সুখের সন্ধান

সুখের সন্ধান

অনেক বছর আগের কথা, কোন এক দেশের শেষ প্রান্তে ছিল একটা পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের নিচে গর্তে বাস করত অসংখ্য পিঁপড়াসহ বহুজাতের পোকামাকড়।

বেশ সুখেই ছিল তারা সেখানে। সবাই স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করত। পোকাদের সাথে পিঁপড়াদের ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। পোকা বা পিঁপড়াদের আস্তানায় কোন অনুষ্ঠান হলে তারা খুব সহজেই যাওয়া-আসা করত। মুগ্ধ হতো নাচগানে সবাই।

১১১১ সালে সেই পিঁপড়াদের আস্তানায় জন্ম নেয় এক পিঁপড়া। তার নাম রাখা হয় কিরণ। তবে পোকাদের মধ্যে এক শিশু চটকা পোকা এক পিঁপড়াকে বলল, “এর নাম কিরণ কেন রাখা হল?”

পিঁপড়াটি বলল, “কিরণ যখন জন্মেছিল, তখন কিরণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল তাই আমরা সবাই ঠিক করলাম, এর নাম কিরণ রাখলে মন্দ হয় না, কারণ ওর সাথে আলোর বন্ধুত্ব বেশ ভালোই, তাছাড়া কিরণের অর্থ আলো।”

চটকা পোকা চটকিয়ে বলল, “ঠিক করেছ, ঠিক করেছ তোমরা।”

দিনের পর দিন চলে যায়, কিরণ বড় হয়। কিরণ এখন একজন তরুণ পিঁপড়া। তার চেহারাও বেশ ভালো কিরণের বন্ধু-বান্ধবী ছিল অসংখ্য পোকা আর পিঁপড়া। তাদের সাথে কিরণ সব সময় খেলাধূলা করত, আর রোজ যেত পিঁপড়াদের, পিঁপড়া বিদ্যালয়ে, পড়াশুনা করার জন্য।

কিরণদের শিক্ষক রোজ কিরণদের শিক্ষা দিত  কীভাবে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে, কীভাবে মাটি খুঁড়ে ঘর বানাতে হবে ইত্যাদি। শিক্ষকরা আরো শিখাত কী খেলে পিঁপড়াদের ডানা গজায় আর সেই ডানা দ্বারা তারা উড়তে পারবে। তবে সবসময় সাবধান করত তরুণ তরুণী পিঁপড়াদের শিক্ষকরা, ডানা গজাবার পানি না খাওয়ার জন্য। শিক্ষক এটাও জানিয়েছে এই খাদ্যটার নাম নীল রস। এই নীল রস যে খেতে পারবে তার দশ মিনিটের মধ্যে ডানা গজাবে।

কিরণ বলল, “স্যার এই নীল রস কই পাওয়া যায়?”

পিঁপড়া শিক্ষক বলল, “এই নীল রস আমাদের এই আস্তানায় শুধু হেডস্যারের কাছেই আছে।”

ক্লাস শেষে কিরণ ও তার বন্ধুরা নাচতে নাচতে আস্তানায় চলে এল। এসেই কিরণ মা পিঁপড়াকে বলল, “মা আমার  খুব ক্ষুধা লেগেছে। খেতে দাও।”

মা পিঁপড়া একটা চিনির দানা খেতে দিল কিরণকে। তবে কিরণ বায়না ধরল, “আমায় তোমার হাতে খাইয়ে দাও?”

মা পিঁপড়া কিরণকে খাইয়ে দিল। তারপর কিরণ প্রতিদিনের মতো তার খেলার সাথী পোকামাকড়ের সাথে খেলতে গেল। কিছুক্ষণ খেলেই খেলা বাদ দিল কিরণরা, আজ আর খেলবে না তারা,কারণ আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে গেছে। কখন যে কী হয় ?

তারা একটা গাছের নিচে বসে বিভিন্ন গল্প করতে লাগল। হঠাৎ কিরণ লাঠি পোকাকে বলল, “তোরাই বড্ড সুখী রে, তোদের ডানা আছে। যখন খুশি তখন উড়তে পারিস, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারিস। আর আমরা দিনে যে অন্ধকারে রাতেও সেই অন্ধকারে থাকি। এটাকে কী জীবন বলে?”

লাঠি পোকা বলল, “সুখ-দুঃখ দিয়ে আমাদের জীবন গড়া। উড়তে পারলেই কি সুখী হওয়া যায় ? তুই যেটা ভাবছিস সেটা ভুল কেন না আমরা প্রতিটা মুহুর্তে ঝড়, তুফান, শীত, গরমের সাথে যুদ্ধ করেই চলি, কেউ এইসব দুর্যোগের শিকার হয়ে অকালেই মারা যায়, আবার কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করে। আমরা কী সুখী? বল?”

কিরণ বলল, “তা ঠিক। তবে আমি মনে করি আমরা পিঁপড়ারা অনেক দুঃখী।”

সন্ধ্যা হয়ে এল। পোকারা গেল পোকাদের আস্তানায়। পিঁপড়া কিরণ এল ওদের আস্তানায়। কিরণ মা পিঁপড়ার বুকে মাথা রেখে মনে মনে বলছে, আমার যদি ডানা থাকত আমি অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম ।

এইকথা ওইকথা ভাবতেই কিরণের মনে হয় হেড স্যারের কথা। তার কাছেই আছে নীল রস। কিরণ ভাবল স্যারকে ফুসলিয়ে নীল রস খাব। তারপর ইচ্ছামতো উড়ব। এই ভেবে সে পরদিন হেলেদুলে চলল হেডস্যারের কাছে।

*****

কিরণ স্যারকে বোকা বানিয়ে নীল রস খেয়ে নিল এবং তার দশ মিনিটের মধ্যে তার ডানা গজাল। আর সে এই সন্ধ্যায় উড়াল দিল অজানা পথে। কিরণ উড়ছে, হঠাৎ তার চোখ যায় একটি আলোর দিকে। কিরণের ইচ্ছা হয় আলোটির কাছে যাওয়ার জন্য। আর সে মনে মনে বলে এরাই হয়তো সুখী। আমি দেখতে চাই এরা কেমন সুখী বা এরা কারা ?

কিরণ এল আলোর কাছে। তবে একটু দূরেই থেমে গেল। কিরণ দেখল আসলে এখানে  কয়জন মানুষ। কিরণ তার মায়ের মুখে শুনেছে মানুষরা সৃষ্টির সেরা জীব। আর সেই মানুষের সামনে কিরণ মনে মনে ভাবছে, এরাই বুঝি সেরা  সুখী। কিরণ দেখল একটা শিশুকে মা ভাত তুলে খাওয়াচ্ছে, আরেকটা শিশু মায়ের কোলে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কিরণ ভাবছে তার মা তাকেও এভাবে আদর করে। এভাবেই খেয়েদেয়ে সে-ও মানুষের মতোই সুখী প্রায়।

কিরণ ভাবছে সে যেখানে আছে সেখানেই ভালো আছে। এখন সে চলে যাবে তার মায়ে কাছে,মাকে সব বলবে,মানুষরা কীভাবে তার সন্তানকে ভালোবাসে। আদর করে। তার নিজের মা-ও কোন অংশে কম নয়।

কিরণ চলে যাবে, তবে তার ইচ্ছা হয় আলোর কাছে যাওয়ার। এবং উড়ে যায় আলোর কাছে গিয়ে আলোটা ধরে। ওমনি তার ডানা দুটি  পুড়ে যায়,এবং পায়ে প্রচন্ড তাপ লাগে তার কারণে তার পায়ে ঠোসা ওঠে। কিরণ আর আর তার আস্তানায় যেতে পারে না।

কিরণ মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থায়  ভাবে আমার মাটির ঘরই ভালো ছিল, আমি সেখানেই সুখী ছিলাম সুখের সন্ধান করতে এসে মৃত্যুর পথে পা দিলাম!

কিরণের চোখে শুধু মায়ের মমতা মাখা মুখখানা ভাসছে । অবশেষে কিরণের আর মায়ের কাছে যাওয়া হয় না। সেখানেই মৃত্যুবরণ করে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত