রঙিন শৈশব

রঙিন শৈশব

একতলায় দুটো সিমেন্টের ধাপের ওপর ছোট্ট একটা মিটার ঘর, মাথায় এসবেস্টসের শেড। স্বপনদের জ্বালায় রান্নাঘর থেকে আচারের শিশি বাঁচানো যেত না। খাবি খা, তাতে আপত্তি নেই, তাই বলে এঁটো করে খাবি? এই বিচ্ছুগুলোর হাত থেকে আচার বাঁচাতে অবশেষে কাকিমা ওই মিটার ঘরের শেডে আচার শুকোতে দিতে শুরু করেছিলেন। আশা ছিল এখানে অন্তত আচার নিরাপদ।

কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ভুল ভাঙল। রহস্যজনকভাবে শিশি থেকে আচার কমে যাচ্ছে। কাকু বললেন “শিশির মুখ খোলা থাকে, নির্ঘাত কাকে খায়।”

পরদিনই শিশির মুখে কাপড় বাঁধা হল। কিন্তু স্বপন এন্ড গ্যাংও শিল্পী মানুষ সব। বাধা কাপড় খুলে, আচার সাঁটিয়ে ঠিক আগের মত আবার কাপড় বেঁধে দেয়।

কাকিমা পড়লেন মহা বিপাকে। কী করে আচার হাওয়া হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছেন না।

একদিন রান্না করতে করতে বাইরে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ দেখলেন তার আচারের শিশি শূন্যে উঠে যাচ্ছে। ছুটে বারান্দায় এলেন। এসে দেখেন শিশির দুই ধারে দুই ছাতার বাঁট, তাতেই ভর দিয়ে শিশিটা সুন্দর উঠে যাচ্ছে ওপরে। কাকিমা হৈচৈ করে উঠতেই ঝনঝন শব্দে কাচের শিশি মেঝেতে পড়ে গুঁড়ো।

সঙ্গে সঙ্গে ওপরে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ, ঠিক যেন কয়েকজন দৌড়ে পালাচ্ছে। কাকিমাও দৌড়লেন ওপরে। কাউকেই ধরতে পারলেন না।

দেখলেন স্বপনের দলবল সিঁড়িতে বসে আছে। কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন “এই স্বপন কোথায় রে?” সবচেয়ে ছোটটা উত্তর দিল “দাদা তো বাবার ঘরে, অঙ্ক করছে।” নিরাশ হয়ে কাকিমা ফিরে এলেন।

সেদিন থেকে কাকিমা তক্কে তক্কে আছেন। চোর একদিন ধরবেনই। অপেক্ষা করতে করতে ফের একদিন চোখে পড়ল আচারের শিশি উড়তে শুরু করেছে। আজ আর কোনোরকম শব্দ না করে পা টিপে টিপে ওপরে উঠলেন। ঠিক যা সন্দেহ করেছিলেন তাই। এই চুরির নেপথ্যে স্বপন আর ওর ভাইবোনেরা। বারান্দার রেলিং থেকে শরীরের অর্ধেকের বেশি অংশ বাইরে ঝুলিয়ে ওনারা ছাতা দিয়ে শিশি তুলছেন।

দেখেই তো কাকিমার মুখ শুকিয়ে গেলে। যদি বেকায়দায় নিচে পড়ে যায়? উনি কোনো শব্দ করলেন না, অপেক্ষা করলেন শিশি ওপরে ওঠার।

বাবার একটা মারও সেদিন বাইরে পড়েনি। অবশ্য শেষমেষ কাকিমাই এসে “আর মারবেন না দাদা” বলে বাঁচিয়েছিলেন।

এই কাকিমা কিন্তু স্বপন, তপন, বেবি, ডলিদের নিজের কাকিমা নন। ওদের বাড়ির একতলার ভাড়াটে। কিন্তু সম্পর্কটা বাড়িওয়ালা ভাড়াটের নয়, ছিল অনেকটা যৌথ পরিবারের মত। যৌথ পরিবার হওয়ার খেসারত কাকিমাকে দিতে হত। নারকেল নাড়ু, নিমকি, জিভে গজা এসব তো রান্নাঘর থেকে উধাও হতই, এমনকি ফলও রেহাই পেত না।

কাকু হয়ত সবে বাজারের থলি রান্নাঘরে নামিয়ে ঘরে গেছেন। কাকিমাও ব্যস্ত অফিসের ভাত দিতে। এই সুযোগে রান্নাঘরের দুই প্রশস্ত দরজা দিয়ে খুদে চোরের দল মালপত্র অর্ধেক ফাঁকা করে দিয়েছে। বাজার গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কাকিমা গজগজ করছেন, “এ কী বাজারের ছিরি! এইটুকু  আমের (বা কুলের) কী চাটনি করব আর কী আচার করব?”

শুনে কাকু ধেয়ে এলেন, “তার মানে? আমি এক কিলো এনেছি, আর কত আনব?”

ব্যাপারটা তখনই জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। তারপর থেকে কাকু সবকিছু আরো বেশি করে আনতেন, চোরেদের ভাগ হিসেব করে।

স্বপনের বাবাও অফিস থেকে ফিরতেন সবার জন্য হিসেব করে তেলেভাজা বা মিষ্টি নিয়ে। দুর্গাপুজোয় একসঙ্গে ঠাকুর দেখা, লোডশেডিঙের রাতে সকলে একসঙ্গে ছাদে শুয়ে স্বপনের বাবার মুখে ভুতের গল্প শোনা বা ইলিশ মাছের মত মহার্ঘ কিছু এলে ভাগ করে খাওয়া, এভাবেই কেটে গেছিল স্বপনদের ছোটবেলা।

আজ আর ও-বাড়িতে তপন ছাড়া কেউ থাকে না। তবু যেন বাড়িতে পা দিলেই ছোটবেলার সেই রঙিন দিনগুলো চোখে ভিড় করে আসে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত