হাই S,
তোর পুরো নামটা না নিয়ে সেটাই নিলাম যে নামে তুই আমার কাছে চিরপরিচিতা। এই চিঠি পড়লেই বেশির ভাগই বলবে, এ কি ধরনের প্রেমের চিঠি ? হাই দিয়ে শুরু, একটা ডিয়ার পর্যন্ত নেই। কিন্তু তারা তো জানেনা যে তুই কি চিজ ? ডিয়ার তো দূরে থাক, কোনো প্রেমের সম্বোধন শুনলেই তুই যে বিশুদ্ধ নাক সিঁটকে বলে উঠবি “হাউ মেলড্রামাটিক”, সে কী আর অন্য কোন বান্দা বুঝবে!
তোর মনে পড়ে, প্রথম বার আমাদের আড্ডার কথা ? বন্ধুদের ভীড়ে একটি ন্যাকা ন্যাকা প্রেমের উপন্যাস ও তার লেখকের শ্রাদ্ধ করছিলাম আমি, সমস্ত প্রতিকূল মতদাতা ও মতদাত্রীর মুখে ঝামা ঘষে।যাকে বলে “একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল বুদিঁগড়” এখান অবশ্য রক্ষা নয় ধ্বংসটাই বোধহয় বেশি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে!
তখন আমার রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে প্রবলা শক্তি নিয়ে আবির্ভূতা হয়েছিলি তুই। যে ফোর্সের সাথে সে ভাষায় তুই সেই লেখাটির মহাশ্রাদ্ধ করেছিলি, তাতে সেই দুর্ভাগা লেখকের ভক্তকুল বাক্য হারিয়ে ফেলেছিল। আর এই অধম অভিভূত হয়ে পরেছিল একটি নিজের ধাঁচের প্রেমের ধজিয়া উড়িয়ে দেওয়া মানুষের সাক্ষাত পেয়ে!
ক্লাসে ডুব মেরে প্রায় তিন ঘন্টা লাইব্রেরিতে বসে টানা আড্ডা মেরেছিলাম দুজনে। কত দুর্ভাগা লেখক ও তাদের ততোধিক দুর্ভাগা কত প্রেমিক প্রেমিকা চরিত্র যে সে দিন আমাদের হাতে বধ হয়েছিল তার বোধ করি কোনো ইয়ত্তা নেই! দুজন ছিটওয়ালাই মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম একে অপরের মহান গুণাবলীর সন্ধান পেয়ে। সেই দিনই নম্বর বিনিময় এবং বাড়ি ফিরেই সবার আগে ফেইসবুকে অ্যাড।
প্রথম বার তোর পাল্লায় পরেই ফোনে ম্যাসেজ কার্ড ভরেছিলাম। কত এস এম এস যে একে অপরকে করেছিলাম তার বোধ করি কোনো সীমা সংখ্যাই নেই! যদিও সেই মহান এস এম এস গুলি পড়ে তার মধ্যে কোনো ব্যক্তি যদি রোমান্সের কোনো ছিটেফোঁটা গন্ধ ও খুঁজে পায় তবে নিসন্দেহে তিনি একজন অতীব বড়মাপের অপটিমিস্ট।
মনে পরে তোর আমাদের আড্ডার টপিকগুলো ? কলেজের কোন ন্যাকা মেয়ে কোন হাঁদার সাথে পিরেম করছে তাদের গুষ্টির তুষ্টি! কোন লেখক এই ধরনের ন্যাকামি মার্কা লেখায় পাঠকের পিন্ডি চটকাচ্ছেন তার চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার! জীবনে যে সুখী থাকতে গেলে এই সব আদিখ্যেতা থেকে শতহস্ত দুরে থাকতে হবে তা সদর্পে ঘোষণা।
মনে আছে একবার দুজনে মিলে সাইন্স সিটিতে গিয়ে কাপলদের নিয়ে যে সমস্ত টিকা টিপ্পনি মারা শুরু করেছিলাম ,তাতে তুই মেয়ে হওয়ার সুবিধায় বেঁচে গেলেও আমার প্রায় গণ খাবার যোগাড় হয়েছিল। যদিও সেদিনও তুই এই অধমের বিপদতারিণী রূপে আবারো আবির্ভূতা হয়েছিলি। শেষ অব্দি দুজনকেই প্রায় ঘাড় ধরেই বার করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের আড্ডার মহান টপিক গুলো শুনে কলেজের আর বন্ধুরাও পরের দিকে আর ধারে কাছে ঘেঁষার সাহস করা ছেড়ে দিয়েছিল।
মনে আছে তোর একবার পুজোর আগে কলেজে ঝড়ের মুহুর্তে কালোমেঘ করে আসা আকাশের নিচে কাশফুল গুলোর ছবি তোলার জন্য টেনে নিয়ে গেছিলি আমায় ?
অসাধারণ এসেছিল ছবিগুলো!……..আর কালো মেঘ করে আসা আকাশের নিচে ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে দুজনের সেই একের পর ছবি তোলার অনুভূতি!!!……….. মনে হচ্ছিল আমরা দুজন ছাড়া এই গোটা জগতে যেন আর কোনো সাক্ষী পরে নেই ওই অদ্ভুত মুহূর্তটার!
ছবিটাকে তোর ফোনের ওয়ালপেপার করেছিলি তুই। তারপর কোনমতে টিচারদের দৃষ্টি এড়িয়ে ব্যাগ দুটো উদ্ধার করে দুজনে পগাড় পার।
মেন রোড ধরে ইচ্ছে করেই সেদিন অনেকটা পথ হেঁটে ছিলাম দুজনে মিলে। নীরবে মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছিলাম আকাশ কাল করে আসা মেঘের ওই অদ্ভুত দামাল রূপ আর মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধটাকে! এখনো মনে পড়লে ওই সময়টাতে যেন হারিয়ে যাই রে।……….
তার পর কলেজ এর লাস্ট সেমেস্টারের রেজাল্ট বেরোনোর আগে কয়েক বন্ধু মিলে অনেক কষ্টে বাড়ির লোককে রাজি করিয়ে দীঘা ভ্রমন। বাকিরা যেখানে সমুদ্রে স্নান ও আদার ফানেই বেশি ব্যস্ত ছিল, সেখানে আমাদের প্রধান আনন্দ ছিল ভোর বেলা সুর্যোদয়ের মুহুর্তে সমুদ্রের ধারে রক্তিম বরণ অরুণের দর্শনে। আর একসাথে বলে ওঠা ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’!
কিন্তু নিজের অজান্তে যে অনুভুতিকে শত বিদ্রূপ করেছি সেটাই যে এবার পালা বদল করে আমাদের নিয়ে খেলতে প্রস্তুত হয়েছে সেটা বুঝেও যেন বুঝতে পারছিলামনা। প্রতিমুহুর্তে যাকে চাইছি জীবনে তাকেই কিছুতেই ভালবাসার মানসী রূপে মেনে না নেওয়ার খেলা শুরু হয়েছিল এবার। তোর মনের কথা তখনও জানতামনা। কিন্তু নিজের মনের সাথে ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছিলাম অলরেডি হেরে যাওয়া যুদ্ধ।……….
কি ভাবে স্বীকার করতাম বল ? যে অনুভুতির বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ সংগ্রাম দিয়ে বন্ধুত্বের স্থাপন সেটাকেই কিভাবে বরণ করতে পারতাম তাও তোকে নিয়ে ?
কলেজের শেষ সময় এসে গেছিল।ফাইনাল রেজাল্ট আনতে সবার ভীড়, কিন্তু সেই ভীড়ে অনুপস্থিত ছিল এই ভিতু অধম। সত্যি নিজেই কি আগে জানতাম রাতদিন অসম সাহসে লোকের শ্রাদ্ধ করা আমি আসলে এতটা ভীতু ? ভীতু নিজের অনুভূতিকে স্বীকার করার ভয়ে নয়, ভীতু সেটা স্বীকার করে তোকে হারানোর ভয়ে!
