“মামা, তুমি ইয়েতি বিশ্বাস কর?”
“উঁউউ!!? …ঘররর্…ফোঁৎ…”
ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষার পর গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি এসেছি দিল্লিতে। পড়াশুনোর বালাই নেই, দিব্যি সারাদিন ফুরসত। বাইরে প্রচণ্ড গরম, লু বইছে। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর গজুমামার তিনতলার ছাদের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে কুলার চালিয়ে খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে ‘তিব্বতে টিনটিন’ পড়ছিলাম। মামা শুয়েছে নিচে ঠান্ডা লাল মেঝেতে, তখন থেকে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে আর খড়কাটা মেশিনের মতো নাক ডেকে চলেছে।
খাট থেকে নেমে এক ধাক্কা মেরে বললাম, “ও মামা, ওঠো না! বিকেল হয়ে গেল যে!”
মামা ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে বলল, “অ্যাঁ অ্যাঁ, বলিস কী!! কে নিয়ে গেল সাইকেল? ধর ধর!!”
“দুত্তোর! সাইকেল কোথায়? বলছি তুমি ইয়েতি বিশ্বাস কর?”
“অ্যাঁ? ইয়েতি? সে আবার কখন এল এখানে?”
“এখানে কেন আসতে যাবে!! এই কমিকসটায় ইয়েতির কথা লিখেছে।”
“ওহ, টিনটিন পড়ছিস! তাই বল,” প্রকাণ্ড একটা হাই তুলে বাঘের মতো আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মামা বলল, “তা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে কেন? ইয়েতি কি ভগবান না ভূত?”
“তার মানে তুমি বলতে চাও ইয়েতি আছে?”
“আছে মানে? না থাকার কী আছে? আলবাত আছে! একশোবার আছে।”
“কেউ দেখেছে ইয়েতি? সেদিন একটা লেখায় পড়লাম অনেক অভিযান চালিয়ে, অনেক খোঁজ করেও কেউ নাকি দেখতে পায়নি কোনোদিন!”
“ধুস! কী যে সব ছাইপাঁশ পড়িস! দেখবে না কেন? আমিই তো দেখেছি।”
“তুমি!! তুমি দেখেছ ইয়েতি? বলোনি তো কোনোদিন!”
“তুই আর কতটুকু শুনেছিস! পোলাপান মানুষ! এক ইয়েতির সঙ্গে আমার একবার রীতিমতো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। খুব ভালো ছিল রে ইয়েতিটা! ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত। এ বাড়িতে সে এসেওছিল, ঘরের বাইরে এই ছাদেই। অবশ্য আমি তখন ছিলাম না।”
“বলো কী গো! দিল্লিতে ইয়েতি? ইয়েতি তো শুনেছি হিমালয়ে থাকে, বরফের দেশে।”
“আদি বাসস্থান তার হিমালয়ই বটে, তবে তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ত্রিবান্দ্রমের সমুদ্র সৈকতে, দিল্লি হয়ে সে দেশের বাড়ি ফিরছিল।”
“ধুর, কী যে সব গুলতাপ্পি দিচ্ছ, সমুদ্রের ধারে ইয়েতি আসবে কোত্থেকে?”
“ও, সত্যি কথা বললে গুল হয়ে গেল, আর নিজে যে বানিয়ে বানিয়ে রাজ্যের আজগুবি গপ্পো লিখে আমার মুখে বসিয়ে চালাচ্ছিস, সেই বেলা কিছু না! যাক গে, বিশ্বাস করলি না তো করলি না, বয়েই গেল আমার।”
“আরে পুরোটা বল আগে, শুনি, তারপর তো বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার।”
“না, বলব না যা! পুরোটা না শুনেই গুলতাপ্পি বললি কেন তাহলে?”
“ভুল হয়ে গেছে, আর করব না। প্লিজ, প্লিজ বল।”
“দাঁড়া, চা-টা খাই আগে, নইলে ঘুমটা কাটবে না। দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছিলাম, তার মধ্যে হঠাৎ ইয়েতি ইয়েতি করে দিলি ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। ওদিকে বললে আবার বলে গুলতাপ্পি!”
“দাঁড়াও, ভুতোদাদুকে চায়ের কথা বলে আসছি।”
দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এলাম একতলায়। দেখি ভুতোদাদুর চা তৈরি, কাপে কাপে ঢালছে তখন। ভুতোদাদু মামাবাড়িতে বহুদিন যাবত কাজ করছে, গজুমামা বিশুমামাকে ছোটো থেকে দেখছে। দুই মামা, দাদু-দিদা আর বুড়োদিদা, অর্থাৎ গজুমামার ঠাকুমাকে ভুতোদাদুই সারাবছর দেখেশুনে রাখে। বললাম, “ভুতোদাদু, তোমায় আর কষ্ট করে তিনতলায় উঠতে হবে না, একটা ট্রেতে সাজিয়ে দাও, আমার আর গজুমামার চা আমিই ওপরে নিয়ে যাচ্ছি।”
ভুতোদাদু খুব খুশি। চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে, সঙ্গে নিমকি আর নোনতা বিস্কুটের কৌটোদুটো বগলদাবা করে ওপরে উঠে এলাম।
“নাও, এবার বল।”
“এনেছিস? বাঃ বাঃ,” গজুমামা চায়ে চুমুক দিয়ে খাদের গলায় ‘আআ…হ্’ করে একটা তারিফের আওয়াজ করে বলতে শুরু করে, “সে অনেকদিন আগের কথা, বুঝলি। আমি তখন জে এন ইউ মানে জওহরলাল নেহেরু ইউনিভারসিটিতে পড়ি। সে বছর অল ইন্ডিয়া ইন্টার ইউনিভারসিটি গেমসের আসর বসেছিল কেরলের রাজধানী ত্রিবান্দ্রম অর্থাৎ তিরুবনন্তপুরমে। আয়োজক ছিল ইউনিভারসিটি কলেজ অব ত্রিবান্দ্রম, বহুদিনের পুরোনো ব্রিটিশ আমলের কলেজ। আমাদের জে এন ইউ ছিল তার আগের দু’বছরের ইন্টার ইউনিভারসিটি গেমস চ্যাম্পিয়ন, সেবারও চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে হ্যাটট্রিক হবে। আর আমি ছিলাম সে বছর আমাদের টিমের ক্যাপটেন।”
“তুমি কলেজে খেলাধুলো করতে? এই ভুঁড়ি নিয়ে?”
“করতাম না মানে? সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম! তখন কি আর ভুঁড়ি ছিল নাকি? ভুঁড়ি তো আমি এখন রেখেছি, দাড়ির মতো। ভুঁড়ি না থাকলে এ দেশে কেউ সম্মান দেয় না রে! রোগাপটকা লোককে কেউ পাত্তা দেয় না, বেশ ষণ্ডাগুন্ডার মতো জাঁদরেল চেহারা হবে, বিশাল একখান ভুঁড়ি হবে, তবে না লোকে স্যার স্যার করে বিগলিত হয়ে পড়বে! সেইজন্য তো ভুঁড়ি রাখতে বাধ্য হলাম!”
“সাঁতারের একটা রুপোর মেডেল অবশ্য দেখেছি, ফোর বাই ফিফটি মিটার রিলের, শো কেসে সাজানো আছে। ওই একটাই?”
“দূর! একটা কেন হবে? আরও কত ছিল! সে সব বাড়ি বয়ে কে আর আনে? হোস্টেলে থাকতেই হাতখরচ জোগাড়ের জন্য সব বিক্রি করে দিয়েছিলাম। তোর দাদু যা কিপটে ছিল! হাত দিয়ে একপয়সা বাড়তি গলত না!”
“বিশুমামা সেদিন ওই রুপোর মেডেলটা নিয়ে বলছিল সেই রিলে রেসে নাকি মোটে দুটো টিমই ছিল? তিনটে টিম থাকলে ওটা ব্রোঞ্জ হয়ে যেত!”
“বিশু বলেছে এ কথা? সে কী করে জানল? আমি যখন ইউনিভারসিটিতে পড়ি তখন তো সে হাফপ্যান্ট পরে! খালি গুল আর গুল, গুল মারায় সব ওস্তাদ!”
“যাই হোক! বল, তারপর ত্রিবান্দ্রমে কী হল?”
“জানি না যা, বিশুকে জিগ্যেস কর গে!”
“আহা, রাগছ কেন? তুমি ভেবেছ বিশুমামাকে আমি বিশ্বাস করেছি? কক্ষনো না। সেবার শান্তিনিকেতন বেড়াতে গিয়ে সোনাঝুরির জঙ্গল দেখিয়ে বলল সেটা নাকি বল্লভপুর অভয়ারণ্য, তারপর একটা ছাগল দেখিয়ে বলে – ওই দ্যাখ কালো রঙের একটা হরিণ।”
নিমকির কৌটোটা খুলে গজুমামার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “ওফ, নিমকিগুলো দারুণ মুচমুচে। ভুতোদাদু খাসা বানিয়েছে। তারপর বল, ত্রিবান্দ্রমে…?”
থাবা দিয়ে একমুঠো নিমকি তুলে নিয়ে গজুমামা বলল, “কথার পিঠে এত কথা বললে গুছিয়ে বলা যায় না। এত প্রশ্ন করলে চলে?”
“আচ্ছা বল, চুপ করেছি।”
নিমকির মুঠোটা মুখে চালান করে চিবোতে চিবোতে গজুমামা ফের শুরু করে, “হ্যাঁ, তো সেবার ত্রিবান্দ্রমে প্রথম দিন থেকেই গেমস পুরো জমে গেল। আয়োজক ইউনিভারসিটি কলেজ অব ত্রিবান্দ্রম বেশ তৈরি হয়েই নেমেছে। নিজের জায়গায় খেলা। দৌড়ের ইভেন্টগুলোয় ওদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল, পি টি ঊষার দেশ কিনা। আবার সাঁতারের ইভেন্টে আমরা টপাটপ মেডেল তুলতে লাগলাম। দিনচারেক পরে ত্রিবান্দ্রম আর আমাদের পয়েন্ট প্রায় সমান সমান। বাকি রয়েছে অ্যাথলেটিকসের কিছু ইভেন্ট আর টিম গেমগুলোর – মানে ফুটবল, ভলিবল, হকি এসবের ফাইনাল। এমনসময় ঘটল এক বিপত্তি। আমাদের দলে মহাবীর নামে একটি তামিল ছেলে ছিল, দানবের মতো চেহারা, সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, তেমনি চওড়া, গায়ে অসুরের মতো শক্তি। ডিসকাস, জ্যাভেলিন থ্রো আর শটপাটে মহাবীরের সোনা ছিল বাঁধা। গেমস ভিলেজের ক্যান্টিনে চিংড়ি মাছের মালাইকারি খেয়ে সেই মহাবীর পেটের গণ্ডগোল বাধিয়ে বসল। গণ্ডগোল মানে সে বিষম গণ্ডগোল, বাথরুমে যাচ্ছে আর আসছে, যাচ্ছে আর আসছে, হাত শুকোচ্ছে না। আমার মেজাজ গেল বিগড়ে। আরে বাপু, তুই জানিস কাল তোর ইভেন্ট আছে, সবাই ভরসা করে আছে তোর ওপর, আর তুই কিনা এরকম পেটের ব্যামো বাধিয়ে বসলি? চিংড়ি মাছের মালাইকারিটা দু’দিন পরে খেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত শুনি? তাকে বেজায় ধমক লাগিয়ে, অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে বেডে শুইয়ে, জলে ‘ও আর এস’ গুলে কাছে রেখে মেজাজ ঠান্ডা করতে ভিলেজ থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
“আমাদের থাকার জায়গা অর্থাৎ গেমস ভিলেজটা ছিল শহরের একটু বাইরে উত্তরদিকে।রাস্তায় বেরিয়ে একটা বাস ধরে চলে গেলাম ভারকালা বিচে। ঘন্টাখানেকের রাস্তা। ত্রিবান্দ্রমের দক্ষিণে বিখ্যাত কোবালম বিচের কথা সবাই জানে, সবসময়ই ভিড় সেখানে। উত্তরদিকে এই ভারকালা বিচটা তুলনায় বেশ নির্জন, কিন্তু সৌন্দর্যের দিক থেকে অসাধারণ। একফালি কুমড়োর মতো সোনালি সমুদ্রসৈকত, তার একদিকে সমুদ্র তো বাকি তিনদিক খাড়াই পাথুরে পাহাড়ে ঘেরা।খাড়া পাড়ের ওপরে আবার ঘন সবুজ সমতল বন।
“আমার নিজের সাঁতারের ইভেন্টগুলো প্রথমদিকেই শেষ হয়ে গেছিল। তাই অন্যান্য ইভেন্টে আমাদের কলেজের প্রতিযোগীদের উৎসাহ দেওয়া ছাড়া হাতে তেমন কাজও ছিল না আমার। বিকেল চারটে হবে তখন। ভাবলাম সন্ধে অবধি এই বিচেই রিল্যাক্স করা যাক। মাথাটা একটু শান্ত হবে। আমার সঙ্গে সবসময় তখন সোনির একটা ওয়াকম্যান থাকত, আর কিটব্যাগে থাকত প্রচুর ক্যাসেট। তখনও সিডি-র যুগ শুরু হয়নি, ক্যাসেটের সময়। তুই তো জানিস, সলিল চৌধুরীর একনিষ্ঠ ফ্যান আমি। বেশিরভাগ ক্যাসেটই ছিল সলিল চৌধুরীর গানের। মুড চাঙ্গা করতে সলিলের সুরের কোনও জুড়ি নেই। তো, বিচে পৌঁছে দেখি চারধার বিলকুল ফাঁকা, কেউ কোত্থাও নেই। প্রথমে সমুদ্রের সামনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ওয়াকম্যানে একটা ক্যাসেট ভরে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে বিচ ধরে সমুদ্রের তীর বরাবর হাঁটা দিলাম। তখনই চোখে পড়ল ইয়েতির পায়ের ছাপটা, সমুদ্রের জল থেকে উঠে এসে বিচের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। অবিকল তোর এই ‘তিব্বতে টিনটিন’ কমিকসটার মলাটের ছবির মতো, সাধারণ মানুষের পায়ের ছাপের দ্বিগুণ সাইজ।
“স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে প্রচণ্ড অবাক হলাম। এখানে, এই সমুদ্রের ধারে ইয়েতি আসবে কোথা থেকে? ব্যাপারটা একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখতে হচ্ছে! পায়ের ছাপ ফলো করে চলতে চলতে দেখি সেটা কোনাকুনি বিচ পার হয়ে পেছনের খাড়াই পাথুরে পাড়ের দিকে এগোচ্ছে। আরেকটু এগোতে দূর থেকেই দেখতে পেলাম সেখানে এক বড়োসড়ো গুহা, পায়ের ছাপটা সেই গুহার দিকেই গেছে। কাছে যেতেই ইয়েতিটার দেখা পেলাম, গুহার ভেতর গুটিসুটি মেরে বসে আমার দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, সারা গায়ে বড়ো বড়ো ধূসর লোম, পরনে একটা কালো হাফপ্যান্ট। তার চোখমুখের ভঙ্গি অবশ্য বেশ বন্ধুত্বপূর্ণই মনে হল। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, ক্যাসেট কখন শেষ হয়ে গান থেমে গেছে, এমনসময় আমায় একেবারে হতভম্ব করে দিয়ে সেই ইয়েতি ইংরিজিতে বিলকুল অক্সফোর্ড অ্যাকসেন্টে জলদগম্ভীর স্বরে বলে উঠল – ইয়েস ম্যান, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
“কোনওরকমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা ঝেড়ে ফেলে বললাম – ইয়েতি!! …আই মিন, বাই এনি চান্স, অ্যাম আই মিটিং এ ইয়েতি?
“সে বলল – সো ইউ নো ইয়েতিস! গুড! ভেরি গুড। ইয়েস অফ কোর্স, ইউ আর মিটিং এ ইয়েতি। ইজ ইট দ্য ফার্স্ট টাইম?
“বললাম – অবশ্যই, ইয়েতির দেখা পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার! কিন্তু আমি তো জানি ইয়েতিরা হিমালয়ে থাকে, চিরতুষারের রাজ্যে, তুমি এখানে এই সমুদ্রের ধারে এলে কী করে?
“ইয়েতিটা বলল – আমার আসল বাসস্থানও হিমালয়েই। অনেকদিন আগে আমার প্রথম জীবনে আমি হিমালয়ে ছিলাম, তারপর বহুবছর ধরে শ্রীলঙ্কায় আছি, শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের পার্বত্য এলাকায়। ক্যান্ডি শহরের নাম শুনেছ? তার কাছাকাছি।
“ – কিন্তু হিমালয় থেকে শ্রীলঙ্কায় এলে কীভাবে? বাই এয়ার, মানে, এরোপ্লেনে? মাপ করো, ইয়েতিরা যে এতটা ভদ্র সভ্য শিক্ষিত হয়ে উঠেছে সেটা আমার ধারণায় ছিল না। আমাদের গল্প-উপন্যাস-কমিকসে ইয়েতিদের আদিম তুষারমানব হিসেবে দেখানো হয়।
“ – হাঃ হাঃ, বাই এয়ারই এসেছিলাম, তবে এরোপ্লেনে নয়। তোমাদের গল্প-উপন্যাসেও তেমন ভুল কিছু লেখে না। আমার কথা আলাদা।
“ – মানে? বুঝলাম না!
“ – আই বিলিভ ইউ নো রামায়াণা। রামায়ণ পড়েছ নিশ্চয়ই।
“ – হ্যাঁ, সে তো পড়েইছি।
“ – সেখানে আছে না, বীর হনুমান হিমালয়ের গন্ধমাদন পর্বত মাথায় তুলে এক লাফে লঙ্কায় পাড়ি দিয়েছিলেন? বুকে শক্তিশেল বিঁধে লক্ষ্মণ যখন মরে গেল তখন তাকে ফের বাঁচিয়ে তোলার জন্য হনুমানকে পাঠানো হয়েছিল বিশল্যকরণী নিয়ে আসতে, তো হনুমান তাড়াহুড়োয় বিশল্যকরণী খুঁজে না পেয়ে পুরো গন্ধমাদন পর্বতটাকেই উপড়ে নিয়ে ঘাড়ে তুলে লাফ মেরেছিলেন। ওই গন্ধমাদন পর্বতেই ছিল আমার গুহা, সেখানেই থাকতাম, হনুমানের ঘাড়ে চড়ে লঙ্কায় চলে এলাম।
“ – সে তো হাজার হাজার বছর আগেকার কথা! তুমি এতদিন ধরে বেঁচে আছ! মানে, আই মিন, ইয়েতিরা কি এতদিন বাঁচে?
“ – মরব কেন? বিশল্যকরণী ছিল না? আমার গন্ধমাদন পর্বতেই তো ছিল সেই গাছ। শ্রীলঙ্কার যে জায়গায় হনুমান পাহাড়চুড়োটা নিয়ে ল্যান্ড করেছিলেন আমি অবশ্য সেখানে থাকিনি, প্রবল যুদ্ধ চলছে তখন সেখানে, একটা বিশল্যকরণীর চারা নিয়ে চলে গেছিলাম নির্জন পাহাড়ি এলাকায়। আমরা ইয়েতিরা ভিড়ভাট্টা লোকজন পছন্দ করি না, এড়িয়ে চলি। তোমরা মানুষরাও সাধারণত আমাদের দেখলে ভয় পাও, ছুটে পালাও। তাই শ্রীলঙ্কার মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছে একটা পছন্দসই পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা বেছে নিই। সেখানেই ছিলাম এতদিন। ওই পাহাড়েই বিশল্যকরণীর চারাটা পুঁতে যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, তোমার কোমরের বেল্টে বাঁধা ওই যন্ত্রটা কী? ও থেকে তার দিয়ে জোড়া মাথার ওই যন্ত্রটাই বা কীসের?
“বুঝলাম ওয়াকম্যান আর হেডফোনটা দেখে ইয়েতির খুব কৌতূহল হয়েছে। কিন্তু আমার মনে তখন হাজারো প্রশ্ন, দশগুণ বেশি কৌতূহল। বললাম – এটার কথা বলছ? এটা একটা গান শোনার যন্ত্র, কানে লাগিয়ে শুনতে হয়। কিন্তু তুমি এইখানে কী করছ? শ্রীলঙ্কা থেকে এলে কী করে? এত ভালো ইংরিজিই বা শিখলে কোথায়?
“আমার প্রশ্নগুলো সে কানেই তুলল না। তার সমস্ত মনোযোগ তখন ওই ওয়াকম্যানে। বলল – গান! মানে মিউজিক? আমায় একটু শোনাবে? আমি মিউজিক জিনিসটার কথা শুনেছি, মানে জানি, কিন্তু নিজে কোনোদিন গান শুনিনি।
“ – হ্যাঁ, নিশ্চয়ই শোনাব। কেন শোনাব না?
“হেডফোনটা তার মাথায় পরিয়ে দিয়ে ক্যাসেটটা চালিয়ে দিলাম। গান শুরু হতেই প্রথমে ইয়েতিটা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি হেডফোনটা খুলে ফেলল, তারপর কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা দেখে ফের ধীরে ধীরে নিজেই মাথায় গলাল। একটু পরে দেখি তার চোখ বুজে এসেছে, তালে তালে মাথা দুলতে আরম্ভ করেছে, তারপর দুই পা দিয়ে মাটিতে ধাঁই ধপাধপ তাল দিতে শুরু করল।
“একটা গান শেষ হতে সে ভাবল মিউজিক খতম। বলল – যাহ্, শেষ হয়ে গেল? আবার শুনি?
“ওয়াকম্যানটা বন্ধ করে বললাম – শোনাব, কিন্তু তুমি তো আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলে না!
“ – বলছি বলছি, সব বলব। সে অনেক কথা। তুমি প্লিজ আরেকবার শোনাও গানটা।”
“ফের গান চালু হতে ইয়েতিটা এবার প্রথম থেকেই দুলে দুলে হাতে তালি আর পায়ে তাল দেওয়া শুরু করল। বোঝা গেল গান বেজায় পছন্দ হয়েছে। আরও দুটো গান শুনিয়ে ক্যাসেট থামিয়ে বললাম – এবার বল।
“ – ওয়েল, কী জানতে চাও বল, তবে আবার গান শোনাতে হবে কিন্তু!
“ – নিশ্চয়ই শোনাব। তুমি তো বললে শ্রীলঙ্কায় কোন এক দুর্গম পাহাড়ি জায়গায় থাকতে, মানুষদের এড়িয়ে চলতে, তাহলে আমাদের ভাষা শিখলে কী করে?
“ – হুম, তাহলে তো প্রথম থেকেই বলতে হয়, এই বলে ইয়েতি তার জীবনকাহিনি শুরু করল। লম্বা কাহিনি। দেখলাম আমাকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে। তাই বিশদেই বলল। গল্প শুনতে শুনতে দেখলাম আরব সাগরের নীল জলকে প্রথমে হলুদ, তারপর কমলা, সবশেষে গাঢ় লাল রঙের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে পশ্চিমে সূর্য অস্ত গেল, সন্ধ্যা হল। তার কথা তখনও চলছে। আমি নিজের মতো করে সংক্ষেপে বলছি তোকে।
“ইয়েতিটার একটা নামও ছিল – তোকমে – তোকমে ইয়েতি। তিব্বতি নাম। তিব্বতি ভাষায় তোকমে মানে হল মুক্ত, বাধাবন্ধনহীন, অনর্গল। প্রথম জীবনে হিমালয়ের তুষাররাজ্যে থাকার কথা তার আবছা আবছা মনে আছে, হাজার হাজার বছর আগের কথা কিনা। শ্রীলঙ্কায় থাকাকালীন মানুষের থেকে সে দূরে দূরে থাকত ঠিকই, তবে আড়াল থেকে তাদের লক্ষ করত, কৌতূহল ছিল খুব। কিন্তু, ইয়েতিদের নিজস্ব ভাষা জানা থাকলেও আমাদের ভাষা সে জানত না। বছর দশেক আগে এক রাত্রে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তার পাহাড়ের ওপর একটা ছোটো টু-সিটার প্লেন ভেঙে পড়ে। প্লেনে দুটো লোক ছিল, একজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়, আরেকজন বেঁচে ছিল, তবে তার পা দুটো পুরো থেঁতলে গেছিল। পরদিন ভোরবেলা ভাঙাচোরা প্লেনের মধ্য থেকে তোকমে তাকে উদ্ধার করে নিজের গুহায় নিয়ে যায়। তার সেবাযত্নে লোকটা বেঁচে যায়। জো নামের সেই লোকটি ছিল ব্রিটিশ, উচ্চশিক্ষিত। বয়স্ক লোক। তখনই তার বয়স ছিল প্রায় সত্তর। পা দুটো অকেজো হয়ে যাওয়ায় সে তোকমের গুহা থেকে বেরোতে পারত না। তোকমে তাকে ফলমূল, শিকার করা কাঁচা মাংস ইত্যাদি এনে খাওয়াত। প্রতিদানে জো ধীরে ধীরে তোকমেকে শিক্ষিত করে তোলে, তাকে ইংরিজিতে কথা বলতে শেখায়, পড়তে শেখায়, পৃথিবীর ইতিহাস বলে, হিমালয়ের কথা বলে। তোকমে জানত তার আদি বাসস্থান হিমালয়ের তুষাররাজ্যে, কিন্তু সেটা পৃথিবীর কোথায়, শ্রীলঙ্কা থেকে কত দূর সে ব্যাপারে তার কোনও ধারণা ছিল না। জো তাকে পৃথিবীর ভূগোল সম্বন্ধে ধারণা দেয়, ম্যাপ দেখতে শেখায়। দশ বছর তোকমের গুহায় বেঁচে থাকার পর কিছুদিন আগে জো মারা যায়। তার ওপর তোকমের মায়া পড়ে গেছিল। পিছুটান কেটে যাওয়ায় নিজের গুহা ছেড়ে তোকমে বেরিয়ে পড়ে তার আদত জায়গা হিমালয়ের উদ্দেশে, নাড়ির টানে। তার নিজের ভাষায় বলতে গেলে ‘ইন সার্চ অব রুটস’, শেকড়ের সন্ধানে। হাফপ্যান্টের পকেট থেকে পাতলা প্লাস্টিকে মোড়া একটা ম্যাপ বার করে তোকমে দেখায় আমাকে, জো তাকে এঁকে দিয়েছিল। দেখি সেই ম্যাপে শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্স থেকে তিব্বতের কৈলাস পর্বতের উত্তরে গন্ধমাদন পর্বত অবধি রাস্তা দেখানো আছে। দু’দিন আগে রওনা হয়ে সাঁতরে সমুদ্র পেরিয়ে আর দৌড়ে সেদিন ভোররাতে সে ত্রিবান্দ্রম এসে পৌঁছেছে।”
“বাপ রে!! সাঁতরেই সমুদ্র পেরিয়ে গেল!! বল কী গো!” গজুমামার গল্পের মধ্যে কথা না বলে আর পারলাম না।
“হ্যাঁ রে! ইয়েতি কিনা! ঘন্টায় একশো কিলোমিটার বেগে দৌড়োয়। ম্যাপ খুলে দেখাল শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্স থেকে কলম্বোর সোয়া’শো কিলোমিটার উত্তরে মুদালাইপালাই নামে এক জায়গায় এসে সে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর প্রায় দু’শো তিরিশ কিলোমিটার সাঁতরে কন্যাকুমারী পৌঁছোয়। সেখান থেকে ত্রিবান্দ্রম একশো কিলোমিটার, এক ঘন্টার মামলা। তবে লোকজন তাকে দেখে ফেললে হৈচৈ বেঁধে যেতে পারে, তাই সে ঠিক করেছে দিনের বেলা দৌড়বে না, রাত দশটার পর ছুটতে শুরু করে ভোররাত অবধি এক এক রাতে সাত-আটশো কিলোমিটার পেরিয়ে যাবে। দিনের বেলা কোনও নির্জন জায়গা খুঁজে লুকিয়ে থাকবে। রুটম্যাপে দেখলাম সে দিল্লির ওপর দিয়েই যাবে। আমাদের এই বাড়িটা ম্যাপে মার্ক করে দিয়ে বললাম – দিল্লিতে তুমি লুকিয়ে থাকার জায়গা কোথায় পাবে? আমাদের বাড়ি চলে এসো, এই ছাদের ঘরে দিনটা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে পরদিন রাতে ফের বেরিয়ে পড়বে।”
এমনসময় ভুতোদাদু গরম গরম পেঁয়াজি আর তেলমুড়ি-মাখা নিয়ে ওপরে উঠে এল। বাইরে অন্ধকার নেমে গেছে। একটা পেঁয়াজি তুলে কামড় দিয়ে বললাম, “কিন্তু মামা, একটা খটকা আছে। জো নামের সেই ব্রিটিশ লোকটা মারা গেল কী করে? তোকমের কাছে তো বিশল্যকরণী ছিল, জো-কে বাঁচিয়ে রাখতে পারল না? এমনকি যে লোকটা প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছিল তাকেও তো সে লক্ষ্মণের মতো বাঁচিয়ে তুলতে পারত!”
“গুড কোয়েশ্চেন,” মামা বলল, “খটকাটা আমারও লেগেছিল। তোকমেকে জিগ্যেস করায় সে বলল – আর দুঃখের কথা কী বলব! প্লেনটা তো সেই বিশল্যকরণী গাছটার ওপরেই ক্র্যাশ করেছিল! খুঁজেই পাইনি আর গাছটাকে। তাই তো জো-কে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। আমিই বা আর কতদিন বাঁচব কে জানে! সেটাও আমার এই হিমালয়যাত্রার আরেকটা কারণ। দেখি দেশে এখনও বিশল্যকরণী আছে কিনা! পলিউশনের চোটে তো শুনি অনেক গাছই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদি পাই ভালো, আরও বেঁচে থাকা যাবে, না পেলেও অন্তত দেশের মাটিতে শান্তিতে মরতে পারব।”
“আচ্ছা, বোঝা গেল!” বলি আমি, “তারপর?”
“তারপর? তারপর সে এক কাণ্ড! নিজের কাহিনি শেষ করার পর তোকমে বলে এবার গান শোনাও। তা, শোনালাম। আমার কাছে তো সব সলিল চৌধুরীর গান। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘ও বাঁশি কেন গায়’ শুনে তার সে কী ফুর্তি! তারপর বলে – প্লিজ প্লে দ্যাট সং, দ্যাট ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’। শোনালাম। সবিতা চৌধুরীর গাওয়া ‘এনে দে এনে দে ঝুমকা’ শুনে তো সে বিচের ওপর ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করল। এদিকে সন্ধে অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফিরতে হবে। তাই তোকমেকে ওয়াকম্যানটা কী করে চালাতে হয় ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে ক্যাসেট-ট্যাসেট সবশুদ্ধু ওর কাছেই রেখে এলাম। তোকমে বলল, সেদিন রাতে আর সে বেরোবে না, ওই গুহাতেই থাকবে। সারারাত গান শুনবে। কাল যেন আমি এসে ওয়াকম্যানটা নিয়ে যাই।
“গেমস ভিলেজে যখন ফিরলাম তখন রাত ন’টা বেজে গেছে। আমাকে অনেকক্ষণ দেখতে না পেয়ে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেছে। মহাবীর দেখলাম একটু সুস্থ হয়েছে, অচৈতন্যের মতো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু পরদিন ভোরবেলা দেখি তার গলা দিয়ে মোটে আওয়াজই বেরোচ্ছে না, কোঁ কোঁ করে কথা বলছে, প্রচণ্ড দুর্বল। জিগ্যেস করলাম, বিকেলে তো তোর ইভেন্ট, নামতে পারবি? দু’দিকে মাথা নেড়ে সে জানাল, তার কোনও সম্ভাবনাই নেই। বিপদ! কী করা যায়! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় এক আইডিয়া এল। সঙ্গে সঙ্গে টিমের আরও দু’জনকে নিয়ে ভিলেজ থেকে বেরিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে গেলাম সেই ভারকালা বিচে, তোকমের সন্ধানে। দেখি সে তখনও সলিল চৌধুরীতে মজে আছে, একের পর এক গান শুনে চলেছে। আমায় দেখে খুব খুশি। বললাম – খুব বিপদে পড়েছি, তোমার একটু হেল্প দরকার। সে বলল – অফ কোর্স, অফ কোর্স! তুমি আমাকে এত সুন্দর গান শুনিয়েছ, জীবনে আমি আর কখনও এত আনন্দ পাইনি। প্লিজ টেল মি হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? বললাম – আমাদের মহাবীর নামে একটা ছেলে হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার কাজটা যদি তুমি একটু করে দাও। তোকমে এককথায় রাজি – কী করতে হবে বল। গাড়িতে করে জ্যাভেলিন, ডিসকাস আর শটপাটের লোহার বল নিয়ে গেছিলাম। তোকমেকে একঘন্টা ধরে সেগুলো কী করে ছুঁড়তে হয় আর বাদবাকি নিয়মকানুন ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম। ততক্ষণে আমার সঙ্গী দু’জন চলে গেছে বাজারে, তোকমের জন্য ফুলহাতা সাদা গেঞ্জি আর ট্র্যাকস্যুট কিনে এনেছে। দুপুর পেরিয়ে যাওয়ার পর মহাবীরের ইভেন্টের ঠিক আগে আগে তোকমেকে ড্রেস-ট্রেস পরিয়ে গাড়ি করে নিয়ে এলাম গেমস ভিলেজে। সাদা ফুলহাতা গেঞ্জিটার ওপর মহাবীরের জার্সিটা পরিয়ে দিলাম, মাথায় ফেট্টি বেঁধে দিলাম। ব্যস, আর বোঝে কার সাধ্যি!
“মাঠে গিয়ে তোকমেকে বললাম – প্রতিটা ইভেন্টে তুমি তিনবার ছোঁড়ার চান্স পাবে। প্রথমবার বেশি জোরে ছুঁড়ো না, দেখবে বাকিরা কে কীরকম ছোঁড়ে। দ্বিতীয়বারে বাকিদের থেকে অনেকটা বেশি ছুঁড়ে দেবে, তাহলেই হবে। তোকমে ব্যাপারটা বুঝল। প্রথমে শুরু হল জ্যাভেলিন থ্রো। প্রথম রাউন্ডটা দেখে নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে তোকমে বাকিদের দ্বিগুণ দূরে থ্রো করল। ব্যস, আমাদের আর পায় কে! সোনা একেবারে বাঁধা। তৃতীয় রাউন্ড ছোঁড়ার আগে তোকমে আমার কাছে এসে বলল – জিতেই তো গেছি, এই শেষ রাউন্ডটা আমার ওপর ছেড়ে দাও, দেখি কতদূরে ছুঁড়তে পারি। বললাম – বেশ। সে রাউন্ডে তোকমে এমন ছুঁড়ল যে জ্যাভেলিনটা আকাশে ভ্যানিশ হয়ে গেল, আর খুঁজেই পাওয়া গেল না! ডিসকাস আর শটপাটেও একই কাণ্ড হল, তৃতীয় রাউন্ডে আকাশে উড়ে গিয়ে মাঠ পেরিয়ে কোথায় যে পড়ল হদিস করা গেল না। যাই হোক, তিন-তিনটে সোনা বাগিয়ে আমরা মোট পয়েন্টে ইউনিভারসিটি কলেজ অফ ত্রিবান্দ্রমের নাগালের বাইরে চলে গেলাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়া তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমনকি ফুটবল, ভলিবল, হকির ফাইনালে হেরে গিয়ে রুপো পেলেও আমাদের কেউ ছুঁতে পারবে না। তুমুল সেলিব্রেশন শুরু হয়ে গেল। কেউ কিছু বোঝার আগেই তোকমেকে তাড়াতাড়ি একটি ছেলের সঙ্গে গাড়ি করে ফের ভারকালা পাঠিয়ে দিলাম।”
“কিন্তু এটা তো জোচ্চুরি হয়ে গেল!” বললাম আমি।
“বা রে! তা কেন? মহাবীর সুস্থ থাকলে সেই তো সোনা পেত, ওই ত্রিবান্দ্রম ইউনিভারসিটির খাবার খেয়েই তো ওর পেটখারাপ হয়েছিল।”
“আচ্ছা বেশ, তারপর?”
“তারপর আর কী? পরদিন হকিতেও আমরা সোনা পেলাম। গেমস শেষ। সেদিন সন্ধেবেলা রওনা হয়ে প্রায় দু’দিন দু’রাত হৈ হৈ ট্রেনজার্নির পর দিল্লি ফিরলাম এক বিকেলে। বাড়ি ঢুকতেই তোর বুড়োদিদা বলে – ও গজু, তোর গান শোনার যন্ত্রপাতিগুলো কি রোদ্দুরে শুকোতে দিয়ে গেছিলি বাবা? সকালবেলা ছাদে বড়ি দিতে গিয়ে দেখি সব ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে। আমি ভয়ে ভয়ে আর হাত দিইনি, ভাবলাম কী জানি বাবা, গানগুলো হয়তো মিইয়ে গেছে, তাই রোদ্দুর খাইয়ে তাজা করতে দিয়েছিস!
“তাড়াতাড়ি ছাদে এসে দেখলাম আমার ওয়াকম্যান, হেডফোন আর ক্যাসেটগুলো সব ছাদে পড়ে আছে। ওগুলো আর তোকমের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে আসার সময় পাইনি। তার মানে আমরা ট্রে্নে করে দিল্লি পৌঁছনোর আগেই সে দৌড়ে তিনরাতে প্রায় দু’হাজার আটশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দিল্লি পেরিয়ে চলে গেছে, যাবার সময় এ বাড়িতে এসেছিল – যেমন ওকে বলেছিলাম। আমাকে না পেয়ে আর ছাদের ঘর বন্ধ দেখে ওয়াকম্যান আর ক্যাসেটগুলো ছাদেই রেখে চলে গেছে। আর কোনোদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। জানি না সে তিব্বত পৌঁছোতে পেরেছিল কিনা!”
“তারপর?”
“আবার তারপর? ও, একটা জিনিস বলা হয়নি। বাইরে ছিলাম বলে ক’দিন ভালো করে খবরের কাগজ দেখা হয়ে ওঠেনি। সন্ধেবেলা তাই পুরোনো খবরের কাগজগুলো নিয়ে বসেছিলাম। যেদিন তোকমের ইভেন্টগুলো ছিল তার পরের দিনের কাগজে ছোটো ছোটো তিনটে আলাদা খবরে চোখ আটকে গেল। প্রথম খবরটায় লিখেছে, আগের দিন সন্ধেবেলা কোয়েম্বাটুরের এক হোটেলের রুফটপ রেস্টুরেন্টে জম্পেশ খানাপিনা চলছিল, এমনসময় ঝনঝন করে কাচের জানালা ভেঙে হঠাৎ একটা জ্যাভেলিন রেস্টুরেন্টের ভেতর এসে আছড়ে পরে। কেউ অবশ্য আহত হয়নি। দ্বিতীয় খবরটা হল, সেদিনই বিকেলবেলা মাদুরাই-এর আকাশে একটা ফ্লাইং সসার দেখা গেছে। স্কুল থেকে ফেরার সময় একটা বাচ্চা ছেলে নাকি দেখেছে। তৃতীয় খবরে প্রকাশ, ত্রিবান্দ্রম থেকে দু’শো কিলোমিটার উত্তরে কোচি-র কাছে এক গ্রামে সেদিন সন্ধেবেলা এক গোয়ালা গোয়ালঘরে তার গরুর দুধ দুইছিল, এমন সময় হঠাৎ একটা কামানের গোলা গোয়ালঘরের টালির চালা ভেদ করে ধড়াম করে ভেতরে এসে পড়ে আর তাইতে গরুটা বেজায় ভয় পেয়ে দড়ি ছিঁড়ে দুধের বালতি উলটে দিয়ে পালিয়ে যায়।”
“উফফ্, মামা,” আর থাকতে না পেরে বলে উঠলাম, “শটপাটের ওই ভারী লোহার বল দু’শো কিলোমিটার দূরে? এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না!”
উঠে পড়ছিলাম। মামা হাত ধরে কাছে টেনে পেঁয়াজি খাওয়া তেলমাখা হাত দিয়েই আমার চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বলল, “ওরে ভাগনে, শোন শোন! গুল যদি দিতেই হয় তবে তোর বিশুমামার ওই ছররা গুলির চেয়ে কামানের গোলা ঢের ভালো। বুঝলি? কী বুঝলি?”