ঘুম ভেঙে গেছে গুলতির। আস্তে আস্তে চোখ খুলে টিপ টিপ করে তাকিয়ে দেখছে চারপাশটা। এমন ঘুমিয়েছে যে চোখ মুখ ফুলে ঢোল। মাথার অল্প পরিমাণ চুলগুলো ফ্যানের হাল্কা হাওয়ায় নড়ে উঠল। আরামেই হয়ত আর একবার চোখ বুজল সে। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। আবার চোখ খুলে, ঠোঁট উলটে এদিক-ওদিক চেয়ে নিল। মাথার উপরের দিকটাও দেখল একবার। ছোট্ট রুপোর বালা পরা হাতদুটো একটু ছোঁড়াছুঁড়ি চলল। তারপর নজর পড়ল পাশে বসা লোকটার দিকে । একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ তাঁর দিকে। ভাবখানা এমন যেন, কী ব্যাপার! একে তো এখানে দেখার কথা নয়।
গুলতিকে ঘুম পাড়িয়ে তার মা গিয়েছিলেন রান্নাঘরে শাশুড়িকে সাহায্য করতে। আজ রবিবার। তাই গুলতির বাবা বসার ঘরে শব্দ-জব্দ নিয়ে গুছিয়ে সংসার পেতে বসেছেন। অগত্যা গুলতিকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব আজ গুলতির ঠাকুরদার।
গুলতির বয়েস আর কত, ওই ছয়–সাত মাস হবে। ঘুমের মধ্যেই কখন যে দিনগুলো কেটে যায় তার কোন হিসাবই থাকে না। সারাক্ষণ ঘুম, আর চোখ খুললেই মাকে চাই। মায়ের কোল ছাড়া এক মুহূর্তও সে থাকবে না। হ্যাঁ ,বাবার উপরেও মাঝেমধ্যে একটু আধটু কৃপাদৃষ্টি যে পড়ে না তা নয়, তবে তা খুবই বিরল ঘটনা। তবে ওই পর্যন্তই, আর অন্য কারও কোলে সে যাবেই না। ধরতে গিয়েছ কী অমনি ভ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করে তার অপছন্দের জানান দিয়ে দেবে। আর কোলে তুলে নিলে তো কথাই নেই। জল থেকে তোলা মাছের মত ছটফট করে উঠবে। সঙ্গে দু’চোখে অফুরন্ত জলের ভাণ্ডার তো সর্বদাই রয়েছে। আর গলার কী জোর! বাপ রে। কান্না শুনে সারা পাড়ার লোক জেনে যায় যে মিত্রবাড়ির নাতনিকে কেউ কোলে নিয়েছে।
তাই সে যতক্ষণ ঘুমোয়, ততক্ষণই শান্তি। বাড়ির সবার তো বটেই, পাড়ার সকলেরও। তবে মায়ের কোলে যখন সে থাকে তখন এমন চুপটি মেরে থাকবে যেন তার মতো লক্ষ্মী মেয়ে আর একটিও হয় না। ঘুমের সময়টাও তার বড্ড বেহিসেবি। হয়ত ভাবছ তাকে নিয়ে একটু খেলবে , কিন্তু কোথায় কী!! সে তো তখন ঘুমে কাদা। আর যেই সবাই ব্যস্ত অথবা রাতে শোয়ার তোড়জোড় করছে অমনি তিনি ঘুম ভেঙে খিলখিলয়ে উঠবেন, বা কেঁদে প্লাবন আনবেন।
ঘুম ভেঙেই অনভিপ্রেত লোকটাকে দেখে গুলতি বেজায় বিরক্ত। গালদুটোর মাঝে ছোট্ট ঠোঁটটা উল্টে, চোখ কুঁচকে বলল, “বু।”
গুলতির ঠাকুরদা চমকে তাকিয়েছেন। অনিলবাবুর মুখশ্রী সম্পর্কে যদিও কেউ কোনোদিন কোন নেতিবাচক মতামত দেয়নি, তবুও তাঁর নাতনি যেন তাঁর মুখদর্শন করবে না বলেই স্থির করেছে। তিনি জানেন এর পর ঠিক কী কী ঘটতে পারে। চোখ দুটো ভরে যাবে জলে। বু বু করে আরও বারদুয়েক ডেকেই ভ্যাঁ করে যে সুর ধরবে গুলতি, তা যেকোনো বিয়েবাড়ির সানাইকেও হার মানাবে।
অবস্থা সামাল দিতে তাই চটপট হাত দিয়ে তিনি গুলতির চোখটাই ঢেকে দিলেন, যাতে সে আর অনিলবাবুকে দেখতে না পায়। সঙ্গে আলতো চাপড় মারতে লাগলেন যাতে গুলতি আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
তবে এক্ষেত্রে বিশেষ কিছু লাভ তো হলই না, বরং হঠাৎ চোখের সামনে নেমে আসা অন্ধকারে গুলতি বেশ ঘাবড়েই গেল। বু বু শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করা থামিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর সরাসরি গলা ছেড়ে কান্না জুড়ে দিল।
অবস্থা ক্রমশ জটিল হয়ে চলেছে বুঝে অনিলবাবুও ছুটলেন রান্নাঘরের দিকে। হাঁফাতে হাঁফাতে রান্নাঘরের দরজায় পৌঁছে শুধু বললেন, “দেখে ফেলেছে… ।”
“কে দেখে ফেলেছে বাবা ?”
সে-প্রশ্নের উত্তর অবশ্য অনিলবাবুকে দিতে হল না। ততক্ষণে গুলতি তার কান্নার সুর সপ্তমে তুলেছে। যেন হঠাৎ বেজে উঠেছে যুদ্ধের সাইরেন, অথবা বাড়ির কলিং-বেলে হয়ে গেছে শর্ট সার্কিট। সেই আওয়াজে জানলার সামনে কেবলের তারে বসা দুটো কাক কা কা করতে করতে উড়ে গেল। হয়ত বলতে চাইল, আরে ভাই কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া।
গুলতির শব্দব্রহ্মে তার বাবার শব্দ-জব্দ মাথায় উঠলো। জলদি গিয়ে গুলতিকে কোলে নিলেন। গুলতিও একবার কান্না থামিয়ে চোখ পাকিয়ে তাঁকে দেখে নিল। যেন বলতে চাইল যে তুমি কোথায় ছিলে? আমি একা একা শুয়ে আছি আর তুমি ছুটি কাটাচ্ছ? কিন্তু মা এখনও আসেনি, তাই সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ উৎসাহে আবার কাঁদতে লাগল। সেইসঙ্গে পাড়ার রাস্তার ধারের নেড়ি কুকুর কালুও ভৌউউউ করে সঙ্গত জুড়ল।
এতক্ষণে গুলতির মা এসেছেন। যেই না তিনি কোলে নিলেন গুলতি একদম চুপ। দুই চোখ আর নাক দিয়ে জল বেরিয়ে এক্কেবারে ত্রিবেণীসঙ্গম হয়ে গেছে। তবে মা’কে পেয়ে এখন তার মুখে বেশ হাসি হাসি ভাব।
অনিলবাবু আর ঘরে ঢোকার দুঃসাহস না দেখিয়ে বাইরে থেকেই বললেন, “পাড়ায় এর পর কারুর বিয়ে হলে তোমাদের নিমন্ত্রণ হবে পাক্কা। গুলতিকে নিয়ে গেলে সানাই এর ক্যাসেট আর আলাদা করে বাজাতে হবে না।”
কথা শুনে সবাই হাসছে, তবে গুলতির কোন হেলদোল নেই। এখন সে তাঁর মায়ের সাথে এমন ভাবে লেপটে আছে যেন গায়ে শীতের চাদর ।
এরপর আরও মাসখানেক কেটে গেল। গুলতির কান্নাকাটির জেরে মিত্র বাড়ির সকলের নাজেহাল অবস্থা। গুলতির মায়ের চোখের নীচে পড়েছে কালি। গুলতির বাবা আর শব্দজব্দ নিয়ে বসেন না। বিনিদ্র রজনী যাপন করার পর এইসব বিলাসিতা কি মানায়? গোপালের পুজোর সময় পরিবর্তন হয়ে গেছে। ঠাকুমা নাতনির কান্না শুনলে মন লাগিয়ে পূজো করেন কী করে? আর অনিলবাবু? তিনি তো গুলতির কান্নার জন্য তাকে কোলে নিতেই ভয় পান। কিন্তু তা বলে নাতনিকে ছেড়ে দূরে থাকবেন কী করে? গুলতি ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি এসে আদর করে যান।
মেয়ে নিয়ে বাড়ির সবাই তটস্থ। উফ কী ছিঁচকাঁদুনে। কবে যে এই কান্না কমবে! তবে কিনা গুলতিকে ছাড়াও আবার কারও এক মুহূর্ত সময় কাটে না। সে সকলের নয়নের মনি। অমন জীবন্ত পুতুলকে ছেড়ে কী করেই বা থাকা যায়!
শীতটা তখন সবে জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করেছে। সাধারণত রাতের দিকে গুলতি একটু ঘুমোলেই বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি লেগে যায়। গুলতির মা তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে ছোটেন গুলতির পাশে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য। কারণ গুলতির ঘুম একবার ভেঙে গেলে বাড়ির কারুর পক্ষে আর ঘুমনো সম্ভব হবে না।
সেদিন গুলতির বাবার ছিল নাইট ডিউটি। গুলতি অঘোরে ঘুমোচ্ছে । গুলতির মাও রাতের খাওয়া সেরে এসে শুয়ে পড়লেন আলো নিভিয়ে। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর লেপের তলায় ঢোকার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম এতটাই গভীর হয়ে গেল যে গুলতির কান্না ছাড়া আর কিছুতেই সে ঘুম ভাঙবে না। একতলায় গুলতির ঠাকুরদা ঠাকুমা থাকেন। গুলতিদের ঘর দোতলায়। রাত তখন প্রায় দুটো। নিঝুম শীতের রাতে পাড়ার কালু ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। তবে কিছু ঘটলে কালুও ডেকে উঠবে সে ভরসা হয় না। কারণ এই শীতের ধাক্কায় সেও ভীষণ কাবু। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
তখন হঠাৎ বাড়ির পাইপ বেয়ে দোতলার ছোট ছাদে উঠে এলো দুটো ছায়ামূর্তি। জমানো ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে রাস্তার কালু সবাইকে সজাগ করার জন্য একবার ভৌউউউউউ করে ডাকল । কিন্তু তাতে কারোই ঘুম ভাঙল না। আরও বারদুয়েক ডাকল কালু, তারপর ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলে গেল। ভাবটা এমন যে যাদের বাড়িতে চোর ঢুকছে তাঁদের যখন কোন হুঁশ নেই তখন সে বেচারা কেন গলা ছেড়ে মরে।
সে যাই হোক, ছায়ামূর্তিদুটো গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল ছোটো ছাদের গেটটার দিকে। তিনটে তালা আটকানো ছিল গেটটাতে। প্রথম ছায়ামূর্তি একটা মাস্টার কি দিয়ে টপাটপ খুলে ফেলল সেগুলো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে অপরজনকে বলল, “আজ আমার সঙ্গে প্রথম বেরিয়েছিস, যা করব চুপচাপ দেখবি, শিখবি, নিজের থেকে কিছু করবি না। সবার ভাগ্যে কিন্তু তিনু চোরের সাথে প্যা-রাক-টিকাল চুরি শেখার সুযোগ জোটে না ।”
অপরজন মাথা নেড়ে সায় দিল তিনুর কথায়। তারপর সন্তর্পণে তারা গেট খুলে বাড়ির দোতলায় ঢুকল। দোতলায় গুলতিদের ঘর বাদে আরও দুটো ঘর আছে। চোরদুটো যা হাতের কাছে পাচ্ছিলো ঝোলার মধ্যে চালান করছিল । দুটো ঘরের যাবতীয় দামী জিনিস ঝোলায় চালান করে তাদের নজর পরল গুলতিদের ঘরের উপর।
তিনু বলল, “কী রে, ঝোলায় আর জায়গা আছে তো? নিয়ে নামতে পারবি তো? ”
“হ্যাঁ ওস্তাদ।”
“চল তাহলে ওই ঘরটায় ঢুকি। মনে হচ্ছে ওইটা বেডরুম। নগদ মালকড়ি কিছু কপালে থাকলে ওই রুমেই পাব।”
দুজনেই পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল গুলতিদের ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে তিনুর চ্যালা থমকে দাঁড়িয়েছে, “ওস্তাদ, ঘরে লোক আছে তো!”
“চুরি করতে এসেছ নাকি জামাই আদর খেতে?”
“আজ্ঞে, আমার তো বিয়ে হয়নি ওস্তাদ।”
“উফফ, কী আপদ! আরে বলছি, ঘরের লোক তো আর আমরা চুরি করব বলে বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে থাকবে না। ”
“জেগে গেলে? ”
“জেগে যাবে? কভি নেহি! চুপচাপ আমার সাথে আয়। তিনু চুরি করতে এলে বাড়ির লোক টের পায় বটে, কিন্তু তা পরের দিন সকালে, যখন দেখে বাড়ির অর্ধেক জিনিস বেপাত্তা। চুপ করে দেখ আর শিখে নে। ”
গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকে পড়ল দুজনে। একটার পর একটা যা পাচ্ছে হাতের কাছে চালান করছে ঝোলায়। হাতঘড়ি, ফুলদানি, ল্যান্ড ফোন, মোবাইল, অ্যালার্ম ঘড়ি কোনটাই ছাড়া পেল না। এতটাই নিঃশব্দে ঘটছে সব, যে গুলতির মা কিছু টেরও পেল না। আরামসে লেপের গরমে শীতের ঘুম উপভোগ করতে লাগল।
গুরুর হাতের কাজ আর নিঃশব্দ বিচরণ দেখে মুগ্ধ শিষ্য একবার ফিসফিস করে প্রশংসা করতেই ফিসফিসিয়ে ধমক খেল। তিনু আর তার চ্যালা নিজেদের কাজ চালাচ্ছে এমন সময় হঠাৎ শব্দ এলো, “ বু বু ।”
গুলতির ঘুম ভেঙেছে সবে। ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে হঠাৎ নজর পড়েছে আগন্তুকদের দিকে। অন্ধকারে পাশে লেপের নীচে মাকে ঠাওর করতে না পেরে হাত ছোঁড়াছুঁড়ি চালাচ্ছিল এমন সময় এই নতুন দুজনকে দেখে নিজের বিরক্তি জানান দিতে বলল, “বু । ”
চোরদের নজর গেছে গুলতির দিকে।
“ওস্তাদ বাচ্ছাটা জেগে গেছে, কেঁদে উঠলে? ”
“হুম, তা হাঁ করে দাড়িয়ে না থেকে যা সামলা বাচ্চাটাকে।”
“আমি, মানে… । ”
“চুপ! যা জলদি। ”
আর কী করা যাবে? চ্যালাটা এগিয়ে গেল মনে মনে গজগজ করতে করতে। গুলতি এখনও গোল গোল চোখে তাকিয়ে চ্যালাটার দিকে। নাইট ল্যাম্পের মায়াময় আলতো আলোয় ছায়ামূর্তি ছাড়া কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। চ্যালাটি ধীরে ধীরে গুলতির কাছে মুখ নিয়ে গেল। খুব সাবধানে বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়াতে হবে যাতে বাচ্চাটার মা যেন কোনভাবে জেগে না যায়।
একে অন্ধকার, তায় মা’কে আশেপাশে খুঁজে পাচ্ছে না, তার উপর একটা উটকো ছায়া এগিয়ে আসছে, সব মিলিয়ে গুলতি বেশ ঘাবড়ে গেছে তখন। ক্রমশ সে তার ঠোঁট উল্টে দিচ্ছিল।
চ্যালাটা তার সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ না, না একদম কাঁদে না। ”
ততক্ষণে অবশ্য গুলতি বুঝে গিয়েছে যে এ তার চেনা কেউ নয়, ফলে থমকে থমকে কান্না শুরু করে দিয়েছে। ব্যাস এ অবস্থায় যেটা এক্কেবারেই উচিৎ ছিল না তাই করল চ্যালাটা। তাড়াতাড়ি সে গুলতিকে কোলে তুলে আর দোল দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগল।
অমনি হাত পা ছুড়ে সেই পাড়া কাঁপানো কান্না জুড়ে দিল গুলতি। যত চ্যালাটা তাকে চুপ করানোর চেষ্টা করল, তত গুলতি আপ্রাণ গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল। এই কান্নার শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেছে গুলতির মা। অচেনা দুটো লোক আর তাদের একজনের কোলে নিজের মেয়েকে দেখে তিনি তো ভয়ে কাঠ। ভাবলেন হয়ত গুলতিকে চুরি করতে এসেছে এরা। জোরে একবার বললেন, “আ-মা- র মে-য়ে … চো- ও –ও –ও –ও -র ”
ব্যাস! এটুকু বলেই তিনি ভিরমি খেলেন। কালুও এতক্ষণে সঙ্গী পেয়ে গুলতির সাথে সঙ্গত দিতে শুরু করেছে। এই হই-চই এর মধ্যে একতলার আলো জ্বলে উঠল। চোর চোর বলে চিৎকার করছেন অনিলবাবুও। বাড়ির সবাই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে পাশের বাড়ির আলো জ্বলে উঠেছে। তারাও না বুঝেই চোর চোর বলে চেঁচাতে শুরু করল। চেন রি-অ্যাকশানের মত এক এক করে পাড়ার বাকি বাড়িগুলোর আলো জ্বলে উঠছে ওই শব্দে । তার সাথে চোর চোর হইচইটা বেড়েই চলেছে।
চ্যালাটা তখনও গুলতিকে সামলানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল। তিনু বিপদ বুঝে বলল, “থাক, আর বাচ্চাটাকে সামলাতে হবে না, পালাতে হবে। জলদি কর।”
অনিলবাবু দোতলায় এসে গিয়েছিলেন ততক্ষণে। তিনি দরজার সামনে আসতেই তিনু তাঁকে এক ধাক্কা মারল। দুটো চোরই ছুটে গেল ছোট ছাদের দিকে। ঝোলা টেনে নেওয়ার সময় নেই,তাই সেটা ঘরেই পড়ে রইল।
ওদিকে চোর চোর শব্দটা বেড়েই চলেছে। সঙ্গে গুলতির সাইরেন। অনিলবাবু নিজেকে সামলে তাড়াতাড়ি দোতলার সব লাইট জ্বেলে দিলেন। আর গুলতির ঠাকুমা তখন তাঁর পুত্রবধূর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
চোরদুটো পড়ি কি মরি পাইপ বেয়ে নীচে নামার চেষ্টা করল। অন্ধকারে নীচের দিকটা ঠাওর করা যাচ্ছিল না। সেখানে বেশ কিছু পাড়ার লোক আগেই চলে এসেছিল। চ্যালাটি নামতেই তাকে পাকড়াও করল তারা। তারপর
তারপর আর কী? ধরা পড়লে যা ঘটে চোরের ভাগ্যে তাই হল। শীতের দিনে এমন হাত গরমের সুযোগ কেউই ছাড়ল না। আর তার গুরু তিনুর পরিণতি হল আরও করুণ। পাইপ বেয়ে যখন নামছিল সে, শিশির ভেজা পাইপ থেকে তাড়াহুড়োয় হাত গেল ফস্কে। অন্ধকারে ধপ করে একটা আওয়াজ হল। আর তারপর ‘ওরে বাবারে, গেলাম রে’ ইত্যাদি ইত্যাদি তিনুর গলায় শোনা গেল।
এর পরের ঘটনাগুলি এইরকম। আপাতত তিনু আর তার শাগরেদ দুজনেই জেলের হসপিটালের অতিথি। তিনুর বাঁ পায়ে ফ্র্যাকচার, আর তাঁর সাগরেদের গনপিটুনিতে ঠিক কটা হাড় ভেঙেছে তা নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যেই বেশ মতভেদ রয়েছে।
বেশ কয়েকমাস ধরে তিনুর উপদ্রবে পাড়ার লোক অতিষ্ঠ হয়ে ছিল। সে ধরা পড়ায় সকলেই খুব খুশি। সবাই একবাক্যে স্বীকার করছে যে মিত্রবাড়ির নাতনি হয়তো একটু বেশি কাঁদে, কিন্তু গুলতির জন্যই এই নামকরা চোর তিনু ধরা পড়েছে।
নাঃ, এর জন্য গুলতি সরকারি পুরস্কার কিছু পায়নি। তবে পাড়ার লোকেরা গুলতির জন্য প্রচুর খেলনা উপহার দিয়ে গেছে বাড়িতে। আর অনিল বাবু গুলতির পুরস্কার হিসাবে একটা বড় টেডি বিয়ার কিনে এনেছেন। যদিও সেটা দেখলেই গুলতি আরও গলা ছেড়ে কেঁদে উঠছে।