ইচ্ছে করে দুদিন পরে গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে এসেছিলাম।ভয়ে তোকে ফোনও করতে পারিনি।উল্টে চূড়ান্ত নির্বোধের মত নিজের ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিলাম।
হা হা হা ,এখন মনে পড়লে ভাবি কত বড় আহাম্মক ছিলাম! তাই না রে? চূড়ান্ত বীরত্বের পরিচয় দিয়ে দুদিন পর তোর খবর নিতে তোর বন্ধু রুচিকে ফোন করেছিলাম।সারা জীবনের মত তোর এই শকুন্তলা মার্কা বন্ধুটির প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব রে। যে কথাটা আমরা দুই সো কলড অসামান্য সাহসী ও সাহসিনী নিজের মুখে বলতে পারিনি, সেটা ওই ভীতু মেয়েটা জানিয়েছিল আমায়। কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছিলাম!………
এত আনন্দ যে জীবনে পেতে পারি সেটাই যেন কোনদিনও ভাবিনি! সঙ্গে সঙ্গে তোকে ফোন করেছিলাম। কি কি কথা হয়েছিল সেটা তুই ও মনে করে নিশ্চয়ই হাসিস, আমিও হাসি।তাই ওটা বলে আর নিজেদের ইডিয়সিকে আর একবার জাহির করবনা। কিন্তু মনে আছে তোর শেষ কথাটা ?
“কপাল আমাদের প্রথম খেলায় হারিয়ে দিল। পরেরটায় কিন্তু একদম হার মানা চলবেনা। ওই সব ন্যাকা ন্যাকা মেলোড্রামা মার্কা রোমান্সে কিন্তু আমাদের একদম নো এন্ট্রি।”
প্রমিস করেছিলাম তোকে মন থেকে
“একদম নো এন্ট্রি”।
কিন্তু ভুলে গেছিলাম এতদিনে শোধ তুলছে আমাদের ভাগ্য। যা যা না করেছিলাম তারই আগমন ঘটবে এবার একে একে। …………
প্রমিস করেছিলি তুই একমাস পর কলেজে আসছিস ।সঠিক দিনে সাত তাড়াতাড়ি ছুটেছিলাম কলেজ। না কোনো সো কলড গিফটই নিইনি। কারণ জানতাম তুই দেখামাত্র বলবি “ডিসগাস্টিং”।
তাই ওই দু:সাহসটা আর দেখাইনি। কিন্তু সেদিন প্রথম তুই প্রমিস ভাঙলি চার বছরে ! টানা সাড়ে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করেও তোর দেখা পেলামনা। এমনকি তোর ফোনটাও আনরিচেবল। না রেগে না, কিছুটা অবাক হয়েই ফিরে এসেছিলাম বাড়িতে। পরে ভেবেছিলাম হয়তো শেষ অব্দি তুই “এই ন্যাকামি” থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিস।
কিন্তু রাতে রুচির ফোনটা পেয়ে যা শুনলাম, তাতে আর কিছু ভাবার শক্তি আর পরেছিলনা!
প্রথম পরাজয়ের পর আমাদের নিয়তি যে এত কদর্য একটা বিদ্রূপ করবে, অতি বড় দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে যে পারিনি! প্রমিস করেছিলাম না “মেলড্রামার নো এন্ট্রি “, সেই মেলড্রামা যে কতটা মারাত্মক রূপে মানুষের উপর বাজ হয়ে পড়তে পারে,এটা প্রথম সেই দিন বুঝলাম! অবশেষে যে দিন আমরা আমাদের অনুভূতিকে স্বীকার করে, প্রথম পদক্ষেপ ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে গেলাম, সেই দিনই তোর জীবনে শেষ দিন হয়ে এলো………এর থেকে বড় হাসির ব্যাপার আর কিছু হতে পারে বল ? এই গল্প যদি আমরা পড়তাম কলেজ লাইব্রেরিতে,তবে লেখকের তো ঠাকুরদার শ্রাদ্ধ করে ফেলতাম তাই না রে? কিন্তু “ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন” এটা বোধ করি সেই দিনই প্রথম বুঝলাম। লোকে বলে তোকে মৃত্যু দিয়েছে ওই নম্বর না জানা কালো ম্যাটাডোরটা, কিন্তু আমি জানি দিয়েছে আমাদের সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দী, আমাদের ভাগ্য। নিষ্ঠুর হাসি হাসতে চেয়েছে তাদের নিয়ে যারা তাকে নিয়ে দিনের পর দিন হেসে গেছে!
কিভাবে, তারপর কি ভাবে যে সময় কাটাচ্ছিলাম আমি নিজেই তা জানিনা। কিন্তু সবসময়ই আমার রক্ষাকর্ত্রী রূপে তুই এসেছিস এবার ও তুইই এলি।
স্বপ্ন ছিল না ইলিউশন না কি চেষ্টা ছাড়াই অজান্তে করা সেয়াঁস ঈশ্বর জানেন! কিন্তু দেখলাম তোকে তোর বিখ্যাত ডায়ালগ টা দিতে ” কিরে শেষ অব্দি দেবদাস হয়ে গেলি ,জীবনে দুটো খেলায় আমরা হেরেছি, তৃতীয়টাতেও আমাদের হারিয়ে দিবি ? প্লিজ এই ভাবে দেবদাস হয়ে থাকাটা, ইট’স জাস্ট টু মেলোড্রামাটিক! ”
ঠিকই রে, জীবনে আর হারবোনা। দেখিয়ে দেব মেলড্রামা ছাড়াও ভালবাসা থাকে।
প্রমান করার পালা এবার আমাদের। জীবন আনন্দে কাটাব, খুশিতে ভরিয়ে দেব তাকে । কোনো দেবদাস অনুভূতির একদম নো এন্ট্রি।………..
আমি জানি যখনই কোনো ন্যাকাপনা মার্কা লেখার শ্রাদ্ধ করব তুই থাকবি আমার সাথে, যখনই কোনো পার্কে কোনো ন্যাকা কাপল কে টিপ্পনী মেরে গণ খাওয়ার উপক্রম করব তুই থাকবি আমার সাথে, তুই থাকবি বৃষ্টির আগের মুহুর্তে কালো মেঘে ঢাকা প্রকৃতির রূপ মন ভরে দেখার সময়, থাকবি প্রাণ ভরে মাটির সোঁদা গন্ধটা অনুভব করার সময়। আর থাকবি সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয় দেখে ম্যাগনিফিসেন্ট বলার মুহুর্তে !
না ক্ষুধিত পাষাণ হয়েও নয় আর মণিহারা হয়েও নয় ।মনে আছে তুই বলেছিলি বড় বেশি মেলোড্রামা (আমার এই উগ্রচন্ডী নাকউচুঁ পাগলী সাথীটিকে ক্ষমা করবেন কবিগুরু)। তুই থাকবি তোর নিজস্ব কাট খোট্টা মার্কা স্টাইলে, যেটাতেই তোকে মানায়।আর আমিও থাকব তোকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দের সাথে জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করতে করতে। প্রাণ খুলে বাঁচব ন্যাকামার্কা পিরিত কাহিনীর শ্রাদ্ধ করে কারণ ওই প্রত্যেকটা মুহুর্তে তুইও যে বাঁচবি আমার সাথে আমাদের দুজনের জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে……………..
তোর মেলোড্রামার বিরুদ্ধে জেহাদী সাথী “M”
(এক নাছোড়বান্দা বন্ধুর একবগ্গা জেদে ,আমার লেখার সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে ,পাঁচই নভেম্বর দুহাজার পনেরোতে, এই লেখাটি দিয়ে।)