কড্ডাশিনি

কড্ডাশিনি

‘নিশির ডাক সম্বন্ধে তোমরা কেউ কিছু জানো কি?’

‘এই মরেচে। আজ যে একেবারে শুরু থেকেই ঘন গুলের ধোঁয়া!’ বিজুদার প্রশ্নের জবাবে সুদীপের জনান্তিক মন্তব্য অনেকেরই কান এড়ালো না।

বিজুদার কিন্তু উষ্মা নেই। বেশ হাসিহাসি মুখ করে বললেন, ‘বাপু হে, এই ভরা বাদরসন্ধেয় ভুতুড়ে অলীক গপ্পো ছাড়া আর কী জমবে?’

সত্যিই, মধ্যশ্রাবণের সপ্তাহান্তে আজ এই শনিবার সকাল থেকেই ঘন বাদলে ছেয়ে আছে উত্তরভারতের আকাশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামলো, বর্ষণ কমার নাম তো নেইই বরঞ্চ বেড়ে চলেছে তা উত্তরোত্তর। আমাদের ফ্ল্যাটের প্রশস্ত ব্যালকনিতে ঠাঁই পড়েছে তাই আজ আমাদের এই সন্ধেয়। না, সামনের শেডটির জন্যে বৃষ্টির ছাঁট এখানে বেশি আসে না, যদিও দূরের গাছপালা রাস্তা ইত্যাদি অবলোকনের অসুবিধে নেই এই পাঁচতলার বারান্দা থেকে।

নীতিন বললো, ‘হ্যাঁ, আমার দাদিমার মুখে গল্প শুনেছি বটে ছোটবেলা… আমার মামাবাড়ি রাজপুতানার চুরু জেলায়… কমলনী দাঈ ছিলো, সে জলে ডুবে…। রাতবিরেতে ডেকে ডেকে বেড়াতো, কার ঘরে খোকা হলো…

তুই থাম্ নীতিন, দাদাকে বলতে দে নিশির ডাকের গল্পটা,’ প্রফেসর সাআব শ্যামলকুমারও আজ দেখছি বিজুদার আষাঢ়ে গল্প শুনতে বড়ো আগ্রহী, এই ভরা শাঁওনে!

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই প্রকার গল্প সারাভারতে শোনা যায়। তিরুনেলবেল্লীতেও শুনেছি…এর কাছ থেকে… ’ সুদীপ বললো।

আমার পুত্র অয়নকুমার অস্থির, বলে, ‘বলো না জ্যেঠু, নিশির ডাক কাকে বলে?’

‘শোনো বাছা, এ আমাদের ছোটবেলা লক্ষ্মীপিসির কাছে শোনা গল্প। আমার বাবা পিসি বলতেন, তার দেখাদেখি আমরাও। রান্না করতেন পিসি আমাদের বাড়িতে। আদত বাড়ি সুন্দরবনের কাছে সন্দেশখালিতে। তাঁর বাবার ছিলো বড্ড মাছ ধরার শখ। রাতবিরেতে উঠে চলে যেতেন তিনমাইল দূরের ডাঙর বিলে, মস্ত মস্ত বোয়াল মাছ পড়তো সেখানে। সঙ্গী ছিলেন তার বন্ধু হাবুকাকা। মাঝরাতে জানলায় এসে টক্ টক্ করতেন, গজেন, ও গজেন, চল্ চল্…তারা যে বড়ো বড়ো ঘাই মারছে… আর লক্ষ্মীপিসির বাপও ধড়মড় করে উঠে ছিপ হাতে হাঁটা দিতেন বন্ধুর সঙ্গে। তা, সে রাতেও অমন জানলায় টক্ টক্। লক্ষ্মীপিসির মা বললেন, হ্যাঁ গা আজ এই তুমুল বিষ্টির মধ্যেও বেরোবে? ‘তুমি থামো’ বলে তাকে ধমকে দিয়ে ছাতা-ছিপ হাতে বেরিয়ে পড়লেন গজেন দাদা। খানিকক্ষণ পরে বৃষ্টিটা একটু ধরে এলে, ফের জানলায় টক্ টক্। গজেন গজেন চল্ চল্…। ধড়মড় করে উঠে বসলেন লক্ষ্মীপিসির মা। সে কি, একটু আগেই যে আপুনি এসে ডাকলেন আর সে মনিষ্যি তো দিব্যি বেরিয়ে পড়লো ছিপ হাতে! খোঁজ খোঁজ পড়ে গেলো! সব পাড়াপড়শী ছুটে এলো লণ্ঠন হাতে। গ্রামের মাতব্বর মুন্সীকাকা বললেন, এ’ নির্ঘাৎ নিশি এসে ডেকে নিয়ে গেছে গজেনকে। অতৃপ্ত প্রেত নিশি এমন পরিচিতজনের কণ্ঠস্বর নকল করে এসে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভুলিয়ে নিয়ে চলে যায়! তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো, কিন্তু আর কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না তেনার… ’

বিজুদা চুপ।

ব্যাস্? হয়ে গেলো গল্প?’ লিলি বললো, বিজুদা শেষ করার এক মিনিট পরে।

বিজুদা চুপ। আমরাও। দূরে কোথাও ক্কড়কড়াৎ করে তুমুল বাজ পড়লো একটা আর বৃষ্টিটাও আবার ঝেঁপে এলো। বিজুদা আনমনে দূরের গাছপালা দেখতে লাগলেন।

আমরা ইঙ্গিতে বুঝলুম, গল্পটা এখনও শুরু হয়নি।

 

এক ঢোঁক জল পান করে নিয়ে বিজুদা বলে চলেনঃ

উত্তরবিহারের পূর্ণিয়া, বুঝলি, সেকালে ছিলো বাঙালীদের এক বর্ধিষ্ণু আবাস। সতীনাথ ভাদুড়ী, ফণীশ্বরনাথ রেণু-জীর মত দিকপাল সাহিত্যিকদের জন্মকর্মস্থান। এককালে আমি বহু গেছি পূর্ণিয়ায়, আমার জ্যেঠিমার বাপের বাড়ি ছিলো সেখানে। মস্ত ক্লাব ছিলো বাঙালীদের, সেখানে দুর্গাপুজো হতো মহা ধুমধাম করে, সঙ্গে বাৎসরিক থিয়েটার বরাদ্দ। জ্যেঠিমার ছোটভাই তপেনমামা ছিলো সে থিয়েটারের হর্তাকর্তা। তা, সেবার হবে বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’। কনকের বাবার চরিত্রটা করার কথা ছিলো যাঁর তিনি হঠাৎ শয্যাগত। তপেনমামা ধরে বসলো আমায়, ‘বিজু, তোকে উৎরে দিতে হবে। এ’তো তোর করা প্লে।’ বললুম, ‘সে তো সেই কবে! পার্ট ভুলে গেছি সব।’ বললো, ‘সে তোকে কিস্যু ভাবতে হবে না। রণেনদা প্রম্পটার, তোকে ঠিক ঠিক ধরিয়ে দেবে’খন।

অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো, বুঝলি, সে রাত্রে। দাড়িওয়ালা দশাসই বুড়ো রণেন ভটচাজ্যি প্রম্পটার। উইংসের পাশ থেকে ধীরগম্ভীরস্বরে প্রম্পট করে যাচ্ছে, স্টেজে অভিনয় করতে করতে সাত হাত দূর থেকে আমার মনে হচ্ছে ঠিক আমার কর্ণকুহরে ঠোঁট ঠেকিয়ে যেন সে কথা বলছে। প্রথমটায় ভড়কে গিয়েছিলুম। পরে মানিয়ে নিয়ে প্লে শেষ করি। শেষ হতে চেপে ধরলুম, ‘বলো রণেনদা, কী করে তোমার ভয়েস অমন করে শুনছিলুম?’ কাষ্ঠ হেসে সে বুড়ো বলে, ‘হইসে হইসে। তোমার পালা তো উৎরে গেসে গিয়া? পরের দিন তপেনমামাকে বলতে সে বললো, ‘বলবো, বলবো এখন তোকে সব।

*

দু’দিন কাটতে না কাটতে সে মামাবাড়িতে বিশাল হুলুস্থুলু পড়ে গেলো এক। কী? না, দ্বারভাঙা মহারাজের এস্টেটের এক খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল জ্যেঠিমার দাদাদের সিন্দুক থেকে চুরি হয়ে গেছে। জ্যেঠিমার বাবা-কাকা-দাদারা পূর্ণিয়ার নামী উকিল ছিলেন। তাঁদের কাস্টডি থেকে এ’হেন চুরি তাঁদের পেশার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। বদনামের ভয়ে থানা পুলিশও করা যাচ্ছে না। বাড়িতে থমথমে আবহাওয়া। কোর্ট খুললেই কেসের ডেট। বেইজ্জতের একশেষ হতে হবে। সকলেই মনঃক্ষুণ্ণ। দু দিন পরেই আমার কলকাতায় ফিরে আসার কথা।

দুপুরবেলায় তপেনমামা আমায় হঠাৎ বললো, ‘বিজু, তুই গাছে চড়তে পারিস্? এ’ আবার কী বেয়াড়া প্রশ্ন?

‘হঠাৎ?’ বললুম, ‘হঠাৎ গাছে চড়ার প্রয়োজন পড়ছে কেন?’

‘চড়তে পারলে তোর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হতো… ’

কথাটা বিরসবদনে বললেও তপেনমামার সুরে উৎসাহী হয়ে উঠলুম ও বিকেল বিকেল দুটো সাইকেল জোগাড় করে দু’জনে বেরিয়ে পড়লুম শহরের অদূরে এক জঙ্গুলে কালীমন্দিরের উদ্দেশ্যে।

স্থান-কাল-পাত্র মামার নির্দেশমত। পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধে হয়ে গেলো। সময় উপযুক্ত ও আগতপ্রায়। সেই ভাঙা মন্দিরের সামনে পৌঁছে ঝোলা থেকে লম্বা ফিতে বের করে কী সব মেপেটেপে মামা বললো, ‘নে, কুইক, বিজু সামনের ঐ জারুল গাছটায় উঠে পড়। সময় হয়ে গেছে।’

অভ্যেস নেই। বহু কষ্টে হাঁকড়পাকড় করে চড়ে বসলুম সে ঝাঁকড়া গাছটার মাঝ বরাবর, বললুম, ‘কেন এ’সব করাচ্ছো বলো তো মামা?’

‘শ্ শ্ শ্ শ্–’ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তারপর মন্দিরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলো তপেনমামা। সেদিকে তাকিয়ে দেখি শ’খানেক মিটার দূরে মন্দিরের দরোজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভিতরে কয়েকটি প্রদীপ জ্বলে উঠেছে আর পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে এক দাড়িওয়ালা আদুড়-গা ধুতিপরা বৃদ্ধ পুজারী ঘণ্টা বাজিয়ে মায়ের আরতি করছে। তা বেশ। তা এটা দেখার জন্যে আবার গাছে চড়তে হলো কেন? তপেনমামাকে শুধোতে যাচ্ছি সেটা হঠাৎ করে এক গম্ভীর পুরুষকণ্ঠের সঙ্গীত ভেসে আসতে লাগলো খুব নিকট হতে। শ্যামাসঙ্গীত। খুব সুরেলা। খালি গলায়। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকিয়েও চতুর্থ কোনো মনিষ্যি নজরে এলো না। যদিও গানটা ভেসে আসছে অতি নিকট থেকে, প্রায় আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে যেন সরাসরি। কখনো তা একটু দূরে চলে যাচ্ছে তো পরক্ষণেই আবার কাছে চলে আসছে। অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর সে সুর। শুনতে শুনতে ঘোর লেগে যায়ঃ “…কালো রূপে দিগম্বরী, হৃদিপদ্ম করে মোর আলো রে…শ্যামা মা কি আমার কালো?”

কতক্ষণ যে সেই সুরে আপ্লুত ছিলাম বলতে পারি না, মিনিট দশেক তো হবেই। ঘোর ফিরে এলো যখন ততক্ষণে সঙ্গীত থেমে গেছে, মন্দিরের ভিতরের আলো নিভে গেছে। তপেনমামা আমায় ঠেলা দিয়ে বললো, ‘নাম এবার।’ কী ঘোরে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম মনে নেই। রাতে শুতে এসে তপেনমামাকে ধরলুম, ‘কী হলো, বলো, মামা আজ সন্ধেয়? কে গাইছিলো ঐ গান? সে কি কোনো অশরীরি?’

‘বুড়োটাকে তো চিনতে পেরেছিলিস?’

‘না, পিছন থেকে ভালো ঠাউর হয়নি।’

‘কেন প্রম্পটার বুড়ো রণেন ভটচাজ্যিকে চিনতে পারলি না?’

‘ওহ্‌, আই সী! উনিই গাইছিলেন, অতদূরে মন্দিরের ভিতর থেকে? মনে হচ্ছিল যে কানের গোড়ায় বসে গাইছেন যেন। আচ্ছা, উনি কি তান্ত্রিক?’

‘তন্তোর-মন্তোর অনেক জানে বুড়ো। তার মধ্যে যে এক সহজ নমুনা আমরা বারংবার দেখেছি তা হলো ওনার দূরে স্বরক্ষেপণ করার ক্ষমতা, যেটা তুইও পরশুদিন স্টেজে অনুভব করেছিস। বুড়ো রণেনদা যেদিন যেদিন অমন অসাধারণ গান করে সেদিন মন্দিরের সামনের ঐ বৃক্ষের ঠিক একটা জায়গায় বসলে তবেই শোনা যায়।’

‘বলো কী তপেনমামা? এ’রকম আবার হয় নাকি?

‘হয় যে, সেটা তো নিজকর্ণে শুনে এলি।’ তপেনমামা বললো।

বিজুদা একটা ব্রেক নিলেন। আমরা চুপ। একটু পরে নৈঃশব্দ ভেঙে অনু শুধলো, ‘মানে ঐ সঙ্গীতটা কি নিশির ডাক ছিলো, দাদা?’

‘কিন্তু ডাকেনি তো সে কারোকে। কেবলই মধুর স্বরে গেয়ে গেছে।’ আমার গৃহিণীর মত।

এ’সব প্রশ্ন এড়িয়ে বিজুদা বলে চলেন, পরের দিন সকালে ফের রৈ রৈ! কী? না সেই দলিল চোর ধরা পড়েছে! সে কী! কে সে চোর? দাদুর খাশ চাকর মঙ্গীরাম, যে কিনা গত পঞ্চাশ বছর এ’ বাড়িতে কাজ করছে এবং সব সন্দেহের উর্ধে, সে-ই কিনা দাদুর আফিঙের নেশার সুযোগ নিয়ে তাঁর পা টিপতে টিপতে কষি থেকে চাবি খুলে নিয়ে…। আশ্চর্য, এ দলিলের গুরুত্ব সে বোঝে? এ তো সোনাদানা টাকাপয়সা নয়, হঠাৎ সে দলিল নিতে গেলো কেন? সে বেচারি হাতেনাতে ধরা পড়ে এমন কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে যে ঘটনা আর পাঁচকান না করতে তাকেই রাহাখরচ দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেন ও দলিল নিতে গেলি তুই? বারবার এ’ প্রশ্নের জবাবে সে বলে প্রভুর বাণী শুনেছে সে, প্রভুই তাকে আদেশ দিয়েছে!! আশ্চর্য! প্রভু চুরি করতে আদেশ দিয়েছেন? এ’ হতে পারে? মঙ্গীরামের পুঁটুলির মধ্যে থেকে দলিল ফিরে পেয়ে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বটে, যদিও রহস্যটা রহস্যই থেকে গেলো, আশু সুরাহা হলো না তার কোনো।

ছেলেপুলের দল আজ একটু উসখুস করছে। বিজুদার গল্প আজ যেন জমছে না ঠিক, যদিও ভরা বাদলসন্ধ্যায় ভৌতিক গল্পের মোক্ষম আবহ বর্তমান।

সীমা অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো, ‘বোলিয়ে না দাদা উহ্ নিশি ডাক কা ক্যা হুয়া? আপনে শুনে কভি?’

উদাস স্বরে বিজুদা বললেন, ‘সত্যিই তো, কীই বা বলবো? শুনেছি কি কখনও নিশির ডাক? পৃথিবীতে কতো কতো শব্দের অব্যাখ্যাত রহস্য রয়ে গেছে… অমন যে অমন দাম্ভিক লর্ড কার্জন… ’

‘মানে, যিনি ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ করেছিলেন?’ ছেলে আমার ইতিহাসে পড়েছে।

ঘাড় নেড়ে বলতে থাকেন বিজুদা, সেই লর্ড কার্জন মিশরে বেড়াতে গিয়ে নীলনদের পশ্চিমপাড়ে ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের ষাট ষাট ফুট উঁচু দুইটি স্ট্যাচু দেখে বাক্যিহারা হয়ে পড়েন, যেদুটি প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো। গ্রীক পুরাণে আছে ঊষার দেবী এয়সের পুত্র মেমনন ট্রয়ের যুদ্ধে নিহত হন গ্রীকবীর একিলিসের হাতে। তাঁর আত্মা এসে আশ্রয় নেয় উত্তরের স্ট্যাচুটাতে এবং প্রতি প্রাতেঃ রাজা মেমনন কেঁদে কেঁদে ডাকেন মা ঊষাদেবীকে। সে স্বর যে শুনতে পায় ভাগ্য ফিরে যায় তার, আর সেটা শুনতে সেকালে রোমান সম্রাট থেকে একালে আমাদের কার্জন সাহেবও ছুটে গিয়েছিলেন।

‘এর সঙ্গে নিশির ডাকের কী সম্পর্ক, দাদা?’ আমি শুধোই।

‘সত্যিই তো…কী ই বা সম্পর্ক,’ উদাস স্বরে বলেন বিজুদা।

তো বলি শোন্, মামাবাড়ি-সূত্রে আমার বন্ধু ছিলো উমা, উমানাথ সর্বাধিকারী, আদি ফুটবলগুরু নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর বংশজ। স্কটিশে ফিজিক্স পড়তো উমা, যার কাছ থেকেই কার্জনের ঐ ‘টেলস অব্ ট্রাভেল’ বইটি নিয়ে আমি পড়েছিলুম। মস্ত বড়লোকের ছেলে, বাড়িতে পেল্লায় লাইব্রেরি। সে থাকতো সিঁথির ভেতর দিকে। তার বিশেষ উৎসাহের বিষয় ছিলো সাউন্ড। সেকালে দামী দামী স্পিকার আর সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে বাড়িতে কত কী গবেষণা করতো।

তা, উমা একদিন আমায় এসে বললো, ‘বিজু, তুই ভেন্ট্রিলোকুইজমের নাম শুনেছিস?’

‘শুনিনি আবার? সেই যে কোলে পুতুল বসিয়ে কথা বলা?’

‘হ্যাঁ, গত মাসে আমাদের পাড়ার বিচিত্রানুষ্ঠানে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এ খেলাটা দেখিয়ে খুব হাততালি কুড়োন। শো-এর পরে আমি গিয়ে আলাপ করি। গুণী মানুষ, কিন্তু হতদরিদ্র, খেতে পান না প্রায়। মুর্শিদাবাদের লোক, এখানে এসে বেলেগেছের কোন্ বস্তি অঞ্চলে থাকছেন। তা, বাবাকে বলে ওনাকে আমাদের বাড়ির নিচের তলার একটা ঘরে ঠাঁই করে দেওয়া গেছে। সারাদিন কী সব মোটা মোটা ইংরিজি বই পড়েন, তার মধ্যে রেজিনাল্ড ফেসেন্ডেনের একটা বই দেখে সেদিন চমকে উঠলুম। বললেন, এমপ্লিচ্যুড মড্যুউলেশনে ওনার বিশেষ উৎসাহ আছে। ইন্টারেস্টিং ব্যক্তিত্ব। চল্, তোর আলাপ করে ভালো লাগবে।’

বস্তিবাসী ম্যাজিশিয়ান ওয়ারলেস টেলিগ্রাফি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন জেনে প্রবল উৎসাহ লাগলো। তখন আমার গরমের ছুটি চলছে। পরের দিনই শেয়ালদ থেকে দোতলা এগারো নম্বর বাস ধরে চলে গেলুম বি টি রোডের ঘোষপাড়া। সেদিনও এমন প্রবল বৃষ্টি। দেখি একতলার ঘরে কুপি জ্বালিয়ে ভদ্রলোক খুটখাট করে কী সব যন্ত্রপাতি তার-ফার নাড়াচাড়া করছেন। উমা আলাপ করিয়ে দিলো, ‘আমার বন্ধু বিজন। বি ই কলেজে পড়ে।’ ভদ্রলোক বিশেষ পাত্তা দিলেন না। ঘোলাটে চোখে একবার তাকিয়ে ফের নিজের কাজে মন দিলেন। বোঝা গেলো, বেশ মুডি লোক। আমরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। মিনিট দশেক পরে উঠে এসে শুধোলেন, ‘কোনো শো-এর বুকিং? আমি পঞ্চাশ টাকা নিই।’

‘না,না, সিংগীমশাই। কোনো শো-টো নয়। বিজন মেটালার্জির ছাত্র। তাই এলয় ওয়ার নিয়ে… ’

এইবার ভদ্রলোকের চোখ-দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ধীরে সুস্থে উঠে বইয়ের গাদার মধ্যে থেকে একটা বহু পুরনো আমেরিকান ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’ জার্নালের কপি খুলে আমার হাতে তুলে দিলেন। দেখি প্রোফেসর ডোলসেকের একটা আর্টিকেল, সুপার-কন্ডাক্টিভিটি নিয়ে। আমার অত জ্ঞান নেই। বললুম, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি।’

ক্রমে ওপরের খোলস ছাড়িয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে দিব্য আলাপ জমে গেলো। বছর পঞ্চাশ বয়স হবে হয়তো। দাড়িগোঁফ কামানো একহারা চেহারা। সাদা ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো করে পরা। গায়ে হাফহাতা সাদা গেঞ্জি। বিকেলের দিকে তখন বৃষ্টিটা থেমে যেতে ছাদে কুর্সি পেতে বসলুম আমরা তিনজনে। নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলতে চান না, যদিও সাউন্ড বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে আর থামতে চান না। বললেন, ‘জানো তো, লাটিন ভাষায় ভেন্টর মানে উদর আর লোকুই মানে বাচন। এ’ দুই মিলে, যেন পেটের মধ্যে থেকে কথা বেরিয়ে আসছে তাই এর নাম ভেন্ট্রিলোকুইজম। যার যত ভালো অভ্যাস, বেশি ক্ষমতা, সে ততো দূরে স্বরক্ষেপণ করতে পারে।’

‘মানে কোলে বসানো আপনার এই পুতুল নয়, সেটি মঞ্চের ঐ কোণে থাকলেও… ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

এটি আমাদের কাছে নতুন খবর। হঠাৎ ছাদের পাঁচিলে বিপরীত কোণ থেকে এক দাঁড়কাকের তারস্বর ক্যা ক্যা শব্দে চমকে ফিরে তাকাই। কাকবাবাজী ততক্ষণে উড়ে হাওয়া। পরমুহূর্তে অপর কোণে তেমনি কর্কশ রব। ঘুরে তাকাতে এবারও কাকটিকে দেখতে না পেয়ে কী রকম সন্দেহ হলো। এতো তাড়াতাড়ি উড়ে পালায় কী করে? এবার রাঘব সিংগীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মুচকি মুচকি হাসছেন উনি! উমা-আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি পরস্পরের মুখের দিকে!

হো হো করে হেসে উঠে বললেন সেই আশ্চর্য মানুষ, ‘পাঁচিলটা তোমাদের সলিড ইঁটের বলে করা গেলো, ফাঁক ফাঁক লোহার রেলিং হলে করা যেতো না। আর হ্যাঁ, সর্বদা কোনো এঙ্গেলেই এটা হবে, নৈলে শব্দ ফিরে আসবে না।’

আমরা হাঁ।

‘কি বোন সুমি, দাদাকে এক কাপ চা খাওয়াবে না? গলা যে…’

গিন্নিকে আমার বলতে হয় না। থার্মোফ্লাস্কে বিজুদার মনোমত অর্গানিক টি মজুদই আছে, কেবল ঢেলে দেবার ওয়াস্তা। আমরাও ভাগ পেলুম অল্পস্বল্প। বৃষ্টিটা ধরে এসেছিলো, এখন পুনরায় ঝামরে এলো। চা পান শেষে রুমালে মুখ মুছে বিজুদা বলে চললেন,

এরপর আমাদের তিনজনের বন্ধুত্ব জমে উঠতে দেরি হলো না। উমানাথ আর আমি কলেজ লাইব্রেরি থেকে দামি দামি বই এনে রাঘব সিংহ মশাইকে পড়তে দিই। অনন্ত পাঠক্ষুধা ওনার। উপযুক্ত রসদ পেয়ে গনগনে জ্বলে উঠলো তা। উনিশশ’ সত্তর দশকের মাঝামাঝি তখন এরিকসন কোম্পানির ব্লু-টুথ ডিভাইস আসতে আরো দুই দশক দেরি আছে হে, এদিকে সিংহী মশায়ের দৌলতে আমরা বিশহাত দূরে দাঁড়িয়েও দিব্যি ওনার পাঠে গীতার শ্লোক শুনছি কর্ণকুহরে। আমার মনে পড়ে গেলো পূর্ণিয়ার নাটকে রণেনদার প্রম্পটিং! শুধোতে, সিংহী মশায় বললেন, ‘দেখো, সুদূরে স্বরক্ষেপণ খুব কঠিন খুব নতুন কিছু বিষয় কিন্তু নয়। ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই এর চর্চা হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রীসের এপোলো মন্দিরের পাইথিয়া পুরোহিতরা এইভাবে ঈশ্বর কথা বলছেন বলে ভক্তদের বিশ্বাস আদায় করতো। এখন, বুঝলে বিজনবাবু, আমাদের লক্ষ্য হবে উমাভাইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমন সাউন্ড-ডিভাইস গড়ে তোলা যা স্পটলাইটের মতো ঠিক একটা জায়গাতেই গিয়ে পড়বে, তার আগে পরে কেউ শুনতে পাবে না!’

বলো কী?! সে আবার হয় নাকি?

এরপর আমার কলেজে পড়ার চাপ বাড়তে উমানাথের সঙ্গে যোগাযোগ একটু কমে এলো। তখন তো এমন হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিলো না যে হোয়াটস্যাপ করে ঘড়ি ঘড়ি খবরাখবর নেওয়া যাবে। মাঝে মাঝে নীলরঙা অন্তর্দেশী পত্রাচার চলতো, তাতে খবর পাই উমানাথ আর রাঘব সিংহ মিলে ‘ডিরেকশনাল সাউন্ড ওয়েভ’ নিয়ে তুমুল কাজ করছে।

এবার উশখুশ করতে লাগলো রূপা-গুগ্গুল-অয়নের দল। গল্পটা বোধহয় বড্ড টেকনিকাল দিকে চলে যাচ্ছে।

সেটা বুঝে নিয়েই বিজুদা ব্যাখ্যা করেন,

শোনো আমার ছোট্ট বন্ধুরা, সাধারণ এক মানুষ কানে বিশ থেকে বিশহাজার হার্জ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পারে। তার বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ আল্ট্রাসাউন্ড আর কম হলে ইনফ্রাসাউন্ড—মানুষের কানে ধরা পড়ে না; বাদুড় বা দক্ষিণমেরুর মিঙ্কে তিমির মতো প্রাণী শুনতে পায় তা। আল্ট্রাসাউন্ড মানুষের কানে ধরা না পড়লেও মেডিক্যাল থেকে নানা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার আছে মানুষের কল্যাণে। আর শব্দের এক ধর্ম হলো কোনো উৎস থেকে জন্মে চারিদিকে পরিব্যাপ্ত হয়ে হয়ে সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো কোনো মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কানে পৌঁছয়। তাই, দুম্ করে একটা বোমা ফাটলে তার শব্দতরঙ্গ দশদিকে ছড়িয়ে পড়ে সকলের কানেই পৌঁছবে যতদূর পর্যন্ত সে তরঙ্গের রেশ মিলিয়ে না যায়। এখন ‘ডিরেকশনাল সাউন্ড’ এমন এক প্রচেষ্টা যাতে স্পটলাইটের মতো শব্দ গিয়ে পৌঁছবে ঠিক তারই কানে যাকে উদ্দেশ্য করে বলা…

‘বলেন কী দাদা? এমন যন্ত্র হয় নাকি? জানি না তো?’ সুদীপ বলে।

‘হ্যাঁ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে তো রয়েইছে…’

‘মানে, জ্যেঠু, সেই পূর্ণিয়ার থিয়েটারের সেই প্রম্পটার…’ গুগ্গুল বললো।

‘এই দ্যাখ্, এই দ্যাখ্, হরিহরণ, তোর পুত্র ঠিক লিঙ্ক করতে পেরেছে… ’ সোৎসাহ বলে ওঠেন বিজুদা, ‘আমারও তাই অনুমান হয় পরে। তবে পূর্ণিয়ার ঘটনাটা যন্ত্রের সাহায্যে নয়, মনুষ্যকণ্ঠ দিয়ে করা হয়েছিল অভ্যাসের দ্বারা। ডিরেকশনাল সাউন্ডে এইটেই করতে চাওয়া হয় মাস স্কেলে, যন্ত্রের সাহায্যে।’

এরপরের ঘটনাবলী বড় অদ্ভুত। বিজুদা বলে চলেন। বি এস সি পাশ করে উমানাথ চলে গেলো বম্বেতে, টিআইএফআরে এমএসসি করতে। আমার তখন ফাইনাল ইয়ার, পড়াশুনোর চাপ খুব বেশি। হঠাৎ একদিন এক চিঠি পেলুম উমানাথের কাছ থেকে। ওর বাবার খুব অসুখ। অদ্ভুত এক অসুখ হয়েছে ওনার। ‘পারলে একবার গিয়ে দেখে আসিস, বিজু,’ লিখেছে বন্ধু, ‘আমার পরীক্ষা শেষে বাড়ি যেতে যেতে এ মাসের শেষ হয়ে যাবে।’

এরপর আর দেরি করা চলে না। পরের দিনই উমানাথদের সিঁথির সেই মস্ত বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। কাকীমা কেঁদে আকুল, ‘দেখো তো বাবা বিজন কী হাল হয়েছে এঁনার!’ দেখি, দুপুরে চাদর মুড়ি দিয়ে চুপটি করে পড়ে আছেন নরহরি সর্বাধিকারী মশায়। পিটপিট করে তাকাচ্ছেন ইতিউতি। চোখদুটি করমচার মতো লাল। উমার ভাইয়ের কাছে জানা গেলো ওনার মধ্যে নাকি উন্মাদের লক্ষণ দেখা গেছে, চিকিৎসাও সেই লাইনেই হচ্ছে। রাতবিরেতে নিশির ডাক শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন প্রহরা রাখা হয়েছে। হাই ডোজ ওষুধ চলছে।

‘তোমাদের একতলার ঘরের সেই রাঘব সিংগী মশাই কোথায় গেলেন?’ ভাইকে শুধোই।

‘তিনি তো দাদা বম্বে যাবার পরপরই এক রাত্তিরে কোথায় উধাও। দু-দিন পরে ফিরে আসতে মা খুব বকলেন। আপনি আমাদের সঙ্গে একই সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন, আর কোথায় চলে গেলেন, বলে যাবেন না? আমরা ভয়ে মরি, কোনো বিপদ আপদ হলো কিনা… । তার দু’দিন পরে নেত্য ঝি-কে “বলে দিয়ো, চললুম” বলে নিজের ডেয়োডাকনা বই-পুতুল সব নিয়ে হাওয়া। আস্ত পাগল একটা।’

আমার মনটা কু গাইছে। বলি, ‘শোনো ভাই বাবুল, আমার মন বলছে, কাকাবাবুর রোগ কিছু হয়নি। রহস্যটা অন্যত্র।’

‘কী সে রহস্য?’

‘সেটা জানতে আমায় আজ রাতে কাকাবাবুর পাশে থাকতে হবে, যখন নাকি সেই নিশির ডাক আসে, শোনা যায় তা।’ আমাদের বৌবাজার বাড়ির পাশের ওষুধের দোকানে ফোন করে জানিয়ে দিলুম যে আজ রাতে আমি বন্ধুর বাড়ি থেকে যাচ্ছি।

উমানাথের বাড়ির লোকজন উৎকণ্ঠিত। কী হয়েছে যে বড়োর বন্ধু রাতে থেকে গেলো? কী ভাবে সে কর্তার রোগ সারাবে? সবাইকে বলে দিলাম, আপনারা যে যার ঘরে শুয়ে পড়ুন গিয়ে রাতে। কেবল ছোটভাই বাবুল আমার সঙ্গে থাকবে দোতলার এই ঘরে কাকাবাবুর পাশে। বাবুলকে বললুম, একতলার সদর গেটের চাবিটা সঙ্গে রাখো।

অনুমান বা আশঙ্কা একটা কিছু করেছিলুমই আমি। ওনার মাথার কাছে মস্ত জানলাটা খোলা রয়েছে। গরমকাল। অসুবিধে নেই। বাবুলের উৎকণ্ঠার শেষ নেই, বললো, ‘বিজুদা, কী ভাবছো বলো তো?’

বললুম, ‘এসো বাবুল, আমরা মেঝেয় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ি, রোজ যেখানে অনাথ চাকর শোয়। তবে ঘুমিয়ে পড়া চলবে না। আর আমরা যে আজ এখানে আছি, সেটা বাইরে থেকে কেউ যেন দেখতে না পায়।’

তথাস্তু।

আমার অনুমান মিথ্যে হয়নি। রাত তখন দুটো-টুটো হবে। ঘোর ঘোর একটু লেগে গিয়েছিলো চোখে। বাবুল তো বেশ ঘুমিয়েই পড়েছে। কাকাবাবুও কড়া ঔষধের প্রভাবে গভীর নিদ্রামগ্ন। হঠাৎ শুনি আমার কানের কাছে কে ডাকছে, ‘নরহরি, ও নরহরি, নরু?’ নরহরিবাবু খাটের উপর গভীর নিদ্রামগ্ন। আমি একবার চমকে উঠে বসতে গিয়েও রুকে গেলুম। মড়ার মতো পড়ে আছি। সেই ভয়েস বলে চলেছে, ‘নরু ওঠ্। আমি মেজ্‌জ্যেঠা বলছি। চাবিটা নে। সিন্দুকটা খোল্।’ আমি আপাদমস্তক বিছানার চাদরটা মুড়ি দিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়ালুম। দূরে রাস্তার অপরদিকে আরেকটা তেতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার। কোত্থাও কোনো লোকজনের দেখা নেই।

‘এই তো। এই তো। এবার চাবিটা খোল্। গেঁজেটা বের কর…’

আমি জানলা থেকে সরে এলুম। বাবুলকে ডাকতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো।

‘কী? কী হয়েছে বিজুদা?’

‘কোনো কথা নয়। তুমি একতলায় নেমে সদর দরোজা খুলে চট করে উল্টোদিকের ঐ বাড়িটার গেটে গিয়ে দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি।

বাবুল বেরিয়ে গেলো। আমি ফের জানলার কাছে এসে দাঁড়াতে শুনতে পেলুম সেই নিশির ডাক, ‘নিয়েছিস? নিয়েছিস বাবা নরু? নে এবার এই উল্টোদিকে বাড়ির তেতলায় উঠে আয়। দরোজা খোলাই আছে।’

সেই মেসবাড়ির ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে বাবুল ও আমি সেই বাড়ির তিনতলার চিলেকোঠায় উঠে এসেছি। সামান্য ঠেলতেই ক্যাঁচ্ করে কাঠের দরোজাটা খুলে গেলো। ছোট একটা কুপী জ্বলছে ঘরটাতে। নানা হাবিজাবি যন্ত্রপাতি ডিশ এন্টেনার মতো দেখতে কিছু দেখা যাচ্ছে, ট্রানজিস্টার রেডিওর মতো দেখতে বড়ো বড়ো দুটো বস্তু, অনেক তার-ফার সকেট। দরোজার কাছে চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি। নিচের সিঁড়ির মাঝধাপে বাবুল।
‘আয়, আয়, নরু, এসেছিস? এনেছিস? দে?’

এ’ কণ্ঠস্বর বড়ো চেনা আমার। ফট্ করে পকেট থেকে টর্চখানা জ্বেলে লোকটার মুখের ওপর ফেললাম আমি, ‘রাঘব সিংগী, এতো বেইমান তুমি?’

‘কে? কে তুমি?’ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে তখন সেই বৃদ্ধ। বাবুল এই ফাঁকে ঘরে ঢুকে এসে বাল্বের সুইচটি অন করে দিয়েছে। এক মাথা পাকা চুল জট পাকানো, পাকা দাড়ি গোঁফে ভরা মুখে চট্ করে চেনাই যায় না সেই ভেন্ট্রিলোকুইস্টকে। আদুড়-গা, প্রায় উলঙ্গ। এক বৈজ্ঞানিক প্রতিভার কী করুণ পরিণতি!

ততক্ষণে ভাইয়ের চেঁচামেচিতে পাড়াভর্তি লোকজন জড়ো হতে শুরু করে দিয়েছে। হৈ চৈ। পুলিশও এসে হাজির। রাঘব সিংহ কিন্তু তখনই এক বদ্ধ উন্মাদের মত আচরণ করছেন, ‘আমার ডিরেকশনাল সাউন্ড মেশিনের জন্য ফান্ড চাই। নৈলে পৃথিবী এক মহান আবিষ্কার থেকে বঞ্চিত হবে।’ তার এক কথা।

‘তাহলে তো দাদা, ঐ নিশির ডাক টাক সব ছেঁদো কথা। এর পিছনে তো রীতিমতো বিজ্ঞান আছে, সাউন্ড প্রজেকশন আর ডিরেকশনাল সাউন্ড মেশিন?’ অধ্যাপক শ্যামলকুমারের মন্তব্য গল্প-শেষে।

‘বটেই তো। তোমাদের ঐ নিশিড্ডাক নিশিড্ডাক করা বাতুলতা, ওসব কিছু হয় না।’ সুদীপ।

সুমি এবার বলে উঠলো, ‘বরঞ্চ, এ’ তো তার উল্টো। আষাঢ়ে গপ্পো নয়, রীতিমত শব্দবিজ্ঞান! নিশিড্ডাক নয়, এ’হলো কড্ডাশিনি।

কড্ডাশিনি।’

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত