষার একটি মূহুর্ত? যাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবেনা।যে ক্রমশ বৃষ্টির ফোটায় মিশিয়ে যাচ্ছে অথৈ পানির স্রোতে।বাসন্তী, কিছুই জানিনা মেয়েটার সম্পর্কে!তবে কি আমার ক্ষুদ্র জীবনে বাসন্তী একটি রহস্য হয়েই রয়ে গেলো?

মায়ের আরেকটা ফোনকল,
-শ্রাবণ, তুই কবে ফিরছিস বাবা?(আমার নাম শ্রাবণ)
-এইতো মা।গোছগাছ করছি।আজ রাতের ট্রেনে ফিরছি।
-আচ্ছা।

ব্যাস,মা ফোন রেখে দিয়েছে।আমি আমার অদৃশ্য অস্তিত্বটা বাসন্তীর বাড়ির বিপরীতে যে বাড়িটা ওখানে দাঁড় করিয়ে রাতের ট্রেন ধরার জন্য ক্রমশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে এগুচ্ছি।

প্রায় সারারাত জার্নি করার পর নিজ গন্তব্যে পৌঁছালাম।সবাই ভীষণ খুশি আমার বিয়ে নিয়ে।মোটামুটি সবকিছুই কমপ্লিট।

আজ কিছুক্ষণ আগে আমার আর অপরিচিতার বিয়ে হয়েছে।অপরিচিতা বলে আখ্যা দিয়েছি কারণ আমি উনার নামটা জানতাম না।আমি ক্রমশ অপরিচিতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।ভীষণ অস্বস্তি লাগছে।কি বলবো? হয়তো অপরিচিতারও আমার মতো অবস্থা হচ্ছে।নীরবতা কাটাতে অপরিচিতাকে বললাম,

-আচ্ছা অপরিচিতা একটা প্রশ্ন করি? তার আগে বলে নেই।অপরিচিতা নামে ডেকেছি কারণ আপনার নামটা আমি জানিনা তাই।
-জ্বী আচ্ছা।অপরিচিতা নামটা সুন্দর।রবীন্দ্রনাথের অপরিচিতা। ভালো লাগলো আপনার দেওয়া নামটা।
আমি নীলা।আপনার প্রশ্নটা করুন।(অপরিচিতার কন্ঠে ভেসে আসলো)
-ধন্যবাদ।
আমি শ্রাবণ।আর হ্যাঁ, প্রশ্নটা হলো,
ভালোবেসেছেন কখনো কাউকে?
-হু।অবশ্যই।ভালোবাসাহীন মানুষ বাঁচে? যে বাঁচে তাকেতো রোবট আখ্যা দেওয়াটাই উচিৎ।
-জ্বী। (মনে হচ্ছে প্রশ্নটা করা বোকামি হয়ে গেলো।মনে মনে ভাবছি।)
-আপনার প্রশ্নটা বলুন, শ্রাবণ।
-মেয়েটা কি করে জানলো যে এটা আমার প্রশ্ন নয়।এর জন্যইতো হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,
মেয়েদের তৃতীয় নয়ন থাকে।যার দ্বারা সে অনেক কিছু বুঝতে পারে।
আসলে অপরিচিতা আমি আপনাকে একটা বিষয় শেয়ার করতে চাই।
-জ্বী অবশ্যই।বলুন আপনি।
-ঠিক আছে।
ভাবছি কিভাবে শুরু করা যায়? বা উনি কিভাবে নিবেন?
নাহ্, এভাবে ভাবতে থাকলে আর বলা হয়ে উঠবেনা।
ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে বলে ফেললাম,
জানেন অপরিচিতা আমি গত দেড়বছর যাবত একটা মেয়েকে দেখছি।অনুসরণ করছি বললে ভুল হবে।তবে একপলক দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম।অবশ্য তার সাথে সবসময় একটা বাচ্চামেয়েকে দেখতাম।হয়তো বাচ্চাটা উনার মেয়ে ছিলো।
-আপনি জিজ্ঞেস করেন নি?(নীলা)
-না,কারণ ব্যাপারটা আমার কেমন জানি লাগতো।রাস্তায় একটা মেয়ের রিকশা দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করাটা আদৌ উচিৎ হতো? তাই কখনো মেয়েটার মুখোমুখি হইনি।তবে মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লাগতো।জানেন আমি উনার একটা নাম দিয়েছি,”বাসন্তী “।
-আচ্ছা।বাসন্তী দেওয়ার কারণ?
-কারণটা হলো একটি #শাবণ_মেঘের_দিন ।
সেদিনের ঘটনা পুরোটা আমি অপরিচিতাকে ব্যাখ্যা দিয়েছি।
কিন্তু জানেন তখন পর্যন্ত আমি অপরিচিতার মুখটা দেখিনি।আমার কথার শেষ মূহুর্তে অপরিচিতা নিজ থেকেই মাথায় আটকিয়ে রাখা দোপাট্টা খুলে ফেললো।আর এক মূহুর্তের জন্য আমি থ হয়ে গেলাম।নীরবতা কাটিয়ে বলেই ফেললাম, “বাসন্তী “!
মেয়েটা একটা রহস্যঘেরা হাসি দিয়ে আমার দিকে কাজল পরিহিত চোখে তাকিয়ে আছে।তার দৃষ্টিশক্তি কেবলই আমাকে তার দিকে অগ্রসর করছে।কারণ অপরিচিতা-ই আমার সেই বাসন্তী।

পরে অবশ্য জানতে পারি বাচ্চা মেয়েটা বাসন্তী’র নয়।এটা ওর বোনের মেয়ে ছিলো।বাচ্চাটা যখন খুব ছোটো তখন একটা রোড এক্সিডেন্টে ওর বোন মারা যায়।তারপর থেকেই বাচ্চাটাকে বাসন্তী লালন পালন করে।বাসন্তী’র বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাচ্চাটাকে ওর বাবা নিয়ে যায় দেশের বাহিরে।কারণ উনি দেশের বাহিরে-ই থাকন।বাচ্চাটার নাম ছিলো ফারিয়া।

নীলার সাথে আমার সংসার জীবনটা দিব্য কাটছিলো।মনে হতো পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী দম্পতি ছিলাম আমরা।

সংসার জীবনের ২বছরের মাথায় আমাদের ঘর আলো করে শ্রাবণী আসে।কিন্তু শ্রাবণীকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর জন্য আমার নীলা পৃথিবী ত্যাগ করে।

-বাবা,তুমি আবারও কাদছো?
-কই নারে মা।ঐ মনে হলো চোখে কিছু পড়েছে।
-বাবা তোমার চোখে চশমা দেওয়া।তাহলে চোখে কি করে কিছু পড়বে? চল বাবা, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
-আপনাদের আগেই বলেছিলাম,শ্রাবণী নিশ্চয় আমাকে সারপ্রাইজ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আজ আবার সারপ্রাইজ?
-হ্যাঁ বাবা,কারণ আজকের দিনটা একটি বিশেষ দিন।তোমার আর মায়ের ২৩তম বিবাহবার্ষিকী।
-জানিরে মা।
আচ্ছা চল্।দেখি তোর কেমন সারপ্রাইজ আমার জন্য,অপেক্ষা করছে?
-শ্রাবণী আমাকে নিয়ে নীলার কাছে গেলো।মানে নীলার কবরের সামনে। আমি আর শ্রাবণী বাবা মেয়ে দু’জনে গেলাম।
নীলার কবরের সামনে গিয়ে আমি নীলাকে নতুনরুপে দেখতে পেলাম।
সত্যি এমন সারপ্রাইজের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।চশমাটা মনে হয় চোখ থেকে সরে গেছে।তাই ঝাপসা দেখছি।নতুবা নীলা কি করে ফিরে আসবে? এইভেবে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমালটা বের করে চশমার ফ্রেমটা ভালো করে মুছলাম।
তারপর চশমাটা চোখে দিয়ে আবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালাম।
আমি এবার সত্যি মাত্রাতিরিক্ত অবাক হলাম।এতো সত্যি নীলা।
ভুল করে মুখ ফসকে মুখ দিয়ে ছোট্ট করে “নীলা” বেরিয়ে গেলো।
-না বাবা,উনি “মা ” নয়।
-আমি মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
-বাবা উনি “ফারিয়া” ।
আমার মায়ের জীবনের প্রিয় একজন মানুষ।
-ফারিয়া !! (তার মানে এতো সেই বাচ্চা মেয়েটা।যে ছোটোবয়সে মা’কে হারিয়েছে।
যাকে নীলা লালনপালন করেছে।আমাদের বিয়ের পর মেয়েটাকে নিয়ে ওর বাবা দেশের বাহিরে চলে যায়।তারপর নীলা থাকতে ওর সাথে ফোনে কথাবার্তা হতো।কিন্তু নীলা চলে যাওয়ার পর আমি আর কখনো যোগাযোগ করিনি।
ফারিয়া দেখতে অবিকল নীলার মতো।)

-ভালো আছেন আঙ্কেল?
-হ্যাঁ মা। ভালো। তুমি কেমন আছো? আর কবে ফিরেছো?
-আমি ভালো। গত পরশু এসেছি আঙ্কেল।ছোটো আম্মুকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো।তাই আমার বরের সাথে এসেছি।
-ওহ্ আচ্ছা।

কিছুক্ষণ কথা বলার ফারিয়া ওর বরের সাথে চলে গেলো।আর আমি পেছন থেকে তাকিয়ে আছি।ওরা অনেকটা দূরে চলে গেলো।আমি নীলার কবরের দিকে তাকিয়ে আছি।
-বাবা,আমাকে ডায়েরিটা ফারিয়া আপু দিয়েছিলো।তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো তার জন্য তখন বলিনি।
-আচ্ছা।আমি আর শ্রাবণী বাসন্তী’র কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ,
চারদিক মেঘলা হয়ে বৃষ্টির আগমন ঘটলো।
সেই প্রথম দিনের মতো।

চলো বাবা, এবার বাসায় যাই।
নীলার থেকে বিদায় নিয়ে চলছি সেই স্মৃতিঘেরা আমার ছোট্ট বাসায়।
আজকের বৃষ্টিতে সেই পুরোনো দিনের মতো গানটা গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম,

ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়োনা।
আমার এত সাধের কান্নার দাগ ধুয়োনা।
সে যেন এসেই দেখে,
পথ চেয়ে তার কেমন করে কেদেছি?

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